তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৪৪+৪৫+৪৬

0
36

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৪৪

লাল শাড়িতে তনয়া কে লাগছে রক্তজবার মতো। ফুটন্ত কোনো রক্তজবা! বিয়ে শেষে খালার বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে প্রায় রাত ১ টা বেজে গেলো। এতোদিন দূরে থাকা সত্ত্বেও তনয়া না কেঁদে থাকতে পারল না। খালা ওমন করে কেঁদে উঠল যে সেও কেঁদে উঠল সাথে সাথে। বিদায় পর্ব বেশি দীর্ঘ হয়নি। জেএস মৌ কে পৌঁছে দিয়ে আসতে গেছে। মৌ যেতে যেতে বলল, তার সব জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখবে!”

কথাটা শুনে তনয়ার শরীরে তরঙ্গ ছুটে গেল তরিৎ গতিতে। টনক নড়ে উঠল। হ্যাঁ তাই তো, এখন তো এই লোকটার সাথে থাকতে হবে। পুরো একটি জীবন, সারাটে জীবন। সেই অধিকার বোধ থেকেই হাতটা মুঠোয় নিয়ে নিল উষ্ণ চৌধুরী। তনয়া বিস্মিত নয়নে ফিরে চাইল। উষ্ণ মৃদু হাসল। যার অর্থ এই, “তুমি এখন আমার অধিকার তনয়া!”

ড্রাইভিং সিটে বসে একহাত দিয়ে গাড়ি ড্রাইভিং করছে উষ্ণ চৌধুরী। অন্য হাত তনয়ার হাতের মুঠোয়। তনয়া হাত ছেড়ে নেবার চেষ্টা করতেই উষ্ণ আরো শক্ত করে হাতটা চেপে ধরল। চুড়ির ঝনঝন শব্দ শোনা গেল। তনয়া অত্যন্ত মিষ্টি আর নরম সুরে বলল,

“হাতটা ছাড়বেন তো!”

“না ছাড়ব না।”

“কেন? আমি তো আর পালি*য়ে যাচ্ছি না।”

উষ্ণ সামনের আয়নার দিকে তাকাল। তনয়াও সেদিকে তাকাল। নজর মিলতেই চোখ নামিয়ে ফেলল সাথে সাথে।

“বলা তো যায় না। এ যদি আমার স্বপ্ন হয়, হয় যদি আমার মতিভ্রম তবে? ভ্রম কাটার সাথে সাথে তো তুমি হাওয়ায় বদলে যাবে। আমি তো তা হতে দিতে পারি না নীলাম্বরী!”

“নীলাম্বরী!” ডাকটা এর আগেও শুনেছিল সে। অনেক কাছে থেকে, গভীর কণ্ঠে, ফিসফিসিয়ে কেউ কানের কাছে নামটা ডেকে বলছিলো। এ বোধহয় ওই রাতের কথা। তনয়ার সারা শরীর গরম হয়ে উঠল রাতের কথা মনে পড়তেই। হুট করে গাড়িতে ব্রেক কষল উষ্ণ। তনয়ার হাতটা গালে রেখে বলল,

“ব্যাপার কি? তোমার হাত গরম হয়ে যাচ্ছে কেন? জ্বর এলো নাকি?”

বলেই তনয়ার কপালে হাত রাখল। তনয়া একটু সংকুচিত হয়ে জবাব দিল, “না না, ঠিক আছি!”

উষ্ণ মুচকি হাসল। খানিকক্ষণ আগেও লোচনে ঢেকে দিল দুঃখের রেশ। বর্ষার ধারার মতো আঁখি জোড়া বেয়ে ঝরিয়ে পড়ল বারিধারা। এখন সেসব নেই? তবে ভেজা ভেজা আঁখি দুটোর রেশ যেন এখনো কাটাতে পারছে না উষ্ণ। কণ্ঠে একটু খাদ নামিয়ে ডেকে উঠল,

“নীলাম্বরী!”

ডাক শুনতে পেয়ে তনয়া যেই না এদিক ফিরল, চট করে তার কপালে চুমু খেয়ে নিল উষ্ণ। দু হাতে শাড়ি খামচে ধরল তনয়া। তার জান যায় যায় অবস্থা। এই ভাদাইম্যা লোক বুঝি আজ তাকে মে*রেই ফেলবে! হুটহাট এমন কাজ করলে কখন যে তার প্রাণ থেকে ভোমরা গায়েব হয়ে যাবে বলা যায় না।

উষ্ণ আবারো গাড়ি ড্রাইভ শুরু করল। তনয়া কোনোমতে তার সিটে শক্ত হয়ে বসে আছে। তার হাতটা এখন আর উষ্ণের হাতে নেই। তনয়াকে আনকর্মফোটেবল দেখেই উষ্ণ হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল। আবার কি জানি মনে করে হাতটা ধরে নিল। বলল,

“অভ্যাস করে নাও মিসেস তনয়া চৌধুরী, এখন থেকে এই‌ মানুষটির হৃদয়ে পার্মানেন্টলি বসবাস করবে তুমি! তাই আনকর্মফোটেবল হলে চলবে না। বুঝলে ম্যাডাম!”

