তোমার সনে বেঁধেছি আমারও প্রাণ পর্ব-০৭

0
15

#তোমার_সনে_বেঁধেছি_আমারও_প্রাণ
#মিমি_মুসকান
#পর্ব_৭

রাতে দেরি করে ঘুমানোর কারণে পরদিন সকালে উঠে অফিসে আসতে আসতে বেশ দেরি হয়ে গেল তনয়ার। আজ সারাদিন বসের সাথে থাকার কথা না থাকলে বোধহয় এতো ভয় পেতো না! অবশ্য একটু ভয়ই করছে। হাঁপাতে হাঁপাতে স্যারের কেবিনের কাছে এসে নক করলো সে। পারমিশন পেতেই ভেতরে প্রবেশ করল। এসেই মুখ খুলে শ্বাস নিচ্ছে সে। উষ্ণ এক পলক তাকে দেখেই বলে দিতে পারবে কতোটা ক্লান্ত সে। তনয়া হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,‌ “সেক্রেটারি বদলে আজ আমি থাকবো স্যার। আমাদের বেরুতে হবে। ৯ টার দিকে আপনাকে ফ্যাক্টরি ভিজিট করতে হবে!”
উষ্ণ নিজের হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, “ওহ! কিন্তু ৯ টা তো বাজে!”
“সরি স্যার আমার আসতে আসতে একটু লেট হয়ে গেছে!”
উষ্ণ ফাইল ঘেঁটে বলল, “ওহ আচ্ছা। তাহলে আপনি একটু বসুন মিস তনয়া। হাতের কাজ টা শেষ করে নিই!”
অনেক ব্যস্ততার সাথে কথাটা বলল উষ্ণ চৌধুরী। তনয়া মাথা নেড়ে পাশের চেয়ারে বসে পড়ল। ব্যাগ থেকে পানির বোতল বের করে ঢকঢক পানি খেলো। অতঃপর খেয়াল করল উষ্ণ স্যার চোখে বিরাট এক সানগ্লাস পরে আছে। রুমের মধ্যে এই সানগ্লাস পরে থাকার অর্থ সে বুঝল না। স্যারের দিকে এতো পাত্তা না দিয়ে আজকের সিডিউল আরো একবার চেক করল সে। হ্যাঁ, আজ তাদের দুটো ফ্যাক্টরিতে ভিজিট আছে। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মচারীদের সাথে দেখা করবেন। এরপর ফুড টেস্টিং। তারপর আবার মিটিং ও আছে। আজ তো তুই গেলি তনয়া। সারাক্ষণ এখন এই ভাদাইম্যার পিছনে ঘুর ঘুর করতে হবে তোকে!

উষ্ণ হাতে কলম নিয়ে নড়াচড়া করছে। মাথা ঝুঁকে আছে ফাইলের উপর। অথচ তার নজর অন্যদিকে। আড়চোখে দেখছে তনয়াকে। তনয়া ঘামছে! ঘেমে একাকার সে। উষ্ণ হাত বাড়িয়ে টিস্যুর কাছ অবধি গেলো কিন্তু পারল না। কোথায় যেন বাঁধা পড়ে গেল। তনয়া ফের তার দিকে ফিরে তাকাতেই ফাইলে মাথা গুঁজল। অথচ মাথার মধ্যে তনয়া ঘুরপাক খাচ্ছে। ১০ মিনিট এভাবে বসে থাকার পর তনয়া অস্ফুট স্বরে বলল, “স্যার!”
উষ্ণ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, “চলো!”

