#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৬
অনেকদিন পর আজ জায়ানের বন্ধুরা এসেছে ডিনারের দাওয়াত। যদিও তিনজনকেই দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল কিন্তু শেষ অব্দি আদিত্য আর রোহানই সময় বের করে আসতে পেরেছে। সবাই মিলে আড্ডা দিতে দিতে দেরি হয়ে গেছিলো, বাসার সবাই আগেই খেয়ে নিয়েছে। পরে জায়ান ওর বন্ধুদের নিয়ে বসলো। আলিশা সবাইকে খাবার সার্ভ করে দিচ্ছিল বলে জায়ান ওকে টেনে নিজের পাশে বসিয়ে বললো…
‘ওরা আমাদের বাসায় গেস্ট না, আগেও বহুবার এসেছে। যার যতটুকু প্রয়োজন নিয়ে খাবে। তুমি চুপচাপ খাওয়া শুরু করো ‘
‘আরেহ! এটা ভালো দেখায়না ‘
আলিশা ওঠার জন্যে আসফাস করছিলো কিন্তু জায়ান শুনলে তো! উল্টে ওই আলিশার প্লেটে খাবার বেড়ে দিয়ে ইশারায় খাওয়ার আদেশ দিলো। স্বামীর আদেশ তো অমান্য করা যাবেনা, তাই আলিশা খেতে শুরু করলো। রোহান ওদের দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো…
‘ ভাই, আমাদের দুজনের ওপর একটু দয়া কর ‘
আদিত্যও ওর কথার তালে তাল মিলিয়ে বললো…
‘ হ্যাঁ জায়ান, তোদের দেখলে মনে হয় আমাদের আর চিনি খেতে হবেনা। তোদের সম্পর্কের মিষ্টতা দেখে আমাদেরই ডায়াবেটিস হয়ে যাবে ‘
‘ ওই চিন্তা করিস না, প্রয়োজনে ইনসুলিন আমি কিনে দেবো ‘
‘ ইনসুলিন লাগবে না রে ভাই, পারলে একটা বউ জোগাড় করে দে। আচ্ছা আলিশা…’
জায়ান চোখ গরম করলো — কিসের আলিশা? ভাবী বল ‘
আলিশা বললো — ‘আমরা তো সমবয়সী, নাম ধরে ডাকলে সমস্যা কি!’
‘ অবশ্যই সমস্যা আছে, আমার স্ত্রী তো ওদের ভাবীই হবে ‘
‘ হ্যাঁ ঠিক বলেছিস! সরি ভাবী! আচ্ছা তোমার কোনো বোন থাকলে আমাদের দিয়ে দাও, কতদিন আর এভাবে ঘুরবো?’
আলিশা হাসলো — ‘ আমার বড় ভাই আছে, বোন থাকলে অবশ্যই তোমাদের কারো সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দিতাম ‘
‘ইশ! থাকলে ভালো হতো। আমার বাবার দেখানো একটা মেয়েও আমার পছন্দ হচ্ছেনা। একটাও মনের মত না’
‘আমারও একই অবস্থা, এরকম চলতে থাকলে দেখা যাবে কদিন পর জায়ান বাপ হয়ে গেছে আর আমরা তখনও অবিবাহিত!’
এ কথা শুনেই জায়ানের মাথায় কি একটা খেলে গেলো, ও আলিশার দিকে তাকালো…
‘ এই, ও তো ভালো কথা বলেছে। কম বয়সে বিয়ে করার আরেকটা ভালো দিক হলো বাচ্চাদের বিয়ে দিয়ে যখন শ্বশুর হবি তখনও ইয়াং থাকবো ‘
‘ অ্যাই! কি বলছো এসব?’