তনয়া শুকনো ঢোক গিলল। বাঁধা দেবার সুযোগ নেই। উষ্ণ স্যার যা করছে অধিকার থেকে করছে। সে বাঁধা দিবে কি করে? আড়চোখে ফিরে চাইল। মনে মনে আওড়ালো, “আচ্ছা এই লোকটা তো আমায় অনেক ভালোবাসে, তিনি আমায় এখনো ভালোবাসতে পারবেন তো। অবশ্যই পারবেন। কিন্তু আমি? আমি ভালোবাসতে পারব তো তার মতো? ঠকাচ্ছি না তো তাকে? তিনি আমায় সবচেয়ে বেশি ভালোবাসেন, ভালোবাসেন বলেই তো এক ফোনে দ্বিতীয় কিছু না ভেবে ছুটে এসেছেন। আমার বিপদে পাশে থেকেছেন, সেই রাতে রাস্তা ধারে যখন পড়েছিলাম তিনিই তো ছুটে এসেছিলেন। ভাগ্য কি তাহলে প্রথম থেকেই তার সাথে জুড়ে দিয়েছিল। তাহলে? তাহলে তন্ময় কেন? কেন আমার মন আমি তন্ময় দিয়ে বসলাম। কেন বুঝতে পারলাম না? কেন? কেন?“

ভাবতে গিয়ে চোখের থেকে আবারো অশ্রু ফোঁটা ঝড়ে পড়ল। তনয়া সামলে নিল বটেই, কিন্তু উষ্ণের নজরে সবটাই এসেছে। লোকটার নজর থেকে কিছু আড়াল না।

কাঁদছ কেন? এখনো কি মন খারাপ লাগছে তোমার? গাড়ি থামাবো?
না ঠিক আছি। গাড়ি থামানোর দরকার নেই।
বাব্বাহ কি কাঁদতে কারো তুমি? এতো কান্না কেউ করে? আমি ভাবিনি তুমি এতো কাঁদবে?
আমরা এখন কোথায় যাচ্ছি?
আমার বাসায়!”
চৌধুরী ভবন? কিন্তু স্যার..
আমার বাসায় যাচ্ছি তনয়া। আমার বাসায়, যেখানে আমি থাকি। সেখানেই থাকবে তুমি! আমার সাথে!
তার স্পষ্ট দৃঢ় কথাগুলো শুনে তনয়া ভারী বিস্মিত হলো। তন্ময় কেন কখনো এভাবে বলে না। কেন সবসময় এতো কনফিউজড থাকে? এতটা দৃঢ় প্রত্যয়ী কেন নয় সে!

তনয়া দীর্ঘ কালো নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“জিজ্ঞেস করবেন না কেন বিয়ে করলাম আপনাকে?”

“না।”

“কেন? আপনার জানতে ইচ্ছে হয় না।”

“এখন জানতে ইচ্ছে করছে না।”

“কিন্তু আমার বলতে ইচ্ছে করছে!”

“তাহলে বলো!”

“বলব, আগে গাড়ি থামান!”

উষ্ণ গাড়ি থামিয়ে ফিরে চাইল তনয়ার পানে। তার হাতের মুঠোয় তনয়ার চিকন হাতটা। সে হাতটা দেখছে আর ভাবছে, এই মেয়ে কখনোই ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করে না। কতোটা শুকিয়ে গেছে। কঙ্কাল হয়ে গেছে একদম। এর গায়ে রক্ত কতোটুকু হবে? শরীর ফ্যাকাশে লাগছে। তনয়া কি রক্ত শূন্যতায় ভুগছে!

“আমি ওই লোকটাকে ঠকা*তে চাইছিলাম না!”

“কাকে?”

“যার সাথে বিয়ে ঠিক হবার কথা ছিলো তার সাথে।”

উষ্ণ চোয়াল শক্ত করে নিল। একটু গম্ভীর স্বরে বলল, “কি‌ বলতে চাইছো?”

“এটাই যে, আমার জীবনে একমাত্র পুরুষ বলতে কেবল তন্ময় ছিল। তন্ময় এমন পুরুষ যাকে আমি ভালোবাসতাম!”

উষ্ণ ফট করে হাতটা ছেড়ে দিয়ে বলল, “এসব আমি মোটেও জানতে চাই না। তুমি এখন আমায় বলবে তন্ময় কে তুমি কতোখানি ভালোবাসতে, কতোটুকু ভালোবাসতে? এখন এসব হিসাব নিকাশ করতে পারব না!”

আচমকা তার অভিমান তনয়ার কাছে বাচ্চাসুলভ লাগব। উষ্ণ ফের তার হাতটা ধরে বলল, “আচ্ছা এরপর বলো!”

তনয়া কোনোমতে হাসি দমিয়ে রেখে বলল,
“কিন্তু আমাকে স্পর্শ করা প্রথম পুরুষ আপনি। বিশ্বাস করবেন কি না‌‌ জানি না, কিন্তু আপনার আগে কেউ কখনোই আমায় ছুঁয়ে দেখেনি। এতোটা স্পেস বা অধিকার আমি কাউকে কখনোই দেয়নি। কেবল একটাই ইচ্ছে ছিল, আমার স্বামী, আমার পুরুষ আমায় ছুঁয়ে দেখুক। অন্য কেউ না। আমি তো আর কোনো খেলনা নই। রক্তে মাংসে মানুষ। আপনি বাদে অন্য কেউ আমায় ছুঁয়ে দেখবে এটা আমি মেনে নিতে পারব না। এখন অন্য কেউ আমায় বিয়ে করে ফেলবে সারাজীবন তার কাছে দো*ষী হয়ে থাকব। তাকে ঠকা*বো। প্রতা*রনা আমি করতে পারি না।”

কথাগুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল সে। উষ্ণ কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনে জবাব দিল ,

“তুমি ইনডাইরেক্টলি বলতে চাইছো ভালোবেসে তুমি আমায় বিয়ে করোনি।”

তনয়া ঠোঁট কামড়ে ফিরে তাকাল। কি বলবে বুঝতে পারছে না। হ্যাঁ উষ্ণ স্যারের বলা কথাটা সত্যি। কিন্তু এখন সে ভালোবাসতে চায়, সে তার স্বামীকে ভালোবাসতে চায়। এই কথাটা বলতে তার গলায় বাধ*ছিলো।

মাঝরাত্রির হুঁ হুঁ ঠান্ডা হাওয়া গাড়ির জানালার মধ্যে দিয়ে তার শুনশুন নিরবতার মাঝে খানিকটা প্রভাব বিস্তার করল। উষ্ণ আচমকা হেসে উঠে বলল, “ব্যাপার না তনয়া। পৃথিবীর সব মানুষ ভালোবেসে বিয়ে করে না। ধরে নিচ্ছি আমাদের বিয়েটা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ! তাই আমাদের ভালোবাসতে সময় লাগবে। কিন্তু তুমি আমায় ভালোবাসবে। সেই অপেক্ষায় আমি রইলাম!”

ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি রেখে গাড়ি স্টার্ট দিল সে। তনয়া অবাক হলো, বিস্ময়ে তার চোখ দুটো ভরে উঠল। এই লোকটা এমন কেন? কেমন? ভাদাইম্যা একটা!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৪৫

তারা দু’জন এসে উঠেছে একটা এপার্টমেন্টে। উষ্ণ তাকে নিয়ে চৌধুরী ভিলা যায় নি। নিয়ে এসেছে তার এপার্টমেন্টে, যেখানে সে বিগত কয়েক দিন ধরে থাকছে। সেখানের ঘর দৌড় সব অগোছালো। তনয়া হা হয়ে দেখছে।একটা ঘর কতোটা নোংরা হতে পারে উষ্ণ স্যারকে না দেখলে সে জানত না। উষ্ণ আমতা আমতা করে বলল, “তুমি সোফায় বসো তনয়া, আমি সব পরিষ্কার করে দিচ্ছি!”

তনয়া শাড়ির আঁচল গুঁজে সোফার কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। সোফার উপরে কিছু একটা পড়ে থাকতে দেখে তনয়া ড্যাব ড্যাব ওদিক চেয়ে রইল। ওটা কি বুঝতে তার সময় লাগলেও উষ্ণের সময় লাগল না। দ্রুতগতিতে ছুটে এসে সেটা সরিয়ে নিল। তনয়া নিজেও লজ্জা পেয়ে ঠোঁট দুটো চেপে ধরল। উষ্ণ নিজেও লজ্জা পাচ্ছে। স্যারকে এই প্রথম লজ্জা পেতে দেখল সে। নাহলে তো ভেবেছিল লজ্জা শরম কবেই বিসর্জন দিয়ে দিয়েছে লোকটা।

উষ্ণ এদিক ওদিক ছুটে বেডরুমের কাছে এগিয়ে গেল। দরজা খুলে ঘরটা এক নজর দেখে বলল, “তুমি এখানে চলে যাও তনয়া। আমি এখানে সব ঠিক করছি।”

এই অস্বস্তিকর পরিস্থিতি থেকে বাঁচার জন্য তনয়া মাথা নেড়ে রুমে চলে গেল। বেডরুম বেশ বড়। একদম মাঝেই বসানো হয়েছে কিং সাইজের বিছানা। ঘরের দেয়াল জুড়ে বিভিন্ন কারুকাজ। দেওয়ালের রঙটাও সুন্দর। চারদিকে আসবাবপত্রে ঠাসা। ঘরের ওদিকে দরজা, বোধহয় বেলকনি। তনয়া সেদিকেই হাঁটল। বেলকনির দরজা খুলতেই দমকা ঠান্ডা হাওয়ায় সবকিছু উড়িয়ে নিয়ে যেতে লাগল। তারা আছেও একদম উঁচুতে। সেভেন‌ ফ্লোর তো আর মুখের কথা নয়। বেশ কিছুক্ষণ সেখানে দাঁড়িয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল সে।

তাদের ফ্ল্যাটে রয়েছে একটা বেডরুম, বেডরুমের সাথে এটার্চ বাথরুম, একটা লিভিং রুম, লিভিং রুমের সাথেই উন্মুক্ত কিচেন। লিভিং রুমে বসেই কিচেন দেখা যায়। আর একটা সুন্দর বেলকনি। এই তো, এতোটুকু ঘর তাদের। ছোটখাটো সংসার!
তনয়া উষ্ণের দেওয়া বিয়ের লাল শাড়ি পরেই চলে এসেছে। সাথে একটা সুতোও আনেনি। এখন পরবে কি? ড্রয়ার থেকে উষ্ণের একটা হুডি আর একটা ট্রাউজার বের করল। লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বেরুলো সে। কালো রঙা হুডিটা তার কোমর অবধি ঠেকেছে। তনয়ার হাইট মোটামুটি খারাপ নয়। ট্রাউজার একটু ঢোলা হলেও লম্বা বেশি হয়নি। পরাই যায়!এদিকে উষ্ণ পুরো লিভিং রুম গুছিয়ে ফেলেছে। বেশ ক্লান্ত লাগছে তাকে।‌ তনয়া কিচেন থেকে ফ্রিজের ঠান্ডা জুস বের করে আনলো তার জন্য। রান্না করা খাবার ছিলো। ওগুলোই গরম করে খেলো দুজন। সবকিছুই কেমন যেন সহজ আর স্বাভাবিক। কোনো দোটনা নেই। তনয়া এসব নিয়ে ভেবেও দেখল না, উষ্ণ কেন তাকে চৌধুরী ভিলা নেয়নি। ভাবতেও চায় না।‌ তার স্বামী যেখানে থাকবে সেও সেখানেই থাকবে!

