#তোমার_নিমন্ত্রণে (পর্ব ৩৭)
নুসরাত জাহান লিজা
দু’দিন ধরে শ্রেয়সী নেই। দীপ্ত আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপ নিয়ে নেটফ্লিক্সে সিরিজ দেখতে বসল। নেইল বাইটিং থ্রিলার সিরিজ। ওর জন্য এটা মাখন টাইপের জিনিস। কিন্তু কিছুতেই মন বসাতে পারল না। উঠে চা বানিয়ে নিয়ে এসে আবারও বসল, কিন্তু লাভ হচ্ছে না। শ্রেয়সী ওকে মুড়ি মাখিয়ে দিত চানাচুর আর বেশি করে কাঁচামরিচ, পেঁয়াজ দিয়ে। সরিষার তেলে মেখে নিয়ে বসেও কোনো লাভ হলো না। অবশেষে বিরক্ত হয়ে সেটা সরিয়ে রেখে শুয়ে পড়ল।
কেন ভালো লাগছে না সে জানে। এসব একসাথে বসে দেখার পার্টনার পাশে নেই। দীপ্তর মনে হলো, এই ঝালমুড়ি, এই চা, রাত জাগা সিরিজ কিংবা মুভি, খেলা এসবের চাইতে সে বেশি উপভোগ করত শ্রেয়সীর পাশে থাকা। নইলে তার শূন্যতায় নিজের প্রিয় জিনিসগুলোও কেন পানসে বলে মনে হবে!
কিন্তু তাই বা কী করে হয়! আগে কত রাত সে মুভি দেখে কাটিয়ে দিয়েছে, কই তখন তো এই অনুভূতি হয়নি। দীপ্তর ভেতর থেকে কেউ বলে উঠল,
“তখন তুমি এমন করে কাউকে ভালোওবাসোনি।”
ভালোবাসা, মেয়েটা বড্ড নিষ্ঠুর, পাথর হৃদয়ের। চলেই গেল। যাবার সময় একবারও পেছনে ফিরে তাকাল না দীপ্তর দিকে!
কখন যেন তন্দ্রা এসে পড়েছিল। এরমধ্যেই খুব ছাড়াছাড়া একটা অনুভূতি হলো ওর। মনে হলো শ্রেয়সী এসে ওর পাশে বসল। এরপর আলতো স্পর্শ করছে ওর মাথায়। স্পর্শেই যেন আপাত নির্জীব দীপ্ত সতেজ হলো। দীপ্ত প্রাণপণে শ্রেয়সীকে স্পর্শ করতে চাইছে জেগে উঠে, কিন্তু ঘুম ভাঙছে না কেন৷ মেয়েটা চলে যায় যদি ওকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে! ওর ইচ্ছাশক্তির বলেই কিনা কে জানে, ঘুমটা ভেঙে গেল। না, কেউ নেই! পুরোটাই তবে স্বপ্ন ছিল। দীপ্তর মনে হলো আরেকবার ঘুমিয়ে যদি স্বপ্নের মধ্যেও মেয়েটার স্পর্শ পাওয়া যেত!
শ্রেয়সীর চোখের দৃষ্টি এত প্রখর যে ওর দিকে যখন অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে তাকায়, মনে হয় ওর ভেতরটা যেন পড়ে ফেলছে। আসলেও যদি পড়তে পারত তাহলে চলে যেতে পারত না।
মোবাইল ফোনটা হাতে নিয়ে দেখল রাত তিনটা সাতাশ। শ্রেয়সীকে কল দেবার আগে একবার মনে হলো এত রাতে কল দেয়া কী ঠিক হবে! পরক্ষণেই সেই চিন্তা নাকচ করে ডায়াল করল। ওর স্ত্রী শ্রেয়সী, ওকে কল দেবার জন্য এত ভাবার, সময়ের হিসেবে কষার আবার কীসের দরকার! বিয়ে করা বউ, যাকে সে ভালোবাসে তার সাথে কথা বলার জন্য স্কেল, কম্পাসে মাপার দরকার কী, শুধু প্রয়োজন ইচ্ছার।
কল যাবার প্রায় সাথে সাথেই শ্রেয়সী কলটা ধরল।
“তুমি জেগে ছিলে শ্রেয়সী?”