‘ভুল কি বললাম? দেখো আমাদের মেয়ে তার জামাইর সঙ্গে হানিমুনে যাবে, সেই ফাঁকে আমরাও না হয় দ্বিতীয় দফা কোথাও হানিমুন করে আসবো ‘
আলিশার ইচ্ছে হচ্ছে এ মুহূর্তে জায়ানকে নিয়ে কোনো একটা রুমে বন্ধ করে দিতে, মুখ বড্ড চলছে ছেলেটার। আলিশা টেবিলের তলা থেকে জায়ানের পায়ে চিমটি কাটলো, জায়ান তো চিমটি খেয়ে বন্ধুদের সামনে কিছু করতেও পারছেনা। কোনরকম ব্যথা গি’লে ফেলার চেষ্টা করছে।
‘ভাই! তোকে লাল সালাম। আমরা এদিকে মেয়ে পাচ্ছিনা আর তুই ইতিমধ্যে তোর মেয়ের বিয়েও দিয়ে দিলি? বিয়ের পর বোধহয় শরীরে এভাবেই স্পিরিট চলে আসে ‘
এভাবে একের পর এক নানান বিষয়ে হাসিঠাট্টা করতে করতে সবাই মিলে খাওয়া দাওয়া করছিলো তখনই সায়নের আগমন ঘটলো, চোখমুখে বরাবরের মতই একটা সিরিয়াস ভাব। ওকে দেখামাত্রই পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। সায়ন শুধু একবার ওদের দিকে তাকালো, এরপর হেঁটে ফ্রিজের কাছে গেলো। ওখান থেকে এক বোতল জুস বের করে নিয়ে চলে গেলো। আদিত্য প্রশ্ন করলো…
‘ আমাদের দেখে কি সায়ন ভাই রেগে গেলো?’
জায়ান খেতে খেতে উত্তর দিলো…
‘ আরে নাহ, ওর মুখটাই অমন। পাথরের মতো। সারা দিনরাত মুখের একরকম এক্সপ্রেশন থাকে। বাড়ি আর অফিসের পার্থক্য বোঝেনা। অবশ্য এখন অন্য একটা বিষয় নিয়ে চিন্তায় আছে ‘
আলিশা জিজ্ঞাসা করলো — কিছু জানতে পারনি?’
‘ ভালোভাবে খবর পাইনি কিছু। কালকে থেকে ভালোভাবে খোঁজ শুরু করবো ‘
আদিত্য কৌতূহলবশত জিজ্ঞাসা করলো…
‘তোর আর সায়ন ভাইয়ের মধ্যে ঝামেলা শেষ হয়ে গেছে?’
‘আমিই এগিয়ে ঝামেলা মিটিয়েছি, নবীকে ওকে চিনিস না? ও এগোবে? ইগোর ঠ্যালায় তো কিছু চোখে দেখেনা। বাদ দে ওর কথা, খা তোরা
বন্ধুদের সঙ্গে রাতে বহুদিন পর আড্ডা দিতে পেরে জায়ানের মেজাজ তো ফুরফুরে কিন্তু সায়নের মনের অবস্থা যে ভালো নয়। বেচারা নিজের না হওয়া ভালোবাসার মানুষের চিন্তায় রাতের ঘুম ভুলতে বসেছে!
_________________________________
জায়ান আজ পুরো দিন মেঘনার সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার পেছনে ব্যয় করেছে, মেঘনা যে বাসায় ভাড়া থাকে সেখানকার একজনের কাছ থেকে কায়দা করে মেঘনা সম্পর্কে তথ্য বের করে জানতে পারলো মেঘনার পরিবারে কেউ নেই, শুধু এক ছোটো ভাই আছে। সেও অসুস্থ, ভাই কোন হসপিটালে আছে সে সম্পর্কেও খবর বের করে জায়ান হাসপাতালে গিয়ে খোঁজ নিলো কিন্তু সব খবর নেওয়ার পর জায়ানের মনটা খারাপ হয়ে গেলো! একবার ভেবেছিল সোজা সায়নের অফিসে যাবে কিন্তু ওখানে মেঘনাও আছে, তাই আর যায়নি। রাতে…ডিনার শেষে জায়ান সিরিয়াস একটা মুড নিয়ে সায়নের রুমে এলো
‘একটা খারাপ খবর আছে’
‘ কি হয়েছে?’
‘মেঘনার ছোটো ভাই প্রায় ছয় মাস ধরে হাসপাতালে ভর্তি’
‘ ছয় মাস?’
‘হুমম, গুরুতর অসুস্থ। লিভার ক্যা’ন্সার!’
