তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-৬৩+৬৪

0
14

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৬৩

আদুরে আদুরে প্রেমের মৌসুম কেমন যেন মিষ্টির মতো মনে হয়। তুলোর মতো নরম, মুখে দিলেই যেন গলে যায়। ভাবটা সেরকমই। তনয়া আর উষ্ণের ভালোবাসা ঠিক তেমনি মাখো মাখো, আদুরে আদুরে ভাবভঙ্গি! এই যেমন খানিকক্ষণ আগে দু’জনে বিছানার মধ্যে সেই যু*দ্ধ করেছে। তনয়া বিছানায় দুটো চাদর নিয়েছে। একটা নিজে অপরটা উষ্ণ কে দিয়েছে। আলাদা আলাদা চাদর গায়ে জড়িয়ে ঘুমাবে। কিন্তু উষ্ণ সেখানে জোড়ালো ভাবে দ্বিমত প্রকাশ করল। সে মানবেই না! তনয়া তার চাদরের ভাগ ও দিবে না। নেহাত ন্যাকা*মো আর আহ্লাদী ভাব! প্রেমে পড়ে এতোটুকু ছেলেমানুষী করাই যায়। তনয়া ইচ্ছে করেই উষ্ণকে রা*গিয়ে দিচ্ছে। উষ্ণকে রা*গতে খুব কমই দেখেছে। বিশেষ করে তার ক্ষেত্রে তো রা*গ যেন বেশিক্ষণ থাকেই না। দু মিনিটের মতো থেকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। এখন ব্যাপারটা হচ্ছে সেরকম। উষ্ণ খুব চেষ্টা করছে না রা*গার কিন্তু তনয়া তাকে রাগা*নোর খুব চেষ্টা করছে। উষ্ণ চাদর ধরে টানছে। তনয়াও চাদর ধরে টানছে। এই চাদরের ভাগ উষ্ণকে দেওয়া যাবে না। বেশ তাই তো! উষ্ণ চাদর সমেত তনয়াকে হিচকে টেনে নিজের চাদরের ভাঁজে লুকিয়ে নিল। এই করে ক্ষান্ত নেই সে। রীতিমতো তনয়াকে চেপে ধরে বুকের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছে। তনয়া ছাড়ানোর চেষ্টা চেষ্টা করছে। যু*দ্ধ লেগে গেছে। তনয়া চাদর ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য যু*দ্ধ করছে অন্যদিকে উষ্ণ তাকে ধরে রাখার জন্য যু*দ্ধ করছে। এই যু*দ্ধের মধ্যেই তনয়া ফট করে হেসে উঠলো। পাক্কা অভিনেতা নয় সে, অভিনয় বেশিক্ষণ টিকল না। উষ্ণ রে*গে তাকে চাদরে জড়িয়ে রেখে বেরিয়ে গেল। উষ্ণ কে রা*গিয়ে দিয়ে ভারী মজা পেয়েছে সে। হাসি থামছে না এখনো!

চাদর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল, তার ধারণা উষ্ণ খুব দ্রুত ঘরে হা*না দিবে। উষ্ণের রাগ যৎসামান্য। এই পড়ে যাবে। কিন্তু না, উষ্ণ তখনো আসেনি। তাকে আসতে না দেখে ভারী চিন্তায় পড়ে গেল তনয়া। বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা দিয়ে উঁকি মারল। ঘরের বেলকনির কাছে ইজি চেয়ারে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। এটা তারই উষ্ণ স্যারের ছায়া। ছায়ামূর্তি বোধহয় ফোনে কারো সঙ্গে কথা বলছে। তনয়া এগিয়ে গেল, দাঁড়িয়ে কথা শুনছে। কথা আহামরি তেমন কিছু শুনতে পেলো না। কেবল শুনল, আচ্ছা আমরা আসব!

আমরা বলতে সে ছাড়া আর কোনো তৃতীয় পক্ষ নেই। উষ্ণ স্যারের গলার স্বর থমথমে। নিশ্চিত উনার বাবা ফোন করেছে। আবারো দেখা করার কথা উঠেছে। উষ্ণ স্যারের মন কি এইজন্যই খারাপ!
তনয়া আলগোছে বসে পড়ল ইজি চেয়ারের পাশে মেঝেতে বসে পড়ল। উষ্ণ যেন কিছু ভাবছিলো, তনয়াকে পাশে বসতে দেখেই তড়িঘড়ি করে বলল,

“করছো কি? ওখানে কেন বসছো!”

তনয়া দুই হাঁটু তুলে বসল। হাত দুটোয় হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলল,
“এভাবেই , ইচ্ছে করল।”

“মেঝে খুব ঠান্ডা তনয়া। উঠো আমি চেয়ার এনে দিচ্ছি।”

তনয়া মাথা ঝাঁকিয়ে না করল। একটু এগিয়ে উষ্ণের পায়ের কাছে ঠেসে বসে বলল, “আমার মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিবেন।”

“এভাবেই!”

তনয়া মাথা দুলাল ফের। উষ্ণ তার হাত বাড়াল। মাথায় হাত রেখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল। তনয়া হাঁটুর উপর মাথা রেখে চোখ বুজে নিল।‌ উষ্ণ ঘাড় বাঁকিয়ে তাকে দেখছে। তনয়া আদ্রকণ্ঠে বলে উঠলো, “জানেন তো, আমার মা বাবা মা*রা যাবার কেউ আর এমন আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়নি!”

উষ্ণের চলন্ত হাত থেমে গেল। সে নিশ্চুপ হয়ে তনয়ার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনছে। ও কি কাঁ*দছে? উষ্ণ চেয়ার ছেড়ে মেঝেতে এসে বসল তনয়ার পাশে। তনয়া তার ঘাড়ে যত্নে মাথা বিছিয়ে দিল। চোখ বুজে নিল। নোনতা পানি গাল বেয়ে চিবুক এসে জড়ো হচ্ছে। উষ্ণের মন আনচান করছে। সে তো পাশেই আছে, তবুও তনয়া কেন কান্না করছে! কেন? আচমকা তনয়া ভিজে কণ্ঠে বলে উঠলো, “আপনি আমায় ছেড়ে দিবেন না তো?”

