তোমার নিমন্ত্রণে পর্ব-২৮+২৯

0
87

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৮)
নুসরাত জাহান লিজা

দীপ্তর পৃথিবীটা যেন থমকে আছে, সে নিজেও একজন অনুভূতিহীন পাথর। পুরো মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে, শুধু তীব্র ব্যথা অনুভূত হচ্ছে। দৃষ্টিতে এক পৃথিবী শূন্যতা, হৃদয় জুড়েও।

কতটা সময় পেরিয়ে গেল তারও কোনো হিসেব নেই। পুরোপুরি অস্তিত্বহীন এক জড়বস্তু বলেই বোধ হচ্ছে। হঠাৎ বৃষ্টি পড়তে শুরু করল, প্রথম ঝিরিঝিরি তারপর ঝুম বৃষ্টি। তাতেও দীপ্ত নির্বিকার। শুধু মাথাটা সোজা করে নিল চোখ আর নাকে পানি ঢুকে পড়া থেকে বাঁচাতে।

পৃথিবী জুড়ে একসময় নামল প্রগাঢ় অন্ধকার। সেই আঁধার ওকে আশ্রয় দিল, ধীরে ধীরে অসাড়তা কাটতে থাকল। আজ এই ঝুম বৃষ্টিতে পার্কে লোক সমাগম এখন নেই বললেই চলে।

ওর মানসপটে ভেসে উঠল ছোট্ট দীপ্ত, ওইটুকু বয়সে যার মুখোমুখি হতে হয়েছিল এই জগতের সবচাইতে নির্মম প্রশ্নের,

“তুমি কার কাছে থাকতে চাও? বাবার কাছে নাকি মা’য়ের সাথে?”

ওর ছোট্ট পৃথিবীটা তখন কেবল ওই দুটো মানুষকে ঘিরেই আবর্তিত ছিল। সে ওই পুরো পৃথিবীর আশ্রয়েই থাকতে চেয়েছিল। সেটা নাকি সম্ভব নয়। পৃথিবীটাতে ভাঙণ অবশ্যম্ভাবী। ওর শিশুমনের চাওয়ায় কিছু আসে যায় না।

ওর প্রতি মায়ের উদাসীনতা আর বাবার স্নেহময়তায় সে সিদ্ধান্ত দিয়েছিল তখন। কিন্তু ওর হৃদয়ে গড়া যে পৃথিবী তা ভেঙে দুই টুকরো হয়ে গিয়েছিল। কাচ ভাঙলে যেমন তা কখনো জুড়ে দেয়া যায় না, বিশ্বাসের পৃথিবীটাও ঠিক তেমন। ওর ভেতরটা তখন তেমনই চিরদিনের জন্য খণ্ডিত হয়ে গিয়েছিল।

রাতে বাবার বুকে শুয়ে সে ভাবত, এই বুঝি মা আসবে। ওকে জড়িয়ে ধরে বলবে, “আমার খোকন সোনাটা ঘুমিয়ে পড়েছে? আয় বাবা, আমার বুকে আয়, তোকে ঘুম পাড়িয়ে দিই।”

মায়ের গলায় ঘুম পাড়ানি গানের সুরটাও সে শুনতে পেত ওর অবচেতনে। যা আর কখনোই সম্ভব হয়নি। অর্ধেক পৃথিবী নিয়ে সে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠেছে। বাবা তার সমস্তটা দিয়ে সারাজীবন চেষ্টা করে গেছেন, পুরো পৃথিবী হয়ে উঠতেও পেরেছেন, তবুও ভাঙার একটা দাগ কোনোদিন মুছে যায়নি, তা রয়ে গেছে প্রবল পরাক্রমে।

নতুন করে শোভা জীবনে এগিয়ে গেছেন, তার কোলজুড়ে নতুন সদস্য এসেছে, তার পৃথিবী পূর্ণ করতে, সেদিন মা’য়ের কোথাও দীপ্ত ছিল না। বাবার সাথে সাথে বাবার দীপ্তও তার কাছে ছিল অচ্ছুৎ।