সায়ন চমকে উঠলো — ‘হোয়াট! মেঘনা তো কোনদিন এ সম্পর্কে কিছু বলেনি ‘
‘হুম, আর সবচেয়ে প্যাথেটিক একটা বিষয় হলো ওর পরিবারে একমাত্র ওর ছোটো ভাই ছাড়া আর কেউই নেই। অফিস শেষ করে মেয়েটা বাসায়ও যায়না, হাসপাতালে ওর ভাইয়ের কাছে থাকে বেশিরভাগ সময়’
এ কথা শুনে সায়ন যেনো আরো একটা ধাক্কা খেলো, যে মেয়েটা সবসময় হাসিমুখে অফিসের সব কঠিন দায়িত্ত্ব পালন করে তার জীবনে যে এত ঝড় বয়ে যাচ্ছে সায়ন কোনোদিন টেরই পায়নি! সায়ন থ হয়ে গেলো…
‘মেঘনার ফ্যামিলিতে কেউ নেই!’
‘তুই এটাও জানিস না? ওর বাবা কোনো এক দুর্ঘটনায় মা’রা গেছিল বছর পাঁচেক আগে। কিন্তু ওর মায়ের সম্পর্কে কিছু জানতে পারলাম না। এরপর থেকে মেঘনাই ওর ভাইয়ের দেখাশুনা করছিলো ‘
‘আমি জানতাম না এসব ‘
‘কেমন ছেলে তুই? যে মেয়েটাকে মন থেকে পছন্দ করিস তার সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টাই করিসনি? ওকে জানার আগ্রহ জাগেনি তোর মনে?’
‘আমি জানার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু প্রতিবার ও আমাকে এড়িয়ে গেছে, পরিবার সম্পর্কে ও আমার সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী ছিলো না দেখে জোর করিনি কিন্তু ওর জীবনে যে এমনকিছু ঘটেছে আমি সত্যিই ভাবিনি ‘
‘ফাইন! এখন তো জানলি সব। কি করবি এবার তুই কর, আমি তোকে হাসপাতালের ঠিকানা দিচ্ছি ‘
‘কোন স্টেজে আছে এখন? কি অবস্থা?’
‘ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম, উনি যদিও আমাকে অতো বিস্তারিত বলেননি তবে অবস্থা বেশি ভালো না। হয়তো…বেশিদিন টিকবে না’
সায়ন নিরব রইলো, যে মেয়েটাকে পাওয়ার আশায় বুক বেঁধেছে তার জীবনে যে এত ঝড় বইছে তা যেনো ঘুর্নাক্ষরেও টের পায়নি। এ মুহূর্তে কিভাবে মেঘনাকে সাপোর্ট করা যায় সেটাই ভাবছে ও। জায়ান হাসপাতালের ঠিকানা, ওয়ার্ড নং সবকিছু সায়নকে দিয়ে দিলো। সায়ন ঠিক করলো এবার আর লুকোচুরি নয়, নিজেই যাবে মেঘনার সঙ্গে দেখা করতে। মেঘনা না চাইলেও ওর পাশে থাকবে। ইদানিং সায়ন আজ অফিসের কাজে মন দিতে পারছেনা। মাথায় শুধু মেঘনার বিষয়টাই ঘুরপাক খাচ্ছে, এতগুলো দিন ধরে মেয়েটা একা সবকিছু কিভাবে সামলাচ্ছে? এসব ভেবেই সায়নের প্রচুর মন খারাপ হচ্ছে। গতকাল মেঘনা এক সপ্তাহের জন্যে ছুটিতে গেছে। সায়ন আজ লাঞ্চ টাইমে হসপিটালে গেলো, মেঘনার ভাইয়ের ওয়ার্ডের সামনে এসে মিনিট পাঁচেক দাঁড়াতেই মেঘনা এলো। সায়নকে দেখেই মেঘনা থমকে গেলো…
‘ আ…আপনি?’
সায়ন ঘুরে তাকিয়ে মেঘনাকে দেখলো, ওর হাতে খাবারের প্যাকেট! মুখটা মলিন দেখাচ্ছে, ওয়ার্ক টাইমে হালকা মেকাপ সবসময় মুখে থাকলেও আজ তার ছিটেফোঁটা নেই। ক্লান্ত, পরিশ্রান্ত একটা মুখ!
‘এজন্যেই সাতদিনের ছুটি নিয়েছিলেন?’
‘আপনি কিভাবে জানলেন?’
