#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ১৭+১৮
সন্ধ্যায়…জায়ান নাস্তার জন্যে নিচে আসতে যাচ্ছিল, কিন্তু আলিশা দৌঁড়ে এসে বাঁধা দিলো..
‘আমাদের এই মুহূর্তে নিচে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, বাবা ভাইয়ার সঙ্গে কিছু কথা বলবেন এখন। তুমি ওখানে গেলে কিছু না কিছু বলে দেবে তখন বাবা উল্টে তোমার ওপর রেগে যাবেন ‘
‘ কি নিয়ে কথা বলবে?’
‘মায়ের কাছে শুনলাম বাবা নাকি কতগুলো মেয়ের ছবি এনেছে, ভাইয়াকে দেখাবে। ওখান থেকে মেয়ে বেছে ভাইয়ার জন্য বউ পছন্দ করবে। দেখছো না, মা বাবা একসঙ্গে বসেছে আজ? কি যে হবে বুঝতে পারছি না ‘
দুজনেই ওপরে রেলিংয়ের ধারে দাড়ালো, নিচে বসার ঘরে কাবেরী বেগম ও এনায়েত সাহেব বসে আছেন। ওনার হাতে কয়েকটা ছবি, পাশে চিন্তিত মুখে বসে আছেন কাবেরী বেগম। সায়ন এখনও আসেনি! জায়ান রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাড়ালো…
‘বাবার এই একটা সমস্যা, কোনো বিষয়ে কেউ যদি বাবার পছন্দের দ্বিমত করে উনি পারলে নিজের পছন্দ তার ওপর চাপিয়ে দেবে। সায়নের ক্ষেত্রেও তেমনি হচ্ছে। বাবার পছন্দ দুটো মেয়ে রিজেক্ট করেছে। ওটা বাবা মেনে নিতে পারছেনা ‘
‘সায়ন ভাইয়া নিজের সেক্রেটারিকে পছন্দ করে এ কথা জানতে পারলে বাবা ঝামেলা করবে না সহজে মেনে নেবে?’
‘কখনোই মানবে না, বাবার কাছে সবসময় নিজের স্ট্যাটাস অনেক গুরুত্তপূর্ণ। সায়ন যদি মেঘনাকে চায়, ওকে ফাইট করতে হবে। বাবার সামনে সবসময় মুখ বন্ধ করে থেকেছে, এবারও যদি তাই করে তাহলে আর নিজের ভালোবাসার মানুষকে পাবেনা’
জায়ান ও আলিশা নিজেদের মধ্যে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করছিল ততক্ষণে সায়ন উপস্থিত হয়, এনায়েত সাহেব টেবিলের ওপর ছবিগুলো ছড়িয়ে দিয়ে বলেন…
‘দেখ সায়ন, তোর ছোটোজনের এতদিন হলো বিয়ে হয়ে গেছে এবার কিন্তু তুই আর হাত গুটিয়ে বসে থাকলে চলবেনা। তোরও বিয়েটা করে ফেলতে হবে। দেখ, এই মেয়েগুলোকে আমি বিশেষকরে তোর জন্যে পছন্দ করেছি। যেকোনো একজনকে…’
‘আমি একজনকে পছন্দ করি সেটা আগেও তোমাকে বলেছি’
এ কথা শুনে এনায়েত সাহেবের মাথা গরম হয়ে গেলো, বড় ছেলের মুখে না শোনার অভ্যাস ওনার নেই। কাবেরী বেগম পরিস্থিতি সামাল দিতে ছেলেকে প্রশ্ন করলো…
‘বেশ, কাকে পছন্দ করিস তুই? বল আমাদের, আমরা দ্বিমত করবো না। কি বলো? ‘
কাবেরী বেগম ইশারায় স্বামীকে শান্ত হতে বললেন, এনায়েত সাহেবও নিজেকে শান্ত করে বললেন…
‘মেয়ে যদি আমাদের ফ্যামিলি স্ট্যাটাসের সঙ্গে যায় তবে আমার আপত্তি নেই। তার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেবো। মেয়ের বাসা কোথায়? ফ্যামিলি স্ট্যাটাস কি?’
‘ওকে তোমরা চেনো, অনেকবার দেখেছো ‘
কাবেরী বেগম বললেন — ‘ আমাদের চেনা?’
‘ হুমম! আমার সেক্রেটারি, মেঘনা ‘
এনায়েত সাহেব কটাক্ষ করে বললেন — ‘মজা করছিস তুই আমার সঙ্গে?’