সমস্যা হলো ঘুমাতে এসে। এক বিছানায় ঘুমাবে দুজন। তনয়ার অস্বস্তি হবে ভেবে টেবিল ল্যাম্প জ্বালিয়ে রাখল উষ্ণ। মৃদু হেসে বলল, “চিন্তা করো না, তুমি ঘুমাও। আমি কিছু করব না!”

তনয়া গভীর চিন্তায় পড়ে গেল। “কিছু করব না মানে?” লোকটা কিসের কথা বলছে। সারাদিনের এতো ধকল গেলো যে বিছানায় মাথা রাখতেই দুজনেই ঘুমিয়ে পড়ল। তনয়া যখন ঘুমিয়ে পড়ল। তখন ৩ টা নাগাদ বাজে। রাত প্রায় ৪ টার কাছাকাছি তার ঘুম ভেঙ্গে গেল।‌ ঘুম ভেঙ্গে গেল অদ্ভুত এক কারণে। চোখ মেলে তনয়া উপলব্ধি করতে পারছে, কেউ তার পেটের উপর হাত রেখে জড়িয়ে ধরেছে। কেবল তাই নয়, তার এক পা তনয়ার গায়ের উপর। মুখটা গলার কাছাকাছি। এসব করে সে আরামে ঘুমাচ্ছে অথচ তনয়ার চোখের ঘুম উধাও। এসব যে করছে তিনি হচ্ছেন স্বয়ং উষ্ণ চৌধুরী। এই তো সবে মাত্র বলল কিছু করব না। এখন আবার কি শুরু করলেন!

তনয়া অস্বস্তির ঠেলায় যতোই সরে সরে যাচ্ছিল ততোই যেন উষ্ণ এগিয়ে আসছে তার দিকে। একসময় ধরাম করে বিছানা থেকেই প*ড়ে গেল সে। কোমরে ব্যথাও পেয়েছে তেমন। কোমরে হাত রেখে ফিরে চাইল। পুরো বিছানা জুড়ে লোকটা শুয়ে আছে। কি অদ্ভুত! তনয়া কোনোভাবে বালিশ টা নিয়ে মেঝেতেই শুয়ে পড়ল। এইখানেই ঠিক আছে সে!

ঘুম ভাঙল বেশ বেলা করে। উষ্ণ বিছানার এপাশ থেকে ওপাশ করে চট করে মনে পড়ল, “আরে আমার বউ কই? রাতে না বিয়ে করে আনলাম। তাহলে বিছানায় আমি একা কেন?” খোঁজাখুঁজির পর হুদিশ পেল। তনয়া মেঝেতে শুয়ে আছে। ড্যাব ড্যাব করে তাকেই দেখছে। উষ্ণ বালিশের উপর মাথা রেখে বলল,

“এই ওখানে কি করছো? আমি কি তোমাকে লা*থি মে*রে বিছানা থেকে ফেলে দিয়েছি?”

তনয়া বিরবির করে বলল,
“সেটা করলেও ভালো হতো!”

“কি বললে?”

“আপনি ইচ্ছে করে এক বেড রুমের ঘর নিয়েছেন!”

“কি আজব? বেড রুম তো একটাই থাকবে। বিয়ে করেছি কি বউ অন্যরুমে ঘুমানোর জন্য?”

তনয়া উঠে বসল। উষ্ণ হাসছে। ঘুম থেকে উঠার কারণে তার মুখটা ফুলে গেছে। তনয়া উঠে দাড়াতেই হুট করে তার হাতটা ধরে টান মারল উষ্ণ। সে ধরাম করে এসে পড়ল তার বুকের মধ্যে। চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে নিল তনয়া। উষ্ণ তার মুখ থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিল। তনয়া ড্যাব ড্যাব করে উষ্ণ কে দেখছে। একটু রাগ ও লাগছে তার। উষ্ণ নরম গলায় বলল,‌

“অভ্যাস করে নাও নীলাম্বরী! এখন আমাকেই তোমার অভ্যাস করতে হবে!”

“অভ্যাস করতে হলে ধৈর্য্য ধরতে হবে। একদিনে কেউ অভ্যস্ত হয়ে যায়।”

“আরো অপেক্ষা? তুমি আমার ধৈর্যের বাপ মা করে ছাড়বে!”

“ছাড়ুন লাগছে!”

উষ্ণ আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল, “লাগার কি আছে? একটু জড়িয়েই তো ধরেছি। খেয়ে তো ফেলছি না। বিয়ের প্রথম সকালে বউকে একটু জড়িয়ে ধরব না?”

তনয়া নড়চড় করে বলল,
“অনেক হয়েছে এবার ছাড়ুন, খিদে পেয়েছে তো। সারাদিন এভাবে শুয়ে থাকলে হবে!”

