তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০৩ এবং বোনাস পর্ব

0
44

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৩

আলিশা ও জায়ানের দেখা-সাক্ষাতের পর কয়েকদিন কেটে গেছে। কিন্তু সেই কয়েকটা দিন যেন দীর্ঘ কয়েকটি বছরের মতো ভারী।
বিয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ, কিন্তু সেটিকে মনের ভেতরে গেঁথে নেওয়া অতোটাও সহজ নয়। তবুও যে সিদ্ধান্ত একবার নেওয়া হয়ে গেছে সেখান থেকে পিছিয়ে আসা যাবেনা। ওদিকে…এনায়েত সাহেব ভেবেছিলেন তার ছেলে হয়তো বিয়ে নিয়ে ঝামেলা করবে কিন্তু এত সহজেই সব মেনে নিয়েছে দেখে ওনার মনে কেমন সন্দেহ জাগছে। জায়ানের মা তো বেজায় খুশি, অনলাইন থেকে তিনি সুন্দর কয়েকটা শাড়ি পছন্দ করেছেন, একটু আগেই সেগুলো ডেলিভারি দিয়ে গেছে। বসার ঘরে সোফার কোণে বসে অর্ডার করা শাড়ির প্যাকেট খুলে দেখে সোনালী পাড়ের হালকা পিঙ্ক শাড়িটা ছেলের বউয়ের জন্য বেছে রাখলেন। জায়ান তা দেখে মজার চলে বললো…

‘তুমি তো এমনভাবে শাড়ি বাছাই করছো, যেন নিজের বিয়ের জন্য শপিং করছো?’

কাবেরী বেগম হেসে উঠলেন…

‘হবু শাশুড়ি তার হবু বৌমার জন্যে শাড়ি বাছাই করছে বুঝলি? আমার সেই ছোট্ট জায়ানের যে বিয়ে হচ্ছে এটাই আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছেনা!’

পাশেই এনায়েত সাহেব বসেছিলেন, মা ছেলের এই সুন্দর মুহূর্তকে উনি এক ঝটকায় উড়িয়ে দিয়ে গম্ভীর স্বরে ছেলেকে প্রশ্ন করে বসলেন…

‘ তুই বিয়ের দিন আবার কোনো ঝামেলা করার তাল করছিস না তো?’

স্বামীর কথায় কাবেরী বেগমের হাসি মিলিয়ে গেলো…

‘ তুমি আবার এ কেমন কথা বলছো? জায়ান তো আলিশার সঙ্গে দেখা করে বিয়েতে রাজি হয়েছে’

‘ তুমি কি তোমার ছেলেকে চেনো না? এক কথায় কোনোদিন কোনো কাজ করেছে ও? সেখানে বিয়ের জন্যে রাজি হয়ে গেলো। দেখ জায়ান, আমি জানি তুই আমার সম্মানের কথা ভাবিস না কিন্তু এমন কিছু করিস না যাতে ওই মেয়েটার কোনো অসম্মান হয় ‘

এনায়েত সাহেব বরাবরই জায়ানের সঙ্গে এভাবে কথা বলেন, তিক্ত ভাবে! ছোটবেলায় খারাপ লাগলেও এখন এসবে আর পাত্তা দেয়না জায়ান, একরকম অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জায়ান কিছুটা হেসে বললো…

‘ এতদিন বলতে আমি অবাধ্য, এবার বাধ্য ছেলের মত কাজ করতে যাচ্ছি তাতেও তোমার সন্দেহ হচ্ছে? আসলে আমি যাই করি না কেনো, তোমার কোনোদিনই ভালো লাগবেনা বাবা ‘

ভেবেছিল মায়ের সঙ্গে একটু সময় কাটাবে কিন্তু বাবার কথা শোনার পর ওখানে আর দুদণ্ড বসে থাকার ইচ্ছে হলো না ছেলেটার, উঠে চলে গেলো ওখান থেকে। গভীর রাত…আলিশা একা নিজের ঘরে। পুরনো একটা স্যুটকেস খুলে বসেছে। ভেতরে আছে কিছু স্মৃতি! প্রাক্তনের লেখা চিঠি, ছোট্ট একটা পারফিউম, হাতে বানানো কার্ড, একটা পুরনো টিকিট। চোখে পানি এসে যায় ওর, চোখ বন্ধ করেই ভাবে…

‘কতটা সহজে কেউ কাউকে ভুলে যেতে পারে?’