চমকে উঠল উষ্ণ, কেঁ*পে উঠল তার দেহের ছোট্ট হৃদয়টা। এই মেয়ে বলে কি? সে কি এখনো বুঝতে পারছে না উষ্ণ তাকে কতোটুকু ভালোবাসে। বুঝবে কিভাবে? কতো টুকুই বা আর জানে সে। তাকে কাছে পেতে সে কি কি এসব কি আর তনয়াকে জানানো যাবে। সম্ভব না তো! উষ্ণ বলে উঠলো,

“ছেড়ে দিব কেন? তোমার একা থাকতে সমস্যা হলে বলবে! একাকিত্ব দূর করার ব্যবস্থা করব!”

তনয়া চোখের পানি মুছে নাক টেনে বলল, “কিরকম?”

“তোমায় একটা বান্ধবী এনে দিব। এটা হচ্ছে ভদ্র ভাষা, যদি অভদ্র ভাষায় বলি সে হচ্ছে তোমার সতীন!”

আকাশে বজ্র*পাতে ঘসে পড়ল। সত্যি সত্যি আকাশেই মেঘ গর্জে উঠল। এখন প্রায় মধ্যরাত! ২ টার কাছাকাছি! এমন সময় আকাশে মেঘের ডাক, তাদের ড্রয়িংরুমের নিভো নিভো মাখা চারদিকে আচমকা বজ্রপাতের তী*ক্ষ্ণ আলোয় উষ্ণের মুখাবয়ব দেখতে পেলো তনয়া। সে কোনো জবাব দিল না। বোধহয় রেগে গেছে। উষ্ণ তার মুখের ভাব দেখে খানিকটা আঁচ করতে লাগল। ঝরঝরিয়ে বৃষ্টি পড়ছে বাইরে।

তনয়াদের বেলকনিটা সুন্দর! এখানে দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজা যায়। বেলকনির উপরে ছাদ খোলা। বৃষ্টি এসে ভিজে যায় পুরো বেলকনি। কোণায় একটা সরু পাইপ আছে, সেখান দিয়ে বৃষ্টির পানি সব নিচে নেমে যায়। তনয়া অপেক্ষা করল না। নিশ্চুপে উঠে দাঁড়িয়ে পা বাড়াল বেলকনির দিকে। নিশ্চিত এই মাঝরাতে মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজবে। এই কথা ভেবে উষ্ণের আক্কেলগুড়ুম। এই মাঝরাতে তনয়াকে রাগি*য়ে দেওয়া মোটেও ঠিক হয়নি। হালকা কে*শে বলে উঠলো,

“বৃষ্টিতে ভিজতে যাচ্ছ!”

“হু!”

শান্ত ভঙ্গিতে জবাব দিল। গা হিম করা ঠান্ডা স্বর। উষ্ণ শুকনো ঢোক গিলে বলল, “এতো রাতে ভেজার কি দরকার। চলো ঘুমাতে যাই কাল অফিস আছে তো।”

তনয়া জবাব দিলো না। সে দরজা খুলে চলে গেলো একদম বৃষ্টিতে ভিজতে। উষ্ণ সাথে সাথে উঠে দাঁড়াল। ছুটে গিয়ে তার হাত টেনে ধরে বলল, “সরি, মজা করেছি। পাগলামী করো না লক্ষ্মী বউ! চলে এসো।”

“আমি যাব না,‌ ছাড়ুন আমায়!”

“আহা এতো রা*গ কেউ করে নাকি। দেখো আমি এই বৃষ্টিতে ভিজতে পারব না। আমার জ্বর চলে আসবে।”

“আপনাকে আসতে কে বলেছে, আমি একাই ভিজব। আপনার আসতে হবে না!”

ততোক্ষণে তনয়া ভালোই ভিজে গেছে। নিরুপায় উষ্ণ তার হাত ছেড়ে দিল। নীলাম্বরী কে চটি*য়ে লাভ নেই। বেশি রে*গে গেলে এই বৃষ্টির মধ্যেই ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতে পারে।

দরজার সামনে দাঁড়িয়ে উষ্ণ। তার নীলাম্বরী ভিজছে বৃষ্টিতে। প্রথম প্রথম এক জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিজল। মন খারাপ বুঝি কেটে গেল। এরপর দাঁড়িয়ে সে লাফাতে লাগল। ঘুরছে,ফিরছে নাচছে! উষ্ণ বেশ অনেকক্ষণ দরজার সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে দেখতে লাগল।

তার মুখের অসহায়ত্ব ভাবটা কেটে গেছে এতোক্ষণে। সেও পা বাড়াল বৃষ্টির মধ্যে। পেছন থেকে আগলে ধরল তার ঢেউখেলানো সরু কোমরটা। নিজেকে গুটিয়ে নিল তনয়া। বলল,

“জ্বর আসবে না আপনার?”

“আসুক, তোমার সাথে ভাগাভাগি করে নিব!”

“ইশ!”

বলেই দূরে পালিয়ে গেল। উষ্ণ তৎক্ষণাৎ তার হাতটা ধরে ঘুরিয়ে তাকে কাছে আনল। দু হাতে কোলে তুলে নিল আচমকা! অকস্মাৎ ঘটনায় তনয়া পুরোপুরি চমকে গেলেও মূহূর্তে উষ্ণের গলা জড়িয়ে ধরে হাসতে লাগল। কানের কাছে মুখটা এনে বলে উঠলো, “শুনুন,আপনি যদি আরেকটা বিয়ে করার কথা মাথাতেও আনেন তাহলে আমি আপনাকে এখান থেকে ধাক্কা মে*রে ফেলে দিব!”

“সোজা মা*র্ডার করে দিবে!”

বলেই কোল থেকে নামাল তাকে। তনয়া তৎক্ষণাৎ তার শার্টের বুকের অংশ চে*পে ধরে বলে উঠল, “আপনি আমার না তো অন্য কারো না!”

উষ্ণ মিষ্টি মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে আছে। তনয়ার পুরো শরীর ভিজে গেছে। বৃষ্টির ফোঁটা সারি সারি দল বেঁধে মুখশ্রী থেকে গড়িয়ে পড়ছে। চুল আষ্টেপৃষ্ঠে আছে কপাল জুড়ে। ঘোরালো নে*শা জমেছে দু চোখে। চুলগুলো কানে গুঁজে দিয়ে হুট করে তাকে কাছে টেনে নিল। চুম্বন করল কাঁপতে থাকা সেই অধর জোড়ায়। ঢেউখেলানো কোমরটা শক্ত করে চেপে ধরল সে। পূর্ব কোনৌ আগাম বার্তা না দিয়েই ঝ*ড় শুরু। তনয়া বেশ আদুরে ভঙ্গিতে তার ঘাড় জড়িয়ে ধরল!

