তোমার বুকেও আকাশ জমুক পর্ব-০৩

0
8

তোমার বুকেও আকাশ জমুক – ৩
আমার হতভম্ব লাগছে। এই ঘটনাটা ঘটবে গতকাল কেউ বললে আমি তাকে নিশ্চিত পাগল ঠাউরাতাম!
কিছুক্ষণ আগে কবুল বলে এসেছি, আমি এখন বিবাহিত এই কথাটা বিশ্বাস হতো না যদি না নববধূ বেশে রুপা মুখোমুখি বসে থাকত!
রুপা আমার সামনে বসে পা দোলাচ্ছে! ওর মাথায় ছোটো একটা ঘোমটা! বয়সে ছোটো, খালাতো বোন হয়। ছোটো বোন ছাড়া অন্যকিছু কখনো ভাবিনি ওকে। এই বাড়িতেই নাজনীনের সাথে আমার পরিচয়, মাধ্যম ছিল এই রুপাই! আমার খুব বিব্রতকর লাগল পুরো ব্যাপারটা।
সংকোচ ঠেলে বললাম,
–তুমি বিয়েতে রাজি হলে কেন?
রুপা ঠোঁট উল্টাল,
–আব্বু, আম্মু বলল, তাই!
আমার ভীষণ রাগ হলো,
–ন্যাকা খুকী তুমি? খালা, খালু মরতে বললে তুমি মরে যাবে?
–শুধু আব্বু, আম্মু না, যে কেউ আমাকে একটু সুন্দর করে যদি বলে, রুপা, মরে যাও! আমি হাসতে হাসতে বিষ খেয়ে ফেলব! আমি কারোর অনুরোধ ফেলতে পারি না!
বলতে বলতে ওর চেহারা বদলে গেল, কঠিন করে বলল,
–কিন্তু তোমার মনে হয় না, আমি কেন বিয়ে করলাম সেটা না হয়ে প্রশ্নটা হওয়া উচিত তুমি কেন বিয়েটা করলে?
–আমি জানি না, রুপা! আমার বিশ্বাস হচ্ছে না! তবে আমাদের পরিস্থিতি ওরকম ছিল। মায়ের সাথে কী হয়েছে, কী জঘন্য আচরণ করেছে ওরা, তুমি তো দেখোনি, কল্পনাও করতে পারবে না। আমি দেখেছি। মাকে না বলা সম্ভবই ছিল না আমার পক্ষে। আর আমি তখন সেন্সেও ছিলাম না! কিন্তু তোমার কাছে সুযোগ ছিল না করার!
–তুমি এত সেন্স হারাও কেন ঘন ঘন? আর আমি না করব কেন?
আমি চোখ কপালে তুললাম,
–তুমি জানো, আমি নাজকে কতটা ভালোবাসি। সব জেনেশুনে…
রুপা খানিকক্ষণ হাসলো। হাসি থামিয়ে বলল,
–তোমার জন্য খুব মায়া লাগছিল!
–মায়া?
এই মায়ার স্বরূপ বুঝি না আমি।
নাজনীনও বলত, খুব মায়া লাগে!
কী করে পারল ও? ওর একবারও আমার জন্য কষ্ট হলো না? আমার জন্য কত চিন্তা ছিল ওর। আমি না খাওয়া পর্যন্ত খেত না! অনেক সময় কাজের ব্যস্ততায় ঠিক সময়ে লাঞ্চ করা হতো না। মিথ্যে বানিয়ে মেসেজ করে দিতাম, খেয়েছি লিখে। তারপর ও খাবার খেত। এখন সব ভুলে গেল? আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে ও কী করে সেটা উপলব্ধি করতে পারছে না?
তবে অতটাও কষ্ট হচ্ছে না, যতটা হবে ভেবেছিলাম। আমি পরিস্থিতির সংকটে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় আছি।
রাতের বাস ধরা যাবে এখনো। আমি ঢাকায় ফিরতে চাইলাম। মা স্পষ্ট আদেশ করল,
–বউ নিয়ে যাও?