প্রতি বছর দীপ্তর জন্মদিনে তিনি একবার করে কল দিতেন। সে কথা বলেনি আর। একদিন জেনেছে তার মা চট্টগ্রাম চলে গিয়েছেন। তারপর বহুদিন তিনি কোনো রকম যোগাযোগ করেননি। দীপ্তর এসএসসি পরীক্ষার আগে দেখা করতে এসেছিল। সাথে তার দুই সন্তানকে এনেছিল, ছোটজন ছিল কোলে। দীপ্ত উঠে চলে এসেছিল। দৃশ্যটা সহ্য হয়নি। ঈর্ষায় নয়, অপ্রাপ্তির আঘাতে। ওইভাবে তো মা ওকে কখনো আগলে রাখেননি তার স্নেহছায়ায়।

তারপর থেকে পারতপক্ষে কোনোদিন মায়ের সাথে সে দেখা করেনি। তবুও কখনো সখনো দেখা হয়ে গেছে, বছর ছয়েক আগে তারা ঢাকায় এসেছেন, শোভার সন্তানরা দেশের বাইরে পড়তে গেছে৷ তখন থেকে নিজের একাকিত্ব ভুলতে দীপ্তকে বিরক্ত করছে এটাই ওর মনে হয় সবসময়।

ওর লাল হয়ে আসা ক্লান্ত চোখের পাতায় শ্রেয়সীর মুখটা ভেসে উঠল। মেয়েটাকে ওর খুব করে ধরে রাখতে ইচ্ছে করে নিজের জীবনে। ভালোবাসতে ইচ্ছে করে। ওর জন্য এতটা ‘কেয়ার করা’কেও ওর ভালো লাগে। কিন্তু ভালোবাসা বলে যদি সত্যিই কিছু না থাকে! যদি ওর প্রতি শ্রেয়সীর মোহভঙ্গ হয় কোনোদিন! তবে তো সে-ও মায়ের মতো ওকে ফেলে চলে যাবে! সে বড্ড হতভাগা। ভালোবাসা ধরে রাখতে পারে না। যেখানে মা জন্ম দিয়েও ওকে উপেক্ষা করেছেন, সেখানে শ্রেয়সী কেন সারাজীবন ওকে আগলে রাখতে যাবে!

এটা তো ঠিক, দীপ্ত বাইরে থেকে যতই চটকদার হোক, ভেতরে ভেতরে সে তো ভাঙাচোরা একজন মানুষ। ওর ভেতরটা যদি শ্রেয়সী কখনো দেখে ফেলে, সেদিন ওর চোখে মুগ্ধতা থাকবে না, মায়া থাকবে না, কেবলই শূন্যতা থেকে যাবে। শূন্যতাই একমাত্র চিরস্থায়ী বস্তু পৃথিবীতে, বাকিসব নশ্বর, ক্ষণস্থায়ী।

পরক্ষণেই বাবার মুখটা মনে পড়ল, মানুষটা ওর মতোই অসহায়। ওদের যত দূর্ভোগ সমস্তই একজনের জন্য, ওর মা, তার স্ত্রী। ওই মানুষটাও শ্রেয়সীকে বড্ড স্নেহ করেন, তিনিও তো কতটা কষ্ট পাবেন।

চিন্তাগুলো ডালপালা মেলে দিচ্ছিল দীপ্তর মনে, সেসব চিন্তা কতটা প্রাসঙ্গিক কতটা অমূলক তা তলিয়ে দেখার মতো মানসিক স্থিতি তখন ওর মধ্যে নেই।

বৃষ্টি একসময় কমে এলো, বেশ কয়েকবার হাঁচি আসতেই খানিকটা যে তাড়া অনুভব করল। বাসায় ফিরতে হবে।

