দখিনা দুয়ারে প্রেমের ছোয়া পর্ব-০২

0
2

গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ২ (❌কপি করা নিষেধ❌)

“মায়াবতী নদী।” মুখে নামটা উচ্চারণ করেই দৌড়ে নদীর একদম কাছে চলে যায় নবনী। আগে নদীটা আরেকটু দূরে ছিল মনে হয়। মাটি ভেঙে স্কুলের কাছে চলে এসেছে। নবনীর মনে পরে যায় ছোটবেলার কথা।

এই নদীর পারে পা ডুবিয়ে কত বসে থাকত। নামের মতো নদীটার মাঝে আসলেই মায়া আছে খুব। পানি এত পরিষ্কার যেন উকি দিয়ে তাকালে নিচের গভীরের মাছ অব্দি দেখা যায়। নাফিজা হাটতে হাটতে বলে উঠে,

“জানো আমগো গ্রামেও না শহরের মতো একটা লাইবেরি আছে।”

“লাইব্রেরি?”

“হ ওইটাই। মেম্বারের পোলারা তো শহরে পড়ালেহা করছে। হেরাই আইয়া দুই ভাই মিললা খুলছে। মাঝে মাঝে বিকালে আমিও যাই। কত রকমের বই! আর ভিতরের জায়গাডাও সুন্দর অনেক। ঢাকা শহর থেকে কেউ গ্রামে আইলেও যায় ঐ জায়গায়।”

“আমাকে নিয়ে চল তো।”

“এহন তো খুলে নাই। চলো বাড়ি ফেরত যাই। সবাই উইঠা গেছে। দাদায় না পাইলে চিল্লাইবো।”

“আচ্ছা চল। কুয়াসাও সরে গিয়েছে। গিয়ে নাস্তা করি চল।”

নাফিজা আর নবনী তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। বাড়িতে পৌছেই নবনী দেখে তার বিড়ালটা মুরগির খোপের উপর ভীত হয়ে লুকিয়ে আছে। নবনী গিয়ে আলতো করে কোলে তুলে নেয়।

“কি হয়েছে পিকু। তুই ঠিক আছিস?”

বিড়ালটা মেও মেও করে নবনী কোলে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়ল। হাতে কয়েকবার জিহ্বা দিয়ে চেটে দিলো। নবনী বুঝতে পারল, গ্রামের অন্য বিড়ালরা পালিত বিড়াল পছন্দ করে না। এজন্য ভয়ে ও এখানে লুকিয়ে আছে। সুযোগ পেলেই কামড়ে দেবে।

“কিরে? সকাল সকাল কোই ছিলি তোরা? আয়। নাস্তা কর।”

বড় মামির কথা শুনে নবনী নাফিজাকে ইশারা করল এখন যেতে হবে। ভিতরে এসে দেখে সবাই নিচে পাটি বিছিয়ে খাবারের আয়োজন করছে। নবনী যেই না সামনে যেতে নিবে তখনই,

“আহহহ।”

সবাই জলদি ওর দিকে ফিরে। দেখে নবনী পেচার মতো মুখ করে দাড়িয়ে আছে। তারপর নানার দিকে তাকিয়ে বলল,

“নানু ভাই! তোমাকে কতদিন বলছি ঘরটা নতুন করে ঠিক করো। তোমাদের মাটির ঘর নিচে ডেবে গিয়ে উপরের টিন কত নিচে এসে পড়ছে দেখেছো? এক রুম থেকে অন্য রুমে যেতে নিয়ে আমি প্রতিবার একটা করে টাক খাই।”

সবাই হো হো করে হেসে উঠল। ছোট মামী নাসরিন ফ্রিজ থেকে একটা বরফের টুকরা এনে নবনীর মাথায় চেপে ধরে। নানা সামনে থেকে বলে উঠে,

“সবাই হাসাহাসি থামাও তো। আমার নাতিডা কপালে ব্যাথা পাইছে রে। দাড়া নানুমনি, তোরে বিয়া দিয়া নতুন জামাই আনার আগেই কাজ ধরমু। অপেক্ষা কর একটু।”

নবনী পাটিতে গিয়ে বসল। তবে খাওয়া শুরু করে বারবার উপরে তাকাচ্ছে। ফ্যানটা এমন গটগট আওয়াজ করছে, যেন এক্ষুণি খুলে পড়ে যাবে। নবনীর মা রিমা বেগম বিষয়টা দেখে নবনীর দিকে চোখ গরম দিয়ে তাকায়। নবনী মাকে দেখে ভয়ে আর কিছু বলেনা। চুপচাপ খেতে থাকে। এত বড় হলেও তার মায়ের শাসন কমেনি।

