তোর রঙে হবো রঙিন পর্ব-০৯

0
38

#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ০৯

সকালটা ছিল যেন এক রূপকথার শুরু।জানালার পর্দা নেমে আসা রোদের আলো ঘরের মেঝেতে আলতো করে আঁচড় কাটছিল। ঘরের একপাশে বিছানায় আলিশা ধীরে ধীরে চোখ মেললো। কিছুক্ষণ কেবল ছাদের দিকে তাকিয়ে থাকলো সে। শুধু নিঃশব্দে অনুভব করছিল পাশ থেকে আসা এক গা-ছমছমে শান্তির নিশ্বাস। জায়ান ঠিক পাশেই ঘুমিয়ে আছে। তার মুখে একরকম নিষ্পাপ প্রশান্তি। যেন কোনো ভার নেই, দায় নেই, শুধু একটা নিঃশব্দ জগত যেখানে সে নিজের মতো করে লুকিয়ে আছে। আলিশা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো। সেই ছেলেটি, যার সঙ্গে মাত্র কয়েক সপ্তাহ হলো সংসার শুরু হয়েছে, এখন যেন কতদিনের চেনা! আলিশা ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লো। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতেই পেছন থেকে জায়ানের কণ্ঠ ভেসে এলো…

‘তুমি উঠে গেলে?’

‘ অনেক বেলা হয়ে গেছে, আর কত ঘুমাবো?’

জায়ান আধো ঘুমে এক হাত তুলে চোখ ডললো, অন্য হাতটা বাড়িয়ে দিলো আলিশার দিকে। ঘুম জড়ানো কোমল কণ্ঠে জায়ান ডেকে উঠলো…

‘এসো একটু…’

আলিশা নিজের এলোমেলো পেছনে থেকে একটু হেসে বললো…

‘তুমি কি আমাকে আবার ঘুম পাড়াতে চাও নাকি?’

জায়ান চোখ মেলে তাকালো। চোখের পাতায় ঘুম আর চোখের দৃষ্টিতে ছিল একরাশ গভীর মায়া।জায়ান ঠোঁট উল্টে আধো ঘুমে এক হাত তুলে চোখ ডললো।আলিশা হালকা হাসলো। সেই হাসিতে ছিল স্বপ্ন ফেরত আসার আলো। কিন্তু রান্নাঘরে ঢুকতেই কাবেরী বেগম হাসিমুখে বললেন…

‘আজকে ভাবছি নাস্তায় অন্যকিছু বানাবো,’ বললেন কাবেরী বেগম…

‘রোজই তো একরকম খাওয়া হয়। তুমি একটু ইউটিউব ঘেঁটে দেখো তো নতুন কিছু?’

আলিশা মুচকি হেসে বললো…

‘ এখনই দেখছি মা, আমি নিজেও কয়দিন ধরে নতুন কিছু ট্রাই করতে চাইছিলাম ‘

আলিশা ফোনে স্ক্রল করতে করতে বললো,

‘এই দেখুন, এই রেসিপিটা ট্রাই করা যায়। ঝামেলা কম, কিন্তু দেখতে আর খেতে দারুণ।’

দুজনেই মিলে রান্নায় লেগে গেল। টুকটাক হাসি, ছোট ছোট আলাপ—এই নতুন সম্পর্কের মাঝে এমন কিছু মুহূর্ত যেন অদ্ভুতভাবে আপন মনে হয়।নাস্তা শেষে আলিশা নিজের ঘরে গিয়ে খুলে বসলো ল্যাপটপ। একটার পর একটা জব পোর্টাল ঘাঁটছে, চাকরির বিষয়ে সে ভীষণ সিরিয়াস! ঠিক তখনই একটা চেনা নাম ভেসে উঠলো মেসেঞ্জারে।মেসেজটা পাঠিয়েছে রিফা, আলিশা কিছুদিন যে কোম্পানিতে চাকরি করেছিলো সেখানে মেয়েটা ওর কলিগ ছিলো। চাকরি ছাড়লেও আলিশার রিফার সঙ্গে যোগাযোগ রয়েই গেছে। আলিশাকে সে জানায় কোম্পানিতে একটা পোস্ট খালি আছে , এখানে ট্রাই করার জন্যে। এক মুহূর্তে শরীরের ভিতর কেমন যেন বিদ্যুৎ ছুটে গেল। আলিশার জব করার ইচ্ছে ছিলো, জব জয়েন করেও শুধু নিশান পছন্দ করত না বলে পছন্দের জব ছেড়ে দিয়েছিল। দীর্ঘদিন পর আবারো একটা সময়-সুযোগ পেয়েছে, এটা হাতছাড়া করা যাবেনা। রিফার সঙ্গে ওই জব পোস্টের বিষয়ে কথা বলে সব বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে আলিশা ঠিক করলো সিভি দেবে। রিফার সঙ্গে কথা শেষে ফোন রেখে আলিশা তাকালো জায়ানের দিকে, সে বারান্দার কর্নারে বসে ফোনে কিছু একটা নিয়ে ব্যস্ত ছিলো। আলিশা কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেলো। ওর আঙুলের নড়াচড়া, চোখের মনোযোগ সবকিছু এতটাই গভীর, যে ভাঙতে ইচ্ছে করলো না আলিশার। সে শুধু তাকিয়ে রইলো, মনের মধ্যে প্রশ্ন

‘বলবো? নাকি এখনই না বলাই ভালো?’

