তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০৮

0
33

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৮

রাতে একটা ট্যাক্সি এসে থামলো বাসার গেটে, আলিশা ও জায়ান অবশেষে বাসায় ফিরলো। কাবেরী বেগম বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন, ওদের একসঙ্গে দেখে একটু স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন।কাবেরী বেগম দ্রুত বেরিয়ে এলেন সদর দরজার কাছে। ছেলেকে দেখে খুশি হলেও কিছুটা রাগ হয়েছে আজ!

‘ কাজটা কিন্তু তুই ভারী অন্যায় করেছিস, তোর থেকে এমনকিছু আসা করিনি জায়ান ‘

জায়ান কিছু বললো না, শুধু মৃদু হাসলো। দরজা পেরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকতেই এনায়েত সাহেব সোফায় বসা ছিলেন। পত্রিকার পাতা উল্টে রাখলেন পাশে, তাকালেন এক ঝলক ছেলের দিকে। জায়ান বুঝেছে এবার বাবার রোষের কবলে পড়তে হবে, ও ইশারায় আলিশাকে ঘরে যেতে বললো। আলিশা একটু অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সবে ঘুরে এসে মানসিকভাবে অনেকটা হালকা হয়েছে, এখন এমন পরিবেশে ও যেন নিজেকে একটু গুটিয়ে নিতে চাইলো। আলিশা যাওয়ার পরেই এনায়েত সাহেব বলে উঠলেন…

‘এটাই কি শিক্ষা পেয়েছিস তুই এ বাড়ি থেকে? বিয়ের পরদিনই বউ রেখে পালিয়ে গেলি? অন্তত মেয়েটার কথা তো মাথায় রাখা উচিত ছিলো ‘

জায়ান ঠাণ্ডা গলায় বললো…

‘আমি পালিয়ে যাইনি বাবা, মুড ঠিক করতে গিয়েছিলাম। একটা সমস্যা নিয়ে মাথা পরিষ্কার করা দরকার ছিল। এখন ঠিক আছি’

এনায়েত সাহেব উঠে দাঁড়ালেন, রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন…

‘ মুড ঠিক করার জন্যে কি তোর বিয়ের দায়িত্ব ভুলে যাওয়া উচিত ছিল? তুই এখন একজনের স্বামী, বুঝতে পারছিস? নিজের মতো করে চলে যাওয়া আর ফেরত এসে ব্যাখ্যা না দেওয়া, এটা কোনো দায়িত্ববান ছেলের কাজ না। আমাদের না হলেও অন্তত নিজের স্ত্রীকে তো একটা খবর দিতে পারতি। মেয়েটা কতো চিন্তায় ছিলো জানিস? আমি জানি তোর স্বভাব, ভেবেছিলাম বিয়ে হলে একটু বদলাবি। ভুল ভেবেছিলাম হয়তো ‘

এই কথায় জায়ানের চোখে একটু তীব্রতা দেখা দিলো। কিন্তু কাবেরী বেগম ছেলের হাত চেপে ধরে ওকে শান্ত করলো…

‘চুপ করো তো এখন, অনেক বলেছো। ছেলেটা মাত্র ফিরলো, এখন তর্ক বাড়িয়ে কোনো লাভ নেই’

‘ তোমার ছেলেকে বোঝাও কাবেরী, এতদিন যা ইচ্ছে করেছে আমি কিছু বলিনি কিন্তু ভবিষ্যতে যদি এমন কিছু করে তাহলে আমি চুপ থাকবো না’

ডিনারের পর জায়ান এসে বারান্দায় বসলো। ভাসুর ও শ্বশুর-শাশুড়ির জন্যে আনা উপহারগুলো তাদের দিয়ে আলিশা ঘরে এসে দেখলো জায়ান এখনও বসেই আছে। হালকা ঠান্ডা হাওয়া বইছে, আকাশে আধো চাঁদ, হঠাৎ পেছন থেকে আলিশার পায়ের আওয়াজ পেয়ে জায়ান ফিরে তাকালো….

‘ তুমি লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ো ‘

‘ আর তুমি কি করবে? রাত তো কম হলো না ‘

‘ আমার এখন ঘুম আসবে না ‘

আলিশা ধীরে ধীরে গিয়ে জায়ানের পাশে একটা চেয়ার টেনে বসলো…

‘ আব্বু কি তখন খুব বকেছে তোমায়?’

