#তোর_রঙে_হবো_রঙিন
#লেখনীতে_মেহেরীন
#পর্ব – ২০
প্রেগনেন্সির খবরটা জানতে প্রায় দুই মাস লেগে গেলেও পরের মাসগুলো যেনো খুব দ্রুত কেটে যাচ্ছে। বর্তমানে আলিশা প্রায় আটমাসের গর্ভবতী, শুরুর মাসগুলোতে সমস্যা না বলেও থার্ড ট্রাইমিস্টারে শারীরিকভাবে ভীষণ দুর্বল হয়ে পড়েছে মেয়েটা। সাত মাসের পর থেকেই মর্নিং সিকনেস বেড়েছে, জায়ানের জোরাজুরিতে জবটা ছেড়েছে আরো আগেই। অবশ্য শরীরও সায় দিচ্ছিলো না তাই আর এ অবস্থায় জব কন্টিনিউ করার সাহস করেনি। রাতে…ঘুমের মধ্যে পাশ থেকে ফোঁপানোর শব্দে ঘুম ভেংগে গেলো জায়ানের, হুড়মুড়িয়ে উঠে বললো…
‘ কি হয়েছে? অস্বস্তি লাগছে?’
আলিশা বিছানায় হেলান দিয়ে বসে ছিলো, ফোনটা ঘুরিয়ে জায়ানকে দেখিয়ে বললো…
‘ এই দেখো, বাঘটা কিভাবে হরিণটাকে খেয়ে নিলো! এবার হরিণের বাচ্চার আর ওর পরিবারের কি হবে?’
জায়ান হতবিহ্বল হয়ে বসলো, এই সামান্য একটা বিষয়ে কান্না করছে মেয়েটা? আলিশার হাত থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো…
‘রাত বিরাতে এসব কি দেখছো? আর জেগে আছো কেনো এখনও? তোমাকে না আমি ঘুম পাড়িয়ে দিলাম?’
আলিশা চোখ মুছে নাক টেনে বললো…
‘ ঘুম আসছেনা, ভালো লাগছেনা কিছু ‘
ইদানিং রাতে একদমই ঘুমাতে পারছেনা মেয়েটা, শান্ত মেয়েটার হুট করে মারাত্মক মুড সুইং শুরু হয়েছে। জায়ান এই নিয়ে ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছে কিন্তু ডাক্তারের ভাষ্যমতে এরকম হওয়া অস্বাভাবিক না। আলিশার খারাপ লাগলেও জায়ান কিছু করতে পারছেনা! জায়ান সাইড ল্যাম্প জ্বেলে আলিশাকে কাছে টেনে আদুরে গলায় জিজ্ঞাসা করলো…
‘ভেবে বলো কি করলে ভালো লাগবে?’
‘আমার খিদে পেয়েছে’
‘ গুড! আজ সারাদিন ভালোমত কিছু খেতে দেখিনি তোমায়। কি খাবে বলো? এনে দিচ্ছি ‘
‘আমাকে ঝাল করে এক বাটি নুডুলস রান্না করে দাও ‘
কথাটা বলতে গিয়েই যেনো আলিশার জিভে পানি চলে এলো, কিন্তু ওর এই আবদার মানতে নারাজ জায়ান!