আলিশা আর তখন কিছু বললো না। দুপুরে জায়ান স্টুডিওতে আসতেই তুহিন গলা চড়িয়ে বললো…

‘ভাই, নতুন যে প্রজেক্ট আছে আর যে গল্প তুই লিখছিস তাতে একটা হ্যান্ডসাম ছেলে দরকার হবে। আমার মনে হয় সেই রোল হিসেবে তুই পারফেক্ট হবি! তুই কি এবার লিড নিবি?’

জায়ান একহাত মাথায় দিয়ে চুপচাপ নিজের লিখা স্ক্রিপ্টটি বারবার পড়ছিল যে কোথাও কিছু ঘষামাজা করা প্রয়জন আছে কিনা ট জায়ান একটু থেমে বললো…

‘ আপনিও তো কম হ্যান্ডসাম না, আপনিও তো নিতে পারেন রোল। আপনি হিরো আর এলি হবে হিরোইন ‘

তুহিন হাসলো — ‘এতদিনে আমার মনের মত একটা প্রস্তাব দিয়েছিস ‘

ঠিক তখনই এলিনা এসে ঢুকলো। কাঁধে ক্যামেরা, চোখে একটা তীক্ষ্ণ আলোর ঝলক। এলিনাকে তুহিন মনে মনে পছন্দ করে ঠিকই কিন্তু মেয়েটার এই তাকানো দেখলেই ভরকে যায় বেচারা…

‘ কি নিয়ে কথা হচ্ছে?’

‘ আমি জায়ানকে লিড করতে বলছি ‘

‘ এটা তো ভালো প্রস্তাব! জায়ান, তুমি রাজি নও?’

জায়ান না সূচক মাথা নাড়তেই এলি বললো…

‘এইবার ক্যামেরার পেছনে না থেকে একটু সামনে আসা উচিত না তোর? আমার মনে হয় তুই অনস্ক্রিন থাকলে প্রেজেন্টেশনে ভালো ইমপ্যাক্ট পড়বে ‘

জায়ান হালকা হেসে বললো…

‘আমার গল্পগুলো ক্যামেরার চোখে ফুটে উঠলেই হবে এলিনা, তার জন্যে আমার সামনে আসাটা জরুরি নয়!’
__________________________________

রাতটা শহরের অন্যান্য রাতের মতো নিস্তব্ধ হলেও, কিছু কিছু মুহূর্ত যেন নিজের মতো করে লিখে নিচ্ছিল স্মৃতির পাতা। বারান্দার দরজাটা খোলা, বাতাসে দুলে উঠছে হালকা পর্দা, আর তার মাঝেই দুজনে দাঁড়িয়ে ছিলো, হঠাৎ জায়ানের মাথায় কি ভুত যে চাপলো! সে বলে উঠলো…

‘চলো, আজ একটু বের হই?’

‘ এখন!’

‘ তাতে কি? আমি তো সঙ্গেই যাচ্ছি ‘

আলিশা প্রথমে একটু অবাক হলেও রাজি হয়ে যায়। সেই তো কতদিন ঘরের মধ্যে কাটছে, এই সন্ধ্যা-রাতের ঠান্ডা বাতাসে একটু হাঁটা, মনটাকেও যেন একটু স্বস্তি দেবে। জায়ানের অনুরোধে শাড়ি পড়লো আলিশা, জায়ানও হালকা রঙের একটা গ্রে পাঞ্জাবি পরে নিয়ে বেরিয়ে পড়লো। আজ রাতটা দুজনে মিলে উপভোগ করবে। দুজনেই যেন খুব সাধারণ, অথচ একসাথে হেঁটে যাওয়ার ভেতর একধরনের ছন্দ আছে। তাদের বেরিয়ে যেতে দেখে, পাশের ঘরের জানালা থেকে কাবেরী বেগম একবার পর্দা সরিয়ে তাকালেন। চোখে জ্যোৎস্নার আলো ছুঁয়ে যাচ্ছে আর তার মাঝখানে দুজনে পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে। কাবেরী বেগমের মুখে হালকা এক তৃপ্তির রেখা ফুটে উঠলো, ছেলেটা বুঝি তার একটু শোধরাচ্ছে! জানালায় পর্দা বসার ঘরে তখন এনায়েত সাহেব কিছু একটা পড়ছিলেন পেপারে। কাবেরী বেগম গিয়ে ধীরে বিছানায় এসে বসে এনায়েত সাহেবকে বললেন…

‘শুনছো?’