চোখের পানি মুছে, সে এক এক করে জিনিসগুলো বের করলো। এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আলিশা সব জিনিস একে একে তুলে এনে জানালার পাশে রাখা ছোট ট্র্যাশবিনে ফেলে দিলো। গলাটা ভারী হয়ে এলো, কিন্তু ঠোঁটের কোণে একরকম মুক্তির ছোঁয়া! কিছুই স্থায়ী নয়, এমনকি স্মৃতিও নয়! আজকেও সে নিজের মনকে হারাতে দিলো না। রুমে ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেই নিজেকে বললো…

‘আমি মোটেই দুর্বল না, আমিও নতুন করে শুরু করতে পারি’

আলিশা নিজের অতীতের সব স্মৃতি ধুয়ে মুছে ফেলতে ব্যস্ত ওদিকে জায়ানের চোখেও ঘুম নেই। কয়েকবার ফোন হাতে তুলে বিছানায় শুয়ে ফোনে আলিশার নাম সার্চ করে আবার বন্ধ করে দেয়, কিছুক্ষণ এমন করতে করতে একসময় আলিশার ফেসবুক আইডি একটু ঘেঁটে দেখলো। অল্প কিছু ছবি ও পোস্ট ব্যতীত আইডিতে বিশেষ কিছু নেই, জায়ান সাধারণত মেয়েদের আইডি স্টক করেনা কিন্তু আলিশার আইডি দেখার ইচ্ছে জেগেছিল। হয়তো মেয়েটাকে জানার একটা ইচ্ছা জাগছে মনে!
___________________________________

একটা ফাইল সাইন করানোর জন্যে সায়নের কেবিনে এসেছিলো মেঘনা, সেদিনের পর সায়নের সঙ্গে সেভাবে আর কোনো কথা হয়নি। ফাইল সাইন করতে করতে সায়ন বললো…

‘ সেদিন আপনি অনেক বিরক্ত হয়েছিলেন তাইনা? আপনার অফ ডে আমার জন্যে নষ্ট হয়ে গেলো ‘

মেঘনার যদিও খুব বলতে ইচ্ছে করেছিলো হ্যাঁ, নষ্ট হয়েছে কিন্তু বসের মুখের ওপর কি আর এমন কথা বলার দুঃসাহস আছে?

‘ না স্যার! বরং আপনার জন্যেই সেদিন ওই ক্যাফের নতুন কিছু আইটেম ট্রাই করতে পেরেছিলাম ‘

‘ হুমম! আমার ছোটো ভাইয়ের বিয়ে সামনের সপ্তাহে, আপনাকেও সেখানে কিছু কাজ করতে হবে ‘

‘ বাহ! জায়ান স্যার বিয়ে করছেন? খুবই ভালো খবর! অভিনন্দন স্যার, কিন্তু বড় ভাই থাকতে ছোটোজনের বিয়ে আগে কেনো হচ্ছে?’

‘ বড় ছেলের আগে ছোটো ছেলের বিয়ে হওয়া কি অপরাধ?’

‘ সরি স্যার! আমি সেভাবে বলতে চাইনি। সাধারণত বড়জনের বিয়েই তো আগে দেওয়া হয়’

‘ আপনার কি সামনে বিয়ের প্ল্যান আছে?’

বসের এমন অকস্মাৎ প্রশ্নে মেঘনা কিছুটা বিচলিত হয়ে পড়লো…

‘ আমার? ন..না। আমার দু – এক বছরের মধ্যে বিয়ের প্ল্যান নেই। তাছাড়া এতো কাজের চাপ মাথায় নিয়ে সংসার কিভাবে করবো!’

‘ গুড! আমারও আপাতত বিয়ের ঝামেলায় জড়াতে চাইছি না। যাই হোক, কালকে থেকে অফিসে একটু টাইম কম দিলেও সমস্যা নেই। আমার বাসায় চলে যাবেন, আমার মাকে একটু হেল্প করবেন বিয়ের কাজে ‘

‘ ঠিক আছে স্যার!’