‘ এটা মজার বিষয় নয় বাবা, আই অ্যাম সিরিয়াস। আশা করি এবার আর অন্য কাউকে বিয়ের জন্যে আমাকে ফোর্স করবে না ‘
এবার রেগে গেলেন উনি — ‘তোর মাথা ঠিক আছে সায়ন? তোর কাছে হাত পেতে বেতন নেয় যে মেয়ে তাকে তুই আমাদের বাড়ির বউ বানানোর জন্যে…’
‘ ভুল বললে! ও পরিশ্রম করে অর্থ রোজগার করে, হাত পেতে অযথা টাকা নেয়না। তাছাড়া তুমি তো ওয়ার্কিং গার্লই পছন্দ করো, আলিশাও জব করছে তাতে তো তোমার সমস্যা হচ্ছেনা’
‘ ওর ব্যাপার আলাদা, তাই বলে তুই আর মেয়ে পেলি না? নিজের সেক্রেটারিকে পছন্দ করতে হলো? তুই জানিস এই বিষয়টার কতো নেগেটিভ এফেক্ট পড়তে পারে? অফিসের লোকেরা তোর সমালোচনা শুরু করবে ‘
‘ কে কি বলল তাতে আমার কিছু যায় আসেনা, আমি মেঘনাকে পছন্দ করি আর বিয়ে করলে ওকেই করবো ‘
‘মেয়েটার বাবা কি করে? বাসা কোথায়?’
সায়ন কিছু না লুকিয়ে সব বলে দিলো, মেয়ে এতিম! ফ্যামিলি নেই, স্ট্যাটাস নেই এ কথা শুনে এনায়েত সাহেবের যেনো মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিলো
‘ তুই এমন একটা মেয়েকে আমাদের বাড়ির বউ বানাতে চাইছিস যার কিছু নেই? হ্যাভ ইউ গন ম্যাড?’
কাবেরী বেগম মেঘনাকে কয়েকবার দেখেছেন, মেয়েটাকে ওনার পছন্দই হয়েছে! উনি স্বামীকে বোঝানোর চেষ্টা করে বললেন…
‘আগেই তুমি এসব কথা কেনো বলছো? মেয়েটার পরিবার দিয়ে কি হবে? ও তো অনেকদিন ধরে সায়নের সঙ্গে কাজ করছে। নিশ্চয়ই মেয়েটার গুন আছে দেখেই…’
‘গুণ দিয়ে কি হবে? আমার সম্মানের কি হবে? লোকমুখে কিভাবে আমার বড় বৌমাকে পরিচয় করাবো? শুনলে না মেয়ের কি আছে?’
সায়নের সঙ্গে এক প্রকার তর্ক লেগে গেলো ওর বাবার, কাবেরী বেগম নিজের স্বামীকে শান্ত করার চেষ্টায় আছেন কিন্তু এনায়েত সাহেবকে শান্ত করা তো অতো সহজ না। ওনার আদরের ছেলের পছন্দ উনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। প্রায় মিনিট পনেরো এই নিয়ে তর্ক হলো, সায়নের এক কথা সে মেঘনাকেই বিয়ে করবে। এক পর্যায়ে, রেগে ওখান থেকে চলে যান এনায়েত সাহেব। কাবেরী বেগম তখন ছেলের কাছে বসে ওকে কিছু বলছিলেন, ওপর থেকে জায়ান আলিশা পুরো ঘটনা দেখলো।
‘ দেখেছো? আমি আমার বাপকে খুব ভালোভাবে চিনি। সায়ন বেকে বসলো না? এবার দেখবে ওর প্রতি বাবার হতো মোহাব্বত ছিলো সব রকেটে করে মঙ্গলে পাড়ি জমাবে ‘
‘ উফফ, এখানে একটা গুরুতর পরিবেশ আর তুমি মজা শুরু করেছো?’