‘কি শুনবো?’

কোম্পানির কিছু দরকারি কাগজ দেখছিলেন এনায়েত সাহেব, কাবেরী বেগম হেসে বললেন…

‘তোমার ছেলেটা বউ নিয়ে একটু আগেই বাইরে গেলো, ভালোই মিল হয়েছে দুজনের ‘

স্ত্রীর কথা শুনে এনায়েত সাহেব কিছু বললেন না, শুধু চশমার উপর দিয়ে তাকালেন। কাবেরী বেগমের মুখে তখন একরাশ তৃপ্তি! জায়ান আর আলিশা হাঁটতে হাঁটতে একটা টং এর সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, বাইরে এসেছে আর চা না খেলে কি চলে? আলিশা বললো…

‘আজকে মা বোধহয় আমাদের বেরোতে দেখে ফেলেছে’

জায়ান মৃদু হাসলো — ‘অন্য মায়েদের কথা জানিনা কিন্তু ছেলে তার বউ নিয়ে চন্দ্রবিলাস করতে বেরিয়েছে দেখে আমার মা খুশিই হবেন এ বিষয়ে গ্যারান্টি দিতে পারি ‘

আলিশার ঠোঁটে এক কোমল হাসি…

‘ রাতে এভাবে হাঁটতে ভালোই লাগে!’

‘তুমি যদি চাও, প্রতিদিন আমরা এভাবেই হাঁটবো। কোনো গন্তব্য না থাকলেও, হাঁটবো পাশাপাশি।’

সেই রাতে শহরের চুপচাপ গলিতে ওরা শুধু হাঁটছিল। একসাথে, নীরবে! দুজনে মিলে ছোটখাটো একটা ডেট সারলো এই রাতেই।ফেরার পথে আলিশা হঠাৎ বললো…

‘আজ একটা ইন্টারভিউ কল পেয়েছি।’

জায়ান তাকালো ওর দিকে, ভ্রু কুঁচকে বললো…

‘ কবে হলো?’

‘ আমি কিছুদিন একটা কোম্পানিতে জব করেছিলাম, সেখানেই আবার সিভি দিয়েছিলাম আর এ সপ্তাহে তারা আমাকে ডেকেছে ‘

‘এতদিনের ব্যাপার আর তুমি আমাকে বলোনি?’

আলিশা একটু ইতস্তত করলো…

‘ নিশ্চিত ছিলাম না আসলে, হবে কি না তাই আগেই জানাইনি’

জায়ানের গলায় ছিল না কোনো অভিমান, বরং একরকম শান্ত কণ্ঠে বললো…

‘তুমি ভয় পাও নাকি আমাকে? আমি কি কখনো এমন কিছু বলেছি যে তুমি কোনোকিছু সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে আমার সঙ্গে শেয়ার করতে পারবে না?’

আলিশা কিছু বললো না, কেবল ওর চোখে চোখ রাখলো। ভেতরটা খানিকটা নরম হলো, একটু হালকা হলো…

‘ আমি আসলে তোমাকে জিজ্ঞাসা না করেই জবের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমার জব করায় কি তোমার কোনো আপত্তি…’

জায়ান আলিশার দু কাঁধে হাত রেখে বললো…

‘আমার বউ জব করবে এটা তো ভালো কথা, তোমাকে নিয়ে আমি শো অফ করার একটা এক্সট্রা সুযোগ পাবো!’

‘ আমার জবটা এখনও কনফার্ম হয়নি, আর তুমি এখনই এতো এক্সসাইটেড হচ্ছো?’

‘ হয়ে যাবে! চিন্তা করো না ‘

আলিশা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। একসময় নিশান ওকে জব করতে নিষেধ করেছিল, সে আলিশার মতামত জানতেও চায়নি অথচ আজ জায়ান নির্দ্বিধায় সাপোর্ট করছে। আলিশা ধীরে ধীরে অনুভব করছে যে কথা নয় বরং একটু সাপোর্ট ও বিশ্বাসই সম্পর্কের আসল জায়গা। ভালোবাসা এখনো উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু অনুভবে তার চিহ্ন রয়ে গেছে। হয়তো একদিন, সময়ের ঠিক গহীনে, তারা স্বীকার করবে। কিন্তু এখন, এই নীরব সম্মতির মধ্যেই এগিয়ে চলেছে তাদের গল্প….

চলবে…