মেঘনা দ্রুত ফাইল নিয়ে বেরিয়ে এলো, কিন্তু ভেবে পাচ্ছেনা ওর বিয়ের প্ল্যান নিয়ে সায়ন হঠাৎ আগ্রহ কেনো দেখাচ্ছে? ওদিকে…আলিশা একটু বাইরে গেছিলো, ওর বান্ধবীরা বিয়ের আগেই ট্রিট চেয়ে বসে আছে তাই ওদের ছোটখাটো একটা ট্রিট দিতে গেছিলো। বাসায় ফিরে মাকে দেখে অবাক হলো আলিশা!

‘ আম্মু! তুমি কখন এলে?’

‘ একটু আগেই এসেছি, মেয়ের বিয়েতে কি কাজ না করে শুধু গেস্ট হিসেবে খেয়ে যাবো? তাছাড়া আদিল আর তোর বাবা পুরুষ মানুষ, ওরা দুজনে এক হাতে পারবে নাকি সব করতে?’

‘ ভালোই হয়েছে তুমি এসেছো, এমনিতেও আমার কোনো প্রয়োজন হলে সেই তোমাকেই ফোন করতে হতো। এবার তুমি আমার সঙ্গে কিছুদিন থাকবে, আমার আর চিন্তা নেই ‘

আলিশার জন্যে ওর বাবা কিছু কেনাকাটা করে দিয়েছে, সেগুলোই মাকে দেখাচ্ছিলো আলিশা। সেসব দেখতে দেখতে জিনিয়া বেগম বলে উঠলেন…

‘জানিস, তোর বাবার সঙ্গে প্রথমদিকে একদম বোঝা যায়নি। আমি ভাবতাম, এই মানুষটা আমার জন্য না। অথচ, আজও কোনো দরকারে ফোন দিলে সে দৌঁড়ে আসে। তুইও নতুন সম্পর্কে পা দিতে যাচ্ছিস, একটাই উপদেশ দেবো। ধৈর্য্য ধরিস আর জায়ানকে বোঝার চেষ্টা করিস। ধীরে ধীরে তৈরি হওয়া সম্পর্কের স্থায়ীত্ব দীর্ঘ হয় ‘

আলিশা হালকা হাসে, ওর মা বাবা প্রেম করে বিয়ে করেছিল কিন্তু কিছু বছর পরেই উভয়ের সিদ্ধান্তেই খুবই ঠাণ্ডাভাবে বিচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু বিচ্ছেদের এতো বছর পরেও আলিশার মা বাবা বন্ধু হিসেবে রয়ে গেছে

‘তোমাদের দ্রুত তৈরি হওয়া সম্পর্কই বা খারাপ কি? তোমার আর বাবার এই অদ্ভুত বন্ধুত্বটাই আমার ভালো লাগে। তোমরা আলাদা থেকেও এতটা একসাথে!’

জিনিয়া বেগম হাসলেন…

‘কারণ তোর জন্মের পর আমরা বুঝে গেছিলাম, তুই আমাদের মাঝের সবচেয়ে বড় বন্ধন। সম্পর্ক না থাকলেও দায়িত্বটা শেষ হয় না। আমরা স্বামী স্ত্রী হিসেবে হয়তো ব্যর্থ কিন্তু মা বাবা হিসেবে সফল অবশ্যই! তোর কি মনে হয়?’

মায়ের সঙ্গে রাজ্যের গল্প জুড়ে বসলো আলিশা, এমন সুযোগ তো আর সবসময় মিলবে না। দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে এ দৃশ্য দেখছিলেন আলিশার বাবা, দেখে উনিও মনে মনে খুশি হলেন। ওদিকে… জায়ানের বন্ধুরা ব্যাচেলর পার্টির জন্যে জোরাজুরি করছে কিন্তু এই ব্যাপারগুলো তার স্বভাবে পড়ে না। জায়ান কিছুটা আপত্তি জানালো…

‘ রোহান, তোরা জানিস আমি এসব পছন্দ করি না ‘

রোহান হেসে বলল…

‘ তুই তো এখনই পুরো বুড়ো হয়ে গেছিস রে! রিল্যাক্স কর, আমরা যা করছি, তোর জন্যই করছি। তুই শুধু সময়মতো চলে আসবি ‘

