#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৪)
নুসরাত জাহান লিজা
সকালে বরাবর দীপ্তেরই আগে ঘুম ভাঙে। শ্রেয়সী সকাল বেলার পাখি নয়। তবে আজ সে আগে উঠেছে। উঠেছে বলাটা ভুল হবে, আসলে গোটা রাতটুকু সে নির্ঘুম কাটিয়েছে। দীপ্ত ওকে প্রবল স্রোতে হারিয়ে যাবার মুহূর্তে লোকে যেমন খড়কুটো আঁকড়ে ধরে, তেমন করে আঁকড়ে ধরে শিশুর মতো ঘুমিয়েছে।
দীপ্তকে এত গভীর ঘুমাতে সে আগে দেখেনি। বিয়ের পর থেকেই রাত জেগে কোনোদিন সিরিজ, মুভি দেখেছে, কোনোদিন প্রিয় দলের খেলা আবার কোনোদিন কেটেছে গল্প করে, ভালোবেসে। ঘুমাতে ঘুমাতে দুটো পার হয়ে যেত প্রায়ই। তবুও প্রায় ভোরেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে দীপ্ত। এত অল্প ঘুমায় ছেলেটা!
শ্রেয়সীর মাথায় চিন্তার ঝড় চলছে। দীপ্তর হুট করে এই এড়িয়ে চলার প্রবল চেষ্টা, আবার আচমকাই এভাবে আঁকড়ে ধরার আকুতি সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো লাগছে শ্রেয়সীর।
আজকের সকালটা সুন্দর। দীপ্ত বালিশে মাথা গুঁজে ঘুমুচ্ছে বলে মুখটা দেখা যাচ্ছে না। শ্রেয়সী উঠে বারান্দায় চলে এলো। সকালের ফুরফুরে বাতাসে মন খানিকটা হালকা হয়ে গেল৷ ঘুমহীন রাতের ক্লান্তিতে সতেজ স্পর্শ বুলিয়ে গেলে যেন নির্মল প্রভাতী বাতাস।
দীপ্তর গাছগুলোতে পানি দিল, এখানে কিছু গাছ শ্রেয়সীও লাগিয়েছে।
“তুমি আজ আমার আগে উঠে পড়েছ? আমাকে ডাকলে না যে?”
হেসে বলল দীপ্ত। হাসি জুড়ে অদ্ভুত সারল্য।
শ্রেয়সীর কোথাও যেন কাঁটা বিঁধিয়ে দিয়ে দিল গতকালের উপেক্ষাটুকু।
“আমার ডাকার প্রয়োজন আছে? তুমি নিজের কাজ, নিজের জীবন নিজেই সামলে নিতে জানো।”
দীপ্তর হাসি মুহূর্তে নিভে গেল, পুরোপুরি বারান্দায় এসে শ্রেয়সীর পাশে দাঁড়িয়ে সকালের শান্ত সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, “ওই যে সূর্যটা দেখছ, সকালের এই সময়টায় কী শান্ত, স্নিগ্ধ। কিছুক্ষণ পর থেকেই উত্তাপ ছড়াতে শুরু করব। দুপুরবেলায় সমস্ত তেজ ঢেলে দেয় পৃথিবীর বুকে। আবার আরও কিছু সময় পর থেকে তেজ কমতে কমতে গোধূলির মতো চমৎকার একটা মুহূর্ত আমাদের দেয়, যেখানে পৃথিবীর সমস্ত মায়া মিশে থাকে। তার কিছুক্ষণ পরেই আবার ঘাপটি মারে মেঘের আড়ালে। একটা সূর্যের একই দিনের রূপের কতো রকমফের দেখেছ?”