‘ আরে নাহ, আমার অভ্যাস আছে। অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকের বকাটা ছিলো একটু অন্যরকম। আজ তোমার কথা ভেবে বকেছে এতে আমার খারাপ লাগেনি ‘

আলিশা চোখ নিচু করলো…

‘ সরি!’

‘ তুমি কেনো সরি বলছো? আজ বাবার কথাগুলো ভুল ছিলো না বরং আমিই দায়িত্বজ্ঞানহীন মানুষের ন্যায় কাজ করেছি। আমার তোমার সঙ্গে সরাসরি কথা বলে নেওয়া উচিত ছিলো’

আলিশার মাথায় হাত বুলিয়ে ফেললো জায়ান…

‘ বাবার সামনে দাঁড়ানোটা সবসময়ই কেমন যেনো এক ধরণের দায়। বাবা লাস্ট কবে আমার সঙ্গে ভালোভাবে একটু কথা বলেছে মনে পড়েনা। আমাকে বকাঝকা করতে তার ভালো লাগে ‘

‘ বাবা মা সবসময় সন্তানের ভালোর জন্যেই বকাঝকা করেন, উনি নিশ্চয়ই চান তুমি এমনকিছু করো যার কারণে উনি তোমায় নিয়ে গর্ব করতে পারবেন ‘

‘সেটাই আমার দ্বারা কোনোদিন সম্ভব হবেনা। কারণ তার পারফেক্ট ছেলে সায়ন, তার সব আশা বড় ছেলেকে ঘিরে। আমি পারফেক্ট নই’

‘পারফেক্ট কেউ হয় না জায়ান আর হাজার চেষ্টা করলেও শতভাগ পারফেক্ট হওয়া যায়না তবুও মানুষ কিন্তু চেষ্টা থামায় না, এটাই তো জীবনের গুরুত্বপূর্ন একটা অংশ তাইনা? নিজেকে অবহেলা করা যাবেনা, আর হাল ছাড়া যাবেনা ‘

আলিশা মোটিভিশনাল কথাবার্তা বলা শুরু করতেই জায়ান ভ্রু কুঁচকে নিলো…

‘ আবারো মুরুব্বিদের মতো জ্ঞান দিচ্ছো?’

‘ আচ্ছা যাও, আর কিছু বলবো না ‘

বাড়িতে সকালের ব্যস্ততা চলছে। কাবেরী বেগম টেবিলে নাস্তার সাজাচ্ছেন। সবাই একসাথে বসেছে আজ টেবিলে, অনেকদিন পর। কাবেরী বেগম গরম গরম পরোটা আর আলুভাজা এনে রাখছিলেন। আলিশা তাকে সাহায্য করছিলো। এনায়েত সাহেব পত্রিকা পাশে রেখে আলতো করে চোখ তুলে ছোটো ছেলের দিকে তাকালেন। কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন…

‘একটা বয়সের পর ছেলেরা নিজে থেকে কিছু করার ইচ্ছা রাখে। কিন্তু তোর মধ্যে তো তেমন মন মানসিকতাই দেখিনা। যাই হোক, অফিসে গিয়ে বসিস এখন থেকে। সায়নের কাছে একটু একটু করে শিখে নিবি, তুই একটু দেখিস তো ‘

সায়ন সরাসরি জায়ানের দিকে তাকিয়েই বললো…

‘ আমার ওকে শেখাতে প্রবলেম নেই কিন্তু…’

জায়ান চামচ দিয়ে সজোরে ডালের বাটিতে নাড় দিলো। ঠোঁট টিপে হালকা হেসে বলল…

‘ কিন্তু আমার শিখতে সমস্যা আছে। তাছাড়া আমি তোমার অফিসে জয়েন করতে চাইনা সেটা আগেও বলেছি ‘

‘ তাহলে কি করবি?’

জায়ান তাকালো না, চুপচাপ পরোটা গুটিয়ে মুখে তুললো। নাস্তা শেষে সবাই উঠে গেলো, জায়ান একা বসে রইলো কিছুক্ষণ। তারপর পকেট থেকে একটা ছোট্ট পেনড্রাইভ বের করে তাকিয়ে রইলো অনেকক্ষণ। সেই পেনড্রাইভে ছিল তার সম্পাদিত সাম্প্রতিক একটি ডকুমেন্টারি, যা গত সপ্তাহেই একটি ইন্টারন্যাশনাল ফেস্টিভ্যালে সিলেক্ট হয়েছে। জায়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিজের সাফল্য, নিজের অর্জন কাউকে জানানো যেন তার কাছে সবথেকে কঠিন কাজ হয়ে উঠেছে। এই বাড়িতে যদি কখনো কেউ বুঝত যে সাফল্য মানেই কেবল মাস্টারস ডিগ্রি আর কর্পোরেট অফিসে ঢুকা নয়, অন্যকিছুও হতে পারে! দুপুরে নিজের রুমে ফিরে আলিশা ওকে একবার জিজ্ঞাসা করলো…

‘তুমি কি সত্যিই কিছু করার ইচ্ছে নেই?’

