তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-২০+২১

0
91

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২০)
নুসরাত জাহান লিজা

মোহসীন সাহেব ঢাকায় ফিরেছেন গতকাল। এখন বেশ কয়েকদিন তার এমন দৌড়াদৌড়ির মধ্যে থাকতে হবে। এই বয়সে এসব ঝুটঝামেলা তার ভালো লাগে না। আগেও লাগত না যদিও। তবে নিজের বয়সের সাথে সাথে অনেককিছু মানিয়ে নিতে তিনি শিখে গেছেন বহু আগেই। আট বছরের ছেলেকে নিয়ে কত চড়াই-উতরাই তাকে পাড়ি দিতে হয়েছে তা কেবল তিনিই জানেন।

তবে শোভার উপরে তার নিজের যত ক্ষোভই থাকুক, তিনি কোনোদিন দীপ্তর উপরে তার নিজের মতামত চাপিয়ে দিতে চাননি। কোনোপ্রকার নেতিবাচক মন্তব্যও প্রাক্তন স্ত্রীকে নিয়ে ছেলের কান বিষিয়ে দিতে চাননি। তার সাথে সংসার টেকেনি বলে যে ছেলেকে উসকে দেবেন তেমন মানসিকতা তার কোনোকালেই ছিল না। তাতে দীপ্তর ছেলেবেলা আরও খারাপ হতো। হয়তো সে ভালো মানুষ হতে পারত না। আরও বেশি ভেঙে পড়ত। তাতে লাভ কিছুই হতো না, বরং সন্তানের মনের বিরূপ প্রভাব সন্তানের মানসিকতাকে বাজেভাবে প্রভাবিত করত। একজন বাবা হিসেবে শোভার সাথে তার ঝামেলার বিষয়টা কেবলই তাদের ব্যক্তিগত হিসেবেই রেখে এসেছেন।

তবুও দীপ্ত মা’কে পছন্দ করে না। চোখের সামনে যা সে দেখেছে, তা ওই ছোট্ট মস্তিষ্কে এখনো রয়ে গেছে। প্রথমদিকে ঘুমের ঘোরে ‘মা’ ‘মা’ বলে কেঁদে উঠত, তিনি কত রাত নির্ঘুম ছেলের মাথার কাছে বসে হাত বুলিয়ে, বুকে চেপে শান্ত করে ঘুম পাড়িয়েছেন তার স্বাক্ষী কেবল তিনি নিজে, আর রাতের চারদেয়ালে বন্দী অসহ্য আঁধারটুকু।

দীপ্ত মা’য়ের সাথে যেতে না চাইলেও ছোট্ট নিষ্পাপ শিশু হৃদয় মনে মনে আশা বেঁধে রেখেছিল। একদিন তার মা আবারও তার কাছে ফিরে আসবে, তাকে কোলে নিয়ে ঘুমপাড়ানি গান শোনাবে। সে না খেয়ে লুকিয়ে থাকলে মা খাবারের থালা হাতে ওর দুষ্টুমি সহ্য করে পিছে পিছে ঘুরে খাইয়ে দেবে! কিন্তু এসব কিছু না হওয়ায় ওর মধ্যে জন্মেছিল সীমাহীন নৈরাশ্য। নৈরাশ্য থেকে বিরাগ।

দীপ্ত একসময় মা’কে ছাড়া বাঁচতে শিখে গেল, অভিমান সরে গিয়ে জায়গা করে নিল রাগ, ঘৃণা৷ কোনো সন্তান তার মা’কে ঘৃণা করুক, তিনি এমনটা চাননি। তবুও সব তো তার চাওয়া মতো ঘটবে না। শিশু হৃদয়ের যে ক্ষত তা এমনই প্রগাঢ় যে সময়ের সাথে সাথে তা মুছে যায়নি। বরং টনটনিয়ে বুকে বেজে উঠে হাহাকারের সুর হয়ে।

“বাবা, বাবা…”

দীপ্তর ডাকে মোহসীন সাহেব নিজের চিন্তা স্রোতে লাগাম টানলেন।

“কী ব্যাপার? কী এত ভাবছো বলো তো? সেই কখন থেকে ডাকছি!”

“কিছু না। অফিস থেকে কখন ফিরলি?”

