#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১২
বাবার সঙ্গে বসে কিছু কাজের বিষয়ে আলাপ করছিলো সায়ন, আজ দুপুরে নিজের এক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে ওকে আলাপ করিয়েছেন এনায়েত সাহেব। কাজের কথার ফাঁকে উনি হঠাৎ ওই প্রসঙ্গ তুললেন…
‘ মেয়েটার সঙ্গে কথা বলে কেমন লেগেছে তোর?’
সায়ন একটু থামলো, কারণ ওই মেয়ের সঙ্গে ও ভালোভাবে কথাই বলেনি আর না কথা বলার ইচ্ছে ছিলো…
‘ বাবা, আমি এখন বিয়ে করতে চাইনা ‘
‘ ঠিক আছে, এখন করতে হবেনা। পছন্দ করে রাখ, বিয়ের বিষয়ে না হয় পরে এগোনো যাবে ‘
‘বাবা আমি তোমার বন্ধুর মেয়েকে বিয়ে করতে পারবো না ‘
‘ তোর ভালো লাগেনি?’
‘না বাবা, সে মেয়ে হিসেবে ভালো কিন্তু আমি তাকে বিয়ে করবো না ‘
‘ তোর কি কাউকে পছন্দ?’
এনায়েত সাহেব এবার নড়েচড়ে বসলেন, যে ছেলে তার পছন্দের বিরুদ্ধে কথা বলত না সে আজ এমন কথা বলছে? বাবার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগেই কাবেরী বেগম ডিনারের জন্যে ডাকেন। সে মুহূর্তে আর দুজনের কথা হয়নি।ডিনার টেবিলে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে, এনায়েত সাহেব কোনো বিষয়ে বিরক্ত সেটা মুখ দেখেই সকলে ধারনা করতে পারছে। খেতে খেতে একসময় হুট করে এনায়েত সাহেব বলে বসলেন…
‘মেয়েটা সবদিক থেকে তোর জন্যে উপযুক্ত তাহলে তুই কেনো তাকে বিয়ে করবি না?’
এ কথা শুনে উপস্থিত সকলে একবার সায়নের দিকে আরেকবার এনায়েত সাহেবের দিকে তাকাচ্ছেন। সায়ন কোনো উত্তর দিচ্ছেনা, কাবেরী বেগম জিজ্ঞাসা করলেন…
‘ কি হয়েছে?’
‘ আরে, আজ আমার এক বন্ধুর মেয়েকে আমাদের অফিসে আসতে বলেছিলাম। মেয়েটাকে আমার সায়নের জন্যে পছন্দ হয়েছে। ওদের দুজনকে আলাদা কথা বলার সুযোগও দিয়েছি অথচ তোমার ছেলে বলছে ওর নাকি মেয়েকে ভালো লাগেনি ‘
এনায়েত সাহেব রীতিমত বকাঝকা করতে শুরু করলেন কিন্তু সায়ন চুপ করে আছে। যাকে পছন্দ করে তাকেই এখনও বলে উঠতে পারেনি, বাবাকে কিভাবে কি বোঝাবে? ও নিরব দেখে জায়ান বললো…
‘ বাবা, এটা জরুরি নয় যে তোমার যা ভালো লাগবে সেটা সবারই ভালো লাগবে। সবারই নিজস্ব পছন্দ আছে ‘
‘ এটা তোর ব্যাপার না জায়ান, চুপ থাক ‘
‘ আমার ব্যাপার না হোক বাবা, আমরা দুজনেই তোমার ছেলে। তুমি আমায় জোর করে বিয়ে…’
কথা বলতে গিয়ে জায়ানের চোখ হঠাৎ আলিশার দিকে পড়লো, মেয়েটা ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে দেখেই জায়ান কথার টোন চেঞ্জ করে বললো…
‘ আই মিন, আমার বিয়ে নিয়ে আগ্রহ ছিল না ঠিক কিন্তু আমি আমার পার্টনারের সঙ্গে ভালো আছি সেটা আলাদা ব্যাপার। আমি যেমন তোমার পছন্দ মেনে নিয়েছি তাই বলে সবার মানতে হবে তার তো মানে নেই’
‘ হুট করেই কাউকে পছন্দ হয়ে যায় না, একজনের সঙ্গে থাকতে থাকতে তার প্রতি ভালো লাগা তৈরি হয়। তুই নিজেকে দিয়েই দেখ, আমি যতদূর দেখছি তোরা ভালো আছিস। তুই যে ছন্নছাড়া জীবনে ছিলি, আলিশা তোর জীবনে আসার পর অনেকটা চেঞ্জ হয়েছিস। তাহলে আমার পছন্দ কি ভুল ছিলো?’
‘ আমার ব্যাপার আলাদা বাবা ‘
‘ কেনো আলাদা?’
