তোমার বুকেও আকাশ জমুক পর্ব-০১

0
6

তোমার বুকেও আকাশ জমুক – ১
আফসানা আশা

ঘটনাটা ঘটল মাগরিবের ওয়াক্তে। এই সময়ে নাকি পৃথিবী ধ্বংস হবে, ইস্রাফীল (আ) সিঙায় ফুঁ দেবেন। আমার মনে হলো, সেই ঘটনাটা ঘটে গেছে। মহাপ্রলয় অতি আসন্ন।
ঢাকা শহরে আমার আর নাজনীনের একটা সংসার আছে। সুন্দর, সাজানো ছবির মতো মনোহর সেই সংসার।
নাজনীন ভার্সিটিতে যায়। ওর বাসা আমার মেসের খুব কাছেই। ও ডিমের তরকারি আর ডাল রান্না করে। একটা টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে আমার মেসবাড়ির নিচে এসে দাঁড়ায়। কল দিয়ে বলে,
–আসবা? আসো তাড়াতাড়ি। গরমে হাসফাস লাগে।
আমি লাফিয়ে নামি। কীসের গরম? ছিপছিপে গড়নের মেয়েটাকে জল টুপটুপ স্নিগ্ধ ফুলের মতো দেখায়! যেদিন নীল সালোয়ার কামিজ পরে, আমি ডাকি অপরাজিতা ফুল! কুসুমদলের মতো নাজুক ওর দীর্ঘ আখিঁপল্লব। লাজুক চোখ ভারী হয়ে আসে, ইষৎ তাকিয়ে বলে,
–তরকারিতে মনে হয় লবণ বেশি হয়ে গেছে। একটু ডাল নিয়ে মিশিয়ে খেও, হ্যাঁ?
খেতে বসে আমি হাসি। ডালেও লবণ চড়া হয়েছে। চড়া লবণের ডাল -তরকারি দিয়ে ভাত খেয়ে তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলি।
নাজনীন মাছ খায় না। মুরগি কুটতে পারে না। আমি মুরগি কেটে ধুয়ে মশলায় মাখামাখো ঝোল রাঁধি। ফোন দিয়ে বলি,
–নাজ, আঙুল চাটবা খেলে!
নাজনীন কিছু বলে না, হাসে।
ঘুরে ঘুরে বড়ো বারান্দাঅলা বাসা খুঁজি আমরা! ঘরময় বিছানোর জন্য নরম কার্পেটের দোকানে হাঁটি।
ফেসবুকের পাতায় ছোটো ছোটো সাদা কাপের পোস্ট শেয়ার করে আমাকে। আমাদের দুজনের সংসারটা যখন কাছাকাছি এক ছাদের নিচে আসবে তখন কিনব ওই কাপ-পিরিচের সেটটা। নীল রঙের পর্দা থাকবে, পাতাবাহারের ঝোঁপ, দগোলাপ গাছে দুটো কলি। বারান্দায় দুটো লাভবার্ডস কিচিরমিচির করবে।
মিহি সুতোয় ছোটো ছোটো স্বপ্নের ফুল বুনি।
মা গিয়েছিল পাশের বাড়িতে। আজান পড়তেই হন্তদন্ত হয়ে ফিরেছে। অজু করতে যেতে যেতে বলল,
–নাজুকে নাকি দেখতে আসছিল আজকে? কথা ফাইনাল হয়ে গেছে। আসছে শুক্রবার দিন পড়ছে!
আমি হা হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। বুকের কপাটে ঝটকা লাগল ধড়াস করে, টের পেলাম!
বাড়িতে আসলে নাজনীনের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয় না। খুব গোপনে রাত নয়টা, দশটার দিকে একবার ফোন করে ও। ফিসফিস করে বলে,
–তুমি কি আজকেই ঢাকায় চলে যাবা?
–যাব না? পরের চাকরি করে খেতে হয়। আর তোমার আব্বা তো বলেই দিলো সরকারি চাকরি না হলে তোমাকে আমার কাছে দেবে না। সরকারি চাকরির জন্য পড়তে হবে না? কোচিংয়ে কথা বলেছি।
নাজনীন ফোঁস করে নাক টানে,
–রাগ করছ? করো না। আব্বা তো, বোঝো না?
