#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_২০
ইরিশা জামান চিন্তিত! কারণ ইরহানের কোনো খোঁজ পাওয়া যায় নি। ফোন অফ। কোনোভাবেই ট্র্যাক করা যাচ্ছে না। পালি*য়ে গেলো? কেন পালা*বে? তবে কি উষ্ণ চৌধুরী.. টেবিলে সজোরে আঘা*ত করল সে। তৎক্ষণাৎ বাইর থেকে তার সেক্রেটারি দৌড়ে ছুটে এলো। ইরিশা জামান দাঁত নিশ*পিশ করছে। এই উষ্ণ চৌধুরী কে খুব হালকা ভাবে নিয়ে নিচ্ছে সে। না ছাড়বে না। এভাবে হবে না, অন্য কোনো পথ বের করতে হবে।
সেক্রেটারী কে কড়া হুকুম দিল, উষ্ণ চৌধুরী কোথায় যায়, কার সাথে কথা বলে বিস্তারিত! একদম বিস্তারিত আমার চাই। ঊনিশ বিশের ফারাক ও যাতে না থাকে। মাইন্ড ইট!”
সেক্রেটারী মাথা নাড়িয়ে বেরিয়ে গেল। তার কাজ সে বুঝে গেছে!
.
পরদিন অফিসে তনয়া এলো ছাতা নিয়ে। আকাশে মেঘের কোনো চিহ্ন নেই। কাঠফাঁটা রোদ অথচ এর মধ্যেও তনয়ার হাতে ছাতা দেখে বেশ অবাক হলো তন্ময়। ছাতা দেখছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। দারুণ সুন্দর ছাতা তো। কোথায় পেলি তনয়া?
তনয়া মুখ ফসকে বলল, “স্যারের ছাতা!
“স্যারের ছাতা মানে? উষ্ণ স্যারের?”
তনয়া মাথা নাড়ল। তন্ময় মুখের ভাব গম্ভীর করে বলল, “তাই তো বলি, ছাতা টা এতো সুন্দর কেন? উষ্ণ স্যারের ছাতা বলে কথা মনে হচ্ছে খুব দামী!”
“রাখ তো ছাতার কথা!”
“না রে আসলেই ছাতা টা বেশ দেখতে। স্যার তো বেশ শৌখিন মানুষ।”
তনয়া ঠোঁট চেপে চুপসে গেল। যাকে দেখছে সেই ছাতার প্রশংসা করছে। সে হাঁপিয়ে উঠছে। তন্ময়ের হাত থেকে ছাতা নিয়ে বলল, “যাই স্যার কে দিয়ে আসি।”
তনয়া এসে দাঁড়াল স্যারের কেবিনের সামনে। যাবে কি যাবে না ভাবছে। গতরাতে যা করল লোকটা। তনয়া বুঝে না এসব পাগলামি। এরমধ্যে স্যারের মাঝে কেবল রহস্য আর রহস্য। এই রহস্য তাকে উন্মেচন করতে হবে। স্যার কি তাকে আগে থেকেই চিনতো। কখন থেকে? স্যার কি তাকে তবে ফলো করছে? ফলোই বা কেন করবে? তিনি তো বিদেশ ছিল অনেকবছর। তাহলে তাদের দেখাসাক্ষাৎ হলো কখন?
তনয়া বেশ অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে এবার নক করল। ভেতর থেকে গম্ভীর স্বর ভেসে এলো। অনুমতি পেয়ে তনয়া ভেতরে ঢুকে গেল। অথচ কেবিনে কেউ নেই। পুরো কক্ষ গালি। স্যার গেলো কোথায়?