দুজনে বেরিয়ে এলো। প্রথম ফ্যাক্টরি তাদের অফিসের নিচেই আছে। সেটিই আগে দেখতে গেলো উষ্ণ! উষ্ণ ঘুরে ফিরে প্রতিটা কাজ ঠিক করে দেখল। খোঁজখবর ও নিলো। সেখানকার দায়িত্বরত কর্মচারী কিছু বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে এলো। তনয়া সেগুলো স্যারের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “এগুলো কিছু মাস আগেই মার্কেটে লঞ্চ হয়েছে। রিভিউ বেশ ভালো!”
উষ্ণ দুটো বিস্কুট মুখে দিলো। আসলেই তার ভালো লাগল। এদিক ওদিক ঘুরা ফেরার পর হঠাৎ তনয়া উধাও হয়ে গেল। উষ্ণ চোখের সানগ্লাস খুলে এদিক ওদিক তাকে খুঁজছে। মেয়েটা হঠাৎ গায়েব হয়ে গেলো নাকি। অবশেষে তাকে দেখতে পেলো। দূর থেকে দাঁড়িয়েই দেখছে, তনয়া কেক খাচ্ছে। মিনিপ্যাক কেক খাচ্ছে খুব আরাম আয়েশ করে। তার পাশেই সেই কর্মচারী দাঁড়িয়ে। তনয়া বোধহয় তার থেকে আড়াল করছে। উষ্ণ সেখান থেকে চলে এলো। খানিকক্ষণ বাদে তনয়া ফিরে এলো। উষ্ণ আড়চোখে ফিরে তাকাল। তার ঠোঁটের কোণে এখনো কেকের গুঁড়ো লেগে আছে। অতঃপর তারা সেখান থেকে বেরিয়ে পার্কিং লটে আগালো। উষ্ণ গম্ভীর কণ্ঠে বলে উঠল, “তুমি লুকিয়ে কিছু খাচ্ছিলে?”
“না তো স্যার!”
“তোমার ঠোঁটে কিছু লেগে আছে!“
তনয়া হকচকিয়ে উঠে দ্রুত ঠোঁট মুছল। উষ্ণ চৌধুরীর নজর এখনো সরেনি। তনয়া দাঁত বের করে হেসে বলল, “ওই আমাকে টেস্ট করতে দিয়েছিলো।”
ব্যাগ থেকে মিনিপ্যাক কেক বের করে দেখিয়ে বলল,‌ “এই যে চকলেট কেক! আমাদের এই প্রোডাক্ট বাচ্চাদের মাঝে খুব জনপ্রিয়। এর চাহিদা দিন দিন বাড়ছে!“
উষ্ণ কেকের প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল, “তুমি সাথে করে নিয়ে এসেছো?”
তনয়া হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে বলল, “একদম না। এটা আমার নিজের টাকায় কেনা। তখন শুধু ওখানে একটা খেয়েছিলাম। আমি চোর নাকি!”
“এই না বললে টেস্ট করছিলে!”
তনয়া থতমত খেয়ে বলল, “ওই একি! খাওয়া আর টেস্ট আলাদা নাকি। গাড়ি এসে গেছে চলুন!”
বলেই সে আগেভাগে হাঁটা ধরল। উষ্ণ মুখ টিপে হাসছে। তনয়া ভয় পেয়ে ঘাবড়ে গেছে!
.
গাড়ির পিছনে সিটে উষ্ণ চৌধুরী বসে পড়ল। এদিক ফিরে দেখলো তনয়া সামনে ড্রাইভারের সাথে বসছে। সে ছোট ছোট চোখ করে ফিরে তাকাল তার দিকে। তনয়া সিটে বসে কিছু কাগজপত্র তার দিকে এগিয়ে বলল, “স্যার এগুলো একটু দেখুন?”
উষ্ণ কাগজপত্র হাতে নিয়ে চাঁপা স্বরে বলল, “তুমি ওখানে কি করছো?”
তনয়া খানিকটা অবাক হলো। স্যার কি বলতে চায়? তার সাথে গিয়ে বসতে। এই বেডার ধান্দা কি আদৌও। স্পষ্ট স্বরে জবাব দিলো, “আপনার সেক্রেটারি তো এখানেই বসতো স্যার!”
উষ্ণ সিটে হেলান দিয়ে বসে পড়ল। বলল,‌“ও তো গাড়ি ড্রাইভ করতো!”
তনয়া মুচকি হেসে বলল, “আমি তো ড্রাইভ করতে‌ জানি না স্যার। কিন্তু যদি আপনি বলেন করছি এরপর কব’রে গেলে আমায় দোষারোপ করা যাবে না!“