বন্ধুদের জোরাজুরিতে আর না করতে পারলো না। সন্ধ্যায়..একটা রুফটপ লাউঞ্জে আসতে বলা হয় জায়ানকে! সন্ধ্যা গড়িয়ে গেছে। রুফটপে সাজানো হয়েছে হালকা আলো, ফেয়ারি লাইট, স্পিকারে বাজছে স্লো ব্লুজ! জায়ান ধীরে ধীরে প্রবেশ করে, সবাই চিৎকার করে ওঠে…

‘ হেয়ার কামস দ্যা দুলহা – টু – বি ‘

বন্ধুদের এ আয়োজন দেখে জায়ান নিজেও অবাক! বন্ধুরা জায়ানকে ঘিরে ধরে, হাতে তুলে দেয় নন-অ্যালকোহলিক ককটেল, কেউ কেউ মজা করে ফেইক মালা গলায় পরিয়ে দেয়। তাফসির বলে…

‘আজ তোকে ছাড়ব না! তুই বিয়ে করতে চলেছিস, ভাবতে পারিস?’

জায়ান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দেয়…

‘কী যেন ভাবার কথা?’

‘মানে, তোর মতো রিজার্ভ টাইপ লোকও বিয়ে করছে! প্রেম-ট্রেম কই?’

আদিত্যর কথায় জায়ান উত্তর দেয়…

‘প্রেম না হোক, তবে দায়িত্ব থাকবে। সেটা অনেক সময় প্রেমের থেকেও বেশি ওজন রাখে ‘

বন্ধুরা কিছুক্ষণ চুপ, তারপর আবার হইচই করে ওঠে। কিছুক্ষণ মজা করার পর আদিত্য হঠাৎ ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলার প্রস্তাব দেয়।
জায়ান প্রথমে না করে, কিন্তু সবাই মিলে বাধ্য করে! জায়ানের পালা এলে রোহান প্রশ্ন করে….

‘তুই আলিশাকে ভালোবাসিস?’

ঘর একমুহূর্ত নিস্তব্ধ, জায়ান সামান্য হাসে…

‘ সবই তো জানিস, তাহলে এমন বেকার প্রশ্ন কেনো করছিস? সিরিয়াস কিছু জিজ্ঞাসা কর!’

‘ কি বলিস ব্যাটা, এটাও হেবি সিরিয়াস প্রশ্ন!’

জায়ান এই প্রশ্নের উত্তর দিলো না, এই নিয়ে সবাই কতো হাসি তামাশা করলো। কিছু সময় পর এক কোণে দাঁড়িয়ে শহরের আলো দেখছিলো জায়ান, সেসময় তাফসির পাশে এসে দাঁড়িয়ে জানতে চায়…

‘তুই কি খুশি, জায়ান?’

‘আমি জানি না। আমি শুধু জানি এই মেয়েটা এলে হয়তো আমার হোপলেস লাইফের কোনো গতি হবে। আমার বাবা তো তেমন ভেবেই আমার বিয়ে দিতে চাইছে ‘

‘শুধু দায়িত্ব না ভেবে ভালবাসিস, দেখবি দুজনেই ভালো থাকবি। মনে রাখিস, ইউ আর নট জাস্ট ম্যারিয়িং অ্যা গার্ল। ইউ আর এন্টারিং হার ওয়ার্ল্ড’
____________________________________

আজ বিয়ের শপিংয়ে যাবে আলিশা, ওর শাশুড়ির সঙ্গে যাওয়ার কথা। আলিশা তৈরি হয়ে বসতেই আদিল এসে জানালো…

‘ আজ সন্ধ্যায় শপিং আছে। জায়ান আসবে নিতে’

‘ জায়ান আসবে? আমি তো শুনেছিলাম অ্যান্টি আসবে ‘

‘ ওনারই আসার কথা ছিলো কিন্তু ওনার বাসায় ব্যস্ততা আছে তাই জায়ান আসবে। তাছাড়া তোরা দুজন হবু বর – বউ, শপিং তোরা একসঙ্গে করলেই ভালো হবে। নিজেদের পছন্দে দেখে কিনতে পারবি ‘

বিকেল পাঁচটার দিকে আলিশাদের বাসার সামনে গাড়ি এসে দাঁড়ায়। আলিশা বেরিয়ে দেখে সাদা গাড়িটার পাশে দাঁড়িয়ে আছে জায়ান, ফোনে কথা বলতে বলতে ভ্রু কুঁচকে একনজর তাকালো, আলিশা এগিয়ে আসতেই জায়ান চোখ তুলে তাকালো, একঝলক স্ক্যান করে বললো…

‘ চলো ‘ — এককথায় বলে দরজা খুলে দিলো।

কথায় ভদ্রতা আছে, কথাবার্তা নেই। গাড়ির ভিতর পুরোটা পথ দুজনেই চুপ। হঠাৎ জায়ান জিজ্ঞেস করলো…

‘তোমার প্রিয় রঙ কী?’

