#তোর_শহরে_রেখেছি_পা
#পর্ব_২৩
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
খান বাড়িতে খুশির জোয়ার বইছে। কারন নতুন অতিথি আসছে । আফরিন অজ্ঞান হওয়ার পরই নাহিয়ান খান ডাক্তার ডেকে আনে এটা অবশ্য আরুহি বলে কারন ওর সন্দেহ হচ্ছিল হচ্ছিল আফরিন প্রেগন্যান্ট কিনা। ডাক্তার দেখে তারপর বলে আফরিন মা হতে চলেছে খান সাহেব মিষ্টি খাওয়ান। আর কাল হাসপাতালে গিয়ে সিওর হতে বলে। এ কথা শুনেই খুশির বন্যা বয়ে যাচ্ছে খান পরিবারে। এতকিছুর মাঝেও দুজনের মুখের অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে না তারা খুশি না দুঃখী। তারা হচ্ছে আফরিন আর আরহাম। আরুহি খুশি হলেও একটু টেনশনে আছে। সে আপাতত তার ভাইয়ের হাত ধরে বসে আছে। জ্ঞান ফেরার পর থেকেই আফরিন খবর শুনে কেমন যেনো থম মেরে আছে। ও যেনো নিজের কান কে বিশ্বাস করছে না। ও ভয় ও পাচ্ছে কারন ওরা প্ল্যান করেছিল আফরিনের পড়াশোনা শেষ হলে বেবি নেবে। কিন্তু এখনই! সবই আল্লাহর ইচ্ছা। ওরা আজকে খান বাড়িতেই থাকবে। সবাই হবু নতুন বাবা মাকে স্পেস দিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। সবাই গেলে আফরিন আরহামের দিকে তাকালো। আরহাম নির্লিপ্ত ভাবে আফরিনের দিকে তাকিয়ে আছে। তা দেখে আফরিন মনে করলো আরহাম খবরটা শুনে খুশি হয় নি। আফরিন কেঁদে উঠলো তা দেখে আরহাম উঠে এসে আফরিন কে জরিয়ে ধরলো। তখন আফরিন বলল,,,
“সরি আমি বুঝতে পারি নি এখন-ই এরকম কিছু হবে। আমরা তো প্ল্যান করেছিলাম আমার পড়াশোনা শেষ করার পর বেবি নেব। আপনি নিশ্চয়ই খুশি হন নি তাই না। তাই তো আপনার মুখে হাসি দেখা যাচ্ছে না আর কিছু বলছেন ও না।”
তখন আরহাম বলল,,,
“আরে বোকা মেয়ে কাঁদছো কেন? আমি খুব খুশি হয়েছি তুমি জানো না তুমি আমাকে কি অনুভুতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিলে। এই অনুভুতি সকল ছেলের কাছে বেস্ট অনুভুতি বাবা হওয়ার অনুভূতি । আমি তো খবরটা শুনেই ভুলে গেছি আমি কি রিয়্যাক্ট দেব আর তুমি ভাবলে আমি খুশি হইনি। আলহামদুলিল্লাহ আমি অনেক খুশি হয়েছি। কিছু অনুভুতি বলে কয়ে বোঝানো যায় না। শুধু আলহামদুলিল্লাহ বলে শুকরিয়া আদায় করা যায়। আর বাকি রইল বেবি না নেওয়ায় প্ল্যান। হ্যা সেটা আমরা করেছিলাম। । কিন্তু আল্লাহ চেয়েছেন এভাবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী। বাচ্চা হচ্ছে আল্লাহর বড় একটা নেয়ামত। তাই তো আমাদের কোল আলো করে আমাদের সন্তান আসবে।
(রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন,,’ যদি আল্লাহ সৃষ্টির ইচ্ছা করেন তাহলে তুমি তা প্রতিরোধ করতে পারবে না।’ আল্লাহ তায়ালা এখন চেয়েছেন আমাদের সন্তান দান করবেন তাই দিয়েছেন।এটা নিয়ে চিন্তা করো না। আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করো। আলহামদুলিল্লাহ আমাদের সন্তান কে সুন্দর ভাবে পৃথিবীতে আনুক। তার আগমনে আমাদের জীবন আরো রঙিন হয়ে উঠুক।
তখন আফরিন আরহামের বুক থেকে মাথা তুলে বলল,,
“আমিন!”
