#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(২৬)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)
সূর্যাস্তের পর নজরাত বিষন্ন মনে গার্ডেনে হাঁটা হাঁটি করে। তিন দিন হলো রূপক ইতালি চলে গেছে। এখনো পর্যন্ত তার কোন খবর পাওয়া যায়নি! আদৌও ঠিক মতো পৌঁছেছে কিনা আল্লাহ তা’আলা জানেন। রাহা কান্নায় ভেঙ্গে পড়লে তাকে রাদ এ বাসায় নিয়ে আসে। ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করছে না মেয়েটা। তার মতো সবাই খুব দুশ্চিন্তায় আছে। নজরাত জায়নামাজে বসে বসে আল্লাহ তা’আলা কে বলে চোখের পানি ফেলে। শরীর টা ও ইদানিং ভালো যাচ্ছে না তার।
কিছুদিন আগে কলেজে গিয়ে সেকি কান্ড! স্যার যখন ক্লাস নিচ্ছেন তখন হঠাৎ মাথা কেমন লাগতে শুরু হলো, মনে হলো আশেপাশের সব কিছু যেন ঘুরছে! কিছুক্ষণ পর সহ্য করতে না পেরে দৌড়ে বাথরুমে ঢুকে মাথায়, চোখ মুখে পানির ঝাপটা দিতে নিলে গলগল করে বুমি করে ভাসিয়ে দেয়। তারপর কোন রকম ক্লাসরুমে ফিরে আসলে শোভা বিচলিত হয়ে জিজ্ঞাসা করে,
–” হঠাৎ দৌড়ে গেলি কোথায় বুঝতে পারলাম না। কি হয়েছে তোর? শরীর খারাপ করছে? ডাক্তার দেখাবি? নাকি ভাইয়া কে খবর দিব?
নজরাত ধীর কন্ঠে বলে,
–” না, কিছু করতে হবে না। একটু বিশ্রাম নিলে ঠিক হয়ে যাবে ইনশা আল্লাহ।
সেদিন শোভা একা ছাড়ার সাহস পায়নি নজরাত কে। তাই মেয়েটা কষ্ট করে নজরাত কে বাসায় পৌছে দিয়ে যায়। সাজেদা চৌধুরী শুনে তখনি ডাক্তার দেখাতে চাইলে নজরাত বলে সে এখন সুস্থ আছে, ডাক্তার দেখানোর প্রয়োজন নেই। তবে নজরাত এর বান্ধবী প্রথমবার এসেছে তাকে খালি মুখে যেতে দেয়নি সাজেদা চৌধুরী। ঐ দিন টা অনেক বলে কয়ে রেখে দেয় শোভা কে। শ্বাশুড়ি মায়ের প্রতি নজরাত এর শ্রদ্ধা বেড়ে যায় দ্বিগুণ। পুরো বিকাল থেকে সকাল পর্যন্ত দুই বান্ধবী গল্প করে কাটিয়েছে। রাদ ও সেদিন বাঁধা দেয়নি একাই থেকেছে নিজের ঘরে।
________
একমাত্র ভাইয়ের চিন্তায় বার বার দীর্ঘশ্বাস ফেলে নজরাত। ঘরের ভিতরেও কেমন দম বন্ধকর পরিস্থিতি লাগে। মনে নানা রকম খারাপ দুশ্চিন্তা ঘুরপাক খায়। কিছুতেই শান্তি পাচ্ছেনা নজরাত। সবকিছু কেমন অসহনীয় লাগছে। ভাইয়ের কথা মনে হতেই বড় বড় দুখানি চোখ টসটসে জলে ভরে উঠল। চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে এলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে যায় নজরাত!
