#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৩
আজ কাজে একটুও মন দিতে পারেনি জায়ান, পুরোটা সময় অফিসের সকল কলিগদের ওপর নজরদারি করেছে। ওর মনে হচ্ছে যেনো কাছের কেউই এই বেইমানিটা করেছে কিন্তু কে হতে পারে বুঝে উঠতে পারছেনা কিন্তু অহেতুক কাউকে সন্দেহ করে কারো সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট করার ইচ্ছেও নেই ওর তাই ঠিক করেছে বিষয়টা নিয়ে আগে নিজেই তদন্ত করার চেষ্টা করবে। টিমের সবার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণই করেছে জায়ান কিন্তু সন্দেহের দৃষ্টি আছে সবার দিকেই।ওদিকে…মেঘনার কাছে রিজেক্ট হওয়ার পর সায়ন মানসিকভাবে অনেকটা ভেঙে পড়েছে। রিজেক্টের কারণ হিসেবে মেঘনা জানিয়েছে যে ও যেমন মধ্যবিত্ত তেমন ছেলেকেই বিয়ে করতে চায়। এ কথা শুনে সায়ন আর কিছু জিজ্ঞাসা করার সাহস পায়নি। কলেজ লাইফের পর এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো কোনো মেয়ের কাছে রিজেক্ট হলো সে, মন মেজাজ বেজায় খারাপ হয়ে গেছে যদিও মেঘনা বুঝতে দেয়নি। কিছুদিন পর…এক ছুটির সকাল…পুরো বাড়ি পরিষ্কারের কাজ চলছে, বৌ- শাশুড়ি মিলে কাজ ভাগ করে নিয়েছে। কাবেরী বেগম বেডরুম ও আলিশা ড্রইংরুম পরিষ্কারের কাজ করছে। কিন্তু শান্তিতে আর কাজ করতে পারছে কই? কথা ছিলো জায়ানও কাজে সাহায্য করবে কিন্তু করছে উল্টো কাজ! আলিশার সঙ্গে সঙ্গে থেকে বাচ্চাদের মত গাকে বিরক্ত করতে ব্যস্ত ছেলেটা। ঝুল পরিষ্কার করতে গিয়ে আলিশা পড়েছে মহা ঝামেলায়, মাঝারি সাইজের একটা টুলে দাড়িয়েছিলো। নিচে দাড়িয়ে জায়ান ওর পেটে সুড়সুড়ি দিচ্ছে! নানাভাবে বিরক্ত করছে, সায়ন তখন উল্টোদিকের সোফায় বসে ছিলো। জায়ানের এসব কাণ্ডে আলিশা ভীষণ লজ্জা পাচ্ছে, ও নিচু হয়ে বসে ধীর স্বরে বললো…
‘কি শুরু করেছো তুমি, ওখানে ভাইয়া বসে আছে দেখছো না?’
‘তাতে কি? ও ওর কাজ করুক আমি আমার কাজ করছি ‘
বলেই আবারো পেটে সুড়সুড়ি দিতে শুরু করলো, আলিশার বিরক্তিমাখা মুখটা দেখে জায়ান উপভোগ করছে…
‘আমার কাজ বাড়ানো তোমার কাজ তাইনা? চুপচাপ ওখানে গিয়ে বসো, আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো’
আলিশা এবার চোখ রাঙালো, জায়ান বুঝলো এভাবে কাজ হবেনা তাই ও হাল ছেড়ে দিয়ে বললো…
‘ ঠিক আছে, আর করবো না বিরক্ত। যতো ইচ্ছা কাজ করো। তোমাকে আমি পরে দেখে নেবো ‘
জায়ান ঠোঁট উল্টে গিয়ে বসে পড়লো সায়নের ওখানে…
‘ রোমান্স ছেড়ে এখানে এলি কেনো?’
‘ ওহ! দেখে নিয়েছিস? হিংসা হচ্ছে নাকি?’
ম্যাগাজিন থেকে মুখ তুলে ভাইয়ের দিকে তাকালো সায়ন, ছেলেটার চোখেমুখে এমনভাব যেনো প্রশংসনীয় কিছু করে এসেছে!