বলেই সোজা হয়ে বসল। ড্রাইভার সাহেব এদিক ওদিক ফিরে তাকাচ্ছে। এদের ভাবসাব সে বুঝছে না। তার বয়স কম! বেশি না। কালো, লম্বা ছেলেটা ভীষণ চুপচাপ! তনয়ার দেওয়া ঠিকানা মত সে কেবল গাড়ি চালাতে লাগল। উষ্ণ চোখ মুখ শক্ত করে এদিকে তাকিয়ে আছে। তার চোখের সানগ্লাস এবার খোলা। সিটে হেলান দিয়ে বসে পা নাড়াচ্ছে। একটু বাদে বাদে সামনের সিটে তাকাচ্ছে। খানিকক্ষণ বাদে বাদে নিজের ঠোঁট কামড়ে ধরছে। কখনো হাতের আঙুল! এই রাস্তা এতো দীর্ঘ কেন? হাঁসফাঁস লাগছে নিজের কাছে!

তনয়া চুপচাপ বসে নেই। টুকটাক কথা বলছে ছেলেটার সাথে। বয়সে সে তাঁর ছোটই হবে। ছোট ভাইয়ের মতো! ছেলেটা ভীষণ চুপচাপ। আগ বাড়িয়ে কিছু বলছে না। তনয়া যা জিজ্ঞেস করছে এক কথায় সেসবের উত্তর দিচ্ছে। তবুও উষ্ণের গা পিত্তি জ্বলে যাচ্ছে। তাঁর পাশে বসলে নিশ্চিত তনয়া তাঁর সাথেও কথা বলতো। ড্রাইভার আনাই ভুল হয়েছে। বিরক্ত চোখে মুখে বাইরে তাকিয়ে রইল। এখানে তার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!