“সুম্মা আমিন মেরে রানী। আলহামদুলিল্লাহ আজ আমি কতো খুশি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবো না।”
আরহাম এর মুখ দেখে আর কথা শুনে মূহুর্তেই সকল ভয় দূর হয়ে গেল। আর মুখে হাসি ফুটে উঠল। আপনাআপনি হাতটা পেটের ভেতরে গেল। আরহাম বলল,,,
“চলো এখন আমরা আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করবো। দুই রাকাত নফল নামাজ আদায় করবো। যাতে আমাদের সন্তান সহি সালামতে পৃথিবীতে আসতে পারে। । আল্লাহ তায়ালা আল কোরআন এ বলেছেন,,
‘যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা আদায় কর তবে আমি অবশ্যই তোমাদের নেয়ামত বাড়িয়ে দেব।
_ (সুরা ইবরাহিম : আয়াত ৭)
“ইনশাআল্লাহ!” হুম চলুন।”
আফরিন আর আরহাম ওযু করে একসাথে নামাজ পড়ে নিল। দোয়া করলো যাতে সকলে বালামসিবত কাটিয়ে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভাবে তাদের সন্তান পৃথিবীতে ভুমিষ্ঠ হতে পারে।
_________________________
নিচে আরুহিরা সকলে সোফায় বসে কথা বলছে। মিস্টিকে বলা হয়েছে তার ভাই কিংবা বোন আসবে। সেদিন তো আবরার বুঝিয়েই দিয়েছিল কিভাবে কি হয়। মিস্টি খুশিতে লাফাচ্ছে। আরুহি একটু চিন্তায় পড়ে গেছে। এমনিতেও ওদের ওপর থেকে এখনো NS নামক অভিশাপ যায় নি। তবে ও চেষ্টা করবে নিজের সবটুকু দিয়ে আফরিন আর ওর সন্তান কে রক্ষা করতে। সবার এত আনন্দ দেখে হুট করে আরুহি বলল,,,
“আংকেল আমি একটা কথা বলতে চাই।”
তখন নাহিয়ান খান বললেন,,
“হ্যা কি বলতে চাও বলো?”
“আংকেল আমি চাইনা এখনি আমাদের আত্মীয় স্বজন জানুক আফরিনের প্রেগন্যান্ট হবার ব্যাপারে।
রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘কিছু খুশির সংবাদ গোপন রাখতে হয়। কেননা প্রত্যেক সংবাদ শ্রবণকারী বন্ধু হয় না।’
~তাবরানি হাদিস
আরো কয়েকটা মাস যাক তারপর জানানো যাবে।”
“তাই বলে কাকাকে ও জানাবে না। তার বংশধর আসতে চলেছে।”
“দাদুভাই কে আমি সময়মতো জানিয়ে দেব। এখন বেশি জানাজানি হলে আফরিন এর লাইফ রিস্ক হতে পারে। আপনারা নিশ্চয়ই আমাদের সম্পর্কে জ্ঞাত।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তুমি যা বলছো তাই হবে। তবে হ্যা আফরিন আমাদের বাড়িতে থাকবে এখন থেকে। আর তোমরাও। ”
তখন ওপর থেকে আওয়াজ আসলো,,,
“না বাবা এটা সম্ভব না। আমি আমার শুশুরবাড়িতেই থাকবো তবে আমার যখন আট মাস হয়ে যাবে তখন এখানে আসবো। তুমি চিন্তা করো না আমার যত্নের কোন ত্রুটি হবে না।”
আফরিন আর আরহাম সিঁড়ি দিয়ে নামছে। আর আফরিন ই এই কথা বলল। তখন নাহিয়ান খান বললেন,,
“আমি জানি তোমার কোন যত্নের ত্রুটি হবে না। কিন্তু আরুহি আর আরহাম তো নিজেদের কাজে চলে যাবে তখন তুমি একা একা কি করবে।”
“আহ হা বাবা তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আরুহি আর আমি একই কলেজে পড়ি।আরুহি সবসময় আমার সাথেই থাকে। এমন কি আরুহি উনি না আসা পর্যন্ত আমার সাথেই থাকে এমন কি আমরা পড়িও একসাথে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে তোমরা যা চাও তাই হবে। এখন ডিনার টাইম সকলে খেতে বসো। আর আফরিন তোমার কি খেতে মন চাইছে তোমার মাকে বলো।”
“বাবা চাইলেও তো খাওয়া যাবে না। কারন সবকিছুর স্মেল আমার ভালো লাগে না। দেখি এখানে যা রান্না হয়েছে সবকিছু টেস্ট করে দেখি যেটা ভালো লাগে সেটাই খাবো।”
ওরা সবাই খেতে বসলো। আফরিন কোন রকমে খেল। আরহাম আফরিন কে নিয়ে রুমে চলে গেল। আরুহি নিজের রুমের দিকে যেতে লাগলো। তখন আবরার পাশ থেকে বলল,,,
“মিস আপনি কি নিশু কে নিয়ে চিন্তিত?”