‘ একটুও লজ্জা নেই তোর ‘
‘বউয়ের সঙ্গে রোমান্স করছি এতে লজ্জার কি আছে? আই অ্যাম শিওর, তোর বউ থাকলে তুইও এমন করতিস’
সায়নের যেনো এ কথা শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো! জায়ানের কফি খেতে ইচ্ছে হচ্ছিল কিন্তু মা আর বউ তো কাজ করছে তাই ও নিজেই দুকাপ কফি বানিয়ে এনে এক কাপ সায়নকে দিলো। কিন্তু কফিপ্রেমী সায়নের যেনো আজ কফির প্রতি মনোযোগই নেই! জায়ান প্রশ্ন করলো…
‘কি হয়েছে তোর? কয়েকদিন ধরে দেখছি বাড়িতে যতক্ষণ থাকছিস কেমন দেবদাসের মতো পড়ে আছিস। ছ্যাঁকা খেয়েছিস নাকি?’
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেলে এবারও নিরব দেখে জায়ান এবার কটাক্ষ করলো…
‘ মেয়েটা রিজেক্ট করে দিয়েছে?’
অবাক হয়ে ভাইয়ের দিকে তাকালো সায়ন!
‘ তুই কিভাবে জানলি?’
‘বাবার মতো তুইও আমাকে ইডিয়ট ভাবিস?
সায়ন রেগে তাকালো – ‘জায়ান!’
‘আমাকে রাগ দেখিয়ে লাভ নেই। তুই কি ভেবেছিস যে ওসব বন্ধুর জন্যে পরামর্শ চাওয়ার ঢপের চপ আমাকে খাওয়াবি আর আমি খেয়ে নেবো? তুই কত জনদরদি জানা আছে আমার’
অন্যদিন হলে হয়তো জায়ানকে ধমকে দিত কিন্তু আজ সায়ন চুপ করে আছে, সত্যিই তো সে কারো কাছে রিজেক্ট হয়েছে!
‘তোর মত পারফেক্ট কাউকে কি বলে রিজেক্ট করলো?’
সায়ন এবার বিষয়টা গোপনের চেষ্টা করলো না, তবে মেয়েটা আসলে কে সেটা নির্দিষ্ট করে বললো না…
‘ ও একট মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে তাই ঐরকম একটা পরিবারেই বিয়ে করতে চায় ‘
জায়ান এ কথা শুনে অনেকটা ইমপ্রেসড হলো!
‘ বাহ! মেয়ের এলেম আছে বলতে হবে। এত্ত সুন্দরভাবে রিজেক্ট করেছে! আহা, আমার তো শুনেই খুব শান্তি লাগছে’
‘ কাটা ঘায়ে আর নুনের ছিটা দিস না ‘
‘ এতো সেন্টি হওয়ার কিছু নেই। রিজেক্ট তো হয়েই গেছিস। তো এখন কি করবি? বাবার পছন্দের মেয়েকে বিয়ে সংসার শুরু কর’
‘ পারবো না আমি ‘
‘ তাহলে আর কি, দেবদাস বসে বসে থাক ‘
‘ তো কি করতে বলছিস আমায়?’
‘মেয়েটা তোকে রিজেক্ট করে দিলো আর তুই এখানে মনমরা হয়ে বসে পড়লি, মেয়েটার সঙ্গে কথা বল ওকে বোঝা। ওকে ফিল করা যে তুই ওকে ভালবাসিস। হতে পারে মেয়েটা দুর্বল হবে আর তোর প্রতি ইন্টারেস্টও জাগবে’
সায়ন উৎসুক হয়ে জানতে চাইলো…
‘ সেটা কিভাবে করবো?’