কথাটা ঠিক, খিদে পেয়েছে। উষ্ণ তনয়া কে ছেড়ে দিল। তনয়া উঠে বেরিয়ে যাওয়া সত্বেও কতোক্ষণ বিছানা শুয়ে এপাশ ওপাশ করতে লাগল। এরপর উঠে ফ্রেশ হতে গেল।

সকাল সকাল টেবিলের উপর নাস্তা রাখা। এসব করেছে তার বউ! আহা বউ থাকলে কতোই না শান্তি। উষ্ণ ভাবছে, অন্যদিন হলে সকালের নাস্তা সে করতোই না। এভাবেই চলে যেত কিংবা অফিস গিয়ে সারত। তনয়া ব্রেডের উপর পিনাট বাটার লাগিয়ে উষ্ণের প্লেটে রাখল। এরকম রসকসবিহীন হওয়া চলে না। তনয়া চাইলেই পারত সোহাগ করে ব্রেডটা মুখে ধরত। ধরল না! শয়*তান বউ একটা। কিন্তু সে তো আর রসকসবিহীন না। তার মন রসে পরিপূর্ণ। ব্রেড টা তনয়ার মুখের সামনে ধরে বলল,

“খাও!”

“এটা তো আপনার!”

“আমার তোমার বলে কিছু নেই। যা তোমরা তা সব আমার। তোমায় খেতে বলেছি তুমি খাবে।”

অযথা তর্ক না বাড়িয়ে তনয়া এক কামড় দিলো। উষ্ণ মুচকি হেসে সেখান থেকেই কামড়ে খেতে শুরু করল। আজকেও সকালটা কি দারুণ!

——–

উষ্ণ আজ অফিস কামাই করেছে। ভেবেছে বউয়ের সাথে খুনসুটি করে সময় কাটাবে। হলো না! যে হাতে বউয়ের চুল নিয়ে খেলা করার কথা ছিলো তনয়া সেখানে একটা ঝাড়ু ধরিয়ে দিয়ে বলল, “পরিষ্কার করুন!”

উষ্ণ ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে উঠল। বলল,

“কি করব?”

“ঝাড়ু হাতে মানুষ কি করে? পরিষ্কার তো!”

“কি পরিষ্কার করব? ঘরে নোংরা কোথায়?”

“আপনার মাথায়!”

“তনয়া!”

তনয়া ঝাড়ু দেয়ালে তাক করে বলল, “ওই যে দেখুন মাকড়সার জাল ঝুলছে। এসব পরিষ্কার করুন। বেলকনিতে গিয়ে দেখুন বালিতে কিচকিচ করছে। এখানে আপনি থাকতে কি করে? মানুষ থাকতে পারে এসবে?”

“আমি তো থাকতাম।”

“থাকুন। আমি পারব না। এখুনি পরিষ্কার করুন।”

প্রায় ধমক দিয়ে কথাটা বলল। উষ্ণ বুঝে গেল বউয়ের উপর খবরদারি করা চলে না। তার আদর সোহাগের মাথায় এখন ঝাড়ুর বাড়ি। তনয়া তার হুডি আর ট্রাউজার পরে ঘর দোর থেকে শুরু করে রান্নাঘর অবধি পরিষ্কার করেছে। উষ্ণ ও কম কিছু করেনি। জীবনের প্রথম ঘরের কাজ করতে গিয়ে তার বারোটা কি তেরোটা বেজে গেছে। তবুও অভিযোগ করেনি। জেএস এসে আবার একনজর দেখে গেল। মুখে কিছু না বললেও স্যারের এমন হালত দেখে মনে মনে সে মহাখুশি! জেএস এসেছিলো তনয়ার জিনিসপত্র নিয়ে। যেসব মৌ পাঠিয়েছে। কিছু জামা কাপড় আর দরকারি জিনিসপত্র। ব্যস্ততার কারণে মৌ আসতে পারেনি। মেয়েটাকে হঠাৎ করে খুব মনে পড়ছে তনয়ার। ইশ, একা একা কিভাবে যে থাকবে মেয়েটা!

সকাল বিকাল এসব কাজ করে যেই না উষ্ণ বিছানায় মাথাটা রেখেছে অমনি তনয়া এসে হাজির হলো তার সামনে। উষ্ণ দু সেকেন্ডের জন্য চমকে গেল। লাল রঙে চুড়িদারে তনয়াকে অপূর্ব লাগছে। পশ্চিমা আকাশের শেষ মূহুর্তের লাল আভার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ও বোধহয় সবে মাত্র গোসল সেরে এসেছে। চুল থেকে টপটপ করে পানি ঝরছে। উষ্ণ ড্যাবড্যাব করে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে শুকনো ঢোক গিলল। তনয়া চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

“এখন শুয়ে পড়লেন যে?”

“কেন? তুমিও শোবে নাকি আমার সাথে!”

তনয়া চোখ মুখ শক্ত করে তাকাল। রসিকতা বোধহয় তার পছন্দ হয়নি। উষ্ণ চোখ সরিয়ে বলল, “কি হয়েছে?”

“বাজার করতে হবে। ঘরে কিছু নেই।”

উষ্ণ বিছানায় গা এলিয়ে বলল, “অর্ডার করে নাও। তোমার কি আর এর্নাজি আছে রান্না বান্না করার। নাকি বাইরে থেকে খেয়ে আসবা। যাবা?”

“আমি বাইরের খাবার খেতে পারি না।”

“ওহ, কিছুই কি নেই?