জায়ান এরপর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়, কারণ সায়ন নিজে চুপ করে আছে আর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে ও মন্তব্য করতে চায়না বলে চুপ করে গেলো। কোনরকম সকলে ডিনার করে নিয়ে ঘরে চলে গেল, আলিশা বিছানা ঝাড়তে ঝাড়তে বললো…
‘ ভাইয়া মনে হয় কাউকে পছন্দ করে, তাই বাবার পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করতে রাজি হচ্ছেনা’
জায়ান পাশের চেয়ারে বসে ফোনে স্ক্রল করতে করতে উত্তর দিলো…
‘ হুমম, জানি। ঐটাই তো সেদিন বলতে গিয়ে নানান টালবাহানা করেছে। কাউকে পছন্দ করে অথচ বাবার সামনে বলার সাহস নেই, অদ্ভুত!’
আলিশা কৌতুহল বশত এগিয়ে এলো…
‘ কি বলো! ভাইয়া বলেছে তোমাকে?’
‘ বলেনি, কিন্তু আমি বুঝে নিয়েছি। ওইদিন তো এই আলোচনা করতেই আমাকে ডেকেছিলো ‘
‘তাহলে তো সিরিয়াস ব্যাপার। আচ্ছা, আমরা ভাইয়াকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারিনা? ওনাকে দেখে আমার আজ বড্ড খারাপ লেগেছে, উনি সত্যিই এই বিয়ে করতে চান না’
‘ যার বিয়ে তার খবর নেই, তুমি এত টেনশন কেনো নিচ্ছ? দেখলে না, বাবার একটা কথার প্রতিবাদ করলো না? সারাজীবন ছেলেটা এমন, বাবার চোখে ভালো থাকাটা যেনো ওর প্যাশনে পরিণত হয়েছে ‘
‘ আহহা, আগে যা হয়েছে হোক। ওসব ভুলে যাও, তোমার ভাই তো। আজ যদি তোমার বাবা জোর করে তাকে বিয়ে দেয় সে তো হ্যাপি হবেনা। চোখের সামনে তাকে অসুখী দেখে তোমার কি ভালো লাগবে দেখতে? চলো আমরা ভাইয়াকে হেল্প করি ‘
‘ কিভাবে করবো? ও তো আমার কাছে কিছুই স্বীকারই করেনি। তবে দেখি না কি করে, কতদিন চুও থাকতে পারে। হেল্প আমার করার ইচ্ছে আছে যদি ও আমার হেল্প নিতে রাজি থাকে ‘
‘ হ্যাঁ, ভাইয়া যদি রাজি হয় আমরা অবশ্যই সাহায্য করবো। ইশ, আমার এখুনি এতো আনন্দ লাগছে ‘
আলিশার এ বিষয়ে এতো উৎসাহ দেখে জায়ান প্রশ্ন করলো…
‘ তোমার এতো আগ্রহের কারণ কি শুনি?’
‘কারো সম্পর্কের বিষয়ে সাহায্য করতে পারাটা অনেক মজার ব্যাপার। জানো, আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডকে আমি পালাতে সাহায্য করেছিলাম। এই বিয়ে ঝামেলা হয়েছিলো অবশ্য কিন্তু এখন ওরা অনেক সুখে আছে ‘
‘ কি বলো! তোমার এই গুনও আছে?’
আলিশা জায়ানের কোলে বসে গলা জড়িয়ে ধরে বললো..
‘আমার আরো অনেক গুণ আছে, ধীরে ধীরে জানবে সব ‘
জায়ান ফোনটা একপাশে রেখে আলিশার কোমর জড়িয়ে ধরলো…
‘ তাই? এবার তাহলে অন্যদের চিন্তা বাদ দিয়ে একটু আমার চিন্তা করো ‘
‘তোমার কি হয়েছে?’
জায়ান আলিশার বুকে মুখ গুঁজে কণ্ঠে একরাশ হতাশ নিয়ে বললো…
‘হয়নি, তবে এভাবেই চলতে থাকলে আমি ডিপ্রেশনে চলে যাবো নিশ্চিত ‘
জায়ানের চুলে হাত বুলিয়ে আলিশা হেসে উঠলো…
‘ খুব মন খারাপ মনে হচ্ছে। শুনি কি হয়েছে ‘
জায়ান কিছু না বলে বাচ্চাদের মত মুখ করে আলিশাকে আঁকড়ে ধরে বসেছিলো, আলিশা এবার হেসে দু হাতে ওর মুখটা উঁচু করলো। টুপ করে ঠোঁটে চু’মু খেয়ে বললো…
‘এবার হয়েছে?’
জায়ান না সূচক মাথা নেড়ে অভিযোগের স্বরে বললো…
‘এইটুকুতে হবে না! গত তিনদিন ধরে আমার ওপর দিয়ে কি যাচ্ছে জানো? তুমি রাতে আগেই ঘুমিয়ে যাচ্ছো, তোমাকে ঘুমাতে দেখে আমি কতটা জেলাস ফিল করি? তুমি ক্লান্ত বলে নিজেকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করছি জানো না, আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু ডিস্টার্ব ইউ কিন্তু তিনদিন ধরে রাতে আমার ঠিকমতো ঘুম হচ্ছেনা’
‘রাতের বেলা ঘুমাবো না তো কি করবো?’