‘ কি আর করবো? আমার বাপটাকে যে কিভাবে তেত্রিশ বছর ধরে আমার মা সহ্য করছে বুঝিনা। আমাদেরই সহ্য হয় না ‘
‘সে যাই হোক, ভাইয়া যে নিজের জন্যে স্ট্যান্ড নিয়েছে এটাই অনেক। যে কথা বললে তাতে তো মেঘনার এখন কাউকে পাশে প্রয়োজন। ভাইয়া যদি ওর পাশে থাকে, মেয়েটা একটু সাহস পাবে ‘
__________________________________
ওইদিনের পর থেকে এনায়েত সাহেব ও সায়নের সম্পর্কে কিছুটা চির ধরলো। কিন্তু এই প্রথমবার বাবাকে খুশি করার চেষ্টা না করে সায়ন নিজের মনের কথা শুনেছে। হসপিটালের ডাক্তারদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে মেঘনার ভাইয়ের চিকিৎসার জন্যে পুরো সাহায্য করার চেষ্টা করেছে যদিও মেঘনা ওর টাকা নিতে রাজি না। তাই সায়ন ওকে টাকা নিতে জোর করেনি, বরং ওই কঠিন মুহূর্তে মেঘনার পাশে থেকে ওর মানসিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। এদিকে বাবার সঙ্গে সায়নের ঝামেলা চলছে, তাও ও মেঘনার পাশে থেকেছে। শেষ পর্যায়ে জায়ান ও আলিশাও মাঝে মাঝে হসপিটালে গিয়েছে, খোঁজখবর রেখেছে। মাস দুয়েক পর…ডাক্তারের বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই মেঘনার ভাই মা’রা যায়। ভাইয়ের মৃত্যুতে মেঘনা মারাত্মকভাবে ভেঙে পড়লো। আলিশা নিজে গিয়ে ওর সঙ্গে প্রায় এক সপ্তাহ মতো থেকেছে, সায়নের মা ও এসেছিলো। সায়নের পরিবার থেকে মেঘনা সে সময়ে অনেকটা সাপোর্ট পেয়েছিল। বিগত দুমাস সায়নের উপস্থিতিতে মেঘনা উপলব্ধি করেছে যে পুরুষটি তাকে সত্যিই ভালোবাসে। একসময় সায়নের প্রতি ও দুর্বল হয়ে গেলেও সেটা প্রকাশ করেনি! এদিকে… দেখতে দেখতে আলিশা ও জায়ানের বিয়ের এক বছর পূর্ন হয়ে গেলো।
আজ সকালেই উঠে ফ্রেশ হয়ে আলিশা সুন্দর করে সেজেছে, জায়ান তখনও ঘুমে! পরিপাটি হয়ে এসে আলিশা ওকে ডাকলো, ঘুমের ঘোরে আধো আধো চোখে চেয়ে জায়ান বললো…
‘আরেহ! এ কি দেখছি? আমার ঘরে সকাল সকাল কোন রূপসীর আগমন ঘটলো?’
‘আমাকে সত্যিই এতো সুন্দর লাগছে?’
এবার চোখ কচলে ভালোভাবে দেখলো জায়ান, একবার পা থেকে মাথা অব্দি দেখে আবারো উল্টোপাশ হয়ে শুয়ে বললো…
‘তুমি! আমি ভাবলাম কোনো পরী এসেছে ‘
ভীষণ রোমান্টিক মুডে ছিলো আলিশা, কিন্তু জায়ানের এমন প্রতিক্রিয়া দেখে সাত সকালেই মুড নষ্ট হয়ে গেলো!
‘এটা কেমন রিয়েকশন? আমি এতো সকালে উঠে তোমার জন্যে পরিপাটি হলাম আর এই তোমার প্রশংসার নমুনা?’
‘ উম্ম! প্রশংসা করতেই হবে? আচ্ছা সুন্দর লাগছে ‘
‘ আজকে কি আছে বলোতো?’
‘ কি আর থাকবে? আজকে সোমবার, তোমার অফিস খোলা। একটু পরেই নিষ্ঠুর তুমি আমাকে ছেড়ে আট ঘণ্টার জন্যে অফিসে চলে যাবে ‘
এবার আলিশা রাগে গজগজ করতে শুরু করলো, বিছানার ওপর উঠে একেবারে কান ধরে টেনে তুললো জায়ানকে। সকালে বউয়ের কান মলা খেয়ে বেচারার অবস্থা তো খারাপ…
‘ এ..এই! লাগছে! ছাড়ো ‘
আলিশা আরো জোরে কান মলে মুখ ফুলিয়ে বললো…
‘কেনো ছাড়বো? আজকের মত একটা বিশেষ দিনের কথা ভুলে যাওয়ার জন্যে এর থেকেও কঠিন শাস্তি হওয়া উচিৎ তোমার। আপনাকে এক বছর ধরে সহ্য করছি আমি, এই তার প্রতিদান দিচ্ছেন আমাকে?’