***
“মা রে, সাড়ে এগারোটা বাজে, আমি একবার বের হই। এভাবে ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছে না।”

মোহসীন সাহেবের উদ্বিগ্নতা দেখে শ্রেয়সী নিজের ভেতরের চিন্তাকে শান্ত করল। তার বয়স হয়েছে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে তাকে বাইরে পাঠাতে মন সায় দিচ্ছে না।

“বাবা, বৃষ্টি তো থামল, হয়তো বৃষ্টিতে কোথাও আটকা পড়েছিল। এখন এসে পড়বে। আর কিছুক্ষণ দেখি।”

এরমধ্যে শ্রেয়সী কিছুক্ষণ আগে শিমুলের সাথে কথা বলেছে, সে বলেছে, “আমি দেখছি। তুমি চিন্তা করো না। আঙ্কেলকে দেখো।”

মোহসীন সাহেব শুনলেন না। তিনি পাঞ্জাবি গায়ে দিয়ে বেরিয়ে এলেন। দরজার কাছাকাছি আসতেই কলিংবেল বাজল।

দরজা খুলে বিধ্বস্ত দীপ্তকে দেখে দুজনেই আঁতকে উঠলেন, “দীপ্ত, কী হয়েছে?”

দীপ্ত ততক্ষণে টলছে। অস্ফুটস্বরে কী বলল বোঝা গেল না। ভেতরে ঢুকে সে পড়ে যাচ্ছিল প্রায়, মোহসীন সাহেব আর শ্রেয়সী দুই পাশে ধরল।

দীপ্তর শরীর অসম্ভব ঠান্ডা হয়ে আছে, পুরো গা ভেজা।

ছেলেকে ওভাবে দেখে মোহসীন সাহেব অস্থির হয়ে গেলেন। ওকে বিছানায় শুইয়ে মোহসীন সাহেব বললেন, “গরম পানি …”

“তুমি বসো বাবা আমি আনছি।”

মোহসীন সাহেব দীপ্তর ভেজা কাপড় পাল্টে দিলেন অভ্যস্ত হাতে৷ এরপর মাথা মুছে দিতে লাগলেন৷ শ্রেয়সী এসে দীপ্তর পা কুসুম গরম পানিতে ডুবিয়ে দিল।

আধা-অচেতন মানুষটাকে হালকা করে বসিয়ে দিয়ে আদা, লবঙ্গ দেয়া চা খাওয়ানোর চেষ্টা করল।

শ্রেয়সীকে নামিয়ে দেবার সময়ও তো দীপ্ত স্বাভাবিক ছিল, হঠাৎ কী হলো! এটা যে স্বাভাবিক বৃষ্টিতে ভেজা নয় তা বোঝা যাচ্ছে স্পষ্ট।

রান্নাঘরে এসেছিল শ্রেয়সী দেখল বসার ঘরে রাখা মোহসীন সাহেবের মুঠোফোনে কল আসছে। সে নিতে নিতে কেটে গেল, ‘শোভা’।

মোহসীন সাহেবকে মোবাইলটা এগিয়ে দিলে তিনি কলারের নামটা দেখে বিতৃষ্ণায় সরিয়ে রাখলেন। তার ছেলে অসুস্থ, এখন তার উল্টাপাল্টা কথা শুনতে একদমই ইচ্ছে করছে না তার।
……..
ক্রমশ

#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ২৯)
নুসরাত জাহান লিজা

শোভা হাতের মুঠোফোনের দিকে মুহূর্ত খানেক করুণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে সেটা সরিয়ে রাখল। দীপ্তর ঘৃণা ভরা দৃষ্টি তার হৃদয়ে তীরের মতো বিদ্ধ করছে। সেই ঘৃণার তীব্রতা তিনি সহ্য করতে পারছেন না। কী অসহ্য ঘৃণা নিজের সন্তানের তার প্রতি! তার চোখ বেয়ে দুফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ল বহুকাল পড়ে।

