#তোর_নামেই_শুরু
#তানজিনা_তিহা (লেখনীতে)
#পর্ব_১২
তার নেকামি আর সইছে না ভাইয়ার দিকে তাকালাম। তিনিও হয় তো এই ঘটনার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। আমি রাগে গজগজ করতে করতে ক্লাস রুমের দিকে পা বাড়ালাম।
পিছন থেকে ভাইয়া ডাকছে, মেঘা শোন!
ভাইয়ার কথার কোন পাত্তা না দিয়ে ক্লাসের দিকে চলে গেলাম। ভাইয়া অনেক বার ডেকেছে আমি পিছন ফিরে একবারও তাকাই নি। মনে মনে অভিমানের পাহাড় গড়ছি। সে কি আমায় বুঝে না? আমার অনুভূতিগুলো যে বদলে গেছে! আমার পথচলা যে তাকে ঘিরে! এটা কি একটুও বুঝে না সে? আমি যে তাকে ছাড়া আর থাকতে পারবো না। তাহলে এমন কেন?
পিছন থেকে বারবার মেঘাকে ডেকে চলেছে রিশান। কিন্তু মেঘা কি তা কানে নেয়? সে মুখ ফুলিয়ে সামনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। রিশান খুব ভালো করেই বুঝতে পারছে তার মেঘপরি তার উপর রেগে গেছে। তার মেঘপরি কি তাকে ভালোবাসা শুরু করে দিলো? ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলো তার। মেঘার পিছু পিছু যেতে নিলো সে। কিন্তু হঠাৎ তার ফোনটা বেজে উঠলো। সে থমকে দাড়ালো। আননাউন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে!
হ্যালো। কে বলছেন?
ওপাশে: আমাকে চিনবা না বাবা। আমি একরাম চাচা কইতাছি।
জ্বি, বলুন। কার কাছে ফোন করেছেন?
ওপাশে: অনেক কিছু কওয়ার আছে বাবা। মেঘা মার কিন্তু সামনে অনেক বিপদ।
কি বলছেন আপনি? কে আপনি?
ওপাশে: আমি মেঘা গো বাড়ির পুরান চাকর। মেঘা গো বাড়িতে কাজ করতাম। কিন্তু সাহেব মারা যাওয়ার পর ওন থেইকা আইয়া পড়ছিলাম।
আপনি এখন কোথায়?
ওপাশে: আমি এহন ……. আছি। মেঘা গো বাড়ি থেইকা একটু পিছনে।
আচ্ছা আমি আসছি।
মেঘার বিপদ? কি বলছে সে?
ক্লাসে এসে বসলাম। একদমই ভালো লাগছে না। হঠাৎ রুহি কোথা থেকে এসে আমার পাশে বসে পড়লো।
কি রে কি হয়েছে?
না কিছু না।
মন খারাপ?
হুম।
কেন?
রুহি আমি রিশান ভাইয়াকে ভালোবাসি। কিছু না ভেবেই একদমে বলে দিলাম আমি।
রুহি আমার দিকে বড় বড় চোখ করে তাকিয়ে আছে।
তুই রিশান ভাইয়া কে ভালোবাসিস? আগে বললি না তো? ভাইয়া জানে?
জানি না। আমি তাকে ভালোবাসি। খুব বেশি ভালোবাসি। আমি তাকে ছাড়া থাকতে পারবো না। কিন্তু কিন্তু
কিন্তু কি?
ভাইয়া কি আমাকে ভালোবাসে?
রুহি আমার মুখ ওর দিকে ফিরিয়ে দিয়ে বললো,
মেঘাকে ভালোবাসবে না? এটা ইম্পসিবল! তোর মতো একটা মিষ্টি মেয়েকে কেউ কখনো না পছন্দ করে থাকতে পারবে না। দেখবি ভাইয়াও তোকে ভালোবাসে। আর জানিস যখন তোকে পাওয়া যাচ্ছিলো না ভাইয়া তো পাগল হয়ে গিয়েছিলো। আই থিংক ভাইয়া তোকে আগে থেকেই ভালোবাসে!