আলিশা অবাক হয়ে তাকালো…

‘নীল। কেন?’

‘তাহলে সেটাই দেখবে। যেটা পরে নিজের মতো লাগবে ‘

‘ কিন্তু বিয়েতে তো লাল বেনারসিই সুন্দর লাগে, তাছাড়া নীল পড়লে লোকে কি বলবে?’

জায়ান তখন আর কিছু বললো না, শপিং মলে ওরা যখন পৌঁছালো তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। ভেতরে ঢুকতেই চারপাশে আলো-আঁধারির মিশেল। কয়েকটা দোকান ঘুরে আলিশা দেখতে শুরু করলো শাড়ি, লেহেঙ্গা। জায়ান কিছু বলছে না, শুধু ঠাণ্ডা চোখে দেখছে। আলিশা অস্বস্তি বোধ করছিল। মনে মনে ভাবছিল, এই ছেলেটা কিছু বলে না। অথচ তার চোখে সবকিছু বলা আছে। একটা লাল লেহেঙ্গা ধরতেই জায়ান বলে উঠলো…

‘না, এটা নয় ‘

‘ তাহলে কোনটা?’

জায়ান সামনে এগিয়ে একটায় আঙুল রাখলো, প্যাস্টেল ব্লু, হালকা সিলভার ওয়ার্ক করা একটা বেনারসি!

‘এটা নাও ‘

জায়ানের পছন্দ প্রশংসনীয় বটে, আলিশা ওই বেনারসিই কিনলো। কিছু জুয়েলারিও কেনা হলো। জায়ান নিজের জন্যেও কিছু ড্রেস কিনলো। শপিং শেষে ফেরার আগে পাশেরই একটি কফিশপে বসলো দুজনে। দুজনেই চুপচাপ কফির কাপ নিয়ে বসে আছে। হঠাৎ আলিশা হেসে বললো…

‘ ভালো ফ্রেন্ডসার্কেল আপনার, আপনার জন্যে কত সুন্দর আয়োজন করেছে। আপনারা অনেক মজা করেছেন নিশ্চয়ই? এমন বন্ধু জীবনে থাকা প্রয়োজন ‘

জায়ান চমকালো না কারণ ওর বন্ধুরা ওর আইডিতেই ব্যাচেলর পার্টির ছবি আপলোড করেছিলো, জায়ান কফি ঠোঁট ছুঁইয়ে বলে…

‘ তুমি আমার আইডি চেক করো?’

‘ আপনিও তো আমার আইডি চেক করেন ‘

এবার চমকে উঠলো জায়ান!

‘ কে বললো?’

‘ কেউই বলেনি, আমি দেখেছি! আপনি আমার একটি পোস্টে রিয়েক্ট দিয়েছিলেন ‘

কয়েক মুহূর্তের জন্যে যেনো হতভম্ব হয়ে গেলো ছেলেটা! আইডি স্টক করতে গিয়ে বেখেয়ালি হয়ে কখন এ কাজ করেছে খেয়ালই করেনি। দুজনের মাঝে আবারো নিরবতা, সঙ্গে কাপের ধোঁয়ায় ভেসে চলেছে অজস্র না-বলা কথা। ফেরার পথেও গাড়ির ভিতরে নীরবতা বিরাজ করছে। কিন্তু সেই নীরবতায় আজ এক ধরনের বোঝাপড়া আছে। দুইটা অচেনা মানুষ, একটা পরিচয়ের দিকে হেঁটে চলেছে। জায়ান হঠাৎ গাড়ির জানালা দিয়ে এক প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো। আলিশা অবাক, খোলে। ভেতরে নীল রঙের সাদা পাথরের ব্রেসলেট…

‘ এইটা…?’

‘নীল তোমার প্রিয় রঙ, বলেছিলে ‘

আলিশা জানতেও চায়নি যে এটা কখন কিনলো, শুধু জায়ানের দিকে চেয়ে আলতো হাসলো। হয়তো এক চিলতে বরফ গলেছে কোথাও….