ভিজে শরীর নিয়ে দুজনে ঘরে ঢুকেছে। আধো আধো ঘর, বাইরে ঝড়ো বৃষ্টি! তনয়া দ্রুত তোয়ালে নিয়ে উষ্ণের কাছে এলো। উষ্ণ টি শার্ট খুলে ফেলেছে। পরনে ভেজা প্যান্ট নিয়েই সোফায় বসে পড়ল। চোখ মুখ ইতোমধ্যে লাল হতে শুরু করেছে। তনয়া ভিজে শরীর নিয়েই ছোটাছুটি করছে। ঘর ভেসে যাচ্ছে তাদের গা থেকে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা পানিতে। তনয়া তোয়ালে এসে দেখল সাং*ঘাতিক অবস্থা। উষ্ণের চোখমুখ ইতোমধ্যে লাল হয়ে গেছে। সে তোয়ালে দিয়ে তার উন্মুক্ত শরীর মুছিয়ে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলল,

“ইশ, আপনার উচিত হয়নি বৃষ্টিতে ভেজা। কি হবে বলুন তো। মনে হচ্ছে জ্বর আসছে। শরীর তো ভীষণ গরম হয়ে উঠছে। আমি ওষুধ নিয়ে আসছি!”

বলেও যেতে পারল না। উষ্ণ তার কোমর আগলে ধরে বলল, “কোথাও যেতে হবে না!”

“যেতে হবে না মানে?”

উষ্ণ উঠে দাঁড়াল। তার চোখে উপচে পড়ছে কামুকতা। নেশা*ধরানো কণ্ঠে বলল,‌”আমার‌ এখন তোমাকে চাই, এখন তুমিই আমার কাছে সবচেয়ে বড় ঔষধ!”

বলেই তাকে আচমকা কোলে নিল। তনয়া হতবুদ্ধির মতো চেয়ে আছে। এই লোক সজ্ঞানে আছে তো! বলে কি এখন এসব? শুকনো ঢোক গিলল সে। ভেজা শরীর সমেত তাকে নিয়ে রাখল বিছানার উপর। তনয়া হকচকিয়ে বলল, “করেন কি? বিছানা ভিজে যাবে তো!”

“তো খুলে ফেলো ভেজা জামাকাপড়, দাঁড়াও আমি হেল্প করছি!”

সত্যি সত্যি উষ্ণ হাত বাড়িয়ে তার টি শার্ট খুলে মেঝেতে ছুড়ে ফেলল। তনয়া জড়ো*সড়ো হয়ে বিছানায় শক্ত হয়ে বসে রইল। উন্মুক্ত শরীরে এখন ভীষণ ঠান্ডা লাগছে তার। উষ্ণ তার গলায় মুখ ডুবানোর সাথে সাথেই উষ্ণতা অনুভব করল সে। উষ্ণ স্যারের গরম শরীর মূহূর্তে তার শীতলতা কমিয়ে নিল। সে নিশ্চুপ হয়ে গেল। তার গলা শুকিয়ে আসছে! উষ্ণ স্যারকে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তিনি মিশে যাচ্ছেন তার সাথে। কি অদ্ভুত! কি আশ্চর্য মানুষের মিলন…

#চলমান

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্বসংখ্যা_৬৪

উষ্ণ বসে আছে জাওয়াদ চৌধুরীর মুখোমুখি হয়ে। তাদের সামনে লম্বা একটা টেবিল। টেবিলের এই প্রান্তে জাওয়াদ চৌধুরী, তিলোত্তমা বেগম আর উষাণ চৌধুরী বসে আছে। বিপরীতে কেবল তনয়া আর উষ্ণ! উষ্ণ মুখোমুখি বসেছে তার বাবার সামনে। তনয়া তো চোখ তুলে তাকাতে পারছে না। চোখ তুলে তাকালেই হয়তো তিলোত্তমা বেগমের কঠি*ন মুখ কিংবা ঊষাণ চৌধুরীর মুখখান দেখা লাগবে। এই ভ*য়ে সে ফিরেও তাকাচ্ছে না। তার হাত উষ্ণ চৌধুরীর হাতের মুঠোয়। তনয়া যেন ভয়* না পায় সেই কারণেই শক্ত করে হাত ধরে আছে। কেবল তাই নয়, তারা চৌধুরী ভবন ছেড়ে বসে আছে পাঁচতারা এক রেস্টুরেন্টে। সবটা উষ্ণের কারণে। তনয়াকে নিয়ে দ্বিতীয় কোনো রি*স্ক সে নিতে চায় না!

জাওয়াদ চৌধুরী বললেন, “বিয়ের তারিখটা তবে এখনি ঠিক করে নিই।”

উষ্ণ কিছু বলার আগেই তিলোত্তমা বেগম তেড়ে উঠলেন। কাঠ কাঠ গলায় জবাব দিলেন, “কি কারণে? এতো কিসের তাড়া?”

“কেন? তুমি কি সব জেনেও না জানার ভান করছো? মিডিয়ে, বিজনেস পার্টনার, ডিলার, ইনভেস্টার সবাই কিভাবে আমায় বলছে শুনোনি? গতকালের পার্টিতেও তো শুনলে। সবাই উষ্ণের বিয়ের কথা বলছিলো। তাদের কাউকে ইনভাইট না করে বড় ছেলের বিয়ে দিলাম কি করে?”

“হাহ, বলে দিলেই পারতে। ছেলে একাই বিয়ে করেছে। বিয়ে করেছে আমাদের চেয়ে নিচু বংশে*র একটা মেয়েকে। না আছে ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড না আছে ফ্যামিলি! বড় লোক বস পেয়ে মাথাটাই গিলে ফেলেছে!”

তনয়া মুখ বুজে সবটা সয়ে নিচ্ছিল। পরক্ষণেই টের পেলো তার হাতের উপর কেউ হাত বুলিয়ে আশ্বাস দিচ্ছে। উষ্ণ কড়া গলায় জবাব দিল, “আপনি কি থামবেন?”