গন্তব্যে এসে পৌঁছাল তারা। আগের থেকে এই ফ্যাক্টরি বড়। এখানেও প্রোডাক্টের কমতি নেই। পুরো ফ্যাক্টরি ঘুরে দেখতে গিয়ে উষ্ণের বেহাল দশা। তার সাথে তনয়ারও। প্রায় দুপুর তিনটে বেজে গেছে। এখান থেকে বেরিয়ে আবার দুটো মিটিং আছে। এসব ভাবতেই উষ্ণের বিরক্ত লাগছে। আবার তনয়া পাশে বলে ভালোও লাগছে। ফের তাঁরা গাড়িতে চড়ল। তনয়া এবারও ড্রাইভারের পাশের সিটে বসল। উষ্ণ মুখ বেজার করে অন্যদিকে চেয়ে আছে। তার বেজার মুখখানা সামনের আয়নাতে দেখে তনয়া শুধালো, “স্যারের কি খুব খিদে পেয়েছে? এমন মুখ করে রেখেছেন যে?“
উষ্ণ মাথা দুলিয়ে বলল, “হ্যাঁ, একটা ভালো রেস্টুরেন্টে চলো। আগে খেয়ে নিই এরপর অফিসে যাবো!”
“হাতে সময় আছে। আপনার মিটিং ৪ টার দিকে! তাহলে একটা রেস্টুরেন্টে যাওয়া যাক!”
অতঃপর গাড়ি এসে থামল একটা রেস্টুরেন্টে সামনে। দুপুরের লাঞ্চ দুজনে একসাথেই সেরে নিল। তনয়ার পুরো মনোযোগ খাবারের উপরেই ছিলো। খিদেও পেয়েছিলো বেশ। উষ্ণ স্যার বার বার তার দিকে আড়চোখে ফিরে চাইছিলো সে খেয়াল তাঁর নেই। দুজনে প্রথমবার একসাথে কোথাও খেতে এসেছে। উষ্ণ চৌধুরী মন পুলকিত হয়ে উঠল। খাবারের দিকে ফিরে মৃদু হাসল সে। দুজনে মুখোমুখি! তনয়া ফিরে তাকাল। উষ্ণের মুখে হাসি দেখে শুধালো, “খাবার কি আপনার পছন্দ হয়েছে স্যার? এটা আমার ফেভারিট রেস্টুরেন্টের মধ্যে একটা! এখানকার খিচুরি এতো মজা আপনি বিশ্বাস করবেন না! তবে কাচ্চি ও অনেক মজা!”
বলেই আবারো সে খাবারে মনোযোগ দিলো। উষ্ণ হাসতে গিয়ে থেমে গেল। কিন্তু পারল না। তার মনের খুশি আজ চেপে থাকতে চাইছে না।
.
অফিসে ফিরল দুজন। তনয়া ফাইল হাতে তার আগে আগে হাঁটছে। পরনে তার হালকা সবুজ রঙের থ্রি পিস। উষ্ণ পিছন পিছন হেঁটে যাচ্ছে। খেয়াল রাখছে তার পায়ের দিকে। তনয়া হাঁটছে আর বলছে। আচমকা সে উষ্টা খেয়ে প’ড়ে যেতে নিল। তখনি কেউ তার কোমর আঁকড়ে ধরল। তনয়া বিস্মিত চোখে সামনের দিকে চেয়ে রইল। দুই হাতে ফাইল জড়িয়ে রেখে সামনে চেয়ে রইল কেবল। তার কোমরে কারো‌ হাত এটা বার বার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে তাকে। তনয়া শুকনো ঢোক গিলল। তার দৃষ্টিতে কেবল বিস্ময়। প্রথমবারের মতো চোখাচোখি হলো দুজনার। এক প্রান্তের দৃষ্টি এসে মিলল অন্য প্রান্তের দৃষ্টিতে। ক্ষণিকের এই মিলনে হৃদয়ের মিলন কতদূর? উষ্ণ কিঞ্চিত হেসে বলল, “ঠিক করে হাঁটতে পারো না? আরেকটু হলেই যাচ্ছিল তোমার কোমর!”
তনয়া ধড়মড়িয়ে উঠে দাঁড়াল। কি অস্বস্তিকর পরিবেশ। অস্বাভাবিক গলায় বলল, “আমি ঠিক আছি স্যার!“ বলেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। উষ্ণ তার হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। তাঁর প্রথম ছোঁয়া ছিল আজ। এতোদিন কেবল দূর থেকেই দেখছিলো আজ প্রথমবার তাকে ছুঁইয়ে দেখল। তার বিশ্বাস হচ্ছে না। ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসল। ল্যাঙ মে রে তাহলে ভালো কাজ করেছে সে!

সেক্রেটারি জেএস ফোন করতেই উষ্ণ রিসিভ করল। সে নিচু স্বরে বলল, “স্যার..
“হ্যাঁ তোমাকেই ফোন করতে যাচ্ছিলাম। পেটের অবস্থা এখন কেমন? ঠিক আছো?”
লজ্জায় সে মাথা নামিয়ে ফেলল। যদিও সে স্যারের সামনে না তবুও তার লজ্জা লাগছে। হতাশা নিয়ে বলল, “জি স্যার সুস্থ আছি।”
“তোমার গলা শুনে তো মনে হচ্ছে না তুমি সুস্থ আছো? আচ্ছা যাও তোমার ছুটি বাড়িয়ে তিনদিন করলাম। রেস্ট নাও!”
“না না না স্যার আমি ঠিক… কথা সমাপ্ত করার আগেই ফোন কেটে দিলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেলে ফোনের দিকে চেয়ে আছে। ভয় হচ্ছে! এই তিনদিনের ছুটি না তিন জনম পেরিয়ে যায়। আদৌও সে চাকরিটা করতে পারবে তো!

#চলবে