চলবে…

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#বোনাস_পর্ব

আজ আলিশার গায়ে হলুদ, জিনিয়া বেগম অতি যত্নের সঙ্গে মেয়ের হলুদের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। দুপুরে অনুষ্ঠান, জায়ান আসবে নিজের বন্ধুদের নিয়ে। নতুন জীবনের ঠিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটা, এখান থেকে আর ফিরে যাওয়ার পথ নেই। সকালবেলায় উঠেই আলিশা দেখল এলাহী কারবার! ঘরভর্তি হলুদ, সাদা আর কমলা গাঁদার মালা। ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা চারপাশ। আলিশা পুরো বাসা ঘুরে দেখলো, তখনই আদিল এসে বোনের কাঁধে হাত রেখে বললো…

‘ হবু বৌয়ের কেমন লাগলো আয়োজন?’

‘ খুব সুন্দর! এগুলো কখন করলে ভাইয়া?’

‘ আম্মু আর আমি মিলে করেছি, আম্মু তো ভোররাতেই আমাকে ডেকে তুলে কাজে বসিয়ে দিয়েছে। দেখ, তোর জন্যে কত খাটতে হচ্ছে আমাকে ‘

‘ কিভাবে আর সুদ-আসল ফেরত দিবি? তোর যদি একটা ননদ থাকতো তাহলেও বুঝতাম। তার সঙ্গে নয় আমাকে সেট করিয়ে দিতি ‘

‘ আচ্ছা? ফোন করবো নাকি তোমার জনকে? বলবো যে তুমি এদিকে অন্য মেয়েকে বিয়ে করার দিবাস্বপ্ন দেখছ?’

আদিল ভেবেছিল মজা নেবে উল্টে আলিশা ওকে নিয়েই মজা করতে শুরু করলো, আদিল মুখ গোমড়া করে ফেললো!

‘ এই, প্লিজ না! এমনিতেই কয়েকদিন ধরে তুলির সঙ্গে আমার ঝামেলা চলছে। তোর বিয়ের কথা বলে ওকে একটু ঠাণ্ডা করেছি, এখন মজার ছলে কিছু বললেও নির্ঘাত আমাকে পে’টাবে!’

‘ মুখটা দেখো তোমার, তুলি আপুর কথা শুনেই ভয়ে কেমন চুপসে গেছে। যাও, বলবো না কিছু ‘

ভাইয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ খুনসুটি চলছিলো, তখনই মায়ের ডাক পড়লো। আলিশা যেতেই যাচ্ছিলো তখন আদিল মৃদু হেসে বললো…

‘ একটা টক্সিক সম্পর্ক ভুলে তুই নতুন করে সবটা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব ভালো কাজ করেছিস। আই অ্যাম সো হ্যাপি ফর ইউ’

পরিবারের সকলের সাপোর্ট পেয়ে আলিশা আরো সাহস পাচ্ছে। ওদিকে…হলুদের পোশাক পরে তৈরি হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় জায়ান, যেনো নিজেকে যাচাই করতে ব্যস্ত ছিলো। তখনই ওর বন্ধু তাফসির এসে বলল…

‘ তুই তৈরি? চল আমাদের বেরোতে হবে নাহলে জ্যামে পরে সময়মতো পৌঁছাতে পারবো না ‘

জায়ান বেরোতেই যাচ্ছিলো তখন তার মায়ের সামনে পড়লো, কাবেরী বেগম মৃদু হেসে ছেলের গাল ছুঁয়ে বললেন…

‘ আজ তোকে খুব সুন্দর লাগছে জায়ান ‘

‘ থ্যাংক ইউ মা!’

মায়ের সঙ্গে কিছু আলাপ শেষে বন্ধুদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লো জায়ান, ওরা বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই মেঘনা এসে উপস্থিত! এ বাড়িতে কিছু কাজের প্রয়োজনে পূর্বেও দু – একবার আসা হয়েছে মেঘনার তবে সেভাবে কারো সঙ্গে কথা হয়নি তবে আজ কাবেরী বেগমের সঙ্গে আলাপ করে ভালোই লাগলো। মেঘনা এসেই কাবেরী বেগমকে কাজে সাহায্য করতে শুরু করলো ওদিকে সায়ন ফোন করেই যাচ্ছে। পরে বসার ঘরে এসে মেঘনাকে দেখলো, কি একটা ভেবে সায়ন দূরে দাড়িয়েই কল করলো। মেঘনা কখন ফোনের দিকে একনজর দেখেও চোখ ফিরিয়ে নিলো তখন সায়নের রাগ হলো। হনহন করে এসে মেঘনার সামনে দাড়িয়ে প্রশ্ন করলো…

‘ আপনি আমার কল দেখেও রিসিভ কেনো করছেন না?’