তিলোত্তমা বেগম কিছু বলতেই যাচ্ছিলেন জাওয়াদ চৌধুরী তাকে থামিয়ে দিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করলেন। বললেন, “আহ, বাইরে এসে তোমরা কেউ সিনক্রিয়েক্ট করো না। এভাবেই আমাদের নিয়ে কথা কম হচ্ছে না।”

“আমায় কেন বলছো? তোমার ছেলেকে বলো না।”

“কি বলবে? আপনি কি শুনতে চান? আমার বউয়ের ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়ে পড়ে আছেন, আপনার ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ড কি?”

জাওয়াদ চৌধুরী শান্ত কিন্তু তীক্ষ্ণ গলায় শাসি*য়ে বলে উঠলেন, “আমি থামতে বলেছি তোমাদের!”

তারা দু’জনেই চুপসে গেল। কিন্তু উষ্ণ তখনো কাঁপ*ছে রাগে। তনয়া দু হাতে তার হাতটা আগলে ধরে আশ্বাস দিল। শান্ত হতে বলছে। ঊষাণের এতোক্ষণ সমস্ত কিছু ভালো লাগলেও এখন আর কিছু ভালো লাগছে না। তার মা কে কেউ কটু কথা বলুক এটা তার সহ্য হয় না। এছাড়া উষ্ণের উপর তার রা*গ আছে,‌তনয়ার উপরেও আছে। ওদের কারণেই সবচেয়ে কাছের বন্ধু ইরিশা কে হারি*য়েছে সে। সেই প্রতিশো*ধের অগ্নি*শিখা এখনো একটু একটু করে জ্বলে* যাচ্ছে

তিলোত্তমা বেগম করুণ স্বরে বলে উঠলেন, “আমার ভাই ঝি মা*রা গেলো এখনো একটা মাস ও হলো না। এখনই তুমি বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লেগেছো!”

“কি আশ্চর্য; তোমার ভাই ঝি মা*রা গেছে বলে কি আমাদের জীবন থেমে থাকবে। পাগলামি করো না তিলোত্তমা! হ্যাঁ, সে আমাদের মাঝে নেই এই নিয়ে আমরা দুঃখিত, খারাপ আমাদের ও লাগছে। তাই বলে কি জীবন থেমে থাকবে। তোমার ভাইয়ের অফিসের কাজকর্ম কি বন্ধ আছে? নাকি তুমি খাওয়া দাওয়া অফ করে দিয়েছো। সেরকম কিছু তো না!”

তিলোত্তমা বেগম উষ্ণের দিকে ধারা*লো দৃষ্টি তাক করে বললেন, “কার জন্য নেই সেটাও তো জানি!”

“অযথা কাউকে ব্লেইম করো না। ভুলে যেও না উষ্ণ আমার ছেলে!”

দীর্ঘ নিঃশ্বাস ছেড়ে নিশ্চুপ হয়ে গেলেন তিলোত্তমা বেগম। এর অর্থ তার কথা বলা শেষ হয়েছে। জাওয়াদ চৌধুরী এবার উষ্ণকে শুধালেন, “তাহলে আগামী সপ্তাহ ডেট ফাইনাল করি?”

উষ্ণ তনয়ার দিকে একবার ফিরে চেয়ে বলল, “আমার কোনো আপত্তি নেই।”

জাওয়াদ চৌধুরী তনয়ার দিকে ফিরলেন। সে প্রথমে বুঝতে পারল না। পরক্ষণেই টের পেয়ে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, “না না, আমার কোনো আপত্তি নেই।”

অতঃপর জাওয়াদ চৌধুরী পরিবারের সকলের সামনে বিয়ের তারিখ ঘোষণা করলেন। বেশি দিন নেই, হাতে গোনা কেবল ১০ দিন। বিয়ে হবে চৌধুরী বাড়িতে। জাওয়াদ চৌধুরী স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, বিয়ের পর দুদিন তাদের ও বাড়িতেই থাকতে হবে। এরপর না হয় তারা নিজেদের বাড়িতে উঠবে। যদিও তিনি চান না উষ্ণ আলাদা থাকুক। কিন্তু উষ্ণ কে আর মানাতে পারছেন না! কথাবার্তা শেষে সকলেই সেখানে ডিনার আরম্ভ
করল!

বিয়ের তোড়জোড় শুরু হয়েছে ভালো ভাবে। তনয়ার বহু দিনের ইচ্ছে ছিল, তার বিয়েটাও সব বিয়ের মতো জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে হোক। মেহমানে বাড়ি ঘর গিজগিজ করবে। মেয়েরা হাত ভরে মেহেদী দিবে, আত্মীয় স্বজনে ঘর জমজমাট। সে লাল রঙের শাড়ি পরে বরের জন্য অপেক্ষা করছে। গুটিকয়েক মেয়ে তাদের জন্য কোমর দুলিয়ে নাচ করছে। কেমন যেন স্বপ্নের মতো সমস্তটা। এখন তার সেই স্বপ্নই পূরণ হতে যাচ্ছে!

বেশ কয়েকদিন ধরে ঘুরে ঘুরে বিয়ের শপিং করেছে। উষ্ণের জন্য বেশ দেখে একটা শেরোয়ানি কিনেছে। নিজের জন্য কিনেছে একটা লাল শাড়ি। ভারী কারুকার্য করা লাল রঙের শাড়ি। শাড়ির পাড়ে সোনালী রঙের লেসের কারুকাজ। পুরো শাড়িতে সোনালী রঙের স্টোন বসানো। একটু সিল্ক টাইপের শাড়িটা। খুব পছন্দ করে এনেছে শাড়িটা। শাড়ি আনবার পর পরই উষ্ণ খেয়াল করছে, বিছানার উপর বসে তনয়া বার বার সেই শাড়ি হাতড়ে দেখছে। তার চোখ জোড়া চকচক করছে। একটু বাদে বাদে শাড়ি গায়ে জড়িয়ে আয়নায় দেখছে। উষ্ণ ফট করে হেসে বলল,

“এতো ইচ্ছে হলে শাড়িটা পরে ফেলো না?”

তনয়া মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, না না, একদম বিয়ের দিন পড়ব। সেদিনই প্রথম পরব। আপনাকে একদম চমকে দিব। দেখবেন আমায় কতো সুন্দর লাগে!”