তখন আরুহি আবরারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলল,,,
“প্রথমে একটু চিন্তা হচ্ছিল পরে একটা কথা মনে পরতে আর বেশি চিন্তা হচ্ছে না। নিশ্চয়ই কোন সমস্যা হলে আমরা সেটা কাটিয়ে উঠতে পারবো ইনশাআল্লাহ। কারন,
“আল্লাহ মানুষের উপর তার সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না!”
~সূরা বাকারা~২৮৬
তবে আমাদের সাবধানে থাকতে হবে। তাকে জানতে দেওয়া যাবে না আমাদের বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে।”
“মিস আপনাকে যত দেখি তত অবাক হয়ে যাই। আপনি সবকিছু আল্লাহর ওপর বিশ্বাস রেখে করেন তাই তো সবকিছু আপনাআপনি সহজে হয়ে যায়।”
“আল্লাহ তায়ালা আল কোরআন এ বলেছেন,,
“তোমরা ভয় করো না; আমি তো তোমাদের সাথেই আছি। আমি সবকিছু শুনি ও দেখি!”
~সূরা ত্ব-হাঃ ৪৬
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে।”
~সূরা আল-ইমরানঃ ১৫৯
তাহলে বলুন তো কেন আল্লাহর ওপর ভরসা রাখবো না। তার হুকুম ছাড়া একটা পাতাও নড়ে না। তিনিই সর্বজ্ঞানী উত্তম পরিকল্পনাকারী। তিনি যা করেন ভালোর জন্যই করেন। কিসে বান্দার কল্যান হবে সেটাই তিনি তার বান্দাকে প্রদান করেন।”
“বুঝতে পেরেছি ম্যাডাম আপনাকে আর বোঝাতে হবে না। আপনি যান এখন রুমে যান। গুড নাইট হ্যাভ এ সুইট ড্রিম। ফি আমানিল্লাহ!
“ধন্যবাদ এবং ইনশাআল্লাহ!”
আরুহি ওর রুমে ঢুকে পড়লো। আবরার ও নিজের রুমে চলে গেল।
__________________
পরের দিন আরুহি রা সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলো তার যার যার কাজে। আফরিন এর মা চাচি আফরিন কে অনেক টিপস্ দিয়েছে। কোন সমস্যা হলে যেনো সেগুলো অ্যাপ্লাই করে । আর নিজের খেয়াল রাখে যেনো। আরো অনেক কিছু। আফরিন আর আরুহি কলেজে এসেছে আফরিন হুট করে বলল,,,
“ভালোই হয়েছে তাইনা বল!”
“কি ভালো হয়েছে?”
“আরে বাবা কয়েকদিন পরেই আমাদের ফাস্ট ইয়ারের পরীক্ষা। আর বেবি ও আসবে সামনে বছর। বেবি হয়ে গেলে তার দু মাস পরে পরীক্ষা হবে। আমি তো ভেবেছিলাম আমার একবছর গ্যাপ যাবে। সকাল বেলা থেকেই আমি এই জিনিস টা ভাবছিলাম তাই তো আগে এসে স্যার কে জিজ্ঞেস করলাম। সব শুনে কি যে খুশি আরু তোকে বোঝাতে পারবো না।”
“তা এই চিন্তাই -ই তুই ভাবুক কাজী নজরুল ইসলাম হয়ে গেছিলি। উল্টো আমি আর ভাইয়া ভাবছিলাম অন্য কথা যাক গে! খারাপ লাগলে আমাকে বলিস কিন্তু।”
“মাই সুইট ননদিনী আপনি ছাড়া আমার আছে টা কে শুনি কিছু হলে আপনাকেই আগে বলবো।”
“হুম এখন ক্লাসে যাই।”
“হুম চল।”
______________________
ক্লাস শেষ করে বেরিয়ে আরুহি আর আফরিন দেখলো আরহাম দাঁড়িয়ে আছে। আফরিন এগিয়ে গিয়ে বলল,,,
“আরে আপনি এসময় এখানে?”
“তোমাকে ডাক্তারের দেখাতে হবে ভুলে গেলে নাকি?”
“ওটা তো আমি আরুহির সাথেই দেখাতে পারতাম আপনি আবার কষ্ট করতে এলেন কেন?”