‘ আমি কিছু না করলে কি ছেড়ে চলে যাবে?’

‘ আমি কিন্তু মজা করছি না জায়ান!

‘ আমিও মজা করছি না, অ্যাজ ইউ ক্যান সি আমি আপাতত বেকার আর আমার কিছু করার ইচ্ছে নেই ‘

আলিশা কিছু না বলেই বিছানায় বসে পড়লো, তার চোখেমুখে স্থিরতা। জায়ান ওর গলায় হাত ঝুলিয়ে হেসে বললো…

‘ কি হলো ম্যাডাম, চিন্তায় পড়ে গেলেন মনে হচ্ছে? আমি বেকার বলে লোকে তোমাকে কথা শোনাবে এমনকিছু ভাবছো?’

আলিশা হাসলো — ‘ লোকের কথায় আমি পাত্তা দেইনা জায়ান। তাছাড়া কর্ম জিনিসটা আসলে স্বেচ্ছায় না করলে কাউকে দিয়ে জোর করে করানো যায় না। ইটস ওকে, এখন হয়তো তোমার ইচ্ছে না। ভবিষ্যতে যখন ইচ্ছে হবে করবে, আর তুমি যাই করবে তাতেই আমার পুরো সাপোর্ট থাকবে’

জায়ান খানিকটা অবাক হলো, কোনো মেয়েরাই স্বামীর বেকারত্ব পছন্দ করেনা। ওর ধারণা ছিল আলিশা হয়তো ওকে জবের কথা বলবে কিন্তু আলিশা উল্টে ওর সিদ্ধান্তকে সম্মান করলো। জায়ান বুঝলো না আলিশা এতো সহজে কিভাবে আর কেনোই বা মেনে নিলো। এদিকে আলিশা মনে মনে অন্য সিদ্ধান্ত নিয়েছে, একটি সম্পর্কে ব্যালেন্স রাখলে তো মন্দ হয় না। জায়ান জব না করুক কিন্তু ওর তো করতে বাঁধা নেই তাই আলিশা নিজেই জবের সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
__________________________________

পরেরদিন ছিলো ভ্যাপসা গরম, গরমে ঘর থেকে বেরোতে মন চায়না কিন্তু কি করার? ঘরে বসে থেকে তো লাভ হবেনা। জায়ান এসেছে, নিজ কর্মক্ষেত্রে! হ্যাঁ, পরিবারের চোখে বেকার হলেও বাস্তবে জায়ান বেকার নয়। শহরের এক বহুতল ভবনের সপ্তম তলায় অবস্থিত Frame-in-Silence Studio। বাইরে থেকে দেখে কেউ বলবে না ভিতরে এরকম একটা আধুনিক ক্রিয়েটিভ স্পেস গড়ে উঠেছে। দুপুর বারোটার সময় অফিসে ঢুকলো জায়ান। সে কখনো সকাল নয়টার আগেই আসে না। কারণ এই অফিস টাইম দেখে না, রেজাল্ট দেখে। স্টুডিওর দরজায় গোটা অক্ষরে লেখা…

“Where silence speaks through visuals”

প্রথম যেদিন এই অফিসে ঢুকেছিল সেদিন থেকেই এই বাক্যটা জায়ানের হৃদয়ে গেঁথে আছে। অফিসের ভেতরে ঢুকতেই কাঁচের জানালা দিয়ে ছড়িয়ে পড়া নরম আলো, দেয়ালে ঝুলছে শহরের ম্যাপ, ট্র্যাভেল ডকুমেন্টারির পোস্টার। পাশেই বসে আছে তুহিন ও এলিনা। তুহিন স্টুডিওর প্রডিউসার। আর এলিনা ডি.ও.পি। সাদাকালো চিন্তার ভেতরে সে রঙিন ফ্রেম খুঁজে বের করে। জায়ান ডেস্কে বসতেই তুহিন চা হাতে এগিয়ে এল…

‘ বিয়ের পর দিনকাল কেমন যাচ্ছে?’