সদ্য তারুণ্যে পা দেয়া শোভা গভীর প্রেমে পড়ে যান ধীরস্থির অথচ প্রাণখোলা মোহসীনের। তিনিই প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিলেন। সুন্দরী, চপলা আর জেদি শোভাকে ফিরিয়ে দিতে পারেননি তিনি। কয়েকবার অস্বীকার করার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু শোভার অদম্য জেদের কাছে তার আপত্তি খরস্রোতা নদীতে খড়কুটোর মতোই ভেসে গেছে। চার বছর চলেছে তাদের প্রণয় পর্ব।

শোভার বাড়িতে বিষয়টা জানাজানি হয়ে যায়। মোহসীন ততদিনে একটা চাকরি জুটিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু শোভার পরিবারের চাহিদার সাথে সেটার দূরত্ব ছিল বিস্তর। তাই তারা অন্যত্র বিয়ে ঠিক করে ফেলেন।

শোভা বরাবর জেদি, একরোখা। একবার যা তার মাথায় ঢুকে যায়, তা থেকে তাকে বিচ্যুত করা তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তিনি একদিন ইউনিভার্সিটি থেকে সোজা মোহসীনের মেসে চলে আসেন। সেই রাতেই তারা বিয়ে করেন।

বিয়ের পরে তার পরিবার থেকে ঝামেলা করার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু একজন সাবালিকা মেয়ের মতামতের বিরুদ্ধে কিছু করা যায়নি।

বিয়ের প্রথম দুই বছর কেটে গেল স্বপ্নের মতো। কত স্বপ্নের হাতছানি, কত পরিকল্পনা সংসার নিয়ে! এরপর হঠাৎ দীপ্ত পেটে আসে। শোভা প্রথমে সন্তানকে রাখতে চাননি। সদ্য অনার্স শেষ হয়েছিল তার। জীবন কেবল শুরু, সেই মুহূর্তে মানসিকভাবে সন্তান জন্ম দেবার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু মোহসীন সন্তান চেয়েছিলেন। তিনি কথা দিলেন,

“শোভা, আমি সব সামলে নেব। ও আসুক প্লিজ।”

তিনি মেনে নিলেন। একটা ফুটফুটে সন্তান কোল জুড়ে এলো। তিনিও তার মায়ায় জড়িয়ে পড়লেন। দীপ্ত জন্মানোর পরে পরেই মোহসীনের প্রমোশন হলো। তার ব্যস্ততা বাড়তে থাকল। বাড়িতে সময় দেবার পরিমান কমে গেল। শোভার সহনশীলতা কমতে থাকল।

নিজেকে মনে হতে থাকল একটা সন্তান জন্ম দেবার মেশিন। সন্তান জন্ম দিয়েছেন, এখন তাকে লালন পালন করা ছাড়া তার জীবনে যেন আর কিছু নেই৷ একটা কাজের লোক ঠিক করে দিয়েই মোহসীন তার দায়িত্ব শেষ করেছেন। শোভা জেদের বশে তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দিলেন। নিজেই রান্না, কাপড় কাচা সব করতে শুরু করলেন৷

দীপ্ত কান্নাকাটি করলে তার রাগ বাড়ত। মনে হতো সে জন্মাল বলেই তার যত দূর্ভোগ। মোহসীন সাহেবের সাথে এটা নিয়ে ঝগড়া হতো। তিনি বললেন,
“সংসারে একজন সদস্য বেড়েছে। তার খরচ আছে। আমার অফিসে কাজের চাপ, তোমাদের জন্যই তো সব।”

এসব ছেলে ভোলানো কথা তার বিষের মতো মনে হতো। তার মনে হতো লোকটা তাকে বাড়িতে রেখে বাইরে অন্য কারোর প্রতি আসক্ত হয়ে পড়েছে। এরকম হওয়া তো অসম্ভব নয়৷ এটা নিয়ে তাদের সংসারে অশান্তি হতে শুরু করল।