জায়ান এবার দুষ্টু হাসি দিয়ে ফিসফিসিয়ে বললো…
‘আরো অনেককিছুই করা যায়’
এই বলেই ঝট করে আলিশাকে কোলে তুলে বিছানার দিকে এগোলো জায়ান। আলিশা মনে মনে ভাবলো, তিনদিনের ক্ষোভ মনে পুষে রেখেছে? আজ বোধহয় আর রক্ষে নেই!
______________________________
স্টুডিওতে জায়ান একটা ভিডিওর কাজ নিয়ে এলিনার সঙ্গে আলাপ করছিলো, আলাপ শেষে ল্যাপটপ নিয়ে বসে একটু অনলাইনে ঘাটাঘাটি করছিলো তখন হঠাৎ একটা ভিডিও চোখের সামনে এসে পড়ল। ইন্ট্রো সিন দেখে জায়ানের কিছুটা সন্দেহ হওয়ায় পুরো ভিডিও দেখলো, পুরোটা মনোযোগ দিয়ে দেখার পর বুঝলো যে এই স্ক্রিপ্ট, ডায়লগ এগুলো ওরই লিখা। কিছুদিন আগেই এই ট্রাভেল বিষয়ক ডকুমেন্টরির স্ক্রিপ্ট লিখেছিলো ও। জায়ান মনে মনে ভাবলো..
‘এটা কিভাবে সম্ভব? আমি তো এখনও বাইরের কারো সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে আলাপই করিনি ‘
জায়ান এসব নিয়ে গভীর ভাবনায় ডুবে ছিলো তখনই ওর টিমের এক মেম্বার কবির এসে ল্যাপটপ নিয়ে টেবিলে বসলো। জায়ানকে অন্যমনস্ক দেখে জিজ্ঞাসা করলো…
‘ কি ব্যাপার, এতো মন দিয়ে বউয়ের কথা ভাবছো নাকি?’
‘ তেমন কিছুনা, আচ্ছা কবির আমাদের অফিসে কি বাইরের কেউ এসেছিলো এই কয়েকদিনের মধ্যে?’
‘ না তো, এখানে বাইরের কেউ তো আসেনা। ডেলিভারি বয় এলেও তো নিচে থেকেই রিসিভ করা হয় যেকোনো জিনিস।
‘কিছু হয়েছে জায়ান, তোমাকে চিন্তিত দেখাচ্ছে’
জায়ান আর কিছু বললো না কিন্তু এই স্ক্রিপ্ট লিক কিভাবে হলো ভেবে পাচ্ছেনা, এই স্ক্রিপ্ট সম্পর্কে তুহিন ও এলিনা ছাড়া আর কারো সঙ্গেই আলাপ করেনি জায়ান তাহলে বাইরের কারো হাতে কিভাবে গেলো? জায়ান চিন্তিত হয়ে পড়ল, তারমানে কি ভেতরের কেউই স্ক্রিপ্ট লিক করেছে? ওদিকে…সায়ন মেঘনাকে নিয়ে আজ লাঞ্চের কিছুসময় আগে একটা ক্লায়েন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। মিটিং শেষে ওরা বাইরেই লাঞ্চের সিদ্ধান্ত নিলো। মেঘনা খাচ্ছে, সায়ন তখন প্লেটে শুধু চামচ ঘোরাচ্ছিল। ঠিক করেছে আজ এই সুযোগে মেঘনাকে মনের কথা বলেই দেবে। মনে সাহস জুগিয়ে ও মেঘনাকে বললো..
‘ মেঘনা, আই ওয়ান্ট টু টেল ইউ সামথিং ‘
‘ জ্বি, বলুন ‘
শুরুতে ইতস্তত করছিল সায়ন, পরে সাহস করে বলেই ফেললো…
‘ মেঘনা, ইউল ইউ ম্যারি মি? ‘
সায়নের মত সিরিয়াস একজনের মুখে এই ধরনের কথা মেঘনা ঠিক গুরুতরভাবে নিতে পারলো না, ও মৃদু হেসে বললো…
‘ স্যার, আপনি এরকম মজা করতে পারেন জানা ছিলো না ‘
সায়ন প্লেটের ওপর সশব্দে চামচটা রাখতেই মেঘনা কিছুটা চমকে উঠলো কারণ বসকে এই মুহুর্তে সত্যিই সিরিয়াস দেখাচ্ছে!
‘ আমি সিরিয়াসলি বলছি, গত কিছু মাসে উপলব্ধি করেছি যে আমি তোমাকে পছন্দ করতে শুরু করেছি। আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু ম্যারি ইউ ‘
মেঘনা যখন বুঝলো সায়ন মজা করছেনা তখন মেয়েটার মুখভঙ্গি যেনো পাল্টে গেলো, ও এক গ্লাস পানি খেয়ে কিছুক্ষণ নিরব রইলো। ওর নিরবতা সায়নকে আরো চিন্তিত করে তুলছে। সায়ন কিছু বলবে তার আগেই মেঘনা মাথা তুলে মৃদু হেসে বললো…
‘ সরি স্যার, কিন্তু আমার পক্ষে আপনাকে বিয়ে করা সম্ভব নয় ‘
চলবে…