@থার্টি ফার্স্ট নাইট
#পর্ব_০৮
#লেখিকা_নুসরাত_জাহান_নিপু
অনাহিতার জ্বর ১০৩° ফারেনহাইট।প্রেমশা তাকে ছুঁয়ে-ই চিৎকার করেছে।রোমিলা বেগম জলপট্টি দিচ্ছে।কিছুক্ষণ পরই ডাক্তার এলো।হুট করে এতখানি জ্বর আসাটা সবাইকে খুব ভাবাচ্ছে।
বিছানায় অনাহিতার পাশে বসে প্রেমশা ক্রমাগত কেঁদেই চলেছে।সে বুঝতে পারছে তার সুপার মাম্মার গায়ে পঁচা পোকা লেগেছে।তাই এত জ্বর!
ঘণ্টা-খানেক সময় পার হয়ে গেল।ততক্ষণে জ্বর অনেকটা কমে গেছে।অভিনব বুঝতে পেরেছে অনাহিতা কোনো কিছু নিয়ে যথেষ্ট ডিপ্রেশনে ছিল।ঠোঁটের নিচ অংশ রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে।এই মেয়েটারও কী কৃষ্ণ রাঙা অতীত আছে?
অনাহিতা চোখ মেলতে নজরে পড়ে প্রেমশাকে।বাচ্চা মেয়েটা কেঁদে কেঁদে চোখ-মুখ লাল করে ফেলেছে।মৃদু হেসে অনাহিতা উঠার চেষ্টা করলে অভিনব তাকে ধরে ফেলল।আড়চোখে এক পলক অনাহিতা তাকে দেখলো।অভিনব বলল,”শুয়ে থাকো।”
অনাহিতা উত্তর না দিয়ে চুপ করে রইলো।তার মস্তিষ্কে এখনো ‘জিসান’ নামটাই ঘুরঘুর করছে।কিন্তু জিসানের কথা শুনে মনে হয়েছে সে অনাহিতার খোঁজে আসেনি।তাহলে এসেছিল কে?দারওয়ানের সাথে কথা বলা উচিত।
প্রেমশা বলল,”সুপার মাম্মা,তোমার কষ্ট হচ্ছে?”
মুচকি হেসে অনাহিতা উত্তর দিলো,”না পিচ্চি মা,সুপার মাম্মা ঠিক আছে।”
নিশি খাবার নিয়ে রুমে প্রবেশ করলো।অনাহিতার উদ্দেশ্যে সে বলল,”কেমন লাগছে ভাবি?”
-“বেটার।”
-“হুট করে জ্বর আসলো কেন?দুপুরে তো ভালোই ছিলে।”
বাধা দিয়ে অভিনব বলল,”আহা,জ্বর কী বলে আসে?তুই খাবার খাইয়ে দে!”
নিঃশব্দে নিশি বিছানায় বসে খাবার খাইয়ে দিতে চাইলে প্রেমশা বলে উঠলো,”সুপার মাম্মাকে আমি খাইয়ে দিবো।ফুফি,তুমি প্লেট ধরো।”
অভিনব বিরক্তিকর স্বরে বলল,”প্রেমশা!সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করো না।”
নিশি বলল,”উফ ভাইয়া,তুমি যাও তো।প্রেমশা চাইছে যখন করুক না।”
আবেগে অনাহিতার চোখ জোড়া অশ্রুতে টইটম্বুর হয়ে গেল।এমন করে তার যত্ন মা-ই নিতো।বাবা-ভাই তাকে কত ভালোবাসতো!কিন্তু হায়!একটা ভুলের কারণে সবকিছু ধূলোই মিশে গেল।আবার সেই একই ভুলকে মনে রেখে এ বাড়ির লোকদের কষ্ট দিচ্ছে।তার মনটা যে খুব বেহায়া!
.
নিশি রান্নাঘরে প্লেট রাখতে আসলে তার মা বলল,”নিশি,অনাহিতার হুট করে জ্বর কেন আসলো?”
বিরক্তিতে নিশির ভ্রু জোড়া কুঁচকে গেল।তার মা এই সামান্য বিষয় নিয়েও যা-তা বানাবে।সে উত্তর দিলো,”মা,জ্বর কী আগে থেকে নেমন্তন্ন দিয়ে আসে?”
