#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১১
সায়ন রুমে বসেছিলো, সে এই প্রথমবার কর্ম ব্যতীত অন্য কোনো বিষয় নিয়ে এতো মাথা খাটাচ্ছে। মেঘনার সঙ্গে কিছুদিন যাবত ভালোমত কথা বলতে পারছেনা, ওর মনে হচ্ছে মেঘনা যেনো ওকে এড়িয়ে যেতে চাইছে কিন্তু মেয়েটাকে সে মনে মনে অনেক পছন্দ করে ফেলেছে। কিন্তু সরাসরি কথাটা বলা উচিত হবে কিনা ভেবে পাচ্ছেনা তাই তো আজ নিজের সব ইগো একপাশে রেখে ভাইয়ের সঙ্গে এ বিষয়ে আলাপ করতে গেছিলো কিন্তু লাভ আর হলো কই? সায়ন ভেবে পাচ্ছেনা কি করবে, তখনই জায়ান এসে ওর ঘরে হাজির। সায়ন একনজর তাকালো…
‘ কি দরকার?’
‘ না, দেখতে এলাম যে তোর মাথায় কোন পাহাড় ভবগে পড়েছিল যার জন্যে তুই আজ আমার যাচ্ছে হেল্প চাইতে গেছিলি ‘
জায়ান গিয়ে খাটের এক কোণে আরাম করে বসতেই সায়ন কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে উঠলো…
‘তোর যদি শয়তানি করার ইচ্ছে থাকে তাহলে যা এখান থেকে, আমার এখন এসব শোনার ইচ্ছে নেই’
‘আচ্ছা আর কিছু বলবো না, বল কি হয়েছে?’
সায়ন একটু চুপ থেকে জায়ানের দিকে ঘুরে বসলো, ভীষণ সিরিয়াস একটা মুখ করে বলতে শুরু করলো…
‘আসলে আমার এক বন্ধুর জন্যে পরামর্শ দরকার। ও একটা মেয়েকে পছন্দ করে কিন্তু বলতে পারছে না। মেয়েটা কিভাবে রিয়েক্ট করবে সেটা ভেবেই বলা হয়ে উঠছেনা। এখন তার কি করা উচিত? আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলো কিন্তু আমার তো এসব ব্যাপারে ধারণা নেই তাই…তোর কি মনে হয়, তার কি করা উচিত?’
জায়ান ভ্রু কুঁচকে তাকালো…
‘তুই বন্ধুর জন্যে আমাকে কাছে সাজেশন চাইতে এসেছিলি? তোর এমন জানের দোস্ত আছে নাকিম জানা ছিলো না তো’
‘ জায়ান, ইয়ার্কি করিস না। তুই এই বিষয়ে কোনো হেল্প করতে পারবি কিনা বল আর যদি না পারিস তাহলে যা। আমাকে কিছু ভাবতে দে’
‘ তোর সাহায্য লাগবে বললি আবার তুই ভাব দেখাচ্ছিস? আমারই ভুল হয়েছে এখানে আসা ‘
জায়ান ভাব দেখিয়ে উঠতে যাচ্ছিল তখন সায়ন মিনতির স্বরে ওকে বসতে বললো…
‘ সরি ইয়ার! বল কি করা যায় ‘
‘ এইতো লাইনে এসেছিস। উম্ম! দেখ, আমার এসব বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ হয়নি। দেখলিই তো কিভাবে হুট করে আমার মত একটা বাচ্চা ছেলেকে বিয়ে দিয়ে দিলো’
‘ বিয়ে তো করেছিস, বউ আছে তোর। বিবাহিত পুরুষ হিসেবেই পারলে কিছু অ্যাডভাইস দে ‘
‘ আমার বউ? ওকে তো আমার কিছু বলতেই হয়নি, ও নিজেই বুঝে গেছে সব। ইন ফ্যাক্ট, হিসেবে ওই প্রথম আমার কাছে এসেছে ‘
কথাগুলো বলতে বলতে জায়ানের নিজের ফার্স্ট নাইটের কথা মনে পড়তেই, লজ্জায় যেনো লাল হয়ে গেল ছেলেটা। এদিকে বেচারা সায়ন কিছু না বুঝে ক্লু-লেস হয়ে চেয়ে ছিলো। একটু পর জায়ান নিজেই স্বাভাবিক হয়ে বললো…
‘ ওকে, লেট বি সিরিয়াস। দেখ, আমার মতে কাউকে ভালো লাগলে তৎক্ষণাৎ বলে দেওয়া উচিত। মনের মধ্যে কথা জমিয়ে রেখে আদৌ কোনো লাভ হবেনা, শুধু শুধু প্রেসার বাড়বে তাছাড়া তোর বন্ধু যে মেয়েটাকে ভালোবাসে তাকে যদি অন্য কেউ উড়িয়ে নিয়ে যায় তখন কি হবে? ‘
‘ হোয়াট! কে উড়িয়ে নিয়ে যাবে? মেয়েটার কোনো প্রেমিক নেই ‘
জায়ান সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো —’ তুই কিভাবে জানলি?’