প্রায় দশ পনেরো মিনিট এভাবেই পরে থাকে। পরে মালি দেখতে পেয়ে দৌড়ে খবর দেয় সাজেদা চৌধুরী কে। খবর পেয়ে সাজেদা চৌধুরী, রাহা এবং মণি সবাই দৌড়ে আসে।
গার্ডেনে গাছের মাঝে মাঝে পাকা রাস্তায় পড়ে কপাল কেটে গেছে। ক্ষ’ত বেশি গভীর না হওয়ায় র’ক্ত গরিয়ে পরছে না। সবাই মিলে ধরাধরি করে ঘরে এনে সোফায় শুইয়ে দিলে মণি দ্রত গিয়ে বালতি ভরে পানি নিয়ে আসে। মাথায় দিতে দিতে আল্লাহ তা’আলার রহমতে জ্ঞান ফিরে। সাজেদা চৌধুরী একজন গাইনোকলজিস্ট কে কল করে বাসায় নিয়ে আসেন। ভদ্রমহিলা নজরাত কে কিছুক্ষণ পরীক্ষা করে বললেন,
–” পেসেন্ট যে প্রেগন্যান্ট আপনাদের জানায়নি?
এ কথা শুনে দুঃখের মাঝেও আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে পড়ে সকলে। সাজেদা চৌধুরীর চোখে পানি টলটল করে। আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়েন।
নজরাত চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। ভাইয়ের দুশ্চিন্তায় কোন কিছুই ভালো লাগছে না তার। সে গতকাল ই জানতে পারে যে সে মা হতে চলেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কাউকে জানানোর আগ্রহ জাগে তার মধ্যে। তাই কাউকেই কিছু বলেনি এবং কি রাদ কে ও না।
রাহা খুব কেঁদেছে। চোখের কোল ভারী। মুখখানা থমথমে। তবু একটু রক্তাভ উজ্জ্বলতা দেখা যায় তার মুখশ্রীতে। নজরাত এর মাথার কাছে নিয়ে বসে। ভাঙা গলায় বলে,
–” এতো বড় খবরটি চেপে রেখেছো কেন গো? খবরটা শুনে কিছুটা হলেও তো আনন্দ পেতাম।
নজরাত চোখ মেলে তাকায়। চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়ে অশ্রু কণা। ডাক্তার কানা স্থানে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়ে বললেন,
–” মিসেস চৌধুরী? আপনি যথেষ্ট বোঝবান তাই আশা করি ভবিষ্যতে এরকম অনিয়ম করবেন না। সাবধানতা অবলম্বন করবেন। এ সময়ে খাবারের অনিয়ম একদম ভালো হবে না। আপনি খাবার গ্রহণ করলে তবেই ভ্রুন বেড়ে উঠবে। কথাটা খেয়াল রাখবেন। আমি কিছু মেডিসিন লিখে দিচ্ছি এগুলো নিয়মিত সেবন করবেন। তারপর একমাস পর চেকআব করাবেন। যদি এর মধ্যে কোন প্রবলেম হয় তবে এর আগেই আমার সাথে যোগাযোগ করবেন।
সাজেদা চৌধুরী হতাশ গলায় বললেন,
–” এমন হওয়ার কারণ কি ছিল ম্যাডাম?