বলেই আবারো শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে আয়নার সামনে অঙ্গিভঙ্গি শুরু করে দিল। উষ্ণ মৃদু হেসে আবারো কাজে মনোযোগ দিল। সামনে বিয়ে, অফিসের অনেক কাজে মনোযোগ দিতে পারবে না সে। নজর দেবার সময় কই? এদিকে তনয়াকে রেখে ওর মন বসবে বুঝি সেখানে। তাই আগে ভাগেই কাজগুলো এগিয়ে রাখছে।যাতে পরে অসুবিধে না হয়।

চোখ ল্যাপটপ আর ফাইলের উপর গুঁজে থাকলেও মন কিন্তু এখনো এদিকে। তনয়া এবার বিছানায় তার পাশে এসে ঠেসে বসে বলল, “আমাদের জুতো কিন্তু এখনো কেনা বাকি।”

“পরশু যাবো কিনে আনতে!”

“না না, কালই চলুন। পরশু থেকেই তো বিয়ের অনুষ্ঠান শুরু। মেহেদী, গায়ে হলুদ কতোকিছু। আবার পরশু খালারা ও আসবে। এতো মেহমান রেখে আমি বের হতে পারব না।”

“আচ্ছা কালই যাব।”

“বিয়ের দিন আপনি আমায় দুটো ফুলের মালা কিনে দিবেন? ওই যে হাতে চুড়ির মতো ওগুলো।”

“কোনগুলো?”

“দাঁড়ান দেখাচ্ছি!”
তনয়া ছুটে ফোন আনতে গেল। সেকেন্ডের মধ্যে ফিরত এলো। গুগল থেকে ছবি বের করিয়ে দেখাল। উষ্ণ মাথা দুলিয়ে বলল, আচ্ছা আনব।

“গোলাপ ফুলের আনবেন কিন্তু।

“আচ্ছা!

খুশিতে আহ্লাদী হয়ে উঠল তনয়া। একটু বিশ্রাম নেবার ছুতোয় বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিল। কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর শুধায়, “আপনি ও বাড়িতে কখন যাবেন?”

উষ্ণ ঘড়ির দিকে তাকাল। রাত ৮ টার দিকে অনুষ্ঠান। এখন সবে ৭ টা বাজে। ৮ টার দিকে হলেও দেখা যাবে লোকজন আসতে আসতে ১০ টা কি ১২ টা বেজে যাবে। ধনী ব্যক্তিবর্গ তারা। বাবা জাওয়াদ চৌধুরীর পরিচিত কয়েকজন। ছোটখাটো একটা গেট টুগেদারের আয়োজন করেছেন। ছেলেকে সেখানে ডেকেছেন। তাদের বোর্ড অফ ডিরেক্টরের সবাই আসবে। আনুষ্ঠানিকভাবেই এস কে কোম্পানির চেয়ারম্যান পদে উষ্ণ কে বসাবেন বলে ভেবেছেন তিনি। এতো বড় একটা ব্যাপার নিয়ে উষ্ণের মাঝে উত্তেজনা কাজ করছে না। সে শুরু থেকেই জানত, এসব তার! এসবে কেবল তারই অধিকার!

জাওয়াদ চৌধুরী তনয়াকে সাথে নিয়েই যেতে বলেছিলেন। কিন্তু উষ্ণ যাবে না। সে বেশ স্পষ্ট গলায় বলে দিয়েছে, তনয়াকে ও বাড়িতে নেওয়া যাবে না। দরকার পরলে সেও যাবে না। জাওয়াদ চৌধুরী কথা বাড়াননি। তিনি বুঝতে পারছেন না, ইরিশা মা*রা যাবার পরেও উষ্ণ এখনো কাকে ভ*য় পায়। কার প্রতি এতো ঘোর বিদ্রোহ শুরু করেছে সে।

রাত্রির তখন ১০ টা। তনয়াকে বাসায় একা ফেলে উষ্ণ তখন চৌধুরী ভবনে। না, তনয়া একা নেই। জেএস আছে তার সাথে। এই একজনের ভরসায় নির্বিঘ্নে তনয়াকে ও বাসায় রেখে এসেছে সে। তনয়া নিশ্চিত এখন ঘুমিয়ে গেছে। নাকি ফোন করে জানবে। ফোন করার কথা বের করতেই পেছনের ঘাড়ে হাত রাখল একজন। উষ্ণ একটু হকচকিয়েই উঠল। ওহ মিস্টার মির্জা! হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো সে। তার চেয়ে গুনে গুনে ১০ বছর বড় হবে মিস্টার মির্জা। অথচ দেখলে মনে হয়, উষ্ণর বয়সী। তিনি হেসে উষ্ণের সাথে কুশল বিনিময় করে বলে উঠলেন,

“ইয়াং ম্যান! ফাইনালি পার্মানেন্ট ভাবে তাহলে এস কে কোম্পানিকে নিজের নামে করেই নিলে হ্যাঁ!”

উষ্ণ ঠোঁটে তৃপ্তির হাসি। “এসব তো আমারই। জানতাম আজ নয় কাল এসব আমারই হবে।”

“আই লাইক ইউর কনফিডেন্স!”

“অ্যান্ড আই জেলাস এবাউট ইউর ফিটনেস।”

“ওহ নো নো, এতো নজর লাগিও না। এভাবেই ইদানিং ঘন ঘন অসুস্থ হচ্ছি।”

“কি বলেন? আপনি আর অসুস্থ? এখনো দেখলে মনে হয় ৩০ বছরের কোটা পার করেনি!”

মিস্টার মির্জা হো হো করে হেসে উঠেন। সকলে এদিক ফিরে তাকায়। তাকাবেই না কেন? এখন মিস্টার মির্জার তাদের সবচেয়ে বড় ক্লাইন্ট। কেউ কেউ উষ্ণের প্রশংসা না করে পারছে না। জাওয়াদ চৌধুরী ভুল লোককে তাহলে বেছে নেয়নি। শেহনেওয়াজ উষ্ণ চৌধুরীর মতো সঠিক লোককে বেছে নিয়েছে। প্রশংসা করতে করতে মুখে ব্যাথা না হলেও তিলোত্তমা বেগমের কান ব্যাথা হবার জোগাড়। তার মুখখানি ভার। অবশ্যই নিতে পারছে না। জাওয়াদ চৌধুরী একটা চক্ষুশূল। ঠিকই কৌশলে বড় ছেলেকে সব দিয়ে দিচ্ছে। ব্যাপারটা নিয়ে তিনি হইচই করেনি তবে একদম মুখ বুজেও নেয়নি। তার আর জাওয়াদ চৌধুরীর মাঝে ঠান্ডা একটা যুদ্ধ চলছে। এক ছেলেকে সব দিয়ে দিলে চলবে কি করে? তার ছেলে কি জলে ভেসে এসেছে। সবই যদি এক ছেলেকে দিয়ে দেয় তবে তারা কেন রয়েছে? নাটক দেখতে!