রুহির কথা শুনে ভাবনার জগতে ডুবে গেলাম। ভাইয়া কি আমাকে ভালোবাসে?
ক্লাস শেষ বাড়ি ফেরার সময় হয়ে এসেছে। কিন্তু রিশান ভাইয়াকে দেখছি না। তিনি কোথায়? ভার্সিটিতে নেই? ভাইয়া খুঁজে খুঁজে ক্লান্ত। পুরো ভার্সিটিতে দেখেছি কিন্তু ভাইয়া নেই!
মন খারাপ করে একাই বাসায় ফিরে আসলাম। বাসায় আসতেই খেয়াল হলো ছোট মায়ের মলিন মুখটা। ছোট মা মুখ মলিন করে রেখেছেন। কি হয়েছে ওনার? বাড়িতে প্রবেশ করে দেখতে পেলাম নিরব ভাইয়া সাথে তার বাবা মা। সবাই সোফায় বসে আছেন। ফুফা তাদের সাথে টুকিটাকি কথা বলছেন।
ছোট মা ওনারা কেন এসেছেন?
ছোট মা হলকা হাসার ভান করে বললেন, তোর বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছে। নিরব নাকি তোকে ভালোবাসে।
কি!!! আমার বিয়ে? নিরব ভাইয়া আমাকে ভালোবাসে?
হ্যাঁ, মা।
বলে ছোট মা চলে গেলেন। আমি কি করবো বুঝতে পারছি না। আমি রিশান ভাইয়াকে ভালোবাসি। আমি তো তাকে চাই। ভাইয়া! রিশান ভাইয়া কোথায়? সে কি জানে না? এগুলো কি হচ্ছে? দৌড়ে রিশান ভাইয়ার ঘরে চলে গেলাম। রিশান ভাইয়া কিছু বলবে না এদের? এরা কেন এসেছে? ঘরে যেয়েই বলতে শুরু করলাম,
ভাইয়া ওরা কেন এসেছে? ওদের চলে যেতে বলো।
কিন্তু ভাইয়া তার ঘরে নেই! কোথায় উনি? এখন কি হবে? বেলকনিতে খুঁজতে গেলাম। তিনি সেখানেও নেই। তবে কি ভাইয়া বাড়ি নেই? শুনতে পাচ্ছি নিচ থেকে ছোট মা ডাকছে।
মেঘা মা এদিকে আয় তো।
এখন কি করবো আমি? ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে আসতে নিবো তখনই চোখে পড়লো সেই দিনের সেই খয়েরি রঙের ডায়েরি টা। বিছানার এক কোণে পড়ে আছে। ডায়েরিটা দেখে বেশ কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। ডায়েরিটা হাতে নিয়ে কাঁপা কাঁপা হাতে সেটা খুললাম। প্রথম পাতা একদমই খালি। পরের পাতায় ভাইয়ার নাম ঠিকানা আর তার পছন্দ সম্পর্কে লেখা। এরপরের পাতা খুলতেই আমার চোখ কপালে উঠে গেল। হাত পা জমে হীম হয়ে গেলো। কারণ পরের পাতাখুলতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো আমার ছবি! আমার সেই ছোট্ট বেলার ছবি। খুব যত্ন করে রেখে দেওয়া হয়েছে। পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পরের পাতায় ভেসে উঠলো বড় করে লেখা মেঘপরি! আমি হা হয়ে গেলাম। ভাইয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলাম। ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে পড়লাম।
ডায়েরির পাতায় মুখ ডুবিয়ে দিলাম।
মেঘপরি! তোকে আমি বোন বলতে পারবো না। লিসা, তাহিয়া, হীমা ওদের সাথে তোকে মিলাতে পারবো না। কেন জানি ওদের আসনে বসাতে পারবো না তোকে। তুই আমার বউ! আমার একমাত্র বউ। তোকে বউ কেন বলছি তা আমার অজানা! এতটুকু জানি তুই শুধু আমার।
কয়েক পাতা উল্টিয়ে দেখতে পেলাম,
মেঘপরি! তুই কি জানিস তোকে কতটা ভালোবাসি? তোমাতে কতটা বিভোর আমি? আমার থেকেও বেশি চাই তোকে। ইস আস্তে আস্তে তো তুই বড় হয়ে যাচ্ছিস। কত সুন্দর হয়েছিস তুই। মনে হয় একদম বুকের ভিতর লুকিয়ে রাখি। আমার মেঘপরি তুই শুধু আমার! ইস কবে যে আমার হবি।
যত পড়ছি ততই অবাক হচ্ছি। এগুলো ভাইয়া লিখেছেন? সত্যি তো ভাইয়ার লেখা? বুকের ভিতর এলোপাথাড়ি ঢেউ বইছে। এগুলো আমার আশার বাহিরে ছিলো!