“ইউ নো আফরিন বাচ্চার বাবা আমি। আমার বাচ্চার সব কাজে আমি থাকবো তোমার তাতে কি?এখন চলুন রানীসাহেবা।”
তখন আরুহি মুচকি হেসে বলল,,
“তা হবু মা বাবা আপনারা ভেতরে যান সবকিছু করুন। আমি বরং বাড়ি যাই।”
তখন আরহাম বলল,,
“এই না দারা তুই ও যাবি আমাদের সাথে। আর আফরিন তোর সাথেই বাড়িতে যাবে। আমি এখান থেকেই আবার অফিসে যাবো।”
“আচ্ছা ঠিক আছে!”
আরহাম আফরিন আর আরুহি ডাক্তারের কাছে গেল। উনি আফরিনের প্রেগনেন্সি টেস্ট করতে দিলেন। । আরুহি ওদের ভেতরে রেখে বাইরে এসে দাঁড়ালো। তখন আবরার ওকে দেখে এগিয়ে এসে বলল,,
“কি হয়েছে মিস একা একা দাঁড়িয়ে আছেন?”
“ভেতরে ভাইয়া আর ভাবি ডাক্তারের সাথে কথা বলছে। তাই আমি এমনিই দাঁড়িয়ে আছি।”
“ওহ আচ্ছা কফি খাবেন?”
“হুম খাওয়া যায় ওদের দেরি হবে। সবে তো টেস্ট করতে দিল। ওটার রিপোর্ট আসবে তারপর কথা বলবে তারপর আমরা বাড়ি যেতে পারবো। আর ভাইয়া বলেছে সব দায়িত্ব সে নেবে। আমাকে পরে সব জানিয়ে দেবে।”
“ওহ আচ্ছা তো যাওয়া যাক!”
“হুম চলুন।”
আবরার আর আরুহি কলেজ থেকে বেরিয়ে একটা পাশের ক্যাফেতে গেল। কারন আবরার চাইছিল আলাদা একটা জায়গায় যেতে এমনি কলেজে সবাই ওদের চেনে এভাবে কফি খেতে দেখলে অন্য কিছু ভাবতে পারে। ওরা দুজনের জন্য কফি অর্ডার করলো। হুট করে আরুহি বলল,,
“মিস্টার নিশান আপনি স্পাই হিসেবে কতোদিন ধরে আছেন?”
“এই তো একবছর হবে। ইন্টার্নশিপ করার আগে যোগ দিয়েছি। ”
“কারো রেফারেন্স ছিল কি?” না মানে এই ভাবে পড়াশোনার মাঝেই স্টার্ট করেছেন তাই জিজ্ঞেস করলাম।”
“হুম বুঝতে পেরেছি। হুম ছিল একজন তবে আপনাকে এখন নাম বলতে পারবো না। পরে একদিন বলবো ওটা সিক্রেট। তবে এখানে আমার যোগ্যতাটাই বেশি।”
“ওহ আচ্ছা।”
“তা আপনার রেফারেন্স এ তো ছিল আপনার ভালোবাবা।”
“ভালোবাবা না থাকলে তো আমি কখনোই এতো তাড়াতাড়ি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারতাম না। আমার যে বয়স! এই বয়সে কেউ সি আই ডি অফিসার হতে পারে না। শুধু মাত্র ভালোবাবা সব ট্রেনিং দিয়েছিল। আর কার কাছে থেকে যেনো আমার জন্য সুপারিশ করিয়েছিল।নিজে তো করেই ছিল আরো ওপর মহল থেকে কারো থেকে অ্যাপ্রোভাল নিয়ে এসেছিল। তারপরে আমার কাজের স্কিল দেখে এখানে আসতে পেরেছি। আর এটাও বলা আছে আমি যেকোন সময় চাকরিটা ছেড়ে দিতে পারি।”
“আপনি দেখছি সব কাজেই ফুল প্রুফ প্ল্যানের সাথেই করেন।”
“আপনি কি একজন ডাক্তারের পাশাপাশি স্পাই অফিসার হয়ে থাকবেন।”
“আমার স্পাই হওয়ার পেছনেও একটা গল্প আছে সেটা আপনাদের শত্রু কে ঘিরেই। আমিও আপনার মতো তাকে ধরতে পারলে কাজ টা ছেড়ে দেব।”
আরুহি অবাক হয়ে বলল,,
“সে আবার আপনার কি ক্ষতি করেছে?”