অসহ্য! বুকে অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছে! উষ্ণ কে দেখলেই মাথায় র*ক্ত চড়ে যায়। মনে হচ্ছে ইরিশার খু*নি তার সামনে দাঁড়িয়ে। ইরিশাকে ব*ড় আদর যত্নে বড় করেছিলেন তিনি। শোক কাটিয়ে উঠতে পারছেন না এখনো।

এদিকে ঊষাণ চৌধুরী আর ক*টাক্ষ মেনে নিতে পারছে না। অনুষ্ঠানে আত্মীয়র লোকের অভাব পড়তে পারে কিন্তু দুই পয়সার উপদেশ দেবার লোকের অভাব পড়ে না। এরা যেন ওত পেতেই থাকে।

অনুষ্ঠান চলমান। খাওয়া দাওয়ার পর্ব চলছে। একা পাশে বারের ব্যবস্থা ও আছে। ঘুরে ফিরে আজ আবারো তিলোত্তমা বেগম আর উষ্ণ একসাথে। এরা একসাথে মানেই ভয়ং*কর কিছু। দুজনেই সামনে ফিরে ঠান্ডা গলায় কথা বলছে। স্বর যত ঠা*ন্ডা ঝড়ের পূর্বাভাস ততোই ভয়া*বহ!

“আমার একমাত্র বোনঝি কে তবে মেরে*ই ফেললে উষ্ণ!”

“কর্মফল সবাইকে ভোগ করতে হয়। আপনিও করবেন!”

তিলোত্তমা বেগম তাচ্ছি*ল্যের স্বরে বলেন, “কর্মফলের ভ*য় আমায় দেখাচ্ছ? তোমার কর্মফল কে দিবে উষ্ণ!”

“সেটা নিয়ে আপনার চিন্তা না করলেও চলবে।

“কি‌ ভাবছো? মেয়েটার সাথে বিয়ে করে সুখে সংসার করবে। এতো সহজ!”

“আপনি সহজ ছিলেন কবে?”

“খুব কথা বেড়েছে তোমার!”

উষ্ণ কিঞ্চিত হাসল। চোখ ফিরাল দূরের দিকে। ঊষাণ এদিক ফিরে চেয়ে আছে পলকহীন। উষ্ণ মেকি স্বরে বলল, “আহা আপনার ছেলেটাকে দেখলে মায়ায় হয়। আপনি এতো কষ্ট করলেন অথচ আপনার ছেলে কিছু পেলো না।”

তিলোত্তমা বেগম মুখ কঠিন করে ফেললেন। ঊষাণ কিছু একটা আঁচ করতে পেরে এগিয়ে এলো। অনুষ্ঠান তখন প্রায় জমজমাট। আড্ডায় মশগুল একেকজন। ঊষাণ কাছে এসেই হেসে বলে উঠলো,

“আমায় নিয়ে কথা হচ্ছিল বুঝি।”

তিলোত্তমা বেগম কড়া গলায় বললেন, “না তুমি নিজের কাজে যাও।”

উষ্ণ দুই হাত পকেটে ঢুকিয়ে বলল, “হ্যাঁ তেমন কিছু না। এই একটু চাকরি বাকরি নিয়ে কথা হচ্ছিল। আমার অফিসে জুনিয়র স্টাফ হিসেবে তোমার চাকরি জোগাড় করে দিতেই পারি। মন্দ হবে না বলুন!”

তিলোত্তমা বেগমের চোখ থেকে যেন আগু*ন ঝরে পড়ছে। ঊষাণের মনের জ্ব*লন্ত অগ্নি”শিখা হঠৎ করেই যেন দা*নবের রূপ ধারণ করল। সে কাছে এসে উষ্ণ কে জড়িয়ে ধরে বলল, কনগ্রাচুলেশন! অতঃপর স্বাভাবিক ভাবেই বলে উঠলো,

“বাবা তোমাকে বিশ্বাস করে কোম্পানির দায়িত্ব দিয়েছে। আশা করছি তুমিও তোমার মায়ের মতো আমাদের ঠকাবে না। তাই না ব্রো!

উষ্ণের দেহজুড়ে শুরু হলো ক*ম্পন। এক ছিটকায় ঊষাণ কে দূরে ছূ,ড়ে মারল। হঠাৎ সবকিছু শান্ত হয়ে গেল। সবাই গোল গোল চোখ করে তাকাচ্ছে উষ্ণ আর ঊষাণের দিকে। সম্পত্তি নিয়ে দুই ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা তো হবেই। তাই বলে আজ থেকেই শুরু নাকি। উৎসুক মেহমান!

ঊষাণ সকলের সামনেই হেসে উঠল। সকলে আশ্চর্যান্বিত! জাওয়াদ চৌধুরী তিলোত্তমা বেগমের দিকে তী*ক্ষ্ণ নজরে দৃষ্টিপাত করলেন। তিলোত্তমা বেগম ঊষাণের কাছে যেতে উদ্যত হলো। ঊষাণ হাসি থামিয়ে আচমকা বলে উঠলো,

“কি হলো? কথাটা হজম করতে পারলে না। ভুল কি বললাম বলো তো ব্রাদার! তোমার মা তো একজনের হাত ধরে ফুউউউউ!ঠিক তেমনি তুমিও যদি কোম্পানি কারো হাতে দিয়ে ফুউউ হয়ে যাও তখন আমাদের কি হবে?”