প্রত্যেকের নানুর বাড়ির ফ্যানে গটগট আওয়াজ করবেই। আর ঘুরা শুরু করতে লাগবে আধা ঘন্টা।
……
“এই সব ছাই পাস আমি গিলতে পারব না। খাবার রান্না না করতে পারলে রাধবে না। এমন রান্না করার দরকার নেই যা গলা দিয়ে নামানো যায় না।”

কথাটা বলেই প্লেটটা ফিক্কে মেরে নিচে ফেলে দিলো মতিসুর। ভদ্র শিক্ষিত ভাষায় কথা বললেও ভিতরের জমা ময়লা পচে দুর্গন্ধ সে ভালোই ছড়াতে পারে। বাড়ির বৌয়েরা সবাই মুখ কালো করে দাড়িয়ে আছে। টেবিলে বসা কারো যেন এসবে কোন হেলদেল নেই। তারা নিজেদের মতো খাবারে ব্যস্ত।

মুগ্ধ একবার তার মায়ের দিকে তাকায়। মুগ্ধর মায়ের চোখের কোনে পানি। তবে ইশারা দিয়ে মুগ্ধকে কিছু বলতে মানা করে। এই বাড়ির একমাত্র এই ছেলেটাই মেয়েদের একটু সম্মান করতে জানে। তাও সে প্রতিবাদ করতে পারে না। এই নিয়ে বাবা ছেলের মাঝে সম্পর্ক যেন খারাপ না হয়, এজন্য মুগ্ধর মা তাকে কসম দিয়ে রেখেছে যেন তার হয়ে ও কিছু না বলে।

তবে আর কতদিন এসব সহ্য করা যায়। সামান্য তরকারিতে ঝাল হওয়ায় এভাবে খাবারের প্লেট উল্টে দেয়ার কোনো মানে হয়। মুগ্ধ নিজের হাতের মুষ্টি শক্ত করে নিজেকে শান্ত করল। তার মায়ের কথার অমান্য সে হতে পারবে না। আর না এসব সহ্য করতে পারবে। খাবার ছেড়ে চলে দিতে নিলেই চাচা শরীফ বলে উঠে,

“কি গো মুগ্ধ? খাওন থুইয়া কই যাস?”

“যারা আমার মাকে সম্মান করতে পারে না, তাদের সাথে বসে খাওয়ার আমার রুচি নেই।”

মুগ্ধ নিজের রুমে চলে যায়। শরীফ মুখে একটা ভেংচি কেটে মতিসুরকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,

“দেখছো বড় ভাই। তোমার পোলাডা কেমন মাইগ্গা হইয়া যাইতাছে। বেডা মানুষ যদি বেডাগো মতোন মেজাজ না দেখাইয়া মাইয়াগো আচলে লুকায়, তাগোরে কি বেডা কওন যায়। দেইখো, মাইনষে এইসব জানে না যেন। তোমারতো নাক কাটা যাইব।”

মতিসুর রাগে জিদে আর কিছু বলল না। শুধু মুগ্ধর মায়ের দিকে তাকায়। চোখে চোখে বুঝিয়ে দেয়, তার জন্যই ছেলে দুটো এমন নষ্ট হয়েছে। দুজনের একজনও পুরুষ হতে পারেনি। সে খাবার ছেড়ে রাগে উঠে চলে যায়। শরীফ হেসে হেসে খাবার খেতে চায়। এটাইতো সে চেয়েছিল। ভাইয়ের চোখে তার ছেলেদের খারাপ করে, নিজের ছেলেকে বাড়ির ভবিষ্যৎ কর্তা বানাতে পারলেই সে সফল।

মুগ্ধর মা চোখের পানি মুছে নিচে ফেলে দেয়া ভাত, খাবারগুলো উঠিয়ে পরিষ্কার করতে থাকে। শাওনের মুগ্ধ ভাই খাবার খায়নি। তার গলা দিয়ে পানিও নামবে না। ছোটবেলা থেকে মুগ্ধ ভাই বলতে সে পাগল। অথচ মুগ্ধ ওর থেকে মাত্র এক বছরের বড়। শাওন নিচে এসে চাচিকে সাহায্য করতে থাকে।

শাওনের মায়ের মুখে কিছুটা হাসি ফুটে। এ বাড়ির কর্তাগুলো নারী বিদ্বেষী হলেও ছেলেগুলো মানুষের মতো মানুষ হতে পেরেছে। মায়েদের যোগ্য সম্মান করতে জানে।

আসলে ছেলে জাতি মেয়েদের কেমন চোখে দেখবে, কতটা সম্মান করবে, কতটা যত্ন করবে। এসব নির্ভর করে তাদের শিক্ষার উপর। ছেলেগুলোকে মানুষ বানাতে পেরে গর্ববোধ করে শাওনের মা। মুগ্ধর মা শাওনকে এসব করতে বাধা দিয়ে বলে,