-“আমি সেটা বলছি না।অনাহিতার চোখগুলো ফোলা ছিল।ঠোঁটের নিচেও দাঁতের দাগ।তোর মনে হয় এগুলা স্বাভাবিক?”
-“অস্বাভাবিক কেন হবে?”
-“তুই বুঝতে পারছিস না।”
-“তুমি কী ভাবছো?”
-“আমি ভাবছি,ও অনেক কান্না করেছে।”
-“হ্যাঁ,তো করেছে।বাবা-মা’কে ছেড়ে নতুন একটা বাড়িতে এসেছে।কান্না করাটা স্বাভাবিক।”
-“আমার মনে হয় না এ কারণে কেঁদেছে।”
-“মা,তোমার সবকিছুতে কিন্তু বের করতে হয়।”
নিশি কয়েক কদম সামনে গিয়ে আবারো ফিরে এলো।রোমিলা বেগম চুপ করে আছেন।সে বলল,”মা,যদি শুনো অনাহিতা আগে কোনো ভুল কাজ করছে।তখন তুমি ও কে ছেলের বউ হিসাবে মানবে?”
রোমিলা বেগমের কপাল কুঁচকে গেল।মৃদুস্বরে তিনি প্রশ্ন করলেন,”ভুল কাজ মানে?”
হাত নেড়ে বুঝানোর ভঙ্গিতে নিশি উত্তর দিলো,”মানে পাপ,অবৈধ…আই মিন ইট ‘যদি’।”
রোমিলা বেগমের মনে ভয় ঢুকে গেল।তিনি কর্কশ কণ্ঠে বললেন,”কী আবোল তাবোল বকছিস?”
হো হো করে হেসে নিশি বলল,”কুল মা,আমি মজা করছি।টেনশন করিও না।নিশ্চিন্তে থাকো…টাটা,গেলাম।হ্যা?”
রোমিলা বেগমের দুশ্চিন্তা বেড়ে গেল।অনাহিতা আগে কোনো ভুল করলে সেটা কেমন ভুল?এমন কোনো ভুল কী,যার জন্য সে প্রেমশা-অভিনবকে ছেড়ে যাবে।
.
ইসমি আক্তারকে একটু আগে রোমিলা বেগম ফোন করে জানিয়েছে অনাহিতা অসুস্থ।কেমন অসুস্থ সেটা জিজ্ঞেস করতে বলেছে হালকা জ্বর।ইসমি আক্তার জানেন তার মেয়ের জ্বর আসে এক.বৃষ্টিতে ভিজলে,দুই.কান্না করলে।এখন তো বৃষ্টি হয়নি।তারমানে কী অনাহিতা কেঁদেছে?
রাত হয়ে যাওয়ায় ইসমি বেগম বাড়ি থেকে বের হতে পারলেন না।এই খবরটা নিজের স্বামীকেও জানানোর প্রয়োজন মনে করলেন না।তার স্বামী পুত্রের সাথে জমি-জমা নিয়ে কথা বলছে।ইসমি আক্তার এসবে কর্ণপাত করেন না।তিনি উঠে চলে গেলেন কফি বানানোর উদ্দেশ্যে।তাছাড়া অনাহিতার শরীরের খবরটা নেওয়া উচিত।
শেখ আহমেদ বললেন,”অনাহিতার সাথে বিষয়টা নিয়ে একবার কথা বলা উচিত।ও কী সংসার করতে চায়, নাকি চায় না।”
আমিন বিপরীতে বলল,”ও যদি ডিভোর্স দিয়ে চলে আসে,তাহলে বাবা আমাদের মান সম্মান যা আছে তাও থাকবে না।”
শেখ আহমেদ দু’ক্ষণ ভাবলো।এটা সত্যি কথা বলেছে আমিন।কিন্তু বিবাহিত একজনের সাথে জোর করে মেয়েকে সংসারে বেঁধে রাখা তো সম্ভব না।ভেবে-চিন্তে তিনি বললেন,”তোর বিয়েটা আগে হয়ে যাক।তারপর অনাহিতার ডিভোর্স করিয়ে ও কে বিদেশ পাঠিয়ে দিবো।থাইল্যান্ডে তোর মামার কাছে।”
সিদ্ধান্তটা আমিনের কাছেও ভালো লাগলো।সবকিছুর আগে খুশিকে বিয়ে করে নেওয়া দরকার।তারপর অনাহিতার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ওর জীবন নিয়ে ভাবা যাবে।
.