‘ঝাল খাওয়া যাবেনা, অন্যকিছু বলো ‘
‘ না! আমার ঝাল কিছু খেতে ইচ্ছে হচ্ছে ‘
‘ সরি, বউ! তোমার সব আবদার মানতে রাজি কিন্তু এটা না। অতিরিক্ত ঝাল খেলে পেটে যন্ত্রণা হবে। গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা বাড়বে। আমি বরং তোমাকে পপকর্ন এনে দেয়, মধু মিক্স করে দেবো’
এ কথা শুনেই আলিশা নাক কুচকালো, ধাক্কা দিয়ে জায়ানকে সরিয়ে রেগে বললো…
‘ তুমি না এখন অনেক খারাপ হয়ে গেছো, একটা আবদার শোনো না আমার। আগে যা খেতে চাইতাম এনে দিতে কিন্তু এখন…আমাকে একটুও ভালোবাসো না ‘
‘ আমি তো তোমার ভালোর জন্যে বলছি ‘
ভারী শরীরটা নিয়ে একটু সরতেও সময় লাগে আলিশার, ও গিয়ে বিছানার এক পাশে গিয়ে গুটিসুটি মে’রে শুয়ে পড়লো। জায়ান পড়লো মহা বিপদে কারণ যেদিন রাতে কিছু খাওয়ার ক্রেভিং হয় সেটা ওকে না দিলে পরেরদিন সারাদিন মুখ গোমড়া করে থাকে। অগত্যা, মরিচের বদলে বেশি করে সস দিয়ে এক বাটি নুডুলস রান্না করে নিয়ে এলো। ওমনি আলিশার সব রাগ যেনো উবে গেলো! মাতৃত্বের স্বাদ আলিশা উপভোগ করছে ঠিকই কিন্তু জায়ানও পিতৃত্বের স্বাদ উপভোগ থেকে বঞ্চিত হতে চায়না তাই আলিশার সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করে। বেবির প্রতিটা কিক অনুভব করার চেষ্টা করে, তবে…বাচ্চার থেকে বেশি নিজের স্ত্রীকে নিয়ে তার চিন্তা। আলিশার একটু ব্যথা লাগলে উল্টে বেবিকেই বকা দেয়। ওর এইসব কান্ড দেখে আলিশা বেশ ইনজয় করে। জীবনের এই বিশেষ সময়টা সুন্দরভাবে উপভোগের স্বপ্ন প্রতিটা মেয়েই দেখে। ওদের জীবনে সুখ থাকলেও সায়ন যেনো সুখের হদিস পাচ্ছেনা। ভেবেছিল মেঘনাকে বিয়ের প্রপোজাল দেবে কিন্তু তার আগেই মেঘনা সাফ জানিয়ে দিয়েছে সে এখন বিয়ে করতে চায়না। সেক্রেটারির চাকরিও ছেড়ে দেয় কয়েকমাস আগে। সায়নও জোর করেনি, মেঘনা কখনো জানায়নি কেনো সে সায়নের দিকে এগোতে চায়না। কিন্তু সায়ন কিছুটা হলেও বিষয়টা ধারণা করতে পেরেছিল, এনায়েত সাহেবের সঙ্গে একবার এই নিয়ে আলোচনা করতে গিয়েও থেমে গেছিলো কারণ বাবার স্বভাব সে বদলাতে পারবে না আর তার বাবার কথায় যদি মেঘনা দূরে কোথাও চলে যায় তখন? মেঘনা চোখের সামনে আছে এটুকুই শান্তি, মেয়েটা যদি কষ্ট পেয়ে গণ্ডির বাইরে কোথাও চলে যায় তখন কি হবে? মেঘনাকে হারানোর ভয় থেকেই সায়ন আর ওর বাবাকে কিছু বলেনি কিন্তু বাবার প্রতি এখন আর আগের মত টান আসেনা ছেলেটার। সন্তানের ভালো চাইতে গিয়ে মা বাবারা যখন তাদের সার্বিকভাবে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করতে শুরু করে, একসময় সেইসব সন্তানরাই দূরে সরে যেতে থাকে। জায়ান তো শুরু থেকেই নিয়ন্ত্রণে নেই, এবার সায়নের নিয়ন্ত্রণও হাত থেকে হারিয়েছেন এনায়েত সাহেব
__________________________________
৫ বছর পর…. অ্যালার্মটা বেজে যাচ্ছে আপনমনে। বিছানার এক কোণে জায়ান উবু হয়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে। অ্যালার্ম বন্ধ করার একটুও ইচ্ছে হচ্ছেনা। পাশে দাঁড়িয়ে বাবাকে কয়েকবার ঝাঁকিয়ে ওঠানোর ব্যর্থ চেষ্টা করলো আয়ান…
‘আব্বু! গেট আপ! আমার স্কুলের দেরি হয়ে যাবে’
জায়ান ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো — ‘ আর পাঁচ মিনিট ‘
গতরাতে একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিল জায়ান, সেখান থেকে ফিরতে অনেক রাত হয়েছে। ঘন্টা হিসেবে ঘুমটা এখনও পরিপূর্ন হয়নি, গতকাল বিকেলে আলিশা আবার ওর বাবার বাসায় গেছিলো বাবা অসুস্থ বলে। ছেলের স্কুল থাকায় ওকে সঙ্গে নিতে পারেনি, জায়ান গতকাল আলিশাকে বলেছিল ছেলেকে নিয়ে চিন্তা না করতে কিন্তু আজকেই গন্ডগোল করে ফেলেছে। আয়ানও সঙ্গে সঙ্গে মাকে ফোন দিয়ে বাবার কানে ধরতেই ওপাশ থেকে আলিশা বলে উঠলো….