“আমার সাথে আমার বাবার সম্পর্ক নষ্ট হওয়ার পেছনে তার হাত আছে। আমার যখন ষোলো বছর বয়স তখন আমার একটা বন্ধু ছিল। সে বন্ধুটা আমাকে একটা ব্যাগ রাখতে দিয়েছিল। আমিও কোন কিছু না ভেবেই সেই ব্যাগটা আমার সাথে নিয়ে যাই। তখন বাবা যতক্ষন পারতেন আমাদের সময় দিতেন আমার কাছে এক্সট্রা ব্যাগ দেখে তিনি সেই ব্যাগটা চেক করেন আমি জানতাম ও না সে ব্যাগে কি আছে। সেই ব্যাগটা খুলে তিনি কিছু ড্রাগ পান। তারপর আমার কোন কথা না শুনেই আমাকে দরজা বন্ধ করে মারেন। সেদিন উনি আমাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিলেন। চোখ বন্ধ করলে আমি আজও সেই দিন টা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে।
এই টুকু বলেই আবরার থেমে গেল ওর চোখ দুটো ভিজে উঠলো। কিন্তু ও কাঁদবে না। ছেলেদের যে কাঁদতে নেই।আরুহি বুঝতে পারল আবরারের মনের অবস্থা। আরুহি কিছুক্ষণ সময় দিল আবরার কে আবরার নিজেকে সামলিয়ে বলল,,,
সেদিন উনি আমায় মেরেছে এটা নিয়ে বেশি কষ্ট না পেলেও সবথেকে বেশি কষ্ট পেয়েছিলাম উনি আমার কথা শোনার প্রয়োজন-ই মনে করেন নি। আমি বারবার বলেছি বাবা এই ব্যাগটা আমার না । এই ব্যাগে এগুলো আছে আমি কিছুই জানি না। কিন্তু উনি আমার কোন কথাই শুনেন নি। আমাকে বুঝতেই চান নি। আমি তখন টিনেজার ছিলাম বাবা ভেবেছিলাম হয়তো বখে গেছি। উনি রাতেই ওগুলো পুরিয়ে ফেলেন। আমি সারারাত ধরে ব্যাথায় কাতরাচ্ছিলাম সেদিন কাকি কাকাই, রিয়াদ আর নিশু ছিল আমার পাশে নিশু কতো কাঁদছিল। সেদিন কার রাতটা আমার জন্য কতোটা যন্ত্রনাময় ছিল কি বলবো। সেদিন অবশ্য আমার মা নামক মানুষটাও আমার পাশে এসে কাঁদছিলেন। হয়তো ভাবছিল তার অনুপস্থিতিতে তার ছেলে খারাপ পথে গেছে। আমার জন্য সেদিন প্রথম নাসরিন খান কে কাঁদতে দেখেছিলাম। বাবা নামক মানুষটাকে ও দেখেছিলাম বারবার আমার রুমের সামনে দিয়ে হেটে যেতে। হয়তো নিজেও ভাবতে পারে নি আমার সাথে এরকম করবে। তারপর থেকেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম যার জন্য আমি আজ কষ্ট পাচ্ছি আমার বাবা মা আমার পরিবার কষ্ট পাচ্ছে তাকে আমি একদিন শাস্তি দেব। পরের দিনই জানতে পারি আমাকে বিদেশ এ পাঠিয়ে দেবে। আমি সাফ সাফ জানিয়ে দিই আমি বিদেশে যাবো না আমি আমার পরিবার কে ছেড়ে কোথাও যাবো না। কিন্তু বাবা আমাকে জোর করে তার জন্য আমি একসময় আর সহ্য করতে না পেরে অসুস্থ অবস্থায় -ই বাড়ি থেকেই বেরিয়ে যাই। আমি আমার একটা বন্ধুর বাড়িতে যাই। সবাই আমাকে খুঁজতে থাকে তখন কাকাই আর রিয়াদ ভাইয়া আমাকে খুঁজে পায় তারপর জানায় আমি যা চাই তাই হবে বাবা আর আমাকে জোর করবে না। তাই আমিও বাড়ি চলে আসি। তারপর থেকে উনি আর আমাকে জোর করেন নি। আমি সুস্থ হয়েই আমার সেই বন্ধু কে ধরি ও এগুলো কেন আমার কাছে দিয়েছে। পরে ওর কাছে থেকে জানতে পারি ও একজন ড্রাগ অ্যাডেক্টেড। ও বলল তার বাড়ির ওদিকে পুলিশ চেক করছিল তাই ও আমার কাছে রাখতে দিয়েছিল পরের দিনই নাকি ওগুলো ও ওর বড় ভাইকে দিয়ে দিত। তারপর থেকেই আমি সবার অগোচরে সব খবর নিতে থাকি কোথা থেকে কে সাপ্লাই দেয়। আর সেগুলো পুলিশ কে ইনফর্ম করে দেয়। আর ততদিনে নাহিয়ান খান ও নিজের ভুল বুঝতে পারে। কিন্তু আমি তো তার থেকে অনেক দূরে সরে গেছি। তারপর থেকে ওভাবেই লুকিয়ে লুকিয়ে সব খবর নেওয়া শেষ এ জানতে পারি এই সব কিছুর মেন হোতা NS.