তনয়া টেবিলের সামনে এসে দাঁড়িয়ে উঁকি মারছে। স্যার কি নিচে আছে? অতঃপর অনুভূতি প্রবল হলো। তীব্রভাবে কাউকে উপলব্ধি করতে পারার অনুভূতি। চট করে পিছন ফিরল। উষ্ণ স্যার এক কদম পিছন চলে গেল। দুই হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে অভিনব কায়দায় হেসে উঠল। তনয়া ভ্রু কুঁচকিয়ে আসল। উত্তেজনায় সে কাঁপছে? তার অনুভূতি? সে কি স্যারকে অনুভব করতে পারছে? কি অদ্ভুত? তাদের অনুভূতির আদানপ্রদান ঘটলো কখন আবার?
মিস তনয়া, আপনি এখানে?
জি স্যার, আপনার ছাতা।
উষ্ণ মাথা দুলাল। তনয়া ছাতা ফিরিয়ে দিল। কালো রঙের লম্বা ছাতাটা। অথচ এর উপর কারুকাজ করা আছে সূক্ষ্ম। এছাড়া ব্যান্ডের নাম ছাপানো। কিছু দামী জিনিস দেখলেই বোঝা যায় তা কতো দামী। উষ্ণ নিল না। ইশারা করে বলল, টেবিলের উপর রাখুন!
তনয়া টেবিলের উপর রেখে বলল, “আসছি স্যার!”
“ট্যুরে যাচ্ছেন তো মিস তনয়া?”
বুক কামড়ে উঠল। ট্যুর? হ্যাঁ প্রতিবছরই তাদের কোম্পানি থেকে ট্যুরের আয়োজন করার হয়। তিন থেকে চারদিনের ট্যুর। অফিসে সবার সুনজরে থাকতে হলে সেখানে যেতেই হবে। তনয়া প্রতিবারই যায়। সকল খরচ যখন কোম্পানি থেকে তখন যাওয়াতে বাঁধা নেই। কিন্তু উষ্ণ স্যারের বাঁকা হাসি এখন তাকে ভ*য় দেখাচ্ছে। সে কি যাবে? আবার তন্ময়ের কথা মনে পড়তেই মন ফুরফুরে হয়ে গেল। আচ্ছা সেও তো যাবে। তনয়া তন্ময়তে ডুবে গেল। একগাল হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, “জি স্যার অবশ্যই!”
উষ্ণের হাসি মিলিয়ে গেল। তনয়ার মনের খবর যেন সে আঁচ করতে পেরেছে। মাথা দুলিয়ে বলল, “আচ্ছা!” মাথার সাথে সাথে তার ঝুটি করা চুলগুলোও নড়চে। ছাগলের লেজ আরকি!
তনয়া বেরিয়ে গেল। রুম থেকে বেরুনোর পর মনে হলো, স্যারের কথা জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেছে। সে কেমন আছে? এতো রাত বৃষ্টিতে ভিজল জ্বর টর আসেনি তো আবার! এসব ভেবে প্রবল বেগে নিজের গালে চ*ড় মারল। তার হঠাৎ স্যারের প্রতি এতো দরদ উতলে উঠছে কেন? এতো বেশি দরদ দেখালে স্যার কি মাথা থেকে নামতে চাইবে। আজব!
——–
কিছুক্ষণ ধরে চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে যাচ্ছে কেবল। তনয়ার অদ্ভুত লাগছে! লাগারই কথা। দুদিন পর তার অফিস ট্যুর আছে। সেসব কাজ নিয়েই সে ব্যস্ত। উষ্ণ স্যার ইচ্ছে করে এসব কাজ তার ঘাড়ে তুলে নিয়েছে। কোথায় যাবে, কিভাবে যাবা আবার কোথায় গিয়ে উঠবে এই তিন চারদিনের প্ল্যানের দায়িত্ব তার মাথার উপর। এসব থেকে মুক্তি পাচ্ছে না এখানে আবার নতুন ঝামেলা হাজির। এই ঝামেলার নাম ইরিশা জামান। সে বুঝতে পারছে না, ইরিশা জামানের তাকে কি দরকার?