“না নেই।”

“তাহলে তো যেতেই হয়। চলো!”
উষ্ণ এতো সহজে মেনে যাবে তনয়া ভাবে নি। না ভাদাইম্যা হলেও খারাপ না ওতোটা। অতঃপর তারা একসঙ্গে সুপার শপে গেল। উষ্ণ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে। তনয়ার বাজার দেখে তার হাত মাথায় চলে এসেছে। এতো কিছু! ও কি পুরো বছরের বাজার করছে? জিজ্ঞেস করতে গিয়েও করল না। মেয়েলি এসব ব্যাপারে জিজ্ঞেস না করাই ভালো। অতঃপর জিনিসপত্র নিয়ে গাড়ি করে ফেরত আসার সময় উষ্ণ মাঝ রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে দিল। গাড়ি থেকে নেমে এক তোড়া গোলাপ এনে দিল তনয়ার হাতে। তনয়া খানিকটা অবাক হয়ে শুধাল,

“এসব কেন?”

“কেন মানে? তোমায় এতো সুন্দর লাগছে আমি কি বলব? কি মাধুর্য তোমার চোখে মুখে। এতো সুন্দর মায়ামাখা মুখখানি দেখে কিছু না দিতে পারলে কতোবড় অ*ন্যায় করতাম জানো? তুমি কি চাও আমি অপরাধী হয়ে যাই?”

তনয়া স্থির নয়নে চেয়ে রইল গোলাপের দিকে। সংসার জীবনে তোমার সুখ কোথায়? ঘর সংসার সামলানো, রান্নাঘর, বাইরের চাকরি এসব করেই বোধহয় মেয়েদের জীবন শেষ হয়ে যায়। দিনের শেষ মূহুর্তে নিয়ন আলো যখন এভাবে কেউ তোমার হাতে ফুল ধরিয়ে একটু খানি প্রশংসা করে তখনি বুঝি জীবনের প্রতি ভালো লাগা কাজ করে। নিত্যদিনের একঘেয়েমি কাজের মধ্যে এই ক্ষুদ্র ঘটনা যেন জীবনে রসের প্রাণসঞ্চার করে দেয়। তনয়া সামনে তাকাল আয়নার দিকে? একই রকম তো লাগছে তাকে দেখতে? একদিনের ব্যবধানে এমনকি সুন্দর হয়ে গেল সে!

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৪৬

শান্তশিষ্ট এক সকাল। বাইরের কোলাহল কোনভাবেই ঘরে প্রবেশ করতে পারছে না। মিষ্টি আদুরে এক চিলতে আলো রান্নাঘরের জানালা দিয়ে ঘরের মেঝে স্পর্শ করছে। মাঝে মাঝে পর্দার আড়ালে লুকোচুরি খেলা খেলছে। শক্ত মেঝের কার্পেটে মেয়েটির নরম পায়ের পদধ্বনি। কেবল রান্নাঘর আর ডাইনিং টেবিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত যাওয়া আসা করছে। পরনে গোলাপী এক চুরিদার। ভেজা চুলগুলো বাঁধার সময় হয়নি। খোলা রেখেই সেগুলো শুকিয়ে গেছে। নাস্তা শেষে বোধহয় তৈরি হতে যাবে। অফিসে যাবার তাড়া আছে আজ।‌ বিয়ের পর প্রতিটা সময় কেমন স্বাভাবিকভাবে যাচ্ছে। অথচ তখন ভেবেছিল এই সংসার কেমন হবে? তার জীবনে আবার নতুন কোনো দুর্বি*ষহ এসে ঠেকবে? কি হবে জীবনে? সবকিছুর উত্তর পেয়ে গেছে!

শুভ্র রাঙা শার্ট আর ফরমাল প্যান্টে ল্যাপটপ হাতে হাজির উষ্ণ চৌধুরী। তনয়াকে এখান থেকে ওখানে পায়চারি করতে দেখছে মগ্ন চোখে। তাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে তনয়া বি*রক্ত হলো কিঞ্চিত। তাড়া দিয়ে বলল, “বসে পড়ুন, দাঁড়িয়ে আছেন কেন?”

উষ্ণ মাথা নেড়ে বসে পড়ল। একে একে তার সামনে নাস্তা হাজির। কমলার জুস, সবেমাত্র ছেকা তিনটে রুটি, সাথে একটা ডিম পোজ, মিক্স সবজিও আছেও একটা। এরই মধ্যে তনয়া আবার ফল কেটে আনলো। এতো আদুরে আয়োজন আজ অবধি তার জন্য কেউ করেনি। উষ্ণ হতবাক হয়ে পড়ল। ঠোঁটের কোণে তার চিলতে হাসি তনয়াকে ভালো লাগার বহিঃপ্রকাশ করছে। সে নিজেও কি জানত, তনয়াকে বিয়ে করে এতো কিছু পাবে। তনয়া ছোটছুটির এক পর্যায়ে বলল, “চা খাবেন?”

উষ্ণের ইন্টারেস্ট অবশ্য কফিতে। তবে তনয়ার চা পছন্দ সে জানত। সে মাথা দুলাল। সঙ্গে সঙ্গে দু কাপ চা নিয়েই তনয়া হাজির। আশ্চর্য তাহলে জিজ্ঞেস করল কেন?