“এই তো। ফিরেই তোমার ঘরে চলে এলাম।”

দীপ্তর অভ্যাস অফিস থেকে ফিরে তার সাথে দেখা করা। আগে তো তিনিই দরজা খুলতেন। এখন দেখা যায় বেশিরভাগ সময় শ্রেয়সীই খোলে। তখন দীপ্ত নিজের ঘরে যাবার আগে তার ঘরে আসে।

“যা, ফ্রেশ হয়ে নে।”

“তা যাচ্ছি। কী হয়েছে কিছু বলবে?” চিন্তিত গলা দীপ্তর।

“কই কিছু না তো।”

“একদম মিথ্যা কথা বলবে না বাবা। আমি দেখেছি তুমি ইদানিং কিছুটা চুপচাপ হয়ে গেছ। সারাক্ষণ কী নিয়ে যেন চিন্তা করো। আমাকে বলো না!” বলতে বলতে দীপ্ত তার পাশে এসে বসে তার কাঁধে হাত রাখল।

ছেলের কাতরতায় তিনি নিজেকে সামলে নিলেন। শোভার প্রসঙ্গ তুলে দীপ্তর মুড খারাপ করতে চান না তিনি। এই প্রসঙ্গ সে শুনতেই চায় না। কিন্তু ওদিকে শোভা মরিয়া।

“আরে এখন কী আমার হৈ হৈ করার বয়স আছে নাকি? আমি ঠিক আছি। অযথাই বেশি বেশি ভাবছিস।”

“তুমি সুস্থ আছো বাবা?”

“আমাকে দেখে তোর এখন অসুস্থ মনে হচ্ছে?”

“তোমার মনের সুস্থতার কথা বলছি বাবা!”

মোহসীন সাহেব কিছুটা চমকে উঠলেন। ছেলে তাকে পড়তে পারে অনেকটাই। তিনি এমন সন্তানের জন্য নিজেকে অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মনে করলেন। সকলেই বাহ্যিক স্বাস্থ্যের খোঁজ নেয়, সন্তানরাও। বয়স্ক বাবার মনের খবর কয়জন সন্তান জানতে চায়! জীবনের সমস্ত অপ্রাপ্তি এক নিমিষেই ভেসে গেল জলের তোড়ে। সহসাই নিজেকে ভীষণ সুখী বলে মনে হলো। এক জীবনে আর কী চাইবার আছে মানুষের!

“সবদিক থেকেই একদম ফিট আছি। তাছাড়া হৈ হৈ জমিয়ে রাখছি। তোর বাচ্চা কাচ্চাদের সাথে দৌড়ে খেলতে হবে না?”

দীপ্ত জানে আর জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, বাবা কিচ্ছু বলবেন না। তবে তার চিন্তার খাত কোনদিকে বইতে পারে তা সে জানে। তাদের দুজনের জীবনের সমস্ত দুর্ভোগের কারণ একমাত্র ওই মহিলা, যে ওর জন্মদাত্রী।

***
রাতে এগারোটার দিকে দীপ্ত হঠাৎ প্রস্তাব দিল, “ছাদে যাবে? বারান্দায় বসেছিলাম, চমৎকার জোছনা। যাবে?”

শ্রেয়সী বৃষ্টি ভালোবাসে, জোৎস্না ভালোবাসে, এটা দীপ্ত জানে। খোলা বারান্দায় চমৎকার আলোর বন্যা দেখে তাই স্ত্রীকে খুশি করতে চাইল। কেন যেন ওর হাসিমুখ দেখতে ভীষণ ভালো লাগে দীপ্তর।

“চলো যাই।”

ছাদে ওঠে মুগ্ধ গলায় শ্রেয়সী বলল, “কী সুন্দর!”

যদিও কৃত্রিম আলো আছে চারপাশে, তবুও তা যেন এমন পৃথিবীপ্লাবি জোৎস্নার আলোর কাছে ম্লান। দীপ্তও মোহগ্রস্ত গলায় বলল, “তোমার মতো।”

শ্রেয়সী এগিয়ে এসে দীপ্তর হাত ধরে বলল, “আমাদের মতো।”

বলেই হাসল দুজন। সেই হাসি মিশে গেল জোৎস্নায়, আর জোৎস্না তার সমস্ত আলো নিয়ে যেন মিশে গেল ওদের হৃদয়ে। সে-ই আলো জুড়ে কেবল ভালোবাসা, ভালোবাসা আর ভালোবাসা।

***
আর এক সপ্তাহ পরেই দীপ্তর জন্মদিন। শ্রেয়সী অফিস থেকে বেরিয়ে ভাবল আজ একবার শপিংমলে যাবে। ওর সাথে পরিচিত হবার পরে দীপ্তর প্রথমবার জন্মদিন। একটু স্পেশাল কিছু না হলে চলে!