“তুমি কল করেছ কেন সেটা বলো।”
“তুমি আমার অভ্যাস খারাপ করে দিয়েছ শ্রেয়সী। নিজের সাথে সাথে আমার ভালোলাগার জিনিসগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে গেছ, আমার শান্তি নিয়ে গেছ। কেন করেছ এটা?”
ওপাশে মুহূর্তের নীরবতা, এরপর শ্রেয়সীর গলা পাওয়া গেল, “এখন রাত কয়টা বাজে দীপ্ত?”
“সাড়ে তিনটা।”
“রাত সাড়ে তিনটায় এসব বলতে কল করেছ?”
“না।”
“তবে? যা বলতে চাও বলো। আমার ঘুম পাচ্ছে, ঘুমাব।”
“আমার মনে পড়ল তুমি আমার কাছে কবিতা আবৃত্তি শুনতে চেয়েছিলে। সেভাবে শোনানো হয়নি। আজ শুনবে?”
“এই শেষ রাতে আমার কবিতা শোনার কোনো মুড নেই দীপ্ত। রাখছি।”
দীপ্ত অস্থির গলায় বলল, “না, প্লিজ। আমি কবিতাটা শেষ করেই রেখে দেব। কেটো না প্লিজ।”
“এ কেমন ভ্রান্তি আমার !
এলে মনে হয় দূরে স’রে আছো, বহুদূরে,
দূরত্বের পরিধি ক্রমশ বেড়ে যাচ্ছে আকাশ।
এলে মনে হয় অন্যরকম জল হাওয়া, প্রকৃতি,
অন্য ভূগোল, বিষুবরেখারা সব অন্য অর্থবহ-
তুমি এলে মনে হয় আকাশে জলের ঘ্রান।
হাত রাখলেই মনে হয় স্পর্শহীন করতল রেখেছো চুলে,
স্নেহ- পলাতক দারুন রুক্ষ আঙুল।
তাকালেই মনে হয় বিপরীত চোখে চেয়ে আছো,
সমর্পন ফিরে যাচ্ছে নগ্ন পায়ে একাকী বিষাদ- ক্লান্ত
করুণ ছায়ার মতো ছায়া থেকে প্রতিচ্ছায়ে।
এলে মনে হয় তুমি কোনদিন আসতে পারোনি..
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি এসেছিলে,
চ’লে গেলে মনে হয় তুমি সমস্ত ভূবনে আছো।”
রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্’র কবিতাটার আবৃত্তি শেষ করে দীপ্ত বলল, “তুমি আমার সমস্ত ভূবনে আছো শ্রেয়সী, সেই ভূবনে এখন স্থবিরতা নেমে এসেছে।”
বলেই কল কেটে দিল দীপ্ত। চোখ মুছে নিল। বাকি রাত কেটে গেল এপাশ-ওপাশ করে। সকালে মোহসীন সাহেবের সাথে মিলে রান্না করে কোনোরকমে খেয়ে বেরিয়ে গেল। খেতেও অনীহা হচ্ছে আজকাল।
***
দীপ্তর গলাটা ভীষণ দরাজ। গমগমে গলায় আবৃত্তি শুনতে শুনতে কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছিল। বুকের কোথাও একটা কষ্ট দুমড়েমুচড়ে ফেলছিল ওকে।
দীপ্তর কল পেয়ে ভেবেছিল, ছেলেটা ডাক্তার দেখাতে রাজি হয়ে গেছে। কিন্তু ওই কথার ধারেপাশেও গেল না। কল ধরাটাই ঠিক হয়নি, কবিতা শোনানোটা আসলে ওর অজুহাত ছিল, শ্রেয়সীর সাথে কথা বলার জন্য একটা ছুতোর দরকার ছিল। তাই এটা করেছে।
আবার কবিতার সাহায্য নিয়ে নিজের ভেতরের আকুতিটুকুও প্রকাশ করেছে। এতসব ছাপিয়ে একটা কথা শ্রেয়সীর মস্তিষ্কে গেঁথে আছে,
“নিজের সাথে সাথে আমার ভালোলাগার জিনিসগুলোও সঙ্গে করে নিয়ে গেছ, আমার শান্তি নিয়ে গেছ।”
সত্যিই কী তাই! নিজের প্রশান্তিটুকুও তো সে রেখে এসেছে ওখানে।
দিনগুলো কাটে অপেক্ষা করে। একটা রবীন্দ্র সংগীত মায়ের ঘরে বাজছে, “দিবস রজনী আমি যেন কার আশায় আশায় থাকি…..”