ডাক্তার আস্বস্ত করে বললেন,
–” এই সময়ে একটু আধটু মাথা ঘুরবে এটা স্বাভাবিক ব্যাপার কিন্তু উনি নিয়মিত খাবার না খাওয়ার ফলে শরীর দূর্বল হয়ে পড়ে। যার ফলে নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারেননি।
সাজেদা চৌধুরী নিস্তেজ গলায় বললেন,
–” একটা দুঃখের সময় পার করছি আমরা। তাই কারোই মন ভালো না। সে জন্যই খাবারের অনিয়ম হয়ে গেছে। এর পর আর হবে না। আমি নিজে খেয়াল রাখবো বৌমার।
________
ডাক্তার চলে গেলে। সাজেদা চৌধুরী নজরাত এর কাছাকাছি বসে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করেন। নজরাত তার হাতটা ধরে কেঁদে উঠে। তাদের সাথে সাথে মণি ও কাঁদে। সবাই কে বোঝায় আল্লাহ তা’আলা সব কিছু ঠিক করে দিবেন। ক্ষনিকের জন্য পরীক্ষা নিচ্ছেন মাত্র।
সবাই যখন নিস্তব্ধ ঘরে, নিস্তেজ হয়ে বসে থাকে তখন নজরাত এর ফোনে কল আসে। মণি ফোনটা এগিয়ে দিলে নজরাত ফোনের স্ক্রিনে বিদেশি নাম্বার দেখতে পেয়ে উত্তেজিত হয়ে উঠে বসে। কল রিসিভ করে কাঁপা কাঁপা গলায় সালাম দিলে অপর পাশ থেকে সালামের জবাব শুনে প্রাণটা জুড়িয়ে যায় নজরাত এর। ভাঙা গলায় কেঁদে ওঠে বলে,
–” ভাইয়া তুমি ঠিক আছো তো? এতো সময় লাগল কেন? কল করতে।
রূপক বোন কে আস্বস্ত করে বলল,
–” আমি ঠিক আছি বোনু। একটু ঝামেলা হয়েছিল তাই আর কি।
এর মধ্যে রাহা অস্থির হয়ে নজরাত এর থেকে ফোন নিয়ে গেল। কেঁদে কেটে ভাসিয়ে জিজ্ঞাসা করলো কি হয়েছে তার? কল করতে এতো দেরি হল কেন?
রূপক নানা কথাবার্তা বলে ব্যাপারটা এরিয়ে গেল। মূলত তার একটা ছোট খাটো এক্সিডেন্ট হয়েছে। ইতালিতে পৌঁছে বাসায় ফেরার পথে ঘটে এই অঘটন। মাথায় চোট পেয়ে র’ক্তক্ষরণ হয়। হসপিটালে ভর্তি করানোর পর চিকিৎসারত থাকে এ কয়দিন। তাই যোগাযোগ করতে পারেনি। সবাই এমনিতেই দুশ্চিন্তা করছে তাই আসল ঘটনা আর জানালো না রূপক।
অনেক কিছু বুঝিয়ে রাহা কে যখন শান্ত করে রূপক তখন রাহা নজরাত এর প্রেগন্যান্সির খবর জানায়। রূপক শুনে খুশি হয়ে আলহামদুলিল্লাহ বলে। তার কোরআনের একটা আয়াতের কথা স্মরণ হয়।
“অবশ্যই আমি তোমাদের পরীক্ষা করবো কিছুটা ভয়, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি ও ফল-ফসল বিনষ্টের মাধ্যমে। তবে সুসংবাদ দাও ধৈর্যশীলদের”। [১]
আরো একটি সুন্দর আয়াত আছে,
আল্লাহ বলেন, হে ঈমানদারগণ,তোমরা ধৈর্য্য ও নামাজের মাধ্যমে সাহায্য প্রার্থনা করো।নিশ্চয়ই আল্লাহ ধৈর্যশীলদের সংঙ্গে আছেন। [২]
রাহা কে বললে রাহা বলে,
–” তুমি ঠিক বলেছো গো। আল্লাহ সুবহানাহু তা’আলা চাইলে সব কিছু সম্ভব। তিনি চাইলে মুহূর্তেই সব কিছু বদলে দিতে পারেন। আলহামদুলিল্লাহ।
________
রূপক এর সাথে কথা বলা শেষ করে রাহা কল করে ইমিডিয়েটলি রাদ কে বাড়ি আসতে বলে। নজরাত অসুস্থ শুনে রাদ অস্থির হয়ে পড়ে। বলে, ডাক্তার সাথে নিয়ে আসবে কিনা? অ্যাম্বুলেন্স কল করবে কিনা? রাহা কেন বসে আছে সে কেন ডাক্তার কে কল করেছে না?