“সূর্যের রূপ বিভাজন শুনতে ইচ্ছে করছে না দীপ্ত। ভালো লাগছে না। আমি চা বানাই, বাবার কোরআন পড়া হয়ে এলো বোধহয়।”
“আমি চা বসিয়ে এসেছি আমি। পাঁচ মিনিট পরে গেলেও হবে।”
শ্রেয়সী ঠিক করেছে আজ সে নিজে থেকে কোনো প্রশ্ন করবে না দীপ্তকে। কয়দিন জিজ্ঞেস করে একই উত্তর পেয়েছে সে। সেই উত্তর আজ শোনার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই।
“সূর্যের কথা কেন বললাম বলি, মানুষের সম্পর্কেও এরকম নানা রূপ নানা ভাবে আসে, নানারকম ভাঙাগড়ায় সম্পর্কের রূপ পরিবর্তন হয় প্রতিনিয়ত। কখনো শান্ত, কখনো উত্তপ্ত, কখনো স্নিগ্ধ আবার কখনো সূর্যের অস্ত যাবার মতো করে সম্পর্কও অস্তমিত হয়ে যায়। আমি কিছুদিন ধরে খুব ভেবেছি জানো, কিন্তু ওই যে অস্ত যাওয়া এটা আমি মানতে পারিনি। আমি ভয় পেয়েছি। বেশি ভালোবেসে ফেললে হারিয়ে গেলে কষ্টও প্রগাঢ় হয়। কিন্তু আমি তোমাকে নিজের সমস্তটা দিয়ে অনুভব করতে শুরু করেছি, যখন বুঝতে পারলাম তখন ভয় পেলাম। ঘর পোড়া গরু যেমন আকাশে সিঁদুর রঙা মেঘের দেখা পেলেই আগুন ভেবে ভয় পায়, আমিও ভয় পেলাম। আরও দূরে সরে যেতে চাইলাম প্রাণপণে। কিন্তু দূরে যেতে চাইলেই কী যাওয়া যায়! তুমি আরও বেশি করে অদৃশ্য সুতোর টানে আমাকে টানতে থাকলে। এই দ্বিমুখী দ্বন্দ্বে আমি এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছিলাম। চিন্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল। তার মধ্যে আমার বন্ধু তূর্যর ডিভোর্স হলো৷ ওদের প্রেম দেখে অনেকে ঈর্ষা করত। সেই প্রেম হারিয়ে গেল। সেদিন অফিসে…”
এটুকু বলে থামল দীপ্ত, একটানা কথা বলে এবার দম নিল বড় করে।
“আমি নিজেকে ডিফেন্ড করছি না, সেই মুখ আমার নেই। কোনো জাস্টিফিকেশনই গ্রহণযোগ্য নয় আমি জানি৷ তবুও উনি যখন আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন, আমার ছেলেবেলার ওই তীব্র আতঙ্ক ভরা দিনগুলো চোখের সামনে ফিরে আসছিল। বাবার সাথে সংসারটাকে বিষাক্ত করে সেই বিষে আমাদের আকুণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে উনি দিব্যি ভালো আছেন। বাবার ভালোবাসা নিয়ে উনি কি অনায়াসে বলে গেলেন, ভালোবাসা বলে কিছু নেই। মানুষের ফ্যান্টাসি ওসব। আমার ভয় ফিরে এলো। হারানোর ভয়।”
ক্ষণকাল বিরতি নিয়ে শ্রেয়সীর চোখের দিকে তাকিয়ে দীপ্ত বলল, “তীব্র ভয় কখনো পেয়েছো শ্রেয়সী? এমন ভয়, যেখানে পৃথিবীর অন্যসব তুচ্ছ মনে হয়?”
প্রশ্ন করে উত্তরের অপেক্ষা না করে নিজেই উত্তর দিল, “আমি পেয়েছি, সেই ছোট্ট বেলায়। ভয়ংকর ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দেখতাম৷ এমন ভয়ংকর মনে হতো সব সত্যি। আমি ঘুমাতে পারতাম না নাইটমেয়ারের ভয়ে। রাতে শুলে সেজন্য বাবা আমার পাশ থেকে নড়তেন না। স্কুলে অন্য বাচ্চাদের অভিভাবকদের টীকাটিপ্পনী সহ্য করতে হয়েছিল সেই সময়। প্রতিবেশি এমনকি নিজেদের আত্মীয় স্বজনের কাছ থেকেও বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছিল ওইটুকু বয়সে। কেউ কেউ হয়তো বুঝেও করেনি, হয়তো নিজের কিউরিওসিটি থেকেই কোনো প্রশ্ন করে ফেলেছে, বা কিছু জিজ্ঞেস করেছে, কিন্তু আমার কষ্টটা বুঝতে পারেনি। আমি একলা হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলে যেতে অনীহা তৈরি হলো, মানুষের সাথে কথা বলতাম না, শুধু বাবা ছাড়া আর কারোর সাথে কথা বলতাম না। সাইকিয়াট্রিস্ট এর পরামর্শে বাবা আমার স্কুল চেঞ্জ করে দিলেন। স্কুলে সাথে গিয়ে বসে থাকতেন, আমার ক্লাসমেটদের সাথে আমার আগে তিনি বন্ধুত্ব করে ফেললেন। তাদের অভিভাবক, স্কুলে শিক্ষক সবার সাথে উনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখতেন৷ বহু কষ্টে সেখান থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম। তবে একটা ভয় কখনো আমাকে ছেড়ে যায়নি, একটা দাম্পত্য সম্পর্কের ভয়। এই সম্পর্ক যে কতটা কদর্য হতে পারে আমি তা দেখেছি। তোমাকে বিয়ের পরে কাটিয়েই উঠছিলাম খানিকটা, কিন্তু লাস্ট দুটো ইনসিডেন্ট আমার পুরোনো ভয়কে জাগিয়ে দিলো।”
এতক্ষণ পরে শ্রেয়সী এগিয়ে এলো ওর দিকে। দীপ্তর হাত দুটো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে চোখে চোখ রেখে সে বলল, “তুমি সূর্যর অস্ত যাবার গল্প করলে দীপ্ত, সকালের মিষ্টি রোদ থেকে শুরু করে গোধূলিতে তার অন্ত এটা বললে। সকাল কী কেবল একদিনের? দিন ঘুরলেই তো আকাশ ঝলমল করে উঠে আবার। এটা ভাবতে পারলে না কেন দীপ্ত?”