জায়ান চোখ পিটপিটয়ে আলিশাকে একবার দেখে অবাক হয়ে বললো..
‘আমাদের অ্যানিভার্সারি আজ? এক বছর হয়ে গেলো?’
‘ খুব তো বলো, এতো ভালোবাসো আমাকে আর এই তার নমুনা তাইনা? খুব ভালো। এতো গুরুত্বপূর্ন একটা দিন সেটাই ভুলে গেছো ‘
আলিশা তো রেগে আগুন, বেচারি কতো প্ল্যান করে রেখেছিল। ভেবেছিল জায়ানের তরফ থেকেও সারপ্রাইজ পাবে কিন্তু আজকের দিনটাই যে ছেলের মনে নেই সেটা ভাবেনি। বিছানা থেকে নেমে আসতে যাচ্ছিল আলিশা, জায়ান ওকে খপ করে ধরে ফেললো। দুহাতে ওকে চেপে ধরে বললো…
‘সত্যিই আমার মনে ছিলো না বউ, সরি! এরকম আর কোনোদিন হবেনা ‘
‘ প্রথম বছরেই এই অবস্থা এরপরের বছরগুলো কি করবে জানা আছে আমার, ছাড়ো ‘
জোরজবরদস্তি করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিচে দাড়িয়েই আলিশা বলে উঠলো…
‘দশদিন তুমি আমার কাছে আসতে পারবে না, আর তুমি যদি কাছে আসার চেষ্টা করো তাহলে আমি অন্যঘরে গিয়ে ঘুমাবো ‘
এ কথা শুনে বেচারার মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়লো! জায়ান ঠোঁট উল্টে অনুনয় করে বললো..
‘দশদিন! বউ এটা একটু বেশি হয়ে গেলো না? আমি তো কোমায় চলে যাবো ‘
‘ আই ডোন্ট কেয়ার!’
খোলা চুলগুলো রাবার দিয়ে আটকে আলিশা ঘর থেকে বেরিয়ে এলো, এদিকে জায়ান পড়লো বিপদে কারণ এতো ঝামেলার মধ্যে সত্যিই আজকের তারিখের কথা ওর মাথা থেকে বেরিয়ে গেছিলো। বউয়ের থেকে দশদিন দূরে থাকা ওর পক্ষে সম্ভব না তাই ওখানে বসেই জায়ান প্ল্যান করতে শুরু করলো কিভাবে আলিশাকে সারপ্রাইজ দিয়ে ওর রাগ ভাঙ্গানো যায়! পরে একটা সারপ্রাইজ প্ল্যান করে বিকেলে ছুটির সময় জায়ান আনতে চায় আলিশাকে। অফিসের গেট থেকে বেরিয়ে জায়ানকে দেখেই ও দাড়িয়ে পড়লো, চোখেমুখে এখনও রাগ!
‘ কি দরকার এখানে?’
জায়ান বাঁকা হেসে বউয়ের হাত ধরে দুলাতে শুরু করলো..
‘ আমার অতি মূল্যবান রমণীকে নিতে এসেছি ‘
আলিশা চোখ রাঙালো — ‘ভাব দেখাবে না একদম! তোমার এসব কথায় আমি গলবো না ‘
‘ আচ্ছা, তুমি আগেই রাগারাগি কেনো করছো? আগে আমার কথা তো শোনো ‘
‘ কি শুনবো?’
‘ আমার সঙ্গে একটা জায়গায় চলো, তাহলেই সব বুঝবে ‘
আলিশা প্রথমে যেতে চায়নি কিন্তু মনে মনে যতোই রাগ দেখাক, প্রথম বিবাহ বার্ষিকীতে জায়ানের সারপ্রাইজের জন্যে তো ওর মনটা উসখুস করছে। ও রাজি হলো যাওয়ার জন্যে, গাড়িতে বসতেই জায়ান ওর চোখে পট্টি বেঁধে দিলো। আলিশা তখন আরো এক্সসাইটেড হয়ে গেলো কিন্তু বাইরে বাইরে ঠিকই রাগ দেখাচ্ছে! এরপর জায়ান ওকে নিয়ে এলো সেই কাঙ্খিত জায়গায়। একটা বিশাল মাঠ, চারপাশে গাছপালা আর গোধূলি বিকেলের আভা ছেয়ে আছে পুরো জায়গাটায়। ওখানে পৌঁছাতেই জায়ান আলিশার চোখের পট্টি খুলে দিলো। আলিশা দেখলো সামনে একটা ছেলে দাড়িয়ে আছে, যার হাতে ক্যামেরা। পাশে আরেকটা মেয়ে, তার হাতে একটা ব্যাগ। জায়ানকে দেখেই মেয়েটা হাত নাড়ালো…
‘এরা কারা?’