রাহা জানায় ডাক্তার দেখে গেছেন। তখন রাদ একটু স্বস্থির নিঃশ্বাস ফেলে। দ্রুত বাসায় ফিরে যখন নজরাত কে শুয়ে থাকতে দেখে তখন কাছে এসে নজরাত এর মলিন মুখ দেখতে পায়। তারপর একটু খেয়াল করে দেখে কপালে কিঞ্চিৎ কাটা স্থান। সেখানে আলতো হাতে স্পর্শ করতে নজরাত চোখ মেলে তাকায়। রাদ কে দেখতে পেয়ে জিজ্ঞাসু চোখে তাকিয়ে বলে,
–” তুমি! কখন এসেছ? আজকে এতো তাড়াতাড়ি চলে এলে যে? অন্যদিন তো কতো রাত হয়ে যায়।
–” তুমি অসুস্থ হয়ে পড়েছ শুনেই তো কাজ রেখে চলে এসেছি। কি হয়েছে তোমার? ডাক্তার কি বলল?
নজরাত ক্লান্ত কন্ঠে বলল,
–” নিশ্চই রাহা জানিয়েছে? মেয়েটা না কি বলবো? তোমাকে কেন বলতে গেল?
–” তুমি অসুস্থ এটা বলবে না? যাই হোক রূপক এর খবর পাওয়া গিয়েছে?
–” হুম। আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া ভালো আছে।
পিছন থেকে আকস্মিক রাহা এসে বলল,
–” ভাইয়া আমার কিন্তু বড়সর একটা ট্রিট চাই! তাড়াতাড়ি বলো দিবে কিনা?
রাদ বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে বলল,
–” কিসের মধ্যে কি বলছিস বল তো?
রাহা বালিকার মতো সরল অকপটে গলায় বলল,
–” কিসের মধ্যে কি আবার? আমি ফুফি হচ্ছি! তুমি বাবা হচ্ছ! মা দাদু হচ্ছে! ভাবীমণি মা হচ্ছে! শ্বশুর বাবা নানা ভাই হচ্ছে! মণি আপা ও ফুফি হচ্ছে! সেখানে তুমি ট্রিট দিবে না আমাদের?
একদমে সব বলে থামে রাহা। এদিকে সব কিছু যেন মাথার উপর দিয়ে গেল রাদ এর। ভাবুক ভঙ্গিতে বলল,
–” মানে কি?
রাহা বলে,
–” আমি কি বলেছি সবটা ভেবে দেখ তবে বুঝতে পারবে।
সবটা ভেবে রাদ শাহমাত লাফিয়ে উঠে। নজরাত কে ঝাপটে ধরে বিকারগ্রস্তের মতো এলোমেলো হয়ে কি বলবে ভেবে পায় না….
_________
রেফারেন্স:-
[১]সূরা বাক্বারাঃ১৫৫
[২] সূরা বাক্বারাঃ১৫৩
___________
#চলবে… ইনশা আল্লাহ।
#তোমার_নিরব_অভিমানীনি(২৭)
#Israt_Bintey_Ishaque(লেখিকা)
(কার্টেসি ছাড়া কপি নিষিদ্ধ)
“বউকে পরে আদর করবে আগে আমার ট্রিট দাও”?
রাহার এহেন কথায় রাদ নজরাত কে ছেড়ে বসা থেকে উঠে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিয়ে বলল,
–” তবে রে!
রাহা দৌড়ে পালায়। ভাই বোনের এই খুনসুটি দেখে নজরাতের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠে। রাদ হেসে তার দিকে ঘুরে বসে, নজরাত এর উজ্জ্বল হাসিমাখা মুখশ্রী দেখে মনটা প্রশান্তিতে ভরে গেল। গাল দুটো আঁকড়ে ধরে বলল,
–” তুমি এতোটা কঠোর মনের কিভাবে হলে বলো তো? এমন একটা খবর জেনেও চেপে রেখে দিয়েছিলে? তোমার মন উসখুস করেনি যে খবরটা সবাইকে জানাই অন্তত আমাকে জানাতে পারতে?