নিজের জন্মদিনে দীপ্তর উপহারের কথা ওর মনে পড়ল, সেদিনটা না এলে হয়তো দীপ্তকে নিয়ে, এই সম্পর্কটা নিয়ে সে ভাবতেই পারত না।

আজ বেশ ভ্যাপসা গরম পড়েছে। রোদে একমিনিট দাঁড়ালে গায়ে যেন ফোস্কা পড়ে যায়। মানুষ যে কেন গাছপালা সব কেটে একাকার করে ফেলছে! তার ফল ভোগ করছে এখন।

শ্রেয়সী সিএনজি থেকে নেমে এলো। কী দেয়া যায় ভাবছে আর এদিক-ওদিক ঘুরছে। কিন্তু সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যে কোনটা স্পেশাল হবে। আজ কিছু পছন্দ না হলে যেন আরও ভাবার সময় পাওয়া যায়, সেজন্য সময় থাকতেই এসেছে৷ তাই অত চাপ নেই।

একবার ভাবল শিমুলকে কল করে দীপ্তর ফ্যাসিনেশন জানবে কি-না। পুরোনো এবং কাছের বন্ধু সে। শ্রেয়সী যেটুকু জেনেছে সে নিশ্চয়ই আরও বেশি করে জানবে।

পরক্ষণেই ভাবনাটা বাতিল করে দিল সে। নাহ্! নিজের জানা থেকেই উপহার কিনবে সে। সেটাই ভালো হবে। ‘’স্পেশাল” মানুষের জন্য উপহারে নিজের ওই ভাবনাটুকুরই তো বেশি বিশেষত্ব থাকে। যাকে উপহার দেয়া হয়, তারও তো এটা ভাবতে ভালো লাগবে যে উপহারদাতা তার জন্য এত ভেবে, ভালোবেসে সেই উপহারটা দিয়েছে। সেটা থেকে সে নিজেও বঞ্চিত হতে চায় না, দীপ্তকেও করতে চায় না।

শ্রেয়সী ভাবল কিছুদিন আগেই সে একা ছিল, নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজন আর অল্পকিছু বন্ধু বাদে আর কারো জন্য কখনো সে ভাবেনি। এভাবে তো ভাবেইনি।

সে তার প্রেমের ‘জিরো’ এক্সপেরিয়েন্স নিয়েও বান্ধবীদের বয়ফ্রেন্ডকে কী গিফট করা যায় তার সাজেশন দিয়ে এসেছে। অথচ আজ নিজের বরকে কী দেবে তা নিয়ে ভেবে অস্থির।

একটা আউটলেট থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে, তখনই আচমকা একজন অভিজাত পোষাক আর চালচলনের মধ্যবয়স্ক মহিলা এসে ওর সামনে দাঁড়ালেন। ওর দিকে খানিকটা তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার নাম শ্রেয়সী?”

শ্রেয়সী মৃদু হেসে বলল, “জ্বি। আপনি…”

মহিলা আরও খানিকটা এগিয়ে এসে ওর চিবুকে হাত রাখলে শ্রেয়সী অস্বস্তিবোধ করল।

“ভীষণ লক্ষ্মী দেখতে তুমি। আমাকে বোধহয় চিনতে পারোনি। তবে তোমাকে ঠিক চিনেছি। কী দূর্ভাগ্য বলো তো, নিজের ছেলেকে ফেসবুকে স্টক করে তোমার ছবি দেখতে হয়েছে। এখন চিনেছ?”