‘এসো, পরিচয় করাচ্ছি ‘
আলিশাকে এনে এলিনা ও তুহিনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলো জায়ান সেই সঙ্গে নিজের কর্মের কথাও আজ প্রথমবারের মত আলিশাকে জানালো। সবটা শোনার পর আলিশা যেনো থমকে গেলো, জায়ান বেকার বলে এনায়েত সাহেব অনেক কথা বলেন আবার আলিশাকে ওর বাসা থেকেও মাঝে মধ্যে টুকটাক কথা বলেছে। আলিশা সেসবের তোয়াক্কা করেনি, আজ জায়ানের প্রফেশনাল লাইফের কথা জেনে আলিশার চোখে পানি চলে এলো!
‘আমাদের স্টুডিওর তরফ থেকেই আজ আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর সুন্দর কিছু মুহূর্ত ক্যাপচার করা হবে ‘
আলিশার গলা কাঁপলো…
‘ ত…তুমি আর ওরা সত্যিই একসঙ্গে কাজ করো?’
তুহিন এগিয়ে এসে বললো — ‘ শুধু কাজ না, আমাদের স্টুডিওর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই জায়ানের ভূমিকা আছে। ওর গুনের কথা বলে শেষ করা যাবেনা, he is multi-talented ‘
জায়ানের গুনের প্রশংসা শুনে আলিশার ভীষণ গর্ব হচ্ছে, মেয়েটা অনেক খুশি। তবুও কিছুটা অভিমান নিয়ে বললো…
‘এতো বড় একটা কথা এতদিন ধরে কেনো লুকিয়ে রাখলে? আর বাবা যে এতকিছু বলে তোমায় তখন কেনো কিছু বলো না?’
‘ তোমার কি মনে হয় বাবা আমার এই কাজের কথা জানলেই আর কিছু বলবেনা? উনি ওনার লেভেলের কাজ ছাড়া কোনো কাজকেই গুরুত্ব দেন না। কি দরকার তাকে জানানোর? আমি আমার কাজ নিয়ে ভালোই আছি ‘
অনেক কথাই সে সময়ে আলিশার বলার ইচ্ছে ছিলো কিন্তু সময় নেই, এলিনা এগিয়ে এসে বলল…
‘জায়ান, সূর্য ডুবে গেলে অন্ধকার হয়ে যাবে। ছবি ভালো আসবেনা। এই গোধূলি সময়ই সুন্দর ছবি ক্যাপচার হবে। তোরা গিয়ে দ্রুত তৈরি হয়ে আয় ‘
জায়ান আগে থেকেই ম্যাচিং ড্রেস রেডি করে রেখেছিল, আলিশাকে নিয়ে এলিনা গেলো তৈরি হতে। একটা ছোটো কক্ষ আছে ওখানেই নিয়ে গেলো এলিনা ওকে। আর জায়ান তো পাঞ্জাবি ওখানেই দাড়িয়ে পড়ে ফেললো। রেডি হয়ে এসে আলিশা তুহিনকে গোপনে জিজ্ঞাসা করলো…
‘ ও এসব আজকে প্ল্যান করেছে তাইনা?’
‘ না না, ও তো আগে থেকেই প্ল্যান করছিলো। আপনাকে সারপ্রাইজ দিতে চেয়েছিল আর কি ‘
তুহিনকে আগে থেকেই এ কথা জায়ান বলে রেখেছিলো, এরপর জায়ানও তৈরি হয়ে নেয়। প্রথমে আলিশার সিঙ্গেল কিছু ছবি তোলা হবে, সেগুলো জায়ান নিজেই তুললো। ছবি তুলতে গিয়ে আলিশা যেনো নিত্যদিনের জায়ানকে নয় বরং প্রোফেশনাল জায়ানকে দেখতে পেলো। এদিকে হাসবেন্ড ওয়াইফের ছবি তুলছে, পাশে দাঁড়িয়ে তুহিন আফসোস করছে!
‘জায়ানেরও বিয়ের এক বছর হয়ে গেলো। জুনিয়র পোলাপান বিয়ে করে ফেলছে, আর আমরা…
এলিনা বললো — ‘আমার অতো আফসোস নেই। আপনার থাকলে নিজেও বিয়ে করুন, কে না করছে?’