বিশাল এই ফাইভ স্টার হোটেলের এক কোথায় তারা দুজন বসা। ইরিশা জামান তার বিপরীতে বসে আছে দূরত্ব রেখে। তার সামনে কফির কাপ। সেখানে ধোঁয়া উড়ছে রীতিমতো। তনয়ার সামনেও কফির কাপ আছে। এখানে তাকে নিয়ে আসার কারণ এখনো সে বুঝতে পারছে না। তবে ইরিশা জামান যে সাংঘা*তিক মেয়ে এই কথা সে টের পেয়েছে আরো আগেই। অফিসের ওই কাণ্ডের পর! যেভাবে অকপটে সবার সামনে স্যারকে চ*ড় মারল। সেই ঘটনা মনে পড়তেই চোখ বুজে নিল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে তার দিকে তাকাল।
ইরিশা জানান ও তাকে দেখছে। নিশ্চিত এবার কিছু বলবে! গাঢ় লাল রং করা ঠোঁট দুটো নড়ছে। তনয়া কান খাড়া করে শুনছে!
তোমার নাম তনয়া?
জি। আপনি আমাকে কেন ডেকেছেন?
আমায় চিনো তো? আমি ইরিশা জামান।
তনয়া বিরবির করল, আপনাকে যে চিনবে না তার মাথায় ঘিলু নাই। মুচকি হেসে জবাব দিল,
জি চিনি।
হ্যাঁ তোমাদের কোম্পানির ভাবী মালকিন হতে যাচ্ছিলাম। হলো না। আচ্ছা শোনো তোমায় একটা কাজ দিবো? করতে পারবে? কি আবার জিজ্ঞেস করছি। অবশ্যই পারবে কারণ মোটা অংকের টাকা পাবে কাজের জন্য।
তনয়ার স্বার্থে ঘা লাগল সাথে সাথে। তার আত্মসম্মানবোধ, তার বিবেক কখনো টাকার কাছে তাকে ছোট হতে শিখায় নি। সে কফির কাপ সামনে এগিয়ে বলল,
আপনি ভুল মানুষকে নিয়ে এসেছেন ইরিশা জামান। আমি আপনার কাজের যোগ্য নই।
ইরিশা জামান অবাক হলেন সাথে সাথে অ*পমানিত। তার মুখের উপর না করা। দাঁতে দাঁত চেপে সহ্য করে নিলেন। একটু নড়েচড়ে বসে বললেন, “কাজটা শুনে নাও। এই কাজ তোমার জন্যই।
তনয়ার রা*গ হচ্ছে। ইচ্ছে করছে কফির কাপ টা ধরে মেয়েটার মুখের উপর ছুঁ*ড়ে মারতে। কেবল পারছে না বলে। ঠোঁটে ঠোঁট মিশিয়ে হাসল। ইরিশা জামান ভাবল তাকে কাবু করতে পেরেছে। বলল,
তুমি শেহনেওয়াজ চৌধুরী কোম্পানির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। উষ্ণের খুব কাছের লোক…
ফোড়ন কেটে তনয়া বলে উঠলো, “টাকার বিনিময়ে আমার কোম্পানির বিরু*দ্ধে আমি কোনো কাজ করব না ম্যাম। আমি আসছি।”
তনয়া উঠে যাচ্ছিল। ইরিশা জামান মিষ্টি গলায় বলল, “কোম্পানির বি*রুদ্ধে না, স্যারের বি*রুদ্ধে!
“মানে?
“মানে তোমাকে একটা পার্সোনাল কাজ করতে হবে। জানোই তো শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরী আমায় প্রত্যাখান করেছে। আমি আলবাদ নিশ্চিত এখানে কোনো মেয়ে জড়িত। হয়তো তোমাদের অফিসের কেউ!”
তনয়া চোখ মুখ ইতোমধ্যে ফ্যাকাশে হতে শুরু করেছে। মেয়ে! কোন মেয়ে? এরা কি তার কথা বলছে? তনয়া কি ধরা পড়ে গেল? কোনো অ*পরাধ না করেও নিজেকে অ*পরাধী মনে হচ্ছে তার। আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল চেয়ারে। ইরিশা জামানের প্রখর দৃষ্টি তার উপর। ঠোঁট নাচিয়ে বলছে,
“তোমার কেবল সেই মেয়ের হুদিশ আমায় দিতে হবে। বলতে হবে মেয়েটা কে?”