শোভার বোনদের সাথে যোগাযোগ ছিল, তাদের দেখে নিজের ভুল তিনি বুঝতে পারলেন। তিনি বোনদের মধ্যে সবচাইতে মেধাবী ছিলেন, সুন্দরীও। অথচ তাদের জীবনযাত্রার সাথে তার কত পার্থক্য। তিনি সংসার আর সন্তানের পেছনে খেটে মরছেন৷ তার জন্ম তো সেজন্য হয়নি। তার কত সম্ভাবণা ছিল, কত ভালো ক্যারিয়ার হতে পারত৷

তিনি মোহসীন সাহেবকে একদিন বললেন, “আমিও চাকরি করব।”

“দীপ্তকে কার কাছে রাখব?”

“মানে?”

“দেখো, দীপ্ত খুব ছোট। আরেকটু বড় হোক৷ এখন ওর তোমাকে প্রয়োজন।”

এই কথার পর তার চোখ পুরোপুরি খুলে গেল। তিনি বুঝলেন তার যোগ্যতাকে লোকটা ভয় পায়। তাই সন্তান আর সংসারে বেঁধে রাখতে চায়। তার মন বিদ্রোহ করল। সংসারের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ হলেন।

চার বছরের দীপ্ত দুষ্টুমি করলে তার গায়ে হাত পর্যন্ত তুলেছেন কয়েকবার। নিজের জেদি সত্তা যা সংসারের জাঁতাকলে হারিয়ে যেতে বসেছিল, সেই সত্তা ফিরে এলো।

মোহসীন নামের লোকটা তার জীবন নষ্ট করেছে, তিনিও তাকে বুঝিয়ে দেবেন, তিনি মোটেও ফেলনা নন। একসময় সরকারি চাকরির বয়স শেষ হয়ে গেল। তার বছর খানেক আগে অবশ্য লোকটা বলেছিল, “তুমি চাইলে এখন চাকরি করতে পারো।”

তিনি তখন তাতে কেন সাড়া দেবেন! তিনি কারোর হাতের কাঠ পুতুল নন। যখন চাবি দেবে তিনি নাচবেন! এখন তার ইচ্ছে নেই।

দীপ্তর বয়স যখন ছয়, তখন তাদের সম্পর্কটা পুরোপুরি বিষাক্ত হয়ে উঠল। একই ছাদের তলায় যেন তাদের বিষ নিঃশ্বাস পড়ছিল।

তবুও দিনশেষে লোকটা ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত মুখে ছেলেকে জড়িয়ে বিষাদ নিয়ে ঘুরত তার সামনে দিয়ে, তার পৈশাচিক আনন্দ হতো। এই সম্পর্কে একসময় শোভাও ক্লান্ত হয়ে গেলেন৷ তিনি নিজেই মোহসীনকে বললেন,

“আমি আর এক ছাদের নিচে তোমার সাথে থাকতে চাই না। ডিভোর্স চাই।”

মোহসীনও হয়তো মুক্তির পথ খুঁজছিলেন, তিনি রাজি হয়ে গেলেন৷

শোভা ততদিনে একটা জিনিস বুঝেছে দীপ্ত হলো লোকটার সবচাইতে বড় দুর্বলতা। শোভারও মায়া আছে সন্তানের প্রতি। তিনি কেন সন্তানকে ছাড়বেন ওই লোকের জন্য!

আজ দীপ্ত বলল, তিনি নাকি কেবল প্রতিশোধ চরিতার্থ করার জন্যই ওকে কাছে রাখতে চেয়েছিলেন। কথাটা তো পুরোপুরি ঠিক নয়! প্রতিশোধ অবশ্যই একটা কারণ, কিন্তু সন্তানকে তো তিনিই জন্ম দিয়েছেন, পেটে ধরেছেন!