‘ এখনও ওঠোনি কেনো? ছেলেকে স্কুল নিতে হবে মনে নেই? কয়টা বাজে খেয়াল আছে?’
আলিশার গলা পেয়েই হুড়মুড় করে উঠে বসলো জায়ান, ফোনটা কানে ধরে ছেলের দিকে তাকালো। ছেলে ফোকলা দাঁতে হাসছে। জায়ান এক হাতে চোখ মুছে বললো…
‘ আ..আলিশা! আমি উঠেছি তো ‘
‘ তুমি উঠলে ছেলে আমাকে ফোন করতো না। দ্রুত গিয়ে ওকে তৈরি করে দিয়ে এসো। আমি সন্ধ্যায় বাসায় আসবো ‘
ফোন কেটেই ছেলের দিকে হতাশা নিয়ে তাকালো জায়ান…
‘ছেলে হয়ে বাপের সাথে সাত সকালে এইরকম বেইমানি করতে পারলে? তুমি না আব্বুর গুডবয়?
আয়ান না সূচক মাথা নেড়ে বললো…
‘ আমি আমার আম্মুর ছেলে। আম্মু বলেছিলো তুমি উঠতে দেরি করলে ফোন করতে ‘
কাবেরী বেগম নিচ থেকে ডাকতেই আয়ান ছুটে চলে গেলো, জায়ান সাবধানে যেতে বললো কিন্তু বাচ্চারা কি ছোটাছুটির সময় আর কারো কথা শোনে? আয়ান ভীষণ চঞ্চল! একাই পুরো বাসা মাথায় করে রাখে, মাঝে মাঝে এনায়েত সাহেব তো বলেই ফেলেন যে একেবারে জায়ানের মিনি ভার্সন! জায়ানের আজ হঠাৎ নিজের ছেলেবেলার স্মৃতি মনে পড়ে গেলো। সুযোগ পেলে মাঝে মাঝে এনায়েত সাহেবকেও এভাবেই ছোটবেলায় বিরক্ত করতো। জায়ান হাসলো…
‘ আমারই ছেলে এটা, কোনো সন্দেহ নেই ‘
আলিশার কাছে ছেলে একদম মুরগির বাচ্চা মতো থাকলেও সব দুষ্টুমি এসে করে জায়ানের কাছে। ছেলেকে একবেলা সামলাতে গিয়েই বেচারার যেনো ঘাম ঝরে যায়। সকাল আটটায় ক্লাস! ছেলেকে গুছিয়ে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এসে জায়ান বসলো নাস্তার টেবিলে। ঘুমটা পরিপূর্ন হয়নি, মাথা ব্যথা করছে। এনায়েত সাহেব খবরের কাগজ পড়ছিলেন। পাতা উল্টাতে উল্টাতে একনজর ছেলের দিকে তাকিয়ে বললেন…
‘ তুইও একসময় এভাবেই আমার হাড়মাস জ্বালিয়ে খেয়েছিস। ছেলের বাবা হয়ে এবার নিশ্চয়ই আমার জায়গায় নিজেকে দাড় করাতে পারবি ‘
খেতে খেতে জায়ান হাসলো…
‘সমস্যা নেই বাবা, বাচ্চা মানুষ দুষ্টুমি করবেই। আমরা ওকে সঠিক শিক্ষা অবশ্যই দেওয়ার চেষ্টা করবো তবে ওকে কন্ট্রোল করার চেষ্টা করবো না। স্বাধীনতা পেলে বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভালোমন্দ নিজেই বুঝতে শিখবে। তাই আমার হয়তো নিজেকে তোমার জায়গায় দাড় করানোর সুযোগ হবেনা ‘
এনায়েত সাহেব চোখ তুলে তাকালেন, জায়ানের ওদিকে পাত্তা নেই। কাবেরী বেগম পাশ থেকে ইশারায় থামতে বললেন, কিন্তু এখন থেমে কি আর লাভ হবে? ওদিকে…মেঘনার বাসার সামনে দাড়িয়ে আছে সায়ন। বছর চারেক আগে নিজের পুরোনো বাসা ছেড়ে নতুন আরেকটা বাসায় ভাড়া এসেছে মেঘনা। বলতে গেলে সায়নের নাগাল থেকে একটু দূরে এসেছে, কিন্তু সায়ন সুযোগ পেলেই এসে দেখা করে। মেঘনা সকালে বাজারে গেছিলো, এসে বাড়ির নিচে সায়নকে দেখলো। মেঘনার চোখে চশমা দেখেই সায়ন বলে উঠলো…
‘সুন্দর চোখদুটো চশমা দিয়ে আড়াল করেছো কেনো?’