শ্রেয়সী এখনো তাকিয়ে আছে, এবার তিনি হেসে বললেন, “আমি দীপ্তর মা।”

শ্রেয়সী স্থানুবৎ দাঁড়িয়ে রইল, কিছুক্ষণ বুঝতে পারল না কী করা উচিত ওর।
……….
(ক্রমশ)

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২১)
নুসরাত জাহান লিজা

শোভা তার বর্তমান হাজব্যান্ডের সাথে থাইল্যান্ড যাবে ভ্যাকেশনে। যদিও দুই সপ্তাহ সময় হাতে আছে। তবুও কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলেন। দূর থেকে শ্রেয়সীকে দেখে তার চেনা চেনা লাগে, এরপর ফেসবুক একাউন্টে লগ ইন করে দীপ্তর প্রোফাইলে গিয়ে কিছুটা নিশ্চিত হন, এরপর এগিয়ে এসে কাছ থেকে দেখেন।

“আসসালামু আলাইকুম, আন্টি।”

শ্রেয়সী আড়ষ্টতা কাটিয়ে উঠে সালাম দিল।

“ওয়ালাইকুম আসসালাম। কেমন আছো মা?”

“ভালো, আপনি?”

“আমার আর ভালো থাকা! ছেলের বউ এভাবে দেখলাম প্রথমবার। দীপ্তকে আমি জন্ম দিয়েছি, ওর মা। একজন মায়ের জন্য এটা কষ্টের তুমি জানো?”

শ্রেয়সীর কী বলা উচিত সে বুঝতে পারে না। দীপ্ত’র মা সম্পর্কে সে তেমন কিছু জানেও না। এটা যেহেতু দীপ্ত এবং মোহসীন সাহেব দু’জনের জন্যই অস্বস্তিকর একটা বিষয়, তাই সে আগ বাড়িয়ে কখনো জানতে চায়নি।

শোভা খোঁজ নিয়ে দীপ্তর ওয়াইফ সম্পর্কে কিছু জেনেছে আগেই। তাই জিজ্ঞেস করল, “শুনেছি তুমি জব করছ। ভালো লেগেছে জেনে। তা তোমার শ্বশুর আপত্তি করেনি?”

এবার শ্রেয়সী কথা বলল, “না, আপত্তি কেন করবেন?”

“তাহলে বলতে হয় সুবুদ্ধি হয়েছে। যাক সে কথা, তুমি পুরোপুরি স্বাধীনতা পাচ্ছ দেখে ভালো লাগল।”

শ্রেয়সী মোহসীন সাহেবকে একজন অত্যন্ত খোলামনের মানুষ হিসেবে জানে। তার কাছ থেকে অগাধ স্নেহ পেয়েছে। তাকে খুব কাছ থেকে দেখেছে, আর শোভাকে আজ প্রথম দেখছে। তাই সে বিশ্বাস করল না। শোভার মধ্যে এখনো চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্য আছে, বয়স ধরে রেখেছেন।

“আন্টি কিছু মনে করবেন না। বাবাকে আমি যতদূর দেখেছি, কারো স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করার মতো মানুষ তাকে আমার মনে হয়নি।”

“দীপ্তর বাবাকে বাবা বলছ, আমাকে আন্টি?”

“আসলে আপনাকে আজ প্রথম দেখছি বলে।”

“এমন আড়ষ্ট হয়ে আছ কেন মা? দীপ্ত আর ওই লোকটা আমার সম্পর্কে তোমার কান ভারি করেছে বুঝি?”

“তাদের সাথে আপনাকে নিয়ে আমার কখনো কথা হয়নি।”

শোভা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। নিজের ছেলের কাছেও তিনি অবাঞ্চিত।

“আচ্ছা, যাক ওসব কথা। তোমাকে আজ প্রথম দেখলাম। খালি হাতে কেমন দেখা যায় বলো তো। তুমি একটু আমার সাথে এসো মা।”

“আন্টি, আমি এখন কিছু নিতে পারব না।”

“কেন? আমি তোমার শাশুড়ি। ছেলে আমার সাথে কথা বলে না। কতদিন ওকে কাছ থেকে দেখি না। তুমিও যদি এভাবে আমাকে প্রত্যাখ্যান করো, তাহলে আমি…”

এটুকু বলে খানিকটা কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “ধরে নাও একজন অত্যন্ত দুঃখী মায়ের পক্ষ থেকে তার কষ্ট কিঞ্চিৎ হলেও লাঘব করবার একটা চেষ্টা। প্লিজ না করো না মা। তোমার মা’কে তুমি না করতে পারতে?”