মেঘনা খানিকটা থ খেয়ে উঠে দাঁড়ালো…

‘ বাসায় চলে এসেছি বলে আর রিসিভ করিনি। তাছাড়া আন্টিকে একটু হাতে হাতে সাহায্য করছিলাম। কোনো দরকার আছে আপনার?’

‘ না!’

‘আপনি আপনার ভাইয়ের সঙ্গে যাননি?’

‘ হলুদ ওর, ওরা গেছে মজা করার জন্যে। আমি ওখানে গিয়ে কি করবো?’

‘ ভাইয়ের বিয়েতে তো ভাইয়েরাই মজা করে। জানেন কতো সুন্দর নাচগান করে ভাইবোন মিলে?’

‘ আমি ওর বড় ভাই, ছোটো ভাইয়ের বিয়েতে গিয়ে নাচবো? হোয়াট ননসেন্স!’

বসের কথা শুনে মেঘনা মাথা নিচু করলো, বিড়বিড় করে বললো…

‘ ভেবেছিলাম এই লোকটা অফিসেই শুধু এমন, এখন দেখছি বাড়িতেও এমন। বেরসিক!’

‘ হোয়াট?’

‘ আপনাকে কিছু বলিনি, আপনি থাকুন আপনার মতো আমি বরং ম্যাডামকে গিয়ে হেল্প করি ‘

মেঘনা পাশ কাটিয়ে চলে গেলো, সায়নের বকা শোনার ইচ্ছে নেই ওর এদিকে সায়ন বিরক্ত হলো। আবারো যে মেঘনার সঙ্গে কথা বলার সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে গেলো!
___________________________________

দুপুরে অনুষ্ঠান শুরু হলো, আলিশা স্টেজে বসেছে সাদার ওপর হলুদ জরির শাড়ি পরে। মেয়ের গালে যখন প্রথম হলুদ ছোঁয়ায় ওর মা ও ভাই। আলিশার বাবাকে শত টানাটানি করেও স্টেজে আনা গেলো না। উনি এসব থেকে দূরে থাকতে পছন্দ করেন তবে দুর থেকে মেয়ের অনুষ্ঠানের সকল দিকেই নজর রাখছেন। একে একে সকলে হলুদ দিচ্ছে, কিন্তু এদিকে আলিশার খেয়াল নেই। ওর নজর সামনে দাঁড়ানো জায়ানের দিকে, জায়ান ঠিক তখনই তাকিয়ে ছিল তার দিকে। যেন দেখতে চাইছিলো—এই মেয়েটির হাসি কি সত্যিকারের, না একটা সামাজিক মুখোশ?
কেউ একজন জায়ানকে ডেকে এনে স্টেজে আলিশার পাশে বসিয়ে বললো…

‘একবার একটা ছবি তুলে ফেলি বর-কনের ‘

ফটোগ্রাফারের নির্দেশনা অনুযায়ী কিছু ছবি তোলা হলো। এরই মাঝে হুট করে জায়ান স্বেচ্ছায় আলিশার কাঁধে হাত রেখে গালে হালকা করে হলুদ ছুঁয়ে দেয়। আলিশা জায়ানের দিকে তাকাতেই মুহূর্তটা যেন স্থির হয়ে যায়! ফটোগ্রাফার যে কখন সেই সুন্দর মুহূর্তটা নিজের ক্যামেরাবন্দি করে ফেলেছিল দুজনের কেউই টের পায়নি! সন্ধ্যাবেলা…অনুষ্ঠান শেষের দিকে চলে এসেছে। পুরো বিকেল হৈ হুল্লোর, নাচগান সহ সকলে অনেক মজা করেছে। এখন চারপাশে ফানুস উড়ছে। সবাই রঙিন ছবি তুলছে, ভিডিও করছে, হাসছে। আলিশা সকল কোলাহল ছেড়ে এক গ্লাস জুস নিয়ে একপাশে এসে বসেছে। জুস খেতে খেতে আকাশের দিকে একটু নজর দিলো। আকাশে চাঁদ নেই, শুধু ঝাপসা আলো। তখনই জায়ান এসে একটা চেয়ার টেনে আলিশার পাশে বসলো…

‘ যার জন্যে এত আয়োজন সেই এসে নিরালায় এখানে বসে পড়লো কেনো?’