‘ আ..আমি জেনেছি মানে অবশ্যই আমার বন্ধু বলেছে তাছাড়া মেয়েটা অনেক হার্ড ওয়ার্কিং। ওসবের সময় নেই ওর কাছে ‘
‘ মেয়ে কি চব্বিশ ঘন্টা কাজই করে নাকি? এর বাইরেও তো ওর ব্যক্তিগত জগৎ আছে। থাকতেই পারে কেউ ‘
‘ তোর বন্ধুকে বলিস অতো ভাবার কিছু নেই, সরাসরি বলে দিতে। যদি মেয়েটার তোকে ভালো লাগে হ্যাঁ বলবে নইলে রিজেক্ট করে দেবে’
সায়ন থতমত খেয়ে উঠলো…
‘ কিসের আমার? আমার বন্ধুর!’
জায়ান একগাল হেসে ভাইয়ের পিঠ চাপড়ে বললো…
‘ হ্যাঁ ওই..তোর বওওওন্ধু! আমার তরফ থেকে এটাই পরমার্শ রইলো বলে দিস ‘
সায়ন এতক্ষণ এক চিন্তায় ছিলো যে কিভাবে বলবে কিন্তু জায়ানের কথা শুনে উল্টে আরেক চিন্তায় পরে গেলো, মেঘনার মনে আবার অন্য কেউ নেই তো? ও না বললেও মুখ দেখেই জায়ান বুঝে গেছে আদৌতে পরামর্শ ওর নিজেরই প্রয়োজন ছিলো। জায়ান হাসতে হাসতে নিজের ঘরে গিয়ে গা এলিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়তেই আলিশা কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে এলো…
‘ ভাইয়া কি বললো?’
‘ আমার পারফেক্ট ভাই ওর অফিস, ল্যাপটপ, মিটিং আর আমার বাবাকে খুশি করার পাশাপাশি আরেকটা কাজে যুক্ত হয়ে গেছে। এতকিছু হ্যান্ডেল করতে পারে এই সামান্য একটা বিষয়ে আমার পরামর্শ চাইছে, ইডিয়ট একটা’
‘ মানে? আমাকেও একটু বুঝিয়ে বলো সবটা। কি বলেছে?’
‘ বলেনি তো কিছু, তবে আমি বুঝেছি। আমার আব্বাজানের মাথায় বাজ ফেলার পথ তৈরি করে ফেলেছে ভাই আমার ‘
‘ কি বলছো এসব, ভালো করে বলো না কি হলো ‘
‘ কয়দিন যেতে দাও, আপাতত কিছু প্রকাশ করতে চাইছি না। কিছুদিন বাদে ভাই আমার নিজেই প্রকাশ করবে সব’
জায়ানের এই রহস্যময় কথার মানে বের করতে পারলো না, শত চেষ্টা করেও ওর মুখ থেকে কথা বের করতে পারলো না আলিশা। এদিকে ভাইয়ের এই নতুন রূপ দেখে জায়ান বেশ মজা পেয়েছে।রাতে…আলিশা ইউটিউবে ভিডিও দেখছিলো। তখন ওর ফিডে একটা চ্যানেলের সাজেশন আসে। সেখানে গিয়ে ও বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্টরি দেখতে পায়। কৌতূহলবশত একটা দেখতে শুরু করে। জায়ান ফ্রেশ হয়ে এসে সব লাইট বন্ধ করে দিয়ে ঘুমানোর জন্যে বিছানায় আসতেই দেখলো আলফা ফোনে কিছু দেখছে…
‘ এতো মনোযোগ দিয়ে কি দেখছো?’
‘ নারী দিবস উপলক্ষে একটা ডকুমেন্টরি সামনে এলো, কনসেপ্টটা দারুন আর প্রেজেন্টেশনও ভালো হয়েছে। দেখো ‘
জায়ান তাকিয়ে দেখলো এটা ওদের স্টুডিওর কাজ, এখানে জায়ান স্ক্রিপ্ট লিখেছিলো আর একটা সিনে ওর ভয়েস ওভারও আছে। আলিশা খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছিলো দেখে জায়ান আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলো…
‘ ভালো লেগেছে তোমার?’
‘ হ্যাঁ, খুব সুন্দর হয়েছে ‘
‘এই জায়ান, এই পার্টটা শোনো। ভয়েস ওভারে যে ছেলে কথা বলছে তার কণ্ঠস্বর তোমার মত তাইনা?’
আলিশা ওই পার্টটুকু টেনে জায়ানকে শোনালো…
‘ হুমম, আমার মতই তো ‘
‘ তাইনা? আমারও শুনেই মনে হয়েছিলো
আলিশা একনজর সময় দেখলো, সাড়ে দশটা বাজে!