–বুঝি। কিন্তু তোমাকে না দেখে থাকতে পারছি না আর।
–আমার ক্লাস শুরু জানুয়ারির এগারো তারিখ। তুমি আট নয় তারিখে এসে গেলে একসাথে ফিরব।
টুকটাক মেসেজ দিতে পারে ও। কথা হয় না। হলেও খুব কম। ফোন দেওয়া বারণ। পারলে ওই কল দেয়। সেই সুযোগ হয় খুব কম। এদিকে আমার দিন চলে না। রাত স্থবির হয়ে থাকে। অস্থির হয়ে ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে অফিসে ছুটির দরখাস্ত ফেলে দিয়ে ছুটে আসি গ্রামে। ফোন দিয়ে বলি,
–একবার দেখা হবে না? আসি একটু? সন্ধ্যাবেলা? তুমি জানালার পাশে এসে দাঁড়াও!
নাজনীন ভয় পায়,
–কে না কে দেখে ফেলবে! আম্মা বলছে, আমি কিছু করলে আব্বা স্ট্রোক করে মরে যাবে!
আমি দীর্ঘশ্বাস গোপন করি। নাজনীন কেঁদে ফেলে। ওর জড়ানো গলা শুনে বলি,
–একটু ভিডিও কলে আসো। তোমাকে দেখি। কতদিন দেখি না!
নাজনীন ফুঁপিয়ে ওঠে।
আমি মানসচক্ষে দেখি, স্ফটিকস্বচ্ছ্ব জলে ওর লালকপোল ভেসে যাচ্ছে! সেই জলে বুদবুদ ওঠে। ও খাবি খেতে খেতে বলে,
–আব্বা আম্মাকে হুমকি দিয়েছে, আমি বংশের মান ডোবালে সে আম্মাকে তালাক দিয়ে দেবে!
–আমি কি কথা বলব তোমার আব্বার সাথে?
নাজনীন ভয় পায়। ফ্যাসফেসে হতে থাকে কিন্নর গলার সুর। ধরা গলায় আতঙ্ক টের পাই,
–না, না। আগে বলছ না? লাভ হয়েছে কোনো?
–কী করব বলো? নিরুপায় লাগে নিজেকে!
–ঢাকায় তো যাচ্ছিই। কয়েকটা দিন একটু ধৈর্য ধরো।
কালকেই না নাজনীন বলল ধৈর্য রাখতে? আজই কাল কেয়ামত নেমে এলো কীভাবে?
মা কলতলা থেকে অজু করে ঘরে ফিরে এসেছে। আঁচলে মুখ মুছে, ভেজা হাতটা আমার মাথায় রেখে জানতে চাইল,
–তুই জানতি না? তোরে বলে নাই?
আমার দরিদ্র মায়ের চোখ ছলছল করে ওঠে,
–আগেই সাবধান করেছিলাম, ওরা কত ধনী! তালুকদারেরা আগে জমিদার ছিল!
মায়ের নাকের পাটা ফুলে ওঠে। কান্নায় বুক ফোলে। ছিঁচকাঁদুনে ধরনের মা-টা কেঁদে ওঠে,
–কী আদরটা করেছিলাম ওরে! কীভাবে তোর বুকে ছুরি দিলো? আমি নামাজে বসতেছি। আল্লাহরে বলব সব। তুই কান্দিস না আমার বাপধন!
মায়ের বাপধন কাঁদে না, পাথর হয়ে থাকে!