‘ মেয়েটার সঙ্গে কথা বল, ওকে বোঝার চেষ্টা কর। কেনো সে তোকে বিয়ে করতে আগ্রহী না সেটা জানার চেষ্টা কর। মোটকথা মেয়েটাকে আগে সম্পুর্নভাবে বোঝার চেষ্টা কর। যাকে ভালবাসিস তাকে যদি বুঝতেই না পারিস তাহলে তো ভালোবেসে লাভ নেই ‘
জায়ানের কথায় সায়ন একটু ভেবে দেখল কথাটা সত্য, কারণ মেঘনাকে একপ্রকার হুট করেই বিয়ের কথা বলে ফেলাটা বোকামি হয়েছে। ওকে আগে বুঝতে হবে। জায়ানের কথায় নিজের ভাঙ্গা মনে কিছুটা সাহস পেলো সায়ন, ঠিক করলো এবার থেকে মেঘনার সঙ্গে কাজের ফাঁকেও কথা বলে টুকটাক ওর বিষয়ে জানার চেষ্টা করবে। কাজকর্ম শেষে দুপুরে খেয়েই ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়েছে আলিশা। জায়ান কোত্থেকে এসে ওর পাশে উবু হয়ে শুয়ে ঘাড় উচু করে আলিশার গালে আঙ্গুল ছুঁইয়ে বললো…
‘অনেক ক্লান্ত লাগছে?’
‘ হ্যা, তবে ভালোও লাগছে। জানো আমি আগে কখনো একসঙ্গে একটানা কাজ করিনি। কেউ করতেই দিত না। মা ও অবশ্য আজ আমায় বারণ করেছিলো, তবে আমি স্বেচ্ছায় করেছি। ঘরের কাজ করার মজাই আলাদা ‘
‘তাহলে তো আমার বউয়ের আজ অনেক খাটনি হয়েছে, হাত-পা টিপে দেবো?’
‘ওসব প্রয়োজন নেই, তুমি বরং এখানে আমার সাথে একটু শুয়ে থাকো। আমাকে ঘুম পাড়িয়ে দাও ‘
জায়ান পাশে শুয়ে আলিশাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো,
_________________________________
সন্ধ্যায়… জায়ানদের এক আত্মীয় বাসায় এসেছে। জায়ানের বাবা বাসায় ছিলো না তাই কাবেরী বেগমই তার সঙ্গে কথা বলতে বসলেন। আলিশা এসে ওনার সঙ্গে একটু দেখা করেই নাস্তা বানাতে গেলো, জায়ানও গেলো আলিশাকে হেল্প করতে। কথার এক পর্যায়ে সেই আত্মীয়টি কাবেরী বেগমকে বললেন…
‘ ভাবী, কিছু মনে করবেন না কিন্তু বিয়ের ছবিতে যেমন দেখেছিলাম আপনার বৌমা তো তেমন না। মানে, গায়ের রংটা তো দেখছি একটু চাপা। আপনাদের ছেলের সাথে ঠিক যাচ্ছে না’
‘ কি যে বলেন না আপা, গায়ের রং দিয়ে কি এসে যায়? ছেলে আমাদের বউ নিয়ে ভালো আছে এটাই যথেষ্ট ‘
‘ না গো আপা, সবকিছু অতো হেলায় ফেলে দিলে চলেনা। আপনারা দেখে ছেলেকে বিয়ে করিয়েছেন, আরো সুন্দর মেয়ে পেতেন। জায়ানের সঙ্গে আরো ভালো মানাতো তাকে ‘
উনি আরো অনেক কথাই বলছিলেন, কাবেরী বেগম টুকটাক কথা দিয়ে সেগুলো কাটিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন। আলিশা আবার নাস্তা নিয়ে আসার সময় ওসব শুনে ফেলে, নতুন এক আত্মীয়র মুখে এমন কথা শুনে মেয়েটার একটু মন খারাপ হয়! জায়ানও বিষয়টা লক্ষ্য করে আলিশাকে ওখান থেকে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে গিয়ে বসলো। হাসিমুখে মহিলাটির পাশে বসে বললো…
‘আন্টি, গীবত…আই মিন গল্প তো পরেও করা যাবে। চা নাস্তা করুন না আগে ‘
মহিলাটি চা খাওয়ার পরেই জায়ান জানতে চাইলো…
‘ চা কেমন হয়েছে অ্যান্টি?’