নজরাত দৃষ্টি নত করে ধরা গলায় বলল,
–” ভাইয়ার জন্য দুশ্চিন্তা হচ্ছিল তখন। তাই তখন খুশি হতে পারিনি আমি।
রাদ তার বাম হাতখানা নজরাত এর গলার দিকটায় ধরে বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে গাল ছুঁয়ে, তীব্র স্থির চোখে তার দিকে চেয়ে থেকে বলল,
–” এ ছাড়াও তোমার হৃদয় নরম হলেও শরীরটা বড্ড শক্ত হাতুড়ে গড়া!
নজরাত এবার রাদ এর চোখে চোখ রেখে বলল,
–” যদি সবটাই নরম হতাম তাহলে বিভিন্ন ব্যভিচারে লিপ্ত হয়ে যেতাম! ছেলেদের বিভিন্ন কু-মন্ত্রনায় জড়িয়ে যেতাম। আপনি জানেন? আমাকে সামনাসামনি দেখতে না পেয়ে বিভিন্ন কৌশলে চেয়েছে আমার ছবি যেন অন্তত দেখতে পারে! যখন সে পথেও দেখতে পায়নি তখন তারা আমাকে উপাধি দিয়েছে, অহং’কারী, দাম্ভিক, শক্ত মন, কাঠের তৈরি হৃদয় ইত্যাদি ইত্যাদি… এছাড়াও যাদের প্রেমের প্রস্তাব প্রত্যাখান করেছি তারা উঠে পড়ে লেগেছিল আমার বিয়ের ঘর ভাঙ্গার জন্য! আপনার মা বিয়ের প্রস্তাব দেওয়ার পূর্বে তিনটি বিয়ের ঘর ভাঙ্গিয়েছে! আমার নামে কুটনা রটিয়ে।
রাদ সকৌতুকে মুখচোখে বিহ্বল ভাব ফুটিয়ে তোলে বলল,
–” নিশ্চই তারা তোমাকে অনেক লাভ করতো! তুমি বুঝলে না তাদের..
নজরাত রাদ কে চুপ করিয়ে গম্ভীর মুখশ্রী করে বলল,
–” আমি অত বোকা নই যে বুঝতে পারবো না। আপনার কি মনে হয়? একটা মেয়েকে না দেখে তার জন্য পাগল হবে! তাও আবার আজকালকার যুগের ছেলেরা? মোটেও না। তারা আমার বাবার টাকা পয়সার লোভে এরকম করেছে!
রাদ অত্যন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে বলল,
–” খারাপের মাঝেও কিছু ছেলে আছে যারা প্রকৃতপক্ষেই ভালোবাসতে জানে। কয়েকটি কীটের জন্য সবাইকে একই খেতাব দিতে পারো না তুমি।
রাদ এর কথায় বিদ্রুপ হাসে নজরাত। সে ক্লান্ত, তবু শান্ত স্বরেই বলল,
–” ভালো ছেলেরা কখনো স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোন নারীর প্রতি আকৃষ্ট হয় না। অন্য নারীদের দেখলে ভালো ছেলেদের দৃষ্টি নত করে ফেলে। ভালো ছেলেরা কখনো স্ত্রী ব্যতিত অন্য কোন নারীর পিছনে সময় নষ্ট, টাকা নষ্ট করে না।
নজরাত এর কথায় রাদ দমে গেল! বারবার উশখুশ করে উঠছে একটা অস্বস্তি। মুখখানা চিন্তিত।
নজরাত খেয়াল করে রাদ এর বক্ষপটে মাথা রেখে ধীর স্বরে বলল,
–” আমি তোমাকে কোন ভাবেই ছোট করতে এ কথা গুলো বলছি না। বলছি এ কারণে যে, আল্লাহ চায়েতো ভবিষ্যতে তুমি বাবা হবে, মামা হবে, দাদা হবে আরো কত কিছু। তখন যেন নতুন প্রজন্মকে ইসলামের এই দিক গুলো শিখাতে পারো সে কারণে বলছি।
–” আচ্ছা হারাম রিলেশনশিপে থাকা অবস্থায় সালাত সহ সব ধরণের ইবাদত এবং দোয়া কবুল হবে কি?