জাওয়াদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে চোয়াল শক্ত করে নিলেন। তিলোত্তমা বেগম সেখানেই স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই পুরনো ঘটনা আবারো রটলো। কেউ কেউ জানত আবার কেউ কেউ বিভ্রান্ত ও ছিলো। সত্যিই কি জাওয়াদ চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী পা*লিয়ে গেছিলো নাকি? ফিসফিস শব্দ শোনা গেল। উষ্ণ চোয়াল শক্ত করে দাঁতে দাঁত চেপে আড়চোখে সবাইকে এক নজর দেখে নিয়ে বলল,

“মুখ সামলে কথা বল। নাহলে তোর মুখ ভে*ঙে দিতেও আমার সময় লাগবে না।”

“কেন? সত্য শুনতে কষ্ট হচ্ছে? সবাই তোমার মা কে নিয়ে কথা বলছে, খারাপ লাগছে শুনতে। কি হবে এতো নাটক করে? সবাই তো সব জানে ব্রো! সবাই জানে তোমার মা আমার বাবাকে ফেলে চলে গেছেন। এখন কোথায় কেমন আছে কে জানে?

তিলোত্তমা বেগম দাঁতে দাঁত চেপে বললেন, “ঊষাণ চুপ করো!”

সেই একটা ড্রামা। কৌতূহলী দৃষ্টি যেন এখান থেকে একনজর সরে না। জাওয়াদ চৌধুরী দাঁড়িয়ে মদ্য*পান করছেন। উষ্ণ নিজেকে সামলে নিয়ে গলার স্বর কঠোর করে বলে উঠলো, “ঠিক কোন সত্যির কথা বলছো? কতোটুকু সত্য শোনার মতো ধৈর্য্য আছে তোমার?”

ঊষাণ নিজেকে ধাতস্থ করল। উষ্ণ ও প্রস্তুত হলো ক*ঠিন কিছু বলার মতো। জাওয়াদ চৌধুরী মাঝে পড়েনি। তার প্রথম স্ত্রী কে কেউ অসম্মান করছে, বাপের হয়ে ছেলে প্রতি*শোধ নিচ্ছে। সব কিছু সমান সমান হওয়া দরকার। উষ্ণ জিহ্ব দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে উঠলো, “সবাই তো বলে তুমিও জাওয়াদ চৌধুরীর সন্তান নও। তোমার জন্মদাতা পিতা কে সেটাও কারো জানা নেই। সেই সত্য কি জানা হয়েছিলো তোমার?”

তিলোত্তমা বেগম তেলে*বেগুনে *জ্বলে উঠে জাওয়াদ চৌধুরীর পানে চাইলেন। তিনি বেপরোয়াভাবে ভাবে গ্লাসে নতুন করে ওয়াইন ঢালতে লাগল। সুক্ষ্ম অশ্রু কণা এসে ভিড় করছে ঊষাণের নয়ন জুড়ে। অশ্রু আটকে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করে মায়ের দিকে তাকাল সে। উষ্ণ আশেপাশে সবার দিকে তাকিয়ে ফিরে ব্লেজার ঠিক করল। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে এগিয়ে এলো ঊষাণের কাছে। ঊষাণের কানে কানে ফিসফিসিয়ে বলতে লাগল, যাস্ট বিলিভ মি, আমার কিছু যায় আসে না। তুমি আমার আপন ভাই কি সৎ ভাই। আমার আর তোমার রক্ত এক না হোয়াটএভার ইট ইজ! আই রিয়েলি ডোন্ট কেয়ার। বাট রিমেমবার, সবার সামনে আমার মায়ের চরিত্র নিয়ে কথা বললে তোমার মা কেও আমি ছেড়ে দিব না। আর হ্যাঁ, শেহনেওয়াজ বংশের এক মাত্র উত্তরাধিকারী ছিলো আর থাকবে। এটা কেউ বদলাতে পারবে না। কেউ না!”

উষ্ণ বেরিয়ে গেলো তৎক্ষণাৎ। নাটকের সেই ক্লাইমেক্স এখন শেষ হলো। অতিথিরাও গমন করছে একে একে। ঊষাণ রাগে ধরধর করে কাঁপছে। তার ঠোঁট জোড়া কাঁপছে। বাড়ি উন হওয়া অবধি অপেক্ষা কেবল। অতঃপর ছুটে এলো জাওয়াদ চৌধুরীর কাছে। তার চোখে চোখ রেখে কা*তর স্বরে বলে উঠলো, “আমি তোমার ছেলে নই বাবা?”

তিলোত্তমা বেগম দাঁড়িয়ে আছে ঠোঁট চেপে। অ*হংকার, দম্ভে*র তেজ আজও তাকে ভে*ঙ্গে যেতে দেয়নি। আক্ষেপ শুধু এখানেই, নিজের কিশোর বয়সে যেই ভুল তিনি করেছেন সেই ভুলের মাশুল বুঝি তার ছেলেকেও দিতে হয়। এসব কথা এর আগেও উঠেছিলো। যখন তার আর জাওয়াদ চৌধুরীর বিয়ের ৫ মাসের মাথায় ঊষাণের জন্ম হলো। অনেকের অনেক কথা শোনা গেল।কেউ কেউ বলল, হয়তো বিয়ের আগেই সম্পর্ক ছিলো। এজন্যই বোধহয় প্রথম স্ত্রী চলে গেছে। সকলে সেটাই জানত। তিলোত্তমা মনে প্রাণে চাইত সকলে এই কথা বিশ্বাস করুক! কিন্তু সত্যিটা ঊষাণ কখনোই জানত না। কখনো জানতে দেয়নি। এসবের ভ*য়ে উষ্ণ কে অবধি দূরে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন তিনি।

বাবার জন্য ঊষাণ চৌধুরী একদম পাগল। তার কাছে মায়ের চেয়েও বাবার প্রতি টান বেশি। সবসময় বাবাকে আইডল হিসেবে মেনে এসেছে সে। বাবার মতো হওয়ার চেষ্টা করেছে। এরই প্রেক্ষিতে বোধহয় ঊষাণ আর জাওয়াদ চৌধুরীর চেহারায় খানিকটা মিল পাওয়া যায়। কিংবা অনেকেই বলে, দীর্ঘসময় একসঙ্গে থাকলে ভিন্ন মানুষ দুজনকেও একরকম মনে হয়। জাওয়াদ চৌধুরী ওয়াইনের গ্লাস রেখে ছেলের মাথায় হাত রেখে বললেন, “তুমি আমারই ছেলে!”