তারপর থেকেই আমি নিজেকে তৈরি করি আমার এক আংকেল ছিলেন পুলিশ তিনি আমাকে সাহায্য করে। নিজেকে তৈরি করার পর তার রেফারেন্স এ এখানে স্পাই হতে পেরেছি তারপর আমার কাজ দেখে আমাকে নেয়। আমি কয়েকটা ড্রাগপাচার কারীকে ধরিয়ে দিয়েছিলাম এই জন্যই মূলত আমাকে স্পাই হিসেবে নেয়।। স্পাই হওয়ার পর NS কে ধরার জন্য সব চেষ্টা করি কিন্তু তাকে ধরা আমার পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তারপরেই আপনাদের সাথে আমার দেখা হয়। তারপর তার সম্পর্কে জেনে এখন তার ওপর নজর রাখছি। অবশ্য আরেকটা কারন ও আছে তার জন্যই আমার মা তার জীবনের থেকে প্রিয় প্রফেশনটা ছেড়ে দিয়েছে। এটা আমি কি করে নেব।
আরুহি খুব মনোযোগ দিয়ে আবরারের কথা শুনলো। সব শুনে এখন বুঝতে পারলো কেন আবরার ওর বাবা মায়ের থেকে দূরে। ওর মা ওকে সময় দিতো না তা আমার বাবা ওকে কোন সুযোগ না দিয়ে মেরেছিল বলে। আর NS এর জন্যই ওর বাবার মধ্যে ওর দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। আরুহি বলল,,
“এবার বুঝতে পারলাম আমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি পেয়ে গেছি।”
“কি পেলেন তাতে?”
“ওসব নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না।”
তখনি আরহাম এর কল এলো। ওদের কথা এখানেই সমাপ্ত হলো। ওরা বেরিয়ে কলেজে গেল। আরহাম জানায় টেস্টের রিপোর্ট আসলে ডাক্তার সিওর হয়ে বলেন আফরিন এক মাসের প্রেগন্যান্ট। ডাক্তার বললেন সব ঠিক নরমাল আছে। কিন্তু আফরিন কে একটু দেখেশুনে রাখতে বলল। সবকিছু শুনে আরহাম আর আফরিন এর খুশি আর দেখে কে।
আরুহি আফরিন কে নিয়ে খুশি মনে বাড়ি গেল। আর আবরার কেও খবর টা জানিয়েছে আরহাম।
রাতে আবরার বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আছে। আজ আরুহিকে সব জানাতে পেরে নিজেকে হালকা লাগছে। প্রিয়সী তুমি জানো নিজেকে অন্যরকম সুখী মনে হচ্ছে। কিন্তু তোমার জন্য হৃদয় টা ব্যকুল ও হয়ে উঠছে। হুট আবরার বলে উঠলো,
“নিঃশ্বাস সম দূরত্ব মানেই কাছের নয়
দৃষ্টির বাহির হলেই অদৃশ্য নয়!
প্রত্যেকের এমন একটা মানুষ থাকে যার জন্য তার কখনো অনুভূতি হারায় না।
তেমন টা আমার মনে হয় তুমি সবসময় আমার সাথেই আছো।”
_____________________
তিন মাস পর,,
রাতে আফরিন ড্রাইনিং টেবিলে বসে আছে। আরুহি আর আরহাম ওকে এটা ওটা এগিয়ে দিচ্ছে। মোট কথা আফরিন কে দুজনে মিলে খাওয়াচ্ছে ডাক্তার ওকে বেশি বেশি খেতে বলেছে। কিন্তু আফরিন তেমন কিছুই খেতে পারছে না। আরুহি বলল,,
“ভাবি এমন করলে কি করে হবে। তুমি না খেলে তো আমাদের প্রিন্স প্রিন্সেস ও খেতে পারবে না।”
“আমি খেতে পারছি না আরু। এতে আমার কি দোষ?”