সায়ন দীর্ঘশ্বাস ফেললো…
‘এতো বছর ধরে আমার সঙ্গে কাজ করছেন অথচ এতো বড় একটা বিষয় আমাকে কোনোদিন বলোনি। নাকি ব্যক্তিগত বিষয়ে শেয়ার করার মতো অতটা বিশ্বাস এখনও আমাকে করতে পারেননি?’
‘জানলে কি করতেন? টাকা অফার করতেন? আমি আপনার টাকা চাইনা, নিজে রোজগার করে যেটুকু পাচ্ছি তাতেই ভাইয়ের চিকিৎসা মোটামুটি চলে যাচ্ছে ‘
‘ শুধু টাকাই সব? মেন্টালি সাপোর্ট প্রয়োজন নেই?’
মেঘনা মলিন হাসলো — ‘প্রয়োজনের সময় আপন কাউকেই পাশে পাইনি সেখানে আপনি তো পর, কিন্তু আপনি যে আমাকে সাপোর্ট করার কথা বললেন এটুকুই আমার জন্যে যথেষ্ট ‘
মেঘনা কেবিনের ভেতরে ঢুকতেই সায়নও ওর পিছু পিছু ঢুকলো, বেডে ওর ভাই শুয়ে আছে। অচেনা এক পুরুষকে দেখেই মেঘনার ভাই প্রশ্ন করলো…
‘ উনি কে আপু?’
মেঘনা খাবারের প্যাকেট একপাশে রেখে স্যালাইনের গতি একবার চেক করে বললো…
‘উনি আমার বস, তোকে দেখতে এসেছেন ‘
সায়ন টুল টেনে বসলো মেঘনার ভাইয়ের কাছে, ছেলেটার বয়স সতেরো – আঠারো হবে। মুখ দেখে বোঝার উপায় নেই যে এমন মরণব্যাধিতে এসে আক্রান্ত। ছেলেটা হাসিমুখে অনেকক্ষণ কথা বললো সায়নের সঙ্গে, পুরোটা সময় মেঘনা চুপ করে পাশে দাড়িয়ে ছিলো। হাই ডোজ ওষুধ ও দুর্বলতার জন্যে মিনিট বিশেক পর ছেলেটা ঘুমিয়ে পড়তেই দুজনে কেবিনের বাইরে এলো…
‘ আমি ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলবো, প্রয়োজনে আরো ভালো হসপিটালে..’
‘ দু মাস সময় আছে ওর কাছে, লাস্ট স্টেজে এসে ধরা পড়েছিল। অপারেশন করলে হয়তো আরো আগেই চলে যেতো তাই অপারেশন করাইনি, আমি চাইনা ও দ্রুত আমায় ছেড়ে চলে যাক ‘
মেয়েটা শক্ত মুখে কথাগুলো বললো, যেনো যেকোনো মুহূর্তে খারাপ কিছু জন্যে নিজেকে তৈরি করে রেখেছে কিন্তু এসব শুনে সায়ন নিজেকে ধরে রাখতে পারছেনা। ও আর কিছু বলার সাহস করলো না। মেয়েটা মাথা নিচু করে দু আঙ্গুল দিয়ে চোখের কার্নিশ বেয়ে আসা পানিটুকু মুছে মৃদু হেসে বললো…
‘ আপনিই প্রথম যে আমার আত্মীয় না হয়েও ভাইকে হসপিটালে দেখতে এলেন। আমার ভাইও আপনাকে দেখে খুশি হয়েছে। থ্যাংক ইউ, স্যার।’
‘ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিতে চাইছেন? লাভ হবেনা, কারণ আমি আবারো আসবো ‘
‘ তার প্রয়োজন নেই, আপনি কেনো সময় নষ্ট…’
সায়ন দু কদম এগোলো, মেঘনার এক হাত ধরে বললো…
‘এই মুহূর্তে আমার জন্যে তুমিই জরুরি। সাবধানে থেকো, কোনো প্রয়োজন হলে আমায় কল করো ‘
সায়ন যাচ্ছে, মেঘনা ওর যাওয়ার পানে চেয়ে আছে। মেঘনা স্বপ্নেও কল্পনা করেনি সায়ন ওর সম্পর্কে এতদূর খোঁজ নেবে। আজ প্রথমবারের মতো সায়ন “তুমি” বলে সম্বোধন করলো, এক মুহূর্তের জন্যে মেঘনার মনে পুরুষটি কি তবে সত্যিই ওকে এতটা পছন্দ করে?
চলবে…