অনাহিতা নিচুস্তরে ফোনের ওপাশে উপস্থিত থাকা তার মায়ের উদ্দেশ্যে বলল,”মা,এখন আমার জ্বর কমেছে।কান্না বন্ধ করো।”
নাক টেনে ইসমি আক্তার বললেন,”কাঁদছি কই?খেয়েছিস কিছু?”
অনাহিতা এক পলক তার বুকে লুকিয়ে থাকা প্রেমশা দিকে তাকালো।এইটুকু মেয়েটা জেদ ধরে তাকে খাইয়ে দিয়েছে।প্রেমশার চুল নেড়েচেড়ে অনাহিতা উত্তর দিলো,”হ্যাঁ মা।এইটুকু প্রেমশা খাইয়ে দিয়েছে।”
-“প্রেমশা কে?”
অনাহিতা চুপ করে গেল।প্রেমশা কে?তার মেয়ে?নাকি উত্তর দিবে ‘আমার স্বামীর প্রথম পক্ষের কন্যা!’।অনাহিতার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন বেড়ে গেল।গাল দুটোর উঞ্চতা দ্বিগুণ হয়ে গেল।মৃদুস্বরে সে উত্তর দিলো,”আমার মেয়ে।”
ওপাশটা নিরবতায় পূর্ণ!অনাহিতা বড়ো করে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।দুই শব্দের কথাটা বলতে মনের ভেতর অস্থিরতা ভীড় করেছিল।কিছু কিছু বাক্য এমন কেন?
ইসমি আক্তার বললেন,”তুই ভালো আছিস?”
ওষ্ঠদ্বয়ে হাসি ঝুলিয়ে অনাহিতা উত্তর দিলো,”বলা যায় স্বর্গে আছি।”
বিয়ের পর কন্যার মুখে এমন বাক্য শুনলে যে কোনো মাতায় তৃপ্তির হাসি হাসে।তাদের খুশির জন্য এই একটা বাক্যই যথেষ্ট!
অনাহিতা ফোনটা বালিশের পাশে রেখে দিলো।সুখের দুনিয়ায় আটকা পড়েও দুঃখরা তার পিছু ছাড়ছে না।স্মৃতিরা এমন কেন?
প্রেমশা তার কপালে হাত রেখে বলল,”জ্বর কম।”
অনাহিতা হেসে বলল,”হুম।ঘুমিয়ে পড়ো।”
প্রেমশা উঠে বলল,”বাব্বা কোথায়?বাব্বা…বাব্বা?”
অভিনব হাতে তিনটা চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করতে করতে বলল,”এসে গেছে বাবা।”
প্রেমশা হাত তালি দিয়ে বলল,”ওয়াও!চা?সুপার মাম্মা,বাব্বার বানানো চা হেব্বি মজা।”
অনাহিতা,অভিনব দু’জনে হেসে উঠলো।প্রেমশা নিজেও হেসে ফেললো।অনাহিতার উদ্দেশ্যে সে বলল,”তোমার জ্বর কমেছে?”
অনাহিতা উত্তর দেওয়া আগে প্রেমশা বলে উঠলো,”হ্যাঁ,দেখ দেখ।কপালে হাত দিয়ে দেখ বাব্বা।”
বলতে বলতে প্রেমশা অভিনবের বাম হস্ত তার মায়ের কপালে ছোঁয়ালো।অনাহিতা আঁতকে উঠে সরে যেতে চাইলে ব্যর্থ হলো।প্রেমশা ঠিকই নিজের উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে।সে হেসে বলল,”দেখেছ বাব্বা,সুপার মাম্মার জ্বর কম।”
প্রেমশা খিলখিল করে হাসছে বাকি দু’জন চুপ করে রইলো।হাসতে হাসতে প্রেমশা বলে উঠলো,”বাব্বা,আজকে পূর্ণিমা বলেছে ফুফি।চলো না,ছাঁদে যায়।”
অভিনব বলল,”কিন্তু মা,সুপার মাম্মা অসুস্থ।”
স্মিথ হেসে অনাহিতা বলে উঠলো,”নাহ,আমি ঠিক আছি।এত সময় রুমে আঁটকে থেকে আমারই দম বন্ধ হয়ে আসছে।চলুন…”
.