আমার মেঘপরিটা তো বড় হয়ে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে কতটা বছর কেটে গেলো। আমার মেঘপরি এখন বড় হচ্ছে। আমার মেঘপরি কবে আমার হবে? কবে আমাকে ভালোবাসবে? কবে আমার হবি তুই?
ভাইয়া এগুলো কেন লিখছে? ভাইয়ার কি মাথা পাগল হয়ে গেছে। আরো আগ্ৰহ নিয়ে পড়ের পৃষ্ঠায় দেখলাম।
মেঘপরি! আজ অনেক কেঁদেছিস। কাঁদবিই বা না কেন? মামা মামি তোকে ছেড়ে চলে গেছে আজ। কীভাবে কি হলো বুঝতে পারলাম না। অনেক কষ্ট হচ্ছে রে। তোর কান্না সহ্য হচ্ছে না। প্লিজ আর কাঁদিস না।
,
মেঘপরি! ছোট মামাকে অনেক কষ্টে রাজি করালাম রে। আজ থেকে তুই আমাদের সাথেই থাকবি। প্রতি দিন দেখবো তোকে। প্রতিটা মূহুর্ত আমার চোখের সামনে থাকবি তুই। আমার মেঘপরি আমার কাছে থাকবে। আমার বুকের মাঝে!
পরের পাতা উল্টিয়ে দেখলাম,
মেঘপরি! ঘুমোলে এতো কিউট লাগে তোকে? এতো মায়াবী কেন তুই? জানিস আজকে একটা মিস্টেক হয়ে গেছে রে। আমি চাই নি তারপরও হয়ে গেছে। রাতে তোকে দেখতে গিয়েছিলাম। ঘুমিয়ে পড়েছিলি। আমি না আমার পরিটার থেকে নিজেকে দূরে রাখতে পারি নি। তোর গালে আর ঠোঁটে চুমু খেয়ে বসেছি। সরি রে। বিয়ের আগে এসব করতে চাই নি। কিন্তু! সরি মেঘপরি!
আমার চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। কি লিখছে এগুলো ভাইয়া? লজ্জায় লাল হয়ে যাচ্ছি বারবার।
পরের কয়েকপাতা উল্টে দেখতে পেলাম,
বড় হচ্ছিস তুই! এখন নিজের ভালো মন্দ বুঝবি না। উঠন্ত বয়স তোর! শোন নিজের মনের ইচ্ছেকে কখনো প্রাধান্য দিবি না।
এর পরের পৃষ্ঠায় দেখলাম,
মেঘপরি! তুই তো অনেক বড় হয়ে গিয়েছিস! কিন্তু ছিঁচকাদুনে স্বভাবটা আর গেলো না। সেই ছোট্টই রয়ে গেলি। কলেজে পড়ছিস। কিন্তু আমাকে কি একটি বারও বুঝতে পারিস নি? আমি কি এতোটাই অযোগ্য? আমার অনুভূতিগুলো কেন বুঝিস না? এগুলো তো সব তোকে ঘিরেই।
এর কয়েক পৃষ্ঠা উল্টিয়ে দেখতে পেলাম,
মেঘপরি! আজ নিহা আমাকে প্রোপোজ করেছে। কি করবো বল তো? আমি তো তোকে ভালোবাসি। ও বলেছে ও আমাকে না পেলে নাকি আত্মহত্যা করবে! এখন কি করবো আমি?