–ওকে এত রাতে কোথায় নেবো? আমি থাকি মেসে।
–সে আমি জানি না। তোমার বউ নিয়ে তুমি গাছতলায় থাকলেও আমার আপত্তি নেই। তবে ও আমার বোনঝিও হয়, তুমি ওকে নিরাপদে রাখবা সেটা সেই সম্পর্কে আমার দাবী!
মায়ের জন্যও একটা ভয়াবহ দিন গেছে। আমি যথাসম্ভব সব ভুলে থাকতে চাইছি। বাকযুদ্ধ না করে মেনে নিলাম।
খুব ভোরে ঢাকায় ফিরলাম। জার্নিতে ক্লান্তশ্রান্ত রুপাকে নিয়ে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। বাসা খুঁজে, মেস থেকে শিফট হতে ন্যুনতম একটা সময় দরকার। আক্ষরিক অর্থেই আমি গাছতলায় এনে ফেলেছি ওকে। ও নিজেও নার্ভাস হয়ে আছে। বাসে খুব একটা কথা বলেনি। ঢাকায় আমার পরিচিত কেউ নেই যে কয়েকটা দিন রুপাকে রাখব সেখানে। রুপার ফ্রেশ হওয়া দরকার। একটা হোটেলের কামরা নিয়ে নিলাম। থ্রি স্টার মানের হোটেল। ইন্টেরিয়র সুন্দর। চমৎকার অভ্যর্থনা। রুপা মেয়েটা ছোটোবেলা থেকেই দুষ্ট প্রকৃতির। এতক্ষণ চুপচাপ ছিল। এখন আমার হাত ধরে ফিঁচেল ধরনের হাসি দিয়ে বলল,
–মনে হচ্ছে হানিমুনে এসেছি!
পরিবেশটা এত দারুণ যে কীভাবে কীভাবে যেন খুব সহজে আমরা খুব কাছাকাছি এসে গেলাম। আমাদের মধ্যে দাম্পত্য সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল।
পরেরদিন রুপাকে একটা ছাত্রী হোস্টেলে তুলে আমি বাসা খুঁজতে শুরু করলাম। ভেতরে ভেতরে খুব গরজ অনুভব করলাম। রুপাকে কাছে আনবার তাড়া!
সকালে উঠে অফিস যাই। লাঞ্চের আগে ছুটি নিয়ে বের হই। রুপাকে হোস্টেল থেকে নিয়ে মার্কেটে ছুটি। না হলে নয়, আসবাব কিনি। পর্দার কাপড় কিনি, ঘটিবাটি কিনি।
কয়েকদিন গেল বাসা গুছিয়ে নিতে।
রুপা অভ্যস্ত বউয়ের মতো ঝগড়া করে। ওর পছন্দের নীল পর্দা কিনিনি বলে গাল ফুলায়। চায়ের কাপগুলো ক্ষ্যাত লাগে ওর কাছে।
আমি কী করে বলি ওকে, নীল পর্দার সংসারটা নাজনীনের ছিল!
সাদা পর্দা সরালে রুপার জানালা!
রুপা ফোনে ঘুটমুট করে। মায়ের সাথে ওর কী কথা হয় আমি জানি না। খালা ফোন করে আমাকে। ভালো আছি কিনা, কী করছি ছাড়া বিশেষ কিছু বলে না। একটা বিরাট কোনো পরিবর্তন ঘটে গেছে সেটা সবাই সচেতনভাবে এড়িয়ে চলি।
খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে পড়ে রুপা। ঘুমঘুম চোখে দ্রুতহাতে নাস্তা সাজায়। আমি অন্য চুলায় চায়ের পানি ফুটতে দিই। দুইজনে দুই কাপ চা নিয়ে মুখোমুখি বসি। রুপাকে আমার নাজনীন মনে হয়। এই মুহূর্তটাকে কতবার কতরকম করে কল্পনায় ধরেছিলাম দুজনে! নাজনীনের সবকিছু রুপার হয়ে গেল? আমার কেমন জানি বিদ্বেষ তৈরি হয়। রুপাকে অসহ্য লাগে! চোখের সামনে ওকে দেখতে ইচ্ছে করে না।
না খেয়েই অফিসের জন্য বেরিয়ে পড়ি। রুপা পেছন পেছন দরজা পর্যন্ত আসে। আমি কোনো কথা বলি না। রিকশায় উঠতে উঠতে একবার পিছু ফিরে তাকাই। রুপা তাকিয়ে আছে বারান্দা থেকে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাতের নখ খুঁটছে।
আমার মন খারাপ করে আবার। রুপার জন্য মায়া লাগে। ওর তো দোষ নেই!