‘ নট ব্যাড, ভালোই ইনজয় করছি। আসলে বিয়ের পর লাইফ কালারফুল হয়ে যায়, আপনারও এবার বিয়েটা করে ফেলা উচিত!

তুহিন চোখ তুলে এলিনার দিকে তাকিয়ে বলে…

‘ আমারও তো ইচ্ছে হয় লাইফ কালারফুল করতে কিন্তু একজন তো আমাকে পাত্তাই দিতে চায়না ‘

এলিনা চশমা মুছতে মুছতে বললো…

‘ নষ্ট করার মতো সময় থাকলে একটু হাত পা চালিয়ে কাজ করুন, পারলে আমাদের কাজে একটু সাহায্য করুন ‘

এলিনার কথা শুনে তুহিন চেয়ারটা জায়ানের কাছে আরেকটু এগিয়ে এনে ফিসফিসিয়ে বললো…

‘ দেখেছো? আমি কিছু বললেই ছ্যাৎ করে ওঠে ‘

‘ ডোন্ট ওরি, লেগে থাকুন এভাবেই। হয়ে যাবে’

কর্মক্ষেত্রের সকলের সঙ্গেই মধুর সম্পর্ক জায়ানের, সকলেই বেশ হেল্পফুল। টিমের আরো দুজন আছে কিন্তু এখন জরুরি কোনো কাজ না থাকায় ওরা ছুটিতে গেছে। জায়ান ল্যাপটপ বের করেই লেগে পড়লো কাজে। প্রতিদিন ভোর ছ’টায় ঘুম থেকে ওঠে সে। তার দিনের প্রথম কাজ, ল্যাপটপ অন করে ভিডিও ফুটেজ ক্লিপ সাজানো। জানালার পাশে বসে কানে হেডফোন গুঁজে একটা জগতে ঢুকে যায় সে, যেখানে আলো, ছায়া আর শব্দ মিলে গল্প তৈরি হয়। সে কাজ করছে একটা প্রাইভেট ক্রিয়েটিভ স্টুডিওর সঙ্গে যার অফিস বিল্ডিং থাকলেও, নেই বড়সড় টিম। ৪-৫ জন তরুণ মিলে অনলাইনেই ফ্রিল্যান্স ভিত্তিতে দেশজুড়ে কাজ করে। ডকুমেন্টারি, ক্যাম্পেইন ফিল্ম, ব্র্যান্ডেড কনটেন্ট, সামাজিক গল্প! জায়ান শুধু ব্যাকএন্ডে থাকে। তার পরিচয় কোথাও লেখা থাকে না। কখনো কোনো গল্পে ক্রেডিটও আসে না। তবে তাতে ওর আফসোস নেই। জায়ান মাঝেমাঝে নিজের কাজের ভিডিও বন্ধুদের দেখায়, বন্ধুরা ভালোমন্দ মন্তব্য করে। বিষয়গুলো দারুন ইনজয় সে। ওদের টিমের সকলেই পারদর্শী, টিম সদস্য কম থাকায় একেকজনকে প্রায় দু – তিনটে কাজ একসঙ্গে করতে হয়। জায়ান ভিডিওর স্ক্রিপ্ট লেখে, মাঝে মাঝে ক্যামেরার কিছু এমনকি লোকেশন স্কাউটের কাজও তাকে করতে হয়! এনায়েত সাহেব সবসময়ই চেয়েছেন তার ছেলেরা “সার্টিফিকেটধারী” চাকরি করুক বা তার মতো বিজনেসম্যান হোক। টাই পরে অফিসে যাক, বেতন হোক নির্দিষ্ট। ছোটবেলা থেকেই বড় ভাই সায়নের ছায়ায় থেকে থেকে জায়ান শিখে গেছে যে নিজের ইচ্ছার চেয়ে পরিবারের চোখে ‘ভালো ছেলে’ হওয়া অনেক বেশি কঠিন! তাই সে এমন পথ অবলম্বন করেছে যাতে কর্মও হবে আর বাবার অযথা কথাও শুনতে হবেনা। কেউ না জানুক কিন্তু নিজের কাছে একটা দাম আছে যে সে বেকার নয়, বরং সাইলেন্ট ওয়ার্কার! জায়ান ‘বেকার’ তকমাটা হাসিমুখেই বয়ে বেড়ায়। কারণ সে জানে কাজ মানে শুধু অফিসে যাওয়া নয়। আর ভালো থাকা মানে সবার কাছে সেটা প্রমাণ করা নয়!

চলবে….