,
উফ, নিহার টর্চার আর ভালো লাগে না। ইমোশনালি ব্ল্যাকমেইল করে ও। যতই দূরে সরে থাকি মেয়েটা ততই কাছে ঘেঁষে।
কয়েক পাতা উল্টিয়ে দেখলাম,
আজ তুই ভার্সিটিতে যাবি। বাবা কে বলে আমার ভার্সিটিতেই তোর ভর্তির ব্যবস্থা করলাম। এখন বাসায় ভার্সিটিতে সব জায়গায়ই আমার চোখের সামনে থাকবি তুই। অনেক ভালোবাসি রে মেঘপরি।
,
মেঘপরি! আমাকে এতো ভয় পাস কেন তুই? তুই কি বুঝিস না তোকে ভালোবাসি? তোকে আমি মন প্রাণ উজাড় করে ভালোবাসি। তোকে ছাড়া আমি শূন্য। #তোর_নামেই_শুরু হতে চাই আমি। #তোর_নামেই_শুরু হোক আমার প্রতিটি দিন। আমি যে তোকে ভালোবাসি। তুই কবে বুঝবি? #তোর_নামেই_শুরু আমি! তোকে ছাড়া থাকাটা আমার সম্ভব না রে।
,
আজ মাকে তোর কথা বলে দিয়েছি। জানিস মাও খুশি হয়েছেন। এখন আর কি বল? তোকে নিজের করে পাবো তো? মা বলেছে ছোট মামার সাথে কথা বলবে। উফ আমার যে আর সইছে না? কবে আমার হবি? আমার আকাশে আমার দুনিয়ায় শুধু তুই।
,
ছোট মামার সাথে কথা বলা শেষ। তিনি কোন দ্বিমত পোষণ করেন নি। সবাই খুশি হয়েছে। তুই আমার এখন শুধু তোকে বলার পালা। তোকে ভালোবাসি মেঘপরি!
,
বাচ্চামি কি আর কোন দিন যাবে না তোর? এতো বড় হয়ে গেলি এরপরও বাচ্চাদের মতো কেন করিস? রাগলে তোর মুখটা না টমেটোর মতো ফুলে উঠে তখন তোকে কিন্তু বেশ লাগে।
,
কেন বুঝিস না আমাকে? আমি শুধু তোকে বকি? কিন্তু কেন বুঝিস না তোকে আমি তোর ভালোর জন্যই বকি। আমার সব কিছু তো তোকে ঘিরেই। #তোর_নামেই_শুরু হতে চাই আমি। জানি না আমার এই অপেক্ষার প্রহর শেষ হবে কিনা। পাবো কি তোকে?
,
জানিস আজ কি মনে হচ্ছে আমাকে কখনো তুই বুঝবি না। আমার অনুভূতি গুলো এই ডায়েরির পাতায় সবার চোখের আড়ালেই রয়ে যাবে। কখনো এগুলো প্রকাশ করতে পারবো না। তোকে ঘিরে রাখা অনুভূতিগুলো স্মৃতির পাতায় ই রয়ে যাবে। তোকে ঘিরে সেই স্বপ্নগুলো হয় তো আর পূরণ করতে পারবো না রে। কিন্তু আমি চাই তুই ভালো থাক। ভালোবাসি রে মেঘপরি। তোর ভালোবাসার অপেক্ষায় থাকবো সারাজীবন।
ডায়েরির প্রতিটা পাতায় লিখিত শব্দগুলো আমার মনে শিহরণ জাগিয়ে দিচ্ছে। রিশান ভাইয়া আমাকে এতো ভালোবাসে? মানুষটাকে আমি কখনো বুঝলাম না? আমি তাকে একটা বারও বুঝার চেষ্টা করলাম না। নিজেকে আজ অসহায় মনে হচ্ছে। হাত থেকে ডায়েরিটা পড়ে গেলো। দরজা খুলে দৌড়ে ছোট মায়ের কাছে চলে গেলাম। ছোট মাকে জরিয়ে কান্না শুরু করে দিলাম। অনেক কষ্ট দিয়েছি তাকে আমি। আর সে আমাকে নিরবে ভালোবেসে গেছে!
চলবে…….