জলের স্পর্শ পেয়ে নিশির ঘুম ভেঙে গেল।চোখ কচলে তার নজরে এলে সূর্যের চেহারা।প্রথমবার ভুল ভেবে সে দ্বিতীয়বার আবারো চোখ কচলে দেখলো।’সূর্য’ সেটা নিশ্চিন্ত হতেই সে ধড়ফড়িয়ে উঠলো।চারিদিকে তখন আবছা সোডিয়াম বাতির আলো।নিশি শোয়া থেকে উঠে বসলো।জায়গাটা তার অপরিচিত।খোলা মাঠের চারিদিকে নারিকেল গাল।গাছগুলো ছোট ছোট বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে।বাতির আলো রাতের অন্ধকার দূর করার বৃথা চেষ্টা করছে।
সে বসে আছে বেডের উপর।দূরে একটা তাবু আটকানো।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে নিশি সূর্যের দিকে তাকিয়ে রইলো।সূর্য তার থেকে এক হাত দূরে বসে বলল,”তোমাকে সাথে নিয়ে পূর্ণিমার জ্যোৎসা স্নান করতে মন চাইলো।তাই কিডন্যাপ করলাম।”
নিশি তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বলল,”হোয়াট ননসেন্স?গার্লফ্রেন্ড আমি আপনার?”
হেয়ালি করে সূর্য উত্তর দিলো,”গার্লফ্রেন্ড না।প্রেমিকা আমার।”
নিশির আরো রেগে বলল,”দুই শব্দের মিনিং এক।”
-“মোটেও এক না।প্রেমিকা যে জন,সে জন আজীবন থেকে যায়।সে প্রেমে রাজী হলেও বা না হলেও।কিন্তু গার্লফ্রেন্ড দুইদিন বাদে ফুস করে উধাও হয়ে যায়।সাইকোলজি কী বলে জানো?”
আকাশ ছোঁয়া বিরক্তি নিয়ে নিশি বলল,”আমি এখানে সাইকোলজি শুনতে আসিনি।এক্ষুণি চলে যাচ্ছি আমি।”
সূর্য দাঁত কেলিয়ে হেসে বলল,”হ্যাঁ যাও।কিন্তু কোন দিকে যাবে?বাম দিক?ডান দিক?সামনে?…”
-“শাট আপ।”
দুঃখে নিশির নিজেকে থাপ্পড় দিতে ইচ্ছে করছে।এই ছেলের প্রেমে পড়াই তার জীবনের বড়ো ভুল হয়েছে।
এই জায়গা তার অচেনা।বাড়ি কীভাবে যাবে?
মনে ফন্দি আঁটে নিশি বলল,”আপনি আমাকে কিডন্যাপ করলেন কীভাবে?”
সূর্য বসা থেকে উঠে বলল,”তোমাকে অজ্ঞান করে গাড়িতে করে নিয়ে আসলাম।”
-“কেউ দেখেনি?”
-“কাঁচা কাজ আমি করি না।”
নিশি দীর্ঘশ্বাস ফেললো।এই ছেলে তাকে এখন যেতে দিবে না।মেসেজ সিন করে রিপ্লাই না দেওয়াটা ভুল হয়েছে।নিশি প্রশ্ন করলো,”কতক্ষণ থাকতে হবে আমাকে?”
-“বেশি না।তিন ঘণ্টা।”
-“হোয়াট?তিন ঘণ্টা?জীবনেও না।”
-“তাহলে দুই ঘণ্টা উনষাট মিনিট।”
সূর্য হো হো করে হাসতে লাগলো।ক্ষণ পলক ভেবে নিশি বলল,”দুই ঘণ্টা।এখন ক’টা বাজে?”
সূর্য মোবাইল দেখে বলল,”এখন ১২টা বাজছে।”
-“১২টা থেকে ২টা।তারপর আপনি আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিবেন।”
সূর্য ‘ওকে’ বলে বেডে বসে পড়লো।নিশি কিছুটা জোরে বলে উঠলো,”আমার থেকে দুই হাত দূরে থাকেন।”
ঘাড় ঘুরিয়ে সূর্য উত্তর দিলো,”অলরেডি এক হাত দূরেই আছি।”
(চলবে)