–”
ইসলামের দৃষ্টিতে বিবাহ বহির্ভূত তথাকথিত রিলেশনশিপ বা প্রেমের সম্পর্ক সম্পূর্ণ হারাম।
একে অপরের সাথে কামনা-বাসনা সহকারে কথাবার্তা, নির্জনে দেখা-সাক্ষাত, ডেটিং, চ্যাটিং, স্পর্শ, হাসাহাসি, দুষ্টামি সবই নিষিদ্ধ।
এই রিলেশনশিপ মূলত শয়তানের ফাঁদ। এই ফাঁদে পড়ে নারী-পুরুষ উভয়ে জিনার দিকে ধাবিত হয়-যার পরিনতি খুবই ভয়াবহ।
তাই তো মহান আল্লাহ আমাদেরকে জিনার নিকটবর্তী হতে নিষেধ করেছেন।
আল্লাহ তা’আলা বলেন,
“আর জিনার কাছেও যেয়ো না। নিশ্চয় এটা অশ্লীল কাজ এবং মন্দ পথ। [১]
তবে দয়াময় আল্লাহ বৈধ উপায়ে বিয়ের মাধ্যমে নিজেদের ভালবাসা প্রকাশ ও জৈবিক চাহিদা মেটানোর সুযোগ দিয়েছেন।
সুতরাং মানুষের কর্তব্য, বিয়ের পূর্বে হারাম সম্পর্কের দিকে পা না বাড়িয়ে আল্লাহর বিধান অনুযায়ী বিয়ে করা।
তবে হারাম রিলেশন (অবৈধ প্রেম) গুনাহের কারণ হলেও তা শিরক, কুফরি বা মুরতাদ হওয়া মত গুনাহ নয় যে, এ কারণে তার সকল আমল বরবাদ হয়ে যাবে বা তার আমল কবুল হবে না।
বরং এ অবস্থায়ও তার সালাত, সিয়াম, দান-সদকা, দুআ, কুরআন তিলাওয়াত ও অন্যান্য নেকির কাজি বরবাদ হয়ে যাবে না।
বরং এগুলো সে যদি খালিস নিয়তে যথানিয়মে সম্পাদন করে তাহলে মহান আল্লাহ তা কবুল করবেন বলে আশা করা যায়।
কিন্তু হারাম রিলেশনের কারণে গুনাহগার হবে।
এ ক্ষেত্রে করণীয় হল, অনতিবিলম্বে তওবা করে এ পথ থেকে ফিরে আসা।
আল্লাহ আমাদেরকে সর্বপ্রকার পাপাচার থেকে তওবায়ে নাসূহা করার নির্দেশ দিয়ে বলেন,
“হে মুমিনগণ, তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে তওবায়ে নাসূহা তথা আন্তরিক তওবা করো।
আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। [২]
তওবায়ে নাসূহা অর্থঃ
খাঁটি ও নির্ভেজাল তওবা, একনিষ্ঠতা ও আন্তরিকতাপূর্ণ তওবা।
অর্থাৎ এমন আন্তরিকতা ও দৃঢ় প্রত্যয় সহকারে তওবা করা যে, তওবা কারী আর কখনো জেনে-বুঝে উক্ত গুনাহে লিপ্ত হবে না।
মহান আল্লাহ আমাদেরকে সব ধরণের হারাম সম্পর্ক থেকে রক্ষা করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।
হারাম রিলেশন এবং ইবাদত কবুল হবে কিনা এ সম্পর্কে উত্তর দিয়েছেন,
আব্দুল্লাহিল হাদী বিন আব্দুল জলীল।
_______
রাহা দরজায় নক করে বলল,
–” ভিতরে আসতে পারি?
তার কথা শুনে নজরাত আর রাদ একটু দূরত্ব নিয়ে বসে। তারপর তাকে ভিতরে আসতে বলে।
রাহা ট্রেতে করে বিভিন্ন রকম ফল কেটে নিয়ে এসেছে। নজরাত এর কাছাকাছি নিয়ে গিয়ে বলল,
–” এখন থেকে খাবারের অনিয়ম একদম চলবে না। ভাইয়া জানো তোমার বউ কি কান্ড ঘটিয়েছে? আমি তো সবটা বলিনি তোমাকে!