একদিন নাজনীন আসে অফিসে। ওকে দেখে চমকে উঠি। চোখমুখ শুকিয়ে আছে। চেহারা বিবর্ণ। উজ্জ্বল ত্বকের পেলবতা কমে রুক্ষ আর শুকনো হয়ে আছে, যেন কত দিনের অযত্ন! অল্প হেসে কৈফিয়ত দেয়,
–ফোন ধরছিলে না, তাই এলাম!
আমার লুকিয়ে রাখা অভিমান ফেনিল হয়,
–কে আসতে বলেছে?
নাজনীনের চোখ লাল। কান্না চাপতে চেষ্টা করছে বুঝতে পারি। ও চাপা গলায় বলল,
–মাফ চাইতে এসেছি।
–মাফ? জিরকনের চাইতে হীরে ঢের বেশি দামি। টেকসইও। দুটো পাশাপাশি থাকলে যে কেউই হীরে বেছে নেবে। তোমার তাতে দোষ নেই।
আমার ঠোঁটে বিদ্রুপের হাসি খেলে যায়!
–ওই বিয়েটা ভেঙে গেছে, আবিদ!
–কীভাবে?
–বিয়ের দিন আন্টি এসেছিল।
–আমার মা?
আমি সব শুনি ধৈর্য ধরে। মা ওই বিয়ের ভাঙানী দিয়েছে। মায়ের যত অপমান হয়েছিল, তার চাইতে বেশি অপমানিত হয়েছে নাজনীনের বাবা। বাড়ি আসা বরযাত্রী বিয়ে না করেই ফেরত গিয়েছে। নাজনীনের কপালে কলঙ্ক স্থায়ীভাবে লেগে গিয়েছে। ও এখন সবার চোখে চরিত্রহীনা, বদমাশ মেয়েছেলে, কুলটা!
অপমানে অপমানে কাটাকাটি হয়ে যায়।
নিক্তির মাপে মায়ের অপমানের পাল্লাটা নাজনীনের ক্ষতির পাল্লায় ওজনে অনেক হালকা লাগে!
সবকিছু শোধবোধ হয়ে যাবার পরে আমি আবার আগের জায়গায়, নাজনীনও ফিরে এসেছে জায়গামতো।
আমাদের মাঝখানে রুপা চরিত্রটাকে অনাবশ্যক মনে হয়!
কী জটিল পরিস্থিতি!
বাসায় ফিরে দেখলাম খালা, খালু এসেছেন। রুপা মা-বাবাকে আপ্যায়ন করতে ব্যতিব্যস্ত।
এক ফাঁকে রুপাকে ডাকলাম আমি,
–তোমার বড়োচাচা ঢাকায়। হাসপাতালে ভর্তি। খালু কি সেজন্য ঢাকায় এসেছেন?
রুপা চমকে ওঠে,
–নাজনীনের সাথে দেখা হয়েছে তোমার?
আমি পালটা প্রশ্ন করি,
–ওর বিয়ে ভেঙে গেছে সেটা তুমি জানতে?
রুপা সম্মতিসূচক মাথা নাড়ায়।
হুট করেই প্রশ্নটা মনে এলো। জানতে চাইলাম,
–রুপা, একটা সত্যি কথা বলো তো। আমার মা কি আগে থেকেই তোমাকে আমার বউ করতে চাইত? পছন্দ করত তোমাকে?
রুপা তাড়া খাওয়া পাখির মতো তাকায়। ওর ঠোঁট তিরতির করে কাঁপতে থাকে। ছলছলে চোখে জল পড়ে পড়ে…

চলবে…
আফসানা আশা