বাবার কথায় এবার ভরসা পাচ্ছিলো না ঊষাণ চৌধুরী। কোথাও আক্ষেপ ছিলো। সত্যিটা সে জানত, অনেক আগেই বের করে ফেলেছিলো। কিন্তু এই সত্য মেনে নেবার মনোবল তার ছিলো না। নিজের জীবনের এই ভয়া*বহ স*ত্য প্রতিবারই সে এড়িয়ে গেছে। কেবল ভেবেছে এই সত্য না জানলেও হতো। খুব অ*ন্যায় করে ফেলেছে এ সত্য জেনে। খুব অ*ন্যায়!

তিলোত্তমা বেগম ছেলেকে কাছে ডাকলেন। এলো না। তিনি আগ বাড়িয়ে যাবার আগেই ছেলে চলে গেল। তার থেকে দূরে। খুব দূরে!

——

উষ্ণের মন ছট*ফট করছে। বাড়ি ফেরবার পরেও ছট*ফট করছে। কিছুতেই কমাতে পারছে না সে। কি করে যে ড্রাইভ করে এসেছে সেটাও জানে না। মনে করতে পারছে না। সবকিছু কেবল ঘোরের মতো লাগছে। জেএস কাছে আসতেই কেবল তনয়ার কথা জিজ্ঞেস করল। জবাবে এলো,

“ঘুমাচ্ছে! আপনার কি হলো? এমন অস্থির কেন লাগছে স্যার?”

“কিছু না। তুমি বাসায় যাও।”

জেএস বেরিয়ে গেলো। উষ্ণ ব্লেজার খুলে সোফার উপরে রেখে বেডরুমের দিকে পা বাড়াল। ঘুমন্ত তনয়ার মুখখানি দেখে মন শান্ত হলো তার। সব দুশ্চিন্তা উবে গেল সাথে সাথে। বিছানার কাছে এসে বসে মাথায় হাত বুলাতে লাগল। তনয়া কে একটু নড়েচড়ে উঠল। মুচকি হাসল সে। তনয়া ফট করে এসে তার কোলে মাথা রেখে ঘুম ঘুম স্বরে বলতে লাগল, “চলে এসেছেন এতো জলদি। অনুষ্ঠান শেষ!”

“হুম, তুমি ঘুমাও নি?”

“হ্যাঁ, ঘুমিয়েছি!”

বলেই ঘুমে তলিয়ে গেল। উষ্ণ মুচকি হেসে তাকে আগলে নিল নিজের কাছে!

জুতো কেনার কথা থাকলেও দেখা গেল একসাথে অনেক কিছু কেনা হয়ে গেল। এতো এতো শপিং ব্যাগ হাতের মধ্যে। টুকটাক জিনিস কিনতে গিয়েই সারা দিন শেষ হবার পথে। আপাতত শেষই ধরা যায়। তবুও দেখা যাবে দুদিন পর এটা ওটা দরকার। উষ্ণ হেসে বলল,‌ঠিক আছে। অনলাইন আছে কি করতে? অর্ডার করে দিবা।”

“ইশ অর্ডার করলেই বুঝি ভালোটা পাবো।”

“অবশ্যই পাবা। ভালো ওয়েবসাইট থেকে অর্ডার করবা।‌ আচ্ছা আর কি?”

“আর কিছু না। ফুচকা খাবো।”

“এখন?”

তনয়া মাথা দুলাল। উষ্ণ হেসে মাথা দুলিয়ে বলল, আচ্ছা!”

শপিং মল থেকে তারা বেরুলো। উষ্ণ গাড়ির মধ্যে ব্যাগ গুলো রেখে তনয়াকে উঠতে বলল। তখনি রাস্তার মাঝে একটা মেয়ে প*ড়ে গেল। তনয়া বলে উঠলো, “আরে মেয়েটা!”

উষ্ণ পিছন ফিরল। তনয়া পা বাড়াচ্ছিলো। আরে রাস্তার মাঝে ছোট মেয়েটা কি করছে? ডান বাম তাকিয়ে উষ্ণই ছুটে গেল তাকে তুলতে। মেয়েটা কাঁদছে। উষ্ণ তাকে দাঁড় করিয়ে বলল, “কাদেঁ না আম্মু, তুমি রাস্তার মাঝে কি করছিলে বলো তো? এখনি একটা গাড়ি চা*পা…

গাড়ি চা*পা! সত্যি সত্যি গাড়িটা চা*পা দিয়ে গেল। লোকজনের হাউমাউ শোনা গেল। আহা আহা, মেয়েটার সাথে কি হলো? র*ক্তে ভিজে উঠল মেইন রাস্তা। দোকানপাট থেকে লোকজন ছুটে এলো,‌ শপিং মলের গার্ড অবধি ছুটে এলো। আহা, মেয়েটাকে নির্মমভাবে গাড়ি চা*পা দিয়ে গেল। ইচ্ছে করেই করল এমনটা। নির্ঘাত নেশা করেছে! গাড়ি পেয়ে মানুষ নিজেকে কি ভাবে কে জানে? মানুষের জীবনের কোনো মূল্য নেই!

এসব কথাবার্তা শুনেই থমকে গেল উষ্ণ! পিছন ফিরে তনয়ার রক্তা*ক্ত দেহটা দেখে নিস্তব্ধ হয়ে গেল সে। মেয়েটার মা বাবা কখন এসে তাকে নিয়ে গেছে। কিন্তু কেউ এলো না উষ্ণের কাছে! উষ্ণ নিস্তব্ধ, নির্বাক! তার জীবন যেন ফুরিয়ে যাচ্ছে। এতো এতো মানুষের ভিড়ের মধ্যেও নিজেকে একা মনে হচ্ছে তার। কেউ নেই, কেউ নেই। একজন তো ছিল! এই ছিলে, হেসে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলো। ফুচকা খাবে বলছিলো। কি হলো? কোথায় গেলো। হাঁটতে গিয়ে ভাঙা গ্লাসের মতো মুচ*রে পড়ে গেল উষ্ণ চৌধুরী । শরীরের সমস্ত শরীর যেন চুষে নিয়েছে কেউ। সে পারছে না! তনয়ার কাছে যেতে পারছে না! হাতড়াচ্ছে! হাতড়ে উঠে গেল তার পানে! অতঃপর…..

#চলমান