কিন্তু দীপ্ত এলো না তার সাথে। প্রথমদিকে তার ভীষণ কষ্ট হতো ছেলেটার জন্য। একসময় পরিবারের মতে আবারও বিয়ে করলেন। সেখানে সংসার সংসার খেলা নেই। কিছুদিন পরপর সমমনা মানুষদের নিয়ে ‘গেট টুগেদার’, কিছুদিন পরপর ট্রিপে যাওয়া সেসবে তিনি অভ্যস্ত হয়ে উঠলেন।

তবুও দীপ্তর মুখটা একখণ্ড পিছুটান হয়ে রইল তার এগিয়ে যাওয়া জীবনে। তিনি কখনো সিঙ্গাপুর, কখনো থাইল্যান্ড, কখনো নেপাল এসব করতে করতে যেটুকু অবসর পেতেন, তখন ওই লোকটার বাসায় টেলিফোন করে দীপ্তর খোঁজ নিতেন।

তার আবারও সন্তান এলো কোল জুড়ে। তিনি তাকে আঁকড়ে ধরে দীপ্তকে ভুলতে চেষ্টা করতে থাকলেন৷ কারণ দীপ্তর সাথে মোহসীন আছে, তার সাথে কথা বলতে হয় আগে৷ এটা তার জন্য চরম অবমাননাকর বলে মনে হতো৷ কিন্তু চাইলেই কি যাকে এতগুলো দিন নিজের ভেতরে ধারণ করে জন্ম দিয়েছেন তাকে ভোলা যায়! তিনিও ভুলতে পারেননি।

আরেকবার তিনি সন্তান সম্ভবা হলেন তিন বছর পর, তখন তিনি আবারও দীপ্তর সাথে যোগাযোগ করার চেষ্টা করলেন, কিন্তু ছেলে তার সাথে কথা বলতে চায় না।

অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ছেলের অভিমান তিনি ভাঙাতে পারেননি। এখন বয়স হয়ে যাচ্ছে, তার অন্য দুই ছেলেমেয়ে তাদের নিজেদের জগতে ব্যস্ত। তার স্বামীও এখন অসুস্থ। তার চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর থাকেন। তিনি এই বিশাল বাড়িতে একা।

তার ফেলে আসা সময়ের কথা মনে পড়ে, মোহসীনকে তিনি ক্ষমা করতে পারেননি। কিন্তু সন্তানকেও তিনি ভুলতে পারেননি। তাই প্রায়ই কল করতেন। কিন্তু ধরে না। ব্লক করত আগে, তিনি অন্য নম্বর নিয়ে আবারও কল দিতেন। এখন বেজে যায় ঠিক কিন্তু রিসিভ হয় না।

মনে হয় এই তো সেদিন, ছোট্ট দীপ্তকে তিনি প্রথমবার কোলে নিলেন। সেই ছেলে বিয়ে করেছে, তাকে জানায়নি পর্যন্ত কেউ। মোহসীন যে এভাবে তার উপরে প্রতিশোধ নেবে তিনি ভাবেননি। এর জন্যও তাকে ক্ষমা করবেন না।

ছেলের মনে কতটা বিষবাষ্প ভরে দিয়েছে লোকটা তাকে নিয়ে আজ ওর অভিব্যাক্তিতে তা স্পষ্ট।

যে রেগে ছিল, রাগের মাথায় খারাপ কিছু ঘটিয়ে না ফেলে, এরজন্য অনেক ভেবে তিনি লোকটাকে কল দিয়েছিলেন আজকের বিষয়টা বলতে সাথে কড়ায় গণ্ডায় হিসেব চাইতে। কিন্তু স্পর্ধা দেখিয়ে কল কেটে দিল মুখের উপরে।

তিনি ছেলের খারাপ কোনোদিন চান না, চাইবেনও না। হাজার হোক দীপ্ত তো তারই অংশ। তিনি সন্তানের খারাপ কী করে চাইবেন! এটা কেন ছেলেটা বুঝল না!
………
ক্রমশ