তখন আরহাম বলল,,
“তোমার দোষ -ই তো তোমার কেন খাবারে রুচি আসে না। এদিকে তোমার জন্য আমার বাচ্চারা খেতে পায় না।”
“যবে থেকে শুনেছেন টুইন বেবি হবে। তবে থেকে আপনারা দুই ভাই-বোন আমার খাবারের ব্যাপারে অত্যাচার করছেন। আরে এতো খাওয়া যায় নাকি?”
“এই কি বললি আমরা তোর ওপর অত্যাচার করি। আচ্ছা আজ থেকে আর খাওয়াবো না ভাইয়া। রেখে দাও উনার যতটুকু ইচ্ছে ততটুকু খাক তাতে আমাদের কি? কিন্তু খবরদার যদি আমার ভাতিজা ভাতিজির কোন অযত্ন হয় তাহলে আফরিন তুই শেষ। এই আরুহিই তোকে শেষ করে দেবে।”
“আরে বাবা রাগ করছিস কেন? তোরা তো জানিসই আমি বেশি খেতে পারি না। তোরা যদি জোর করে না খাওয়াস তাহলে তো আমি আরো খেতে পারতাম না। ওটা তো আমি এমনিই বলেছি। ”
“আচ্ছা ঠিক রাগ করলাম না। এবার খেয়ে নে?”
“হুম।”
তখনি আরহাম এর ফোনে কল এলো। আরহাম কথা বলার জন্য বেলকনিতে গেল। এদিকে আরুহি আর আফরিন দুজনে খুনসুটি করছে। আরহাম কথা শেষ করে আসলো আর আরুহিকে বলল,,
‘বোনু নেহমাত শেখ পালিয়েছে!”
আরুহি মুচকি হেসে বলল ,,
” উনি পালাবে ঠিক আছে কিন্তু এতো সময় লাগালো কেন বুঝলাম না। ”
“এখন তো তোর ডাক পরবে।”
“সেটা আমি জানি। ”
“এখন তুই কি করবি?”
“যে একবার পালিয়ে যায় তাকে কি সহজে বের করা যায় নাকি। তুমি এখন অফিসে যাও। আর বলে দিও A.K এর কাজ আছে সঠিক সময় মতো সে তার কাজ করবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। সাবধানে থাকিস!”
“হুম।”
আরহাম রেডি হয়ে আফরিনের কপালে একটা চুমু দিয়ে বের হলো। তখন আফরিন বলল,,,
‘তোকে দেখে মনে হচ্ছে তুই সিওর ছিলি যে নেহমাত শেখ পালাবে!”
আরুহি মুচকি হেসে বলল,,
“কিছু কিছু জিনিস তোর জানতে হবে না। এখন তুই চল ওপরে চল।”
“আজ কিছু পারিনা বলে ইনসাল্ট করছিস। তুই দেখিস আমার পুলাপাইনরে তোর থেকেও বড় অফিসার বানামু।”
“হুম বুঝতে পেরেছি চল এখন”
আরুহি আফরিন কে ওপরে নিয়ে গেল। আরুহি আফরিন কে রুমে শুয়িয়ে কুরআন তেলাওয়াত করে শুনাতে লাগলো। আরুহি কুরআন তেলাওয়াত শেষ করে বলল,,
“ঘুম আসছে না তোর?”
“আরু আমার না আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে?”
“দারা এক মিনিট আমি নিয়ে আসছি।তোর জন্য ভাইয়া ফ্রিজ ভরে আইসক্রিম কিনে রেখেছে। ”
“একদিন ঘুম থেকে জাগিয়ে আইসক্রিম আনতে পাঠিয়েছিলাম। তাই তোর ভাইয়া আইসক্রিম এনে রেখেছে। ”
“দেখেছো আমার ভাইয়া কি অ্যাডভান্স। তুমি কখন আইসক্রিম খেতে চাও তার ঠিক নেই। তাই আগে থেকেই সব ব্যবস্থা করে রেখেছে।”
“তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ইশশ্ আমি কি করে ভুলে গেলাম।”
“কি ভুলে গেলি?”
“কাল ও বাড়ির সকলে আসবে আমাকে দেখতে। তোকে আর উনাকে বলতে ভুলে গেছি।”
“এ কথা টা আগে বলবি না। তাহলে ভাইয়া আজকেই বাজার করে রাখতো।”
“আরে বললাম না ভুলে গেছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে। কাল সকালে আমি গিয়ে বাজার করে আনবো। ভাইয়ার আসতে তো অনেক রাত হবে।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
“তুই বোস আমি আইসক্রিম নিয়ে আসছি।”
আরুহি আফরিনের জন্য আইসক্রিম নিয়ে এলো আফরিন এখন বাচ্চাদের খাচ্ছে । আরুহি মুচকি হেসে ওকে দেখতে লাগলো। তখন আফরিন বলল,,
“তুই এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?”আইসক্রিম খাবি?