‘ তুমিই তো রাজি হচ্ছো না ‘
এলিনা ভ্রু কুঁচকে বললো — ‘জায়ান, তোর ছবি তোলা হলে ক্যামেরা আমায় দিস তো। একজনের মাথায় ভা’ঙবো ‘
তুহিন বেচারা ভয়ে চুপসে গেল, এলিনাকে প্রায় দু বছর ধরে পছন্দ করে ছেলেটা কিন্তু মেয়েটা যে ওকে পাত্তাই দেয়না। আদৌ কোনোদিন মেয়েটার মন পাবে কিনা তুহিনের জানা নেই। সিঙ্গেল ফটো শেষে এলিনা ওদের যুগল ছবি তুললো, এমন এক বিশেষ দিনে গোধূলী বিকেলে ভালোবাসার মানুষের হাত ধরে ক্যামেরাবন্দী হতে কারই না ভালো লাগে। সকালের সকল রাগ যেনো জায়ানের দেওয়া এই সারপ্রাইজের সামনে বাষ্প হয়ে উবে গেলো। ফটোসেশন শেষে চারজন মিলে সন্ধ্যার নাস্তাও বাইরেই করে নিলো। তাদের সঙ্গে কথা বলে আলিশা জায়ানের কর্মজীবন সম্পর্কে অনেক ধারণা পেলো। তুহিন যখন প্রশংসা করছিলো জায়ান কিছুটা লজ্জা পাচ্ছিল বটে তবে বউ তার প্রশংসা শুনে খুশি হচ্ছে দেখে জায়ানের যেনো আনন্দে মন ভরে গেলো।আসার সময় আলিশা কিছু নাস্তা প্যাক করে আনলো বাসার সবার জন্যে। এসেই কাবেরী বেগমের হাতে ওগুলো দিলো…
‘ এগুলো কেনো আনতে গেলে? তোমরা খেয়ে এলেই পারতে। এতো মশলা আমাদের খাওয়া ঠিক না ‘
‘ একদিন খেলে কিছু হবেনা মা, তাছাড়া এগুলো অনেক মজা। আমরা টেস্ট করেই এনেছি ‘
এরপর দুজনেই ফ্রেশ হয়ে এলো, আলিশা শাশুড়ির সঙ্গে রান্নাঘরে এলো আর জায়ান বসলো সায়নের পাশে। দুই ভাইয়ের সম্পর্কের বরফ এখন অনেকটা গলেছে কিন্তু সায়নের শাসন থেকে জায়ান এখনও রেহাই পায়নি। এইতো একটু আগে, বিস্কুট খেয়ে হাত না ঝেরেই সায়নের কাধেঁর ওপর হাত রেখেছিলো জায়ান…
‘কিরে মজনু, দিন কেমন যায় এখন?’
ঝাড়ি দিয়ে কাধ থেকে হাতটা সরিয়ে দিলো সায়ন!
‘behave yourself! এখনও এসব ছেলেমানুষী করিস কেনো?’
‘তো কি তোর মত মুখ শক্ত করে রাখবো? সরি, ওসব আমি পারবো না। মা! আজকে আমাদের প্রেসিডেন্ট বাসায় নেই? এ সময় তো উনি এখানেই বসে থাকে’
রান্নাঘর থেকে কাবেরী বেগম বলে উঠলেন…
‘ জায়ান, মা’র খাবি কিন্তু এবার ‘
‘ যাই হোক, কোথায় গেছে?’
‘ জানিনা রে, আজ হুট করে বিকেলে কোথায় কেনো বেরিয়ে গেছে। কোনো পুরোনো বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেছে হয়তো ‘
ওদিকে…সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফিরে ঘরের জানালাগুলো খুললো মেঘনা। অফিসে সারাদিন লোকের ভীড়ে মন্দ কাটেনা, কিন্তু এই ঘরে ঢুকলেই নিজেকে বড্ড অসহায় লাগে ওর। যেনো এই ভাড়ার ঘর আর ও ছাড়া পৃথিবীতে কেউই নেই। সব রেখে সবে ফ্রেশ হয়ে এসে বসেছে তখনই কলিং বাজলো। ও ভেবেছিল সায়ন এসেছে, কিন্তু দরজা খুলে এনায়েত সাহেবকে দেখে চমকে উঠলো মেয়েটা!
চলবে…