তাড়াহুড়ো করে খাচ্ছে তনয়া। উষ্ণের চেয়ার পার করে দু তিনটে চেয়ার পর বসেছে সে। এটা হলো কিছু? উষ্ণ প্লেট সমেত নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে তনয়ার পাশে এসে বসল। তনয়ার মনোযোগ তখন নাস্তার প্লেটে আর ফাইলে। অফিসের কাজের চাপ উষ্ণ স্যারের চেয়েও যেন তার বেশি। উষ্ণ তার পাশে এসে যে বসল খেয়াল করেনি। খেয়াল করিনি, দুটো স্বচ্ছ আঁখিতে ভাসমান তার সুশ্রী চেহারা।

কিন্তু তনয়া টের পেলো অনেকক্ষণ বাদে। যখন উষ্ণের পারফিউমের ঘ্রাণ তার নাক ভেদ করে মস্তিষ্কে এসে কড়া নাড়ল, তখন বুক সামান্য কেঁপে উঠলো। মিনিমিনি দৃষ্টি ফেলে এদিক ফিরতেই উষ্ণ তার মুখের সামনে খাবার তুলে ধরল। এতো আদুরে ভঙ্গিতে খাবার ধরে রাখল যে তনয়া না করতে পারল না। সে টুক করে খাবার খেয়ে ফেলল। উষ্ণ মৃদু হাসল। হয়তো তনয়া তাকে ভালোবাসে না, কিন্তু ভালোবাসার সুযোগটুকু তো দিচ্ছে। এটাই কম কিসের!

উষ্ণ তনয়াকে খাইয়ে দিচ্ছে। একপর্যায়ে তনয়া বারণ করে বলল, “হয়েছে!”

“না হয়নি। আমি তোমাকে খাইয়ে দিব। ব্যস!”

অধিকারবোধে বলা কথাটায় তনয়া বারণ সাধতে পারেনি। খেতে খেতে উষ্ণ বলে উঠলো,

“তোমাকে চৌধুরী ভিলা নিয়ে যায়নি তনয়া। জানতে ইচ্ছে করে না কেন? তোমার শ্বশুর বাড়ি তো ওইটাই।”

তনয়া জুসের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, “আপনি যেখানে থাকবেন আমিও সেখানেই থাকব।”

উষ্ণ মাথা নাড়ল। তনয়ার মন খচখচ করছে। সে বলেই উঠল, “আচ্ছা তারা তো জানে না আমাদের বিয়ের কথা?”

“কাদের কথা বলছো?”

“আপনার মা বাবা!”

“তোমার স্যার আর সৎ মায়ের কথা বলছো। হ্যাঁ তারা জানে না। জানবে! কিন্তু তনয়া আমরা ততোদিনই অনেক সুখী যতদিন তারা না জানবে। তারা জানলেই আমাদের জীবনে দুর্বি*ষহ নেমে আসবে।”

তনয়া একটু ভ*য় পেলো। শুকনো ঢোক গিলে বলল, “বিয়েটা তারা মেনে নিবে না তাই না?”

উষ্ণ মুচকি হাসল। হাতের মুঠোয় তনয়ার হাত আঁকড়ে ধরে বলল, “আই ডোন্ট কেয়ার, তারা মানল কি না মানল। তাদের পছন্দ কি অপছন্দ। তুমি আমার পছন্দ, আমার দায়িত্ব। আমি আমার সর্বস্ব দিয়ে তোমায় আগলে রাখব।”

বলেই ছোট একটা চুমু খেলো তার ললাটে। লজ্জা পেলো সে। তাড়াহুড়ো করে দাঁড়িয়ে যেতেই উষ্ণ বলল,

“আমি নিচে অপেক্ষা করছি, দ্রুত এসো। আমরা একসাথেই যাব!”

——–

তনয়া দ্রুত পায়ে নিচে নেমে আসছে। পার্কিং লটে এসে উষ্ণ কে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আপনাআপনি হেসে উঠল সে। গাড়ির ড্রাইভিং সিট থেকে উঁকি মা*রছে জেএস। উষ্ণ এগিয়ে এসে গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়াল। তনয়া গুটি গুটি পায়ে এসে গাড়িতে বসে পড়ল। উষ্ণ হেঁটে ওপাশ গিয়ে তার পাশে গিয়ে বসল। গায়ে গা ঘেঁষে বসেছে। তনয়া আপত্তি করেনি,‌ বিরক্ত হয়নি। মেনে নিয়েছে!

অফিসে অফিশিয়ালি কেউই বিয়ের কথাটা বলেনি। বলেনি তার কারণ তনয়া জানে না। উষ্ণ স্যার না বললে সে বলে কেমন করে? আবার তারা জানলেও জিজ্ঞেস করবে, ধুমধাম করে বিয়েটা কেন হলো না? স্যারের বিয়েতে এতো লুকোচুরির কিসের। কতো মানুষের কতো কথা? না জানিয়েই বোধহয় ভালো করেছে।

কিন্তু তনয়ার রূপ আর সৌন্দর্য সেই কথা ভুলে যায়নি। তারা তো আর এসব কিছু বুঝে না। টেবিলে বসার পর থেকে একেক জন এসে তার সৌন্দর্যের প্রশংসা করে যাচ্ছে। সকলের একই কথা, তোমাকে তো দারুণ লাগছে তনয়া? হঠাৎ এতো সুন্দর হলে কি করে? এই তোমার রূপের রহস্য কি?