“না আমি ভাবছি এই তো সেদিন তোদের সাথে আমাদের দেখা হলো। তারপর তোর আর ভাইয়ার বিয়ে হলো। এখন তোদের বেবি হবে। কয়েকদিন পর এ বাড়িতে দুজন বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শোনা যাবে। সব যেনো অনেক তাড়াতাড়ি হয়ে গেল। এই জন্যই বোধহয় বলে সুখের সময়গুলো তাড়াতাড়িই চলে যায়।”
“হুম সময় গুলো কিভাবে পার হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। ধন্যবাদ তোদের দুই ভাই-বোন কে আমার জীবনকে এত সুন্দর করে তোলার জন্য”
“হুম অনেক হয়েছে।আচ্ছা এখন ঘুমিয়ে পর আইসক্রিম খেয়ে।”
“হুম খাওয়া শেষ।”
আফরিন শুয়ে পরলো। আরুহি লাইট অফ করে ওর পাশে শুয়ে পড়লো। আরহাম আসলে ও ওর রুমে চলে যাবে। আফরিন কে ওরা দু ভাই-বোন কখনোই একা ছাড়ে না।
পরের দিন সকালে আবরার দের বাড়ি থেকে কল আসলো। ওরা আজ আসবে না। কাল আসবে আজ ওরা একটা জায়গায় যাবে। একথা শুনে আরুহি আর বাজার করলো না। আরহাম -ই না হয় করবে। আরুহি কোন একটা কাজে মার্কেটে এসেছে। হুট করে রুহানির সাথে দেখা। রুহানি আরুহিকে দেখে বলল,,
“আসসালামু আলাইকুম আরুহি!”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম আপু। আপনি এখানে!”
“হ্যা কিছু কেনাকাটা করতে এসেছিলাম। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে!”
“কি কথা ?”
“এখানে না চলো কফি খেতে খেতে বলি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে।”
আরুহি আর রুহানি একটা কফিশপে এলো। রুহানি বলল,,
“বাবা পালিয়েছে জানো তো?”
“হুম জানি!”
“বাবা আমাকে সব বলেছে!”
“মানে কি সব বলেছে।”
“আমি জানি তুমি আর আরহাম সব জানো?”
রুহানি কেঁদে উঠলো। আরুহির ওকে দেখে খারাপ লাগছে কিন্তু কিছুই করার নেই। আরুহি বলল,,
“ফুপা এখন কোথায়?”
“জানিনা তবে কাল আমার সাথে দেখা করে সব বলেই আবার চলে গেছে! ও আমাদের সাথে এরকম কেন করলো আরুহি।”
“আরুহি আপু নিজেকে শান্ত করুন। এভাবে ভেঙে পরবেন না।”
“তোমার তো তাও আরহাম আছে। কিন্তু আমি তো একেবারে এতিম হয়ে গেছি আরুহি। সত্যগুলো জানার পর আমার নিজেকে অনুভূতিশূন্য লাগছে।”
“আল্লাহর ওপর ভরসা রাখুন সব ঠিক হয়ে যাবে।”
“কিছু ঠিক হবে না। ঐ মহিলা সব শেষ করে ফেলেছে ।”
“আল্লাহ তায়ালা আল কোরআন এ বলেছেন,,
“ভেঙ্গে পড়োনা, নিরাশ হয়োনা, সাহায্য আসবেই, এটা আল্লাহর ওয়াদা। জেনে রেখো আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে!
– সূরা বাকারা- ২১৪!
তার সব খেলা শেষ হবে আর খুব তাড়াতাড়ি হবে। তোমাকে আমি যা বলি সেসব মন দিয়ে শুনো তাহলে আমরা সহজেই তাকে ধরতে পারবো,,
*************”
আরুহির কথা শুনে রুহানির মুখের হাসি ফুটে উঠল। আর মুচকি হেসে বলল,,
“ইউ আর জিনিয়াস আরুহি।আমি আজই আরহাম এর সাথে যোগাযোগ করছি।”
“হুম আজ তাহলে আসি আল্লাহ হাফেজ।”
“আল্লাহ হাফেজ!”
~চলবে,,