আমার বিশ্বাস হয় না এসব। নাজনীন বলে নাই কিছু। কালকেও বাসে আসতে আসতে সারা রাত জেগে ওকে মেসেজ দিয়েছি। ও বলে, শক্ত হও। পাগলামি কোরো না।
আমার পাগল মন কথা শোনে না। বিক্ষুব্ধ জোয়ার জলকে কি বাধ দিয়ে ঠেকিয়ে দেওয়া যায়? যায় না।রুদ্ধ বুক ভাসিয়ে ভিসুভিয়াসের হুতাশন জেগে উঠতে চাইছে, তারে রুধে দিই সাধ্য নেই আমার।
ছুটে বেরিয়ে এলাম। রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াচ্ছি। নাজনীনের ফোনে কল ঢুকছে না। দুই গ্রাম পার হলে ওদের বাড়ি। কিন্তু সেখানে যাওয়া বারণ। বন্ধুদের সবার ফোন দিয়ে কল দিলাম। ধরল না।
রুপার শরণ নিলাম। ও আশ্বাস দিতে পারল না কোনো। মিনমিন করে দাঁতে নখ খুঁটতে খুঁটতে বলল,
–আবিদ ভাই, এক গ্লাস পানি খাও!
–আমার কিছু লাগবে না। তুমি শুধু নাজনীনের কাছে যাও। আমার অবস্থা তুমি দেখতে পাচ্ছ। কিন্তু নাজনীনের বুক ফেটে গেলেও মুখ ফুটবে না। ওর কী হচ্ছে সে শুধু আমি টের পাচ্ছি। ওকে গিয়ে সাহস দাও। বলো, আমি আছি। আমি থাকব। আমি আজকেই ওকে নিয়ে যেতে পারব। ঢাকায় বাসা নেব। আমি অক্ষম না। ও যেন ভেঙে না পড়ে। শক্ত থাকে। আমার ক্ষতি করবে বলে কেউ যেন ওকে ভয় দেখিয়ে দুর্বল করতে না পারে!
–এরকম বলেছে নাকি? মারবে তোমাকে?
–আর কী? নইলে আর কী দিয়ে ওকে বিয়েতে রাজি করাতে পারবে? আমার সাথে একটু কথা বলিয়ে দাও ওরে!
–বড়োচাচাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক ভালো না, জানো তো! ওই বাড়ি যাওয়া আব্বার বারণ।
রুপার জড়ভরত অবস্থা কাটে না। আমি পায়ে পড়ি প্রায়! সম্পর্কে আমি ওর খালাতো ভাই হই। আমার আর্জি ফেলতে পারে না শেষ পর্যন্ত!
খানিক বাদে নাজনীনদের বাড়ি থেকে রুপা কল দিলো,
–আবিদ ভাই, একটু ঝামেলা হয়েছে!
আমার গলা শুকিয়ে আসে। কাঁপতে কাঁপতে বলি,
–কী হয়েছে?
–ও তো বলছে তোমাকে চেনে না! দুয়েকবার দেখেছে। আর কোনো সম্পর্ক নেই।
–ও কে?
–নাজনীন!
রুপা চলে আসে। আমি ওকে বুঝাই,
–তুমি ওর আব্বা, আম্মার সামনে কেন বললা? ভয় পেয়ে গেছে বেচারি!
রুপার থমথমে মুখ অন্ধকারে আরো গম্ভীর দেখায়। সেরকমই অন্ধকার গলায় বলল,
–নাজু একাই ছিল, আবিদ ভাই! বড়োচাচা-বড়োমা কেউ আশেপাশে ছিল না। ওর রুমের দরজা লাগিয়ে দিয়েছিলাম!
আমার বিশ্বাস হয় না রুপাকে! সারা দুনিয়া ষড়যন্ত্রে মেতেছে! আমাকে না মেরে এরা কেউ থামবে না!
মা কল দিয়েই যাচ্ছে। ফোন কেটে দিলাম। আমি কী করব বুঝতে পারছি না। অজান্তেই হেঁটে হেঁটে নাজনীনদের বাড়ির পেছনে চলে এলাম। আমার নম্বর এখন ওর ফোনের ব্লকলিস্টে। মেসেঞ্জার, হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো যা যা জানি কোনোটা দিয়ে ওর কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। আগেও তো কতবার এখানে এসে দাঁড়িয়েছি আমি। ও চুপিচুপি বারান্দায় এসে দাঁড়াত! এক পলকের ক্ষণিক দেখা মিলত!
আজকে একবারটি কি জানালাটা খুলবে না ও?
সারারাত কেটে গেল ধূলায় বসে।
সকালে ওর আব্বা আমাকে বাড়িতে ডাকলেন…

চলবে?