মেঘনা স্মিত হাসলো…
‘মাথা ব্যথা হয়েছে, ডাক্তার দেখিয়ে চশমা নিয়েছি। আপনি আজ হঠাৎ এদিকে?’
‘হুমম, এদিকে কাজ আছে তাই ভাবলাম একটু আগে এসে তোমার সঙ্গে দেখা করে যাই’
‘ আসুন তবে, একসঙ্গে ব্রেকফাস্ট করি ‘
মেঘনার এই ঘরটা দুইরুমের, একটায় ডাইনিং ওখানেই একপাশে রান্নাঘর। আরেকটা থাকার ঘর। ছোটো, তবে গোছানো। সায়ন একনজর দেখে নিলো মেঘনার ঘরে কোনোকিছুর অভাব আছে কিনা। একটু পরে মেঘনা এক প্লেট সব্জি খিচুড়ি ও চামচ এনে দিলো।
‘ এবার বলুন, কেমন আছেন আপনি?’
সায়ন খেতে খেতে উত্তর দিলো — ‘ যেমন রেখে এসেছিলে ‘
মেঘনা নিরব রইলো, সায়নের বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলো ঠিকই কিন্তু ওর প্রতি দুর্বলতা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেয়েটা। বলতে গেলে সে সুযোগও সায়ন দেয়নি!
‘প্রতিবার এখানে আসার সময় একটা ভয় হয়, এই ঠিকানায় এসে তোমায় পাবো কিনা। তুমি আবার ফাঁকি দিয়ে কোথাও চলে গেলে কিনা ‘
‘চার বছর হয়ে গেছে, এখনও এইসব চিন্তা আপনার মাথায় ঘোরে?’
সায়ন চোখ তুলে তাকালো…
‘হুমম, ভয় হয়। এমনিতেই অনেকটা দূরে আছো। এখান থেকে কোথাও চলে গেলে আমি তো জানতেও পারবো না আর তুমিও আমায় জানতে দেবেনা’
‘অন্য কোথাও গিয়ে থাকবো সেই সাহস আমার নেই। যা পরিচিত আছে সব এই শহরেই, এর বাইরে গেলে সম্পূর্ন একা পড়ে যাবো। জীবনে এমনিতেই একা, আর একাকীত্ব চাইনা। তাই এসব নিয়ে অযথা চিন্তা করবেন না। ‘
সায়ন নিরবে চেয়ে রইলো মেয়েটার দিকে, মেঘনা এখানে আসার পর থেকেই সবসময়ই সায়নের মন খুঁতখুঁত করে। মেয়েটা দূরে কোথাও পালানোর ধান্দা করছে না তো? মাঝে মাঝে ওর ইচ্ছে হয় মেয়েটাকে ধরে বেঁধে নিজের কাছে নিয়ে যেতে কিন্তু…ভালোবাসার মানুষকে জোর করাটা যে সবচেয়ে বড় কাপুরুষতা আর মেঘনার চোখে সারাজীবন শুধু শুধু সুপুরুষ হিসেবেই থাকতে চায় সায়ন!
চলবে….