কাকতালীয়ভাবে শ্রেয়সীর মনের সাথে মিলে গেল গানটা৷
রাতে খাবার টেবিলে ভাত নাড়াচাড়া করছিল বলে, মা বললেন, “কী রে, খাচ্ছিস না কেন?”
আবারও খেতে চেষ্টা করল, কিন্তু খাবার গলা দিয়ে নামছিল না। সে বলল.”মা, একটু রুম থেকে আসি। এরপর খাই।”
তিনি মেয়ের অদ্ভুত কান্ডকারখানা দেখেন।
শ্রেয়সী এসে মোহসীন সাহেবকে কল দিল, “বাবা, কেমন আছো তুমি?”
“ভালো। তুই কবে ফিরবি?”
“আমি তো ফিরতেই চাই। বাকিটা তোমার ছেলের উপরে।”
“হ্যাঁ তুই বলেছিস।”
“তোমার ছেলে খেয়েছে বাবা?”
“খাইয়ে দিয়েছি জোর করে। তুই খেয়েছিস তো? তোর তো অফিস?”
“ঠিক করেছি ঢাকায় ফিরে কদিন ছোট খালামনির বাসায় থাকব।”
শ্রেয়সী এবার এসে খেতে বসল। শুনেছে সকালে খায়নি দীপ্ত।
আজ আবার রাত তিনটার পরে কল এসেছে।।শ্রেয়সী ধরল না আজ। প্রশ্রয় দিলেই গড়বড় করবে এই ছেলে। কিন্তু অনবরত বাজতে থাকল। এবার দেখল দীপ্ত নয়, বাসার দারোয়ানের কল। কী হলো!
দেখার জন্য সে কল রিসিভ করতে করতে বারান্দায় এলো। এখান থেকে আধো আলোয় মানুষটাকে চিনতে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হচ্ছে না শ্রেয়সীর। দীপ্ত ঢুকছে বাসায়।
শ্রেয়সী আর কিছু না শুনে দীপ্তকে কল দিল, “তুমি আমার বাসার সামনে কেন?”
“শ্বশুর বাড়ি আসতে পারি না?”
“শ্বশুরবাড়ি কী দরকার?”
“তুমি এত পাষাণ কেন শ্রেয়সী? এতটা পথ জার্নি করে এসেছি, তুমি বাসায়ই ঢুকতে দিচ্ছ না। কলিংবেল বাজিয়ে বাবা মার ঘুম নষ্ট করতে হবে এখন।”
শ্রেয়সী দরজা খুলে দিল। দীপ্ত এত দ্রুত ঘরে ঢুকে দরজাটা লাগিয়ে ওকে দৃঢ় আলিঙ্গনে বেঁধে নিল।
“আমি ভালো ছিলাম না শ্রেয়সী। অনেকদিন পর শান্তি পেলাম এই মুহূর্তে।”
“কেন এসেছ?”
“তোমাকে ফেরাতে।”
“আমি তো বলেছিলাম আমি ফিরব…..”
“আমি সাইকিয়াট্রিস্টের এপয়েনমেন্ট নিয়েছি। কিন্তু আমি ভয় পাই। আমি চাই তুমি সেই সময়টায় আমার পাশে থেকে আমাকে সাহস দাও।”
এবার শ্রেয়সীও আলিঙ্গন ফিরিয়ে দিল। মুহূর্তের জন্য সমস্ত দুনিয়া বিস্মৃত হয়েছিল ওদের জন্য। শ্রেয়সীর মনে হলো বাবা-মার ঘুম যে কোনো মুহূর্তে ভাঙবে। তাই সরে এসে দীপ্তকে নিয়ে নিজের ঘরে এলো।
……….
ক্রমশ