‘ মাঝে মাঝে একাকীত্ব প্রয়োজন হয়, আপনি গিয়ে ইনজয় করুন না। আমি একটু পরেই আসছি’

জায়ান উঠলো না, আবার কিছু বললোও না। চুপচাপ আলিশার পাশে বসে রইলো। হঠাৎ আলিশার হাতের দিকে নজর গেলো ওর, সেদিনের গিফট করা ব্রেসলেটটা পরেছে আলিশা

‘ ব্রেসলেট পছন্দ হয়েছে! ‘

আলিশা অন্যমনস্ক ছিলো, জায়ানের প্রশ্নে ধ্যান ভাঙতেই এক নজর ব্রেসলেটের দিকে তাকিয়ে হেসে বললো…

‘ হুমম, আপনার পছন্দ দারুন। বিয়ের বেনারসিও দারুন পছন্দ করেছেন। আগে কারো জন্যে পছন্দ করে দিয়েছিলেন নাকি?’

‘ উহু, প্রথমবার! ভাবিনি আমার পছন্দ তোমারও পছন্দ হবে ‘

‘ আপনি তো আমার পছন্দকেই প্রাধান্য দিয়েছেন, পছন্দ না হয়ে আর উপায় ছিলো না ‘

দুজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলো! এরপর মিনিট পাঁচেক নিরবতা, আলিশা প্রশ্ন করলো…

‘ আচ্ছা, জায়ান আপনি কি কখনো এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন যেখানে কোনো সিদ্ধান্ত আপনাকে পরিবর্তনের দিকে ঠেলে দেয়, কিন্তু আপনি জানেন না সেটা ঠিক পথ কিনা?’

জায়ান দুদণ্ড না ভেবেই উত্তর দিলো…

‘হ্যাঁ, এখন অনেকটা সেরকম এক পথেই হাঁটছি ‘

আলিশা অবাক হলো! — ‘আপনিও?’

‘আমারও তো এই বিয়েটা একটা বড় পরিবর্তন’

‘ তাও ঠিক তবে এখনও সময় আছে, আপনার যদি পিছিয়ে যেতে ইচ্ছে হয় পেছাতে পারেন। আমি জোর করবো না ‘

‘ পেছানোর হলে এতদূর আসতামই না!’

আলিশা হালকা হেসে তাকালো আকাশের দিকে…

‘ দেখুন না, আকাশে আজ চাঁদ নেই, তবু আলোর অভাব নেই ‘

জায়ান চুপচাপ তাকিয়ে থাকে আলিশার দিকে…

‘কাল আমাদের বিয়ে ‘

‘ হুমমম, আপনি কি তৈরি কালকের জন্যে?’

জায়ান কিছু না বলেই মৃদু হেসে উঠে দাঁড়ালো, একটু ঝুঁকলো। জায়ান হঠাৎই এতটা কাছে চলে এলো যে আলিশা কিছু মুহূর্তের জন্যে বিচলিত হয়ে পড়লো, আলিশা ভেবেছিল কি না কি বলবে কিন্তু ওর হাতে থাকা গ্লাসটা নিজের হাতে নিয়ে জায়ান বলে উঠলো…

‘ শুধু জুস খেলে পেট ভরবে না, কিছু ভারী খাবার খেয়ে নাও। সারা বিকেল তোমাকে কিছু খেতে দেখিনি ‘

আলিশার অর্ধেক খাওয়া ওই জুসের গ্লাসটা নিয়ে অবশিষ্ট জুসটুকু খেতে খেতে জায়ান চলে গেলো, আলিশা থ হয়ে চেয়ে আছে জায়ানের যাওয়ার পানে। সে যে কয়েক মুহূর্তের জন্য ছোটখাটো একটা হার্ট অ্যাটাক দিয়ে চলে গেলো!

চলবে…