তনয়া মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে ফেলে। বিয়ের কথা মুখ ফুটে সে বলতে পারছে না। এরপর আবার এতো শত প্রশংসা। বিয়ের পর প্রতিটা মেয়ের সৌন্দর্য বেড়ে যায়। চেহারায় ফুটে উঠে লাবণ্য, ভাসা ভাসা নেত্রদ্বয় নেতিয়ে পড়ে লজ্জায়! তনয়ার হাল ঠিক তেমন। একজন তো বলেই ফেলল, বিয়ে হয়েছে নাকি?

তনয়া জবাব দেবার আগেই ম্যানেজার সাহেব বলে উঠলো, “না না, এসব কি বলেন? তনয়ার বিয়ে হবে আর আমরা জানব না। একটা কার্ড তো পাবো। কি তনয়া?”

তনয়া কেবল দাঁত বের করে হাসে। সত্যি কথা বলার সাহস সে পাচ্ছে না। কলিগদের সাথে এই আড্ডার মধ্যেই চোখ পড়ল দূরের দরজায়। তন্ময় ওখান থেকে দাঁড়িয়েই তাকে দেখছিল। চোখে চোখ পড়তেই তন্ময় চলে গেল। হৃদয়ে কেমন গেঁথে গেল। তবে কি তাদের বন্ধুত্ব টা আর থাকবে না? দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব তাদের, সম্পর্ক অনেকদিনের। বন্ধু বলতে একমাত্র সেই তো ছিলো! এবার তাকেও হারি*য়ে ফেলবে তনয়া। কিন্তু আটকানোর সাধ্য ও তো নেই!

লাঞ্চ টাইম, উষ্ণ চেয়ারে বসে হাতের ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখছে। লাঞ্চ টাইম শুরু হলো সবে ৫ মিনিট। তনয়া এখনো কেন আসছে না? এতো সময় কেন লাগছে তার। বলতে বলতে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। উষ্ণ অনুমতি দিতেই তনয়ার হাস্যোজ্জ্বল মুখের প্রতিচ্ছবি দেখতে পেলো। এই আশায় তো ছিল সে। তনয়ার টিফিন বক্স হাতে ভেতরে চলে এলো। চেয়ারে এগিয়ে বসতে এলেই উষ্ণ বলে উঠলো,

“আমার কেবিনে আসতে তোমার অনুমতি নিতে হয় নাকি? তোমার যখন ইচ্ছে চলে আসবে!”

তনয়া জবাবে মাথা নাড়ল। খাবার একে একে সাজাচ্ছে উষ্ণের টেবিলে। সেও বসে নেই। হাতে হাতে সাহায্য করছে তাকে। টেবিলে কয়েক রকম খাবার। এতোসব খাবার দেখে উষ্ণ চক্ষু চড়কগাছ। এই মেয়ে সেই ভোরে উঠে এতোসব রান্না করেছে। এসব দেখে সে অভিভূত আর বিস্মিত! এতোটুকুই তো চাওয়া। তার ভালোবাসা, আদর, যত্ন সবকিছুই তার হোক। তনয়া কেবল তার জন্যই ভাবুক। একজন নারীর চেয়ে কেউ আর ভালো সংসার সাজাতে পারে না। একটা অগোছালো সংসার নারীর হাতে পড়লেই হলো। চোখের নিমিষেই সবটা সাজিয়ে গুছিয়ে নেয়।

———-

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে! কথাটা সত্য। উষ্ণ মনে প্রাণে কথাটা বিশ্বাস করে। কিন্তু সংসারে ঝামেলা হয় দু’জনের দো*ষে। এখন উষ্ণ কার দো*ষ দিবে? তনয়ার নাকি নিজের ভাগ্যের! বিয়ের আজ ১০ দিন পূর্ণ হলো। সবকিছু্ই তো ঠিকঠাক যাচ্ছিল এখন। তাদের সম্পর্কের উন্নতি হচ্ছিল। কিন্তু আজ যা হলো, তা হওয়া উচিত হয়নি। এপার্টমেন্টের লিভিং রুমে সোফার উপর বসা উষ্ণ! রাগে চোখ কট*মট করে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। চোয়াল শ*ক্ত করে চেপে আছে। পুরো ঘর অন্ধকার, নিভো নিভো আলোয় একটু কিছু দেখা যাচ্ছে। উষ্ণ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাঁত কিড়মিড় করছে। রাত ১২ টা বাজতেই ধৈর্য্যের সকল সীমা পেরিয়ে গেল তার। সোফার ডানদিকে রাখা নীল রঙের ফুলদানির উপর নজর পড়ল । ফুলদানিটা তনয়া দুদিন আগেই শখ করে এনেছিলো। তনয়ার রা*গ এখন এটার উপরই ঝাড়ল। দু হাতে তুলে আছা*ড় মাড়”ল। দাঁত নিশপিশ করে বলল, “তুমি কাজটা ঠিক করোনি তনয়া? একদম ঠিক হয়নি। আমায় ঠকা*তে পারো না তুমি, কখনোই না। তোমায় ছাড়তে পারব না আমি, না তুমি আমায় ছাড়তে পারো। এতো সাহস তোমার? এর মাসু*ল তোমায় দিতেই হবে। আমিও দেখে নিব তোমায়! উষ্ণ চৌধুরী ভালো মানুষি দেখেছো। এবার দেখবে হিং*স্র রূপ। যা তোমাকে কখনোই দেখাতে চায়নি আমি! তোমায়! আমি তোমায়…..

#চলমান