হ্যাঁ মামা বাড়ির আবদার নাকি? হাতে ছু*রি দিয়ে বলছে নিজেই নিজের গলায় ধ*রো। তাকেই কাজ দিচ্ছে তাকে খুঁজে বের করার। তনয়া অস্থির হয়ে উঠল। ইরিশা জামানের কথার ফাঁকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,
“আমি পারব না ম্যাম। সরি!”
“আহা, কথা তো শেষ করতে দাও। ( ব্যাগ থেকে টাকার বান্ডিল টেবিলে ছুঁড়ে বলল) আরো পাবে! এ তো কেবল শুরু!”
তনয়া ঘৃণা*র দৃষ্টিতে টাকাগুলোর দিকে তাকাল। তার কোনো পিছুটান নেই। টাকার জন্য আহামরি সে ম*রেও যাচ্ছে না। অসহায় তো সে একদমই না। দম্ভে পরিপূর্ণ আত্মসম্মানবোধে ভরপুর এক নারী।তাকে টাকা দিয়ে কেনা অসম্ভব। তনয়া মৃদু হেসে বলল,
“আমার টাকার দরকার নেই ম্যাম। এই কাজ আমি করতে পারব না। কারো পার্সোনাল লাইফ নিয়ে উঁকিঝুঁকি করার স্বভাব আমার নেই!”
ইরিশা জামান ঠোঁট চেপে হাসল। তনয়ার কথায় সে বিন্দুমাত্র খুশি নয়। তার ধারণা টাকার জন্য সবাই সব করতে পারে। আপন ভাইও ভাইয়ের গলায় ছু*রি ধরতে পারে। সেখানে এই মেয়ে তো পর। এতো কিসের দম্ভ তার!
তনয়া তবুও ভদ্রতা দেখিয়ে বলল, “আসছি ম্যাম!
পেছন ঘুরতেই পিছন থেকে কেউ বলে উঠলো, “কোথাও যাচ্ছ মিস তনয়া?”
তনয়া পেছন ফিরল। এই কণ্ঠ তার চেনা নয় অর্থাৎ মানুষটিও অচেনাই হবে। তবে না, মানুষটি তার মোটামুটি চেনা। তিলোত্তমা বেগম! হাতে ব্র্যান্ডের ব্যাগ নিয়ে তিনি টেবিলে এসে বসলেন। চেহারা পোশাকে চাকচিক্য ভেসে উঠছে। রূপায় বাঁধানো যেন পুরো দেহ।
তনয়া কিৎকর্তব্যবিমূঢ়! তিলোত্তমা বেগমকে সে কোনোভাবেই আশা করেনি। মাথা যেন ভনভন করছে তাকে দেখে। তিলোত্তমা বেগম বললেন,
“এ কাজ আপনি কেন করতে পারবেন না তনয়া? দরকার পড়লে আপনাকে আরো পারিশ্রমিক দেওয়া হবে। নিসংকোচে বলুন!
তনয়া বলবে কি? কথা বলতেই ভুলে গেছে। এ মহিলা তার মায়ের বয়সী হবে। তার সামনে কথা বলতে গেলেই তার গলা কেঁপে উঠে। বার বার মনে হয় এখন উল্টোপাল্টা কিছু বললেই মহিলা বাঘি*নীর মতো গর্জে উঠবে। তনয়া ঢোক গিলল। এ কি বিপদে সে এসে পড়ল। কেন তাকেই ঠিক করা হলো এই কাজের জন্য? কি দায় পড়েছে তার? চঞ্চল আঁখি জোড়া ছোটাছুটি করছে। হাতের ছোট্ট ব্যাগটা শক্ত করে আঁকড়ে ধরল। খোদা! এ কি বিপদে ফেললে আমায়!
#চলবে