রাদ ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞাসা করে, কি ঘটিয়েছে?
রাহা বলতে নিলে নজরাত মুখ ফ্যাকাসে করে বলল,
–” প্লিজ বলো না ভাবীমণি।
রাদ সন্দিহান দৃষ্টিতে চেয়ে বলে,
–” বলবে না কেন? রাহা কি হয়েছে বল তো?
রাহা চোখে ইশারা করে বলল,
–” দেখ না কপালের অবস্থা? খাওয়া দাওয়া ঠিক মত করেনি বলে মাথা ঘুরিয়ে পড়ে গিয়েছিল গার্ডেনে! আমরা ঘরে থেকে কিভাবে জানবো বলো? তারপর ধনু কাকা এসে আমাদের খবর দিলেন যে, এমন বিপদ ঘটেছে।
সবকিছু শুনে রাদ খুব রে’গে গেল। গম্ভীর মুখভঙ্গি করে বলল,
–” সত্যি বলবে?
নজরাত জিজ্ঞাসু চোখে তাকালে রাদ অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে বলে,
–” প্রেগন্যান্সির খবরে তুমি কি খুশি নও?
রাদ এর কথায় নজরাত বরফের মতো ঠান্ডা হয়ে গেল। সে মা হতে চলেছে। এর থেকে খুশির সংবাদ দ্বিতীয়টি আছে নাকি? চোখের কোল ভারী হয়ে এল কান্না রোধ করতে না পেরে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ল। এর মধ্যে রাদ আবার বলল,
–” এতোটা ইরেসপনসিবিলিটি কিভাবে হলে তুমি? মানছি রূপক এর খবর পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই বলে তুমি না খেয়ে থাকলে তার খবর চলে আসবে?
রাহা ভাইকে শান্ত করতে বলল,
–” ভাইয়া শান্ত হও। ভাবীমণি এমনিতেই অসুস্থ, আর বকা দিও না প্লিজ।
রাদ উঠে চলে যায়। যাওয়ার আগে বলে যায় সব গুলো ফল যেন নজরাত খায়। একটাও যদি অবশিষ্ট থাকে তবে তার খবর আছে!
রাদ চলে গেলে রাহা বসে নজরাত এর চোখের পানি মুছে দিয়ে ফল গুলো খেয়ে নিতে বলে। তখন নজরাত হেঁচকি তুলতে তুলতে বলে,
–” খাবো না আমি। আমার সন্তানের আগমনের সংবাদে আমি অখুশি! উনি এভাবে আমাকে বলতে পারলেন?
–” আসলে ভাইয়া মন থেকে কিছু বলেনি ভাবীমণি। তোমার শরীরের কন্ডিশনের কথা ভেবেই বলেছে। খেয়ে নাও প্লিজ প্লিজ প্লিজ?
_______
মাস খানেক পর,
রাহা শ্বশুরবাড়ি চলে গেলে নজরাত খাবার থেকে শুরু করে সবকিছুর দায়িত্ব নেয় রাদ। সে যখন অফিসে থাকে তখনো কল করে করে নজরাত কে খাবারের কথা মেডিসিন নেওয়ার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। তাছাড়া সাজেদা চৌধুরী এবং মণি ও খুব খেয়াল রাখে নজরাতের।
সবকিছুর ফাঁকে ফাঁকে নজরাত ডায়েরী নিয়ে বসে লেখালেখি করতে। তার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে আর বেশি সময় বাকি নেই ইনশা আল্লাহ। কিছুদিন পর ই কিছু একটা হতে চলেছে!….
_________
রেফারেন্সঃ
[১]সূরা ইসরা: ৩২
[২]সূরা তাহরীম: ০৮
_______
#চলবে…. ইনশা আল্লাহ।