আরেকটু এগিয়ে এসে শ্রেয়সী দীপ্তের দুই গালে হাত রেখে বলল, “যা তোমার অতীতে ঘটে গেছে, সেটা চাইলেও জীবনের খাতা থেকে ইরেজারে মুছে ফেলা সম্ভব নয়৷ সেসব মুছে ফেলার দরকারটাই বা কী? জীবনের বাকি খাতা তো শূন্য পড়ে আছে, সেটা ভরাট করবে না? অতীতের ঘষামাজা না করে নতুন করে গল্পটা লেখা যায়, জীবনের গল্প। জীবনটা চমৎকার দীপ্ত। সেখানে কেবল অপরিসীম দুঃখ নয়, খুঁজে নিতে চাইলে অফুরন্ত আনন্দের উৎসের দেখাও মেলে। সেটা খুঁজে নিতে হয় দীপ্ত।”
“আমি খুঁজতে চাই শ্রেয়সী। আমার সাথে থাকবে? বাকি গল্পটা নাহয় দুজন একসাথে লিখব? থাকবে আমার সাথে আজীবন?”
শ্রেয়সী পিছিয়ে গেল দুই কদম, এরপর দীপ্তর দিকে অন্তর্ভেদী দৃষ্টি মেলে বলল, “তোমার সব কথা বলা শেষ? আর কিছু বাকি আছে? আরও কিছু থাকলে বলে ফেল, আজ একেবারে সব শুনে ফেলি।”
দীপ্ত বলতে চেয়েও পারল না, যে শ্রেয়সীকে সে ভালোবেসে বিয়ে করেনি, বরং বিয়ের পর ভালোবেসেছে। কিন্তু তখন ওর আচরণ…
দীপ্ত হঠাৎ প্রায় আঁতকে উঠে বলল, “আমি চা বসিয়েছিলাম না? পাঁচ মিনিটের জায়গায় প্রায় পৌনে এক ঘন্টা চলে গেছে। পাতিলের দফারফা হয়ে গেছে নিশ্চিত।”
“পোড়া গন্ধ যেহেতু পাইনি, বাবা চুলা বন্ধ করে দিয়েছেন তাহলে। তাই ওটা নিয়ে ভাবতে হবে না। উত্তর কই?”
দীপ্ত বলল, “আমি আগে প্রশ্ন করেছি।”
“হাত ছেড়ে যাবার জন্য ধরিনি দীপ্ত। পৃথিবীর সবাই এক নয়। তুমি কী অন্য দশজনের মতো? কত সংসার যুগের পর যুগ কেটে যায়, সব নাহয় পরে বলি। আমার বাবা মাকে দেখোনি তুমি? তবে আগেও বলেছি, রেসপেক্ট ভীষণ জরুরি একটা সম্পর্কে। সেটা আর নষ্ট করো না।”
“আমার মস্তিষ্কে দুঃসহ যে স্মৃতি গেঁথে আছে সেটাকে তোমার ভালোবাসা দিয়ে ভুলিয়ে দেবে? যে ভালোবাসায় সমস্ত অসুন্দর ডুবে যায় অতল গহ্বরে? দেবে?”
এমন পৃথিবীপ্লাবি আহ্বানে সাড়া না দিয়ে কে থাকতে পারে! এত শক্তি মানুষকে দেয়া হয়নি!
………….
(ক্রমশ)