‘ ওহহও! অনেক রাত হয়ে গেছে, আমার কালকে অফিস যেতে হবে। চলো ঘুমাই ‘
জায়ানকে জড়িয়ে ধরে ঘুমানো আলিশার নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। জায়ানও আলিশাকে নিজের সঙ্গে জড়িয়ে ভাবতে লাগলো আলিশাকে কি নিজের প্রোফেশন সম্পর্কে বলে দেবে? জায়ানের ইচ্ছে ছিলো কাউকে বলবে না কিন্তু ভালোবাসার মানুষের কাছে কোনো বিষয় গোপন করতে ইচ্ছে করে না এখন জায়ানের। পরে ও ঠিক করলো যে সময় সুযোগ বুঝে একদিন আলিশাকে সব বলবে
_____________________________________
অফিসের পর আলিশাকে সারপ্রাইজ দেওয়ার জন্যে জায়ান আনতে গেছিলো, ওখানে অফিসের কিছু কলিগের সঙ্গেও দেখা হয়েছে। আলফা যখন সকলের সঙ্গে “হাসবেন্ড” হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলো জায়ান মনে মনে বেজায় আনন্দিত হচ্ছিলো। বউয়ের মাধ্যমে সরাসরি অন্যদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার ব্যাপারটাই যেনো আলাদা। টুকটাক ঘুরাঘুরি করতে করতে যখন সন্ধ্যা হয়ে এলো তখন আলিশা বললো…
‘আমরা যখন এদিকে এসেছি তাহলে চলো তোমাকে আমার পছন্দের দোকান থেকে পেস্ট্রি খাওয়াই ‘
‘পেস্ট্রি?’
‘হ্যা, এই কাছেই শপটা। বিশ্বাস করুন অনেক মজা ওখানকার পেস্ট্রি ‘
‘ আলিশা কয়টা বাজে দেখেছো? আমরা কিন্তু চাইলে একটু পর ডিনার করতে পারি। ডেজার্ট হিসেবে না হয় পেস্ট্রি নিও ‘
‘ না না, বাড়ি গিয়ে ডিনার করবো। এখন শুধু পেস্ট্রি খাই চলো ‘
‘ তুমি এখন শুধু পেস্ট্রি খাবে?’
আলিশার কথামতো পেস্ট্রি শপে এলো দুজনে, শপের মালিক একজন মহিলা। ছোটো দোকান, আর বেশিরভাগ কাস্টমার পার্সেল করে নিয়ে যায় তাই একজন মাত্র কর্মচারী। আলিশাকে দেখা মাত্রই মহিলাটি হাসিমুখে বলে উঠলেন…
‘ তুমি আজ একা যে, আরেকজন কোথায়?’
‘ ও বাড়ি চলে গেছে আন্টি। আজ আমি নতুন একজনকে নিয়ে এসেছি দেখুন আপনার পেস্ট্রি খাওয়ানোর জন্যে’
‘ আচ্ছা, তোমার বন্ধু?’
‘ না না, আমার হাসবেন্ড ‘
আলিশা বেশ উচ্ছাসিত হয়েই পরিচয় করিয়ে দিলো, দোকানদার একগাল হেসে বললেন…
‘ বাহ! বিয়ে হয়ে গেছে তোমার? খুব ভালো। বসো তোমরা। আমি তোমাদের জন্যে আমাদের স্পেশাল চিজ অরীও পেস্ট্রি দিচ্ছি’
ওরা চেয়ার টেনে বসলো, জায়ান ধীরে ধীরে প্রশ্ন করলো…
‘ আরেকজন মানে কার কথা বলছিল?’
‘ আমার কলিগ! ওর সঙ্গে প্রায়ই এখানে দুপুরে আসা হয়। ওই আমাকে এই দোকানটা চিনিয়েছে ‘
‘ ওহ!’
‘ কেনো? তুমি কি ভেবেছিলে কোনো ছেলের সঙ্গে আসি?’
‘ উহু! আই ট্রাস্ট ইউ!’
একটু পর পেস্ট্রি আসলো, আলিশার তো দেখেই যেনো জিভে পানি এসে গেলো…
‘ পেস্ট্রি আমার পছন্দ না কিন্তু আমার মিষ্টি বউটার যেহেতু পছন্দ, অবশ্যই আমি ট্রাই করবো ‘
‘ হ্যাঁ খেয়ে দেখো, আর যদি পুরোটা না খেতে পারো তবে আমায় দিয়ে দিও ‘
খাওয়ার পাশাপাশি দুজনে গল্প করলো, একে অপরের সঙ্গে খুনসুটিও চলছিলো। নিশানের সঙ্গে সম্পর্ক শেষ হওয়ার পর জীবনের প্রতি যেনো সব আশাই শেষ হয়ে গেছিলো আলিশার, ভেবেছিল কোনোদিন হয়তো আর কাউকে ভালোবাসতে পারবে না কিন্তু জায়ানের সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ওর ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। নতুন করে এই মানুষটাকে যখন থেকে বুঝতে শুরু করেছে তখন থেকেই জীবন যেনো পূর্বের তুলনায় আরো দ্বিগুণ সুন্দর লাগতে শুরু করেছে আলিশার। বাইরে অনেকক্ষণ ঘোরাঘুরির পর দুজনে ডিনারের কিছু সময় আগে বাড়ি ফেরে।
চলবে…