‘ খুব ভালো হয়েছে! আসলে কি জানেন তো আপা পুরুষ মানুষদের অতোকিছু লোক দেখে না। প্রেম করে যদি বিয়ে করতে তাহলে মানা যেত কিন্তু আপনার বউমা তো…’
জায়ান বাঁকা হেসে বলে উঠলো…
‘ ওহ অ্যান্টি! আমার জন্যে আপনাকে এতো চিন্তিত দেখে সত্যিই আমি কৃতজ্ঞ, আমার মা বাবাও আমার কথা এতো ভাবেনি। দেখো মা, অ্যান্টি কতো ভালো? হাউ সুইট অফ হার’
কাবেরী বেগম ছেলের উদ্দেশ্য বুঝে ইশারায় ওকে থামতে বললো কিন্তু জায়ান কি এই মুহূর্তে মায়ের কথা শুনবে? জায়ান ওই মহিলার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিলো..এক পর্যায়ে বললো…
‘আপনার ছেলের সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা হয়েছিল। আপনার বৌমাকে প্রথম দেখলাম ‘
‘ হ্যাঁ, ওই ছুটি পেলে বউ নিয়ে একটু বেরোয় আর কি ‘
‘ ভালোই তো, আপনার বৌমা তো ভীষণ সুন্দর মাশা আল্লাহ কিন্তু আপনার ছেলের পাশে তাকে মানাচ্ছিল না। আপনার ছেলের গায়ের রং ভীষণ চাপা। কেনো যেনো দুজনের ঠিক ম্যাচ হচ্ছিলো না ‘
এ কথা শুনে মহিলার মুখ কালো হয়ে গেলো, উনি বিব্রত কণ্ঠে বললেন…
‘ জায়ান, তুমি কি আমাকে অপমান করছো?’
‘ আরে অ্যান্টি, আপনি তো সিরিয়াস হয়ে গেলেন। আপনার ছেলের বউকে প্রথম দেখলাম ওইদিন তাই বললাম আর কি। আপনার সুন্দর বৌমাকে যদি আপনার চাপা রংয়ের ছেলেকে নিয়ে থাকতে দেখতে আপনার আপত্তি না থাকে তাহলে আমাদের একই রং নিয়ে কিসের আপত্তি? এতো বৈষম্য তো ঠিক না। বাই দ্যা ওয়ে, চা টা কিন্তু আমার বউই বানিয়েছে ‘
জায়ান উঠে দাঁড়ালো, প্যান্টের পকেট থেকে একটা কার্ড বের করে মহিলাটির হাতে ধরিয়ে বললো…
‘ এটা আমার বন্ধুর জিমের কার্ড। আমার নাম বললেই ডিসকাউন্ট দেবে। আপনার ছেলেকে পাঠিয়ে দেবেন। আপনার ছেলের পেটটা ইদানিং বেরিয়ে এসেছে ‘
জায়ানের কথা শুনে মহিলাটি ভীষণ অপমানিতবোধ করলেন, কোনরকম নাস্তা করেই উনি উঠে চলে এলেন। উনি যাওয়া মাত্রই নাস্তার পিরিচ জায়ান হাতে তুলে নিলো, একটা ড্রাই কেক মুখে দিতেই কাবেরী বেগম ছেলের কাধে হালকা চাপর মারলেন…
‘ এই, এইভাবে ওনাকে বলতে গেলি কেনো? বড়দের সঙ্গে এভাবে বেয়াদবি করতে নেই ‘
‘আমার বাসায় বসে আমার সামনেই আমার স্ত্রীর বানানো নাস্তা খেতে খেতে ওকে নিয়ে সমালোচনা করলে আমি চুপ থাকবো? তাছাড়া আমি কিছু ভুল বলিনি, ওনার ছেলেকে দেখেছো তুমি? ভুঁড়িওয়ালা, আর ওনার বৌমাকে ওই ছেলের সাথে মানায় না ‘
‘ তাই বলে এইভাবে বলবি? উনি কি মনে করবে?’
‘ উনি কি মনে করলো সেসব তো আমার ভাবার দরকার নেই, যাই হোক, আমি এই কেকগুলো নিয়ে গেলাম ‘
জায়ান ওখানে যে নাস্তা উদ্ধৃত ছিলো সেগুলো নিয়ে আলিশার কাছে চলে গেলো, কাবেরী বেগম যদিও ছেলের কাণ্ডে বিরক্ত হয়েছিলেন তবে তার ছেলে নিজের স্ত্রীর জন্যে কথা বলছে দেখে উনি মনে মনে খুব খুশি হয়েছেন। জায়ান নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করতে শিখছে!
চলবে…