শ্রেয়সী অদ্ভুত এক দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ল। একদিকে শোভার বলা কথাগুলো, অন্যদিকে ওই বাসায় সবাই কীভাবে নেবে।

“আমি ধরে নেব এই ছোট্ট উপহারের সাথে হলেও সন্তানের সাথে খানিকটা থাকলাম। এটুকু স্বস্তি থেকে আমাকে বঞ্চিত করো না প্লিজ।”

এবার শ্রেয়সী না করতে পারল না। হাজার হোক, তিনি দীপ্তর মা। তার যদি কোনো ভুলও থাকে তবুও সন্তানকে তো ভালোবাসেন। এমন আকুতি সে কী করে এড়িয়ে যাবে! সে সম্মতি দিল।

শোভা তাকে নিয়ে জুয়েলারি শপে ঢুকল। তিনি নিজে একটা চেইন পছন্দ করে শ্রেয়সীর গলার সামনে ধরে বললেন, “বাহ্! বেশ মানিয়েছে তোমাকে। পছন্দ হয়েছে?”

প্রথম পরিচয়ে এমন দামী উপহার নিতে ওর মন একেবারেই সায় দিচ্ছিল না। শোভা এবারও আকুতিভরা গলায় ওকে বোঝালেন, তিনি নিজে শ্রেয়সীর গলায় পরিয়ে দিলেন। একসাথে শপিংমল থেকে বাইরে এলেন। শ্রেয়সীকে গাড়ির জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বললেন, “আমি তোমাকে পৌঁছে দেই।”

“না আন্টি প্লিজ। আমি চলে যাব। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।”

“অবশ্যই। সন্তানের জন্য মায়ের দোয়া সবসময় থাকে।”

শ্রেয়সী সিএনজিতে উঠে বসল। ওর মন খচখচ করছে। চেইনটা গলা থেকে খুলে ভ্যানিটি ব্যাগে রাখল। বাসায় ফিরতে মোহসীন সাহেব দরজা খুলে দিলেন।

শ্রেয়সী একবার ভাবল মোহসীন সাহেবকে ঘটনাটা বলবে কি-না। পড়ে মনে হলো না থাক। কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা যদি মনে হয়। তারথেকে বরং দীপ্ত ফিরুক। তাকে বুঝিয়ে বলতে হবে। তবে না বলা পর্যন্ত স্বস্তি পাচ্ছে না।

দীপ্তও মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরল। শ্রেয়সী যেদিন অসুস্থতা নিয়ে রান্না করেছিল, তারপর থেকে সে বাইরে দেরি করে না। অফিস টাইম শেষ হলে বাসায় ফিরে আসে।

সন্ধ্যার পরে তিনজন একসাথে বসে কিছুক্ষণ আড্ডা দেয়। পারিবারিক আড্ডা। একান্ত তাদের নিজেদের। নয়টায় খাবার পরে মোহসীন সাহেব ওষুধ খেয়ে কিছুক্ষণ টেলিভিশনে খবর দেখেন। জিওগ্রাফি চ্যানেল দেখেন কিছুক্ষণ, তারপর দশটার দিকে নিজের ঘরে চলে যান।

দীপ্ত আর শ্রেয়সী বারান্দায় বসে ঘরের আলো নিভিয়ে দিয়ে। এই পাশটায় এখনো খোলামেলা। বাতাসটা ভালো লাগে। এগারোটার দিকে একসাথে মুভি কিংবা সিরিজ দেখে কিছুক্ষণ। তারপরের সময়টা একেবারে তাদের একান্ত।

আজ দীপ্ত ভীষণ ফুরফুরে মুডে আছে। বারান্দায় চাঁদের আলো আসছে।
“নতুন গোলাপ গাছে কলি এসেছে দেখেছ?”

দীপ্তর বারান্দায় নিজের লাগানো অনেকগুলো গাছ। এই গাছটা সর্বশেষ লাগিয়েছে। অত্যন্ত গুছিয়ে চলার পাশাপাশি গাছ, ফুল এসবও ভালোবাসে সে। সেইসব গাছে নতুন ফুল ফুটলে বা নতুন কুঁড়ি এলেই শিশুর মতো উচ্ছ্বসিত হয়ে ছেলেটা।

শ্রেয়সী কীভাবে কথা শুরু করবে ভাবছিল। দীপ্ত ওর পেছন থেকে কাঁধের সামনে হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে জিজ্ঞেস করল, “কী এত ভাবছ?”