“তোর এখন এসব করতে হবে না বাবা। তুই খাওয়া শেষ কর। বিয়ের পর বৌয়ের যত্ন নিস। তাতেই হবে। একটা জিনিস মনে রাখবি, পুরুষ যেভাবে তার বৌকে সবার সামনে উপস্থাপন করবে। তার স্ত্রী সবার থেকে ততটুকুই সম্মান পাবে। নয়ত বাহিরের মানুষ কথা শোনাতে একটুও ছাড় দেয় না।”

শেষের কথাটা যে বড় ভাবী তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছে তা বেশ ভালো বুঝতে পেরেছে শরীফ। মুখ বাকিয়ে কথা শুনাতে শুনাতে সে খাওয়া শেষ করে,

“মাইয়া মানুষ এজন্য পায়ের নিচে রাখন লাগে। নয়ত চেটাং চেটাং মুখের বুলি ছুটাইতে পারে। বুজছো সবাই, স্বামীর পায়ের নিচে বৌয়ের বেহেশত। এই বেহেস্তরে কষ্ট দিলে জাহান্নামে যাইতে হইবো। পাপী নারী।”

শাওয়নের মা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে টেবিল গোছাতে থাকে। এসব কথা নতুনের কিছু না। আসলেই হয়ত তাদেরই দোষ। তারাই খারাপ। শরীফ আর মতিসুরের মতো লোকেরাই ভালো।

পাকের ঘরে দাড়িয়ে এসব শুনছিল শ্যামলী। স্নিগ্ধর স্ত্রী। বাড়ির বড়দের মাঝে সে কোনো কথা বলে না। মনে মনে বলে উঠে,

“এ বাড়ির লোকদের মন মানুষিকতা কি কখনো বদলাবে না? ”

আকাশের দিকে তাকিয়ে কেদে কেদে বলে, “খোদা। তুমি তো নারী পুরুষ সব জাতিকেই বানিয়েছ। এ বাড়ির অবিচার আর কতদিন সহ্য করবে। এমন কেউ কি আসবে না, যার মাঝে প্রতিবাদের সাহস আছে। এদেরকে তাদের পাপের শাস্তি দিবে।”

উপর থেকে কোনো আওয়াজ আসল না। শুধু আকাশ থেকে এক ফোটা বৃষ্টির ফোটা তার মুখে পড়ল। শ্যামলী ভাবে এটা হয়ত আল্লাহর আশীর্বাদ। তবে খেয়াল হয় আকাশে মেঘ জমেছে।

তাড়াতাড়ি সে উঠোনে গিয়ে পাতা কুড়াতে থাকে। মাটির চুলায় রান্নার জন্য পাতা শুকাতে দিয়েছিল। ভিজলে সব শেষ।
………

বৃষ্টি পড়ছে দেখে নিজেকে আর আটকে রাখতে পারছে না নবনী। একা একা বাগে(গ্রামের বাড়িতে পিছনের বাগান) চলে যায় ভিজতে। নাফিজা মায়ের সাথে লাড়কিগুলোকে পলি দিয়ে ঢাকতে গিয়েছে। নবনী একাই এসেছে ভিজতে।

এখন বাহিরে বেশি একটা মানুষ দেখা যাচ্ছে না। সাদা গোল জামার একপাশে ওড়নাটা ছড়িয়ে ফেলে রাখা। খোলা চুলগুলো অন্যপাশে সামনে এনে রাখা। বৃষ্টিতে দুহাত মেলে ভিজতে থাকে নবনী। বৃষ্টির ফোটাগুলো তার ফর্সা গাল হতে গলা বেয়ে সারা শরীর ভিজাতে থাকে।

তবে বাগানের বড় বড় নাড়কেল আর তাল গাছের জন্য এখানে ভিজতে ভয়ও হচ্ছে কিছুটা। যদি মাথায় তাল পড়ে। নবনী একা একা পিছনের পুকুরের পাড় হতে চিকন রাস্তাটায় যায়। জুতোগুলো খুলে একপাশে রাখে। কাদায় খালি পায়ে হাটলে পা পিছলে যাওয়ার সম্ভাবনা কম।

ভেজা মাটিতে খালি পায়ে হাটতে খুব ভালো লাগছে নবনীর। কিছুটা দূরে রাস্তার পাশেই একটা ক্ষেতে ফসল ফলানো হয়নি। সেখানে গিয়ে জমিতে নেমে পাশ ঘেষে ফসলে হাত বুলাতে বুলাতে এগুতে থাকে নবনী। ঠিক তখনই…

#চলবে …..