শ্রেয়সী ওকে জড়িয়ে রাখা দীপ্তর হাতের উপরে আলতো করে হাত রেখে বলল, “দীপ্ত, আজ আমার একজনের সাথে দেখা হয়েছিল।”

দীপ্ত নিজের চিবুক শ্রেয়সীর কাঁধে রেখে বলল, “কার সাথে? এত অস্বস্তিবোধ করছ কেন? পুরোনো বয়ফ্রেন্ড?”

শ্রেয়সী হাত দিয়ে দীপ্তর হাতে চাপড় মেরে বলল, “ধূর, আমার কোনো বয়ফ্রেন্ড ছিল না। সরো তো। যত বাজে কথা।”

দীপ্ত হেসে বলল, “তাহলে এমন ভাবনার কী আছে?”

শ্রেয়সী বারান্দায় আসার সময় চেনটা সাথে করে নিয়ে এসেছে। দীপ্তের হাতের বেষ্টনী থেকে বেরিয়ে এসে লাইট জ্বালিয়ে সেটা দীপ্তর হাতে দিয়ে বলল,

“তিনি এটা দিয়ে আমাকে আশীর্বাদ করেছেন। আমি নিতে চাইনি। কিন্তু উনি এমন ইমোশনাল হয়ে গেলেন…”

দীপ্ত অধৈর্য গলায় বলল, “এমন প্যাঁচাচ্ছ কেন? কে সেটা বলবে তো।”

“তোমার মা। আজ শপিংমলে…”

বাকি কথা শেষ করতে পারল না শ্রেয়সী, দীপ্তর অভিব্যক্তি ভোজবাজীর মতো বদলে গেছে। উৎফুল্ল দীপ্ত অপরিসীম ক্রোধে ফুঁসছে। নাকের পাটা লাল হয়ে গেছে মুহূর্তেই। শ্রেয়সী ওকে এমন ক্রুদ্ধ হতে কোনোদিন দেখেনি। আগেও ওরা তুমুল ঝগড়া করেছে, তখনও ভীষণ রেগে যেত, কিন্তু এমন ভয়ংকর প্রতিকৃতিতে কোনোদিন দেখেনি।

ভেতরে ভেতরে দমে গেল শ্রেয়সী।

“দীপ্ত, প্লিজ শান্ত হও। আমি পুরো বিষয়টা ক্লিয়ার করি।”

দীপ্ত সেই চেইনটা শ্রেয়সীর হাত আঁকড়ে ধরে হাতে গুঁজে দিল।

“তোমার গহনা দরকার হলে আমাকে বলতে। যার তার কাছ থেকে কেন নিতে হবে?”

শ্রেয়সী আহত গলায় বলল, “তোমার মনে হচ্ছে আমি গহনার লোভে এটা নিয়েছি? এতদিনে আমাকে এটাই চিনেছ? ভালোই হলো। মা হিসেবে কিছু উপহার দিয়ে তিনি শান্তি পেয়েছেন। তবে তুমি আমার সম্পর্কে কেমন ধারণা পোষণ করো সেটা আজ বুঝতে পারলাম।”

দীপ্তর মাথায় এখন কিছুই ঢুকছে না, সে ফুঁসতে ফুঁসতেই বলল, “ওই মহিলার কী মনে হয়? এতদিনে তার মনে পড়েছে সন্তানের প্রতি কর্তব্যের কথা? ঝগড়া করে ওই মহিলা পাশের ঘরে দরজা বন্ধ করে বসে থাকত। এই পাশে আমি ভয়ে ক্ষুধায় কাতরাতাম, তখন তার মায়ের কর্তব্য মনে পড়েনি? নিজের জেদ বজায় রাখতে যখন আমাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে বাবাকে ব্ল্যাকমেইল করত তখন মাতৃত্বের কথা মনে পড়েনি? আজ কেন মাতৃত্ব উপচে পড়ছে তার? তুমি এটা নিয়ে আমাকে অপমান করেছ শ্রেয়সী।”

“দীপ্ত, আমি…..”

“আমি একা থাকতে চাইছি। তুমি আমার চোখের সামনে থেকে যাও।”

শ্রেয়সী যেতে যেতে পেছনে শব্দ শুনে একবার পিছু তাকিয়ে দেখল, নিজের প্রিয় একটা টব পা দিয়ে উল্টে ফেলেছে, সেটা কয়েক টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে।

শ্রেয়সীর চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল।
……..
ক্রমশ