গল্পের নাম : #দখিনা_দুয়ারে_প্রেমের_ছোয়া
লেখনীতে : #আরফিন_জাহান_আনিকা
পর্বসংখ্যা : ৫ (❌কপি করা নিষেধ❌)
মাঝখানে কেটে গিয়েছে আরো দুদিন। চারপাশে কুয়াশায় ঢেকে আছে সবকিছু। শুধু অন্ধকার। এত সকাল কোনো কিছু দেখতে পাওয়ার কথাও না। তবে হঠাৎ সব কুয়াশা সরে গিয়ে খা খা রোদ উঠে যায়। একটা সুন্দর বাগান। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ সব রঙের ফুলদিয়ে সাজানো। নিচে ছোট ছোট সবুজ ঘাস।
নবনী একটা সাদা শাড়ি পড়ে বাগানটার ঠিক মাঝ বরাবর বসে আছে। আচমকা দূর থেকে কে যেন তার গায়ে রঙের ছিটা মারল। গায়ের পোশাকটা সাদা থেকে রঙিন হয়ে উঠল। নবনীর সামনে দিয়ে ছোট ছোট করে কাটা চুলগুলোর উপর মুক্তার পাথর লাগানো আছে। কি সুন্দর চকচক করে জলছে সেগুলো। ফুলগুলোও আলোতে জ্বলজ্বল করছে। হঠাৎ একদল লাল আর সাদা রঙের প্রজাপতি কোথা থেকে যেন উড়ে এলো।
নবনীর মাথার উপর গোল হয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে প্রজাপতিগুলো। রোদের আলো খুব বেশি হওয়ায় চোখের উপর হাত দেয় নবনী। আঙুলের ফাঁকা দিয়ে বাগানটা দেখতে থাকে চোখ বুলিয়ে। হঠাৎ নজর কারে শার্ট, প্যান্ট পরিহিত এক যুবকের উপর। চেহারাটা ঠিক দেখা যাচ্ছে না। তবে তার চুলগুলো পিছন দিয়ে সুন্নতি স্টাইলে কাটা। মুখে হয়ত চাপদাড়ি আছে। সেও নবনীর মতো মাথা উপর করে প্রজাপতিগুলোকে দেখছে। ঠিক তখনই…..
“জমিদারের বাচ্চা। ঘুম থেকে উঠেন। বিছানা গুছাবো।”
আস্তে আস্তে চোখ মেলে তাকায় নবনী। কাল রাতেও সব কাজিনরা মিলে গল্প করতে করতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। দেরীতে ঘুমানোর ফলে উঠতেও দেরী হয়েছে। শিটট! ফজরের নামাজ পড়া হয়নি আজকে।
চোখ ডলতে ডলতে নবনী বসে পড়ে। মায়ের দিকে বিরক্ত নয়নে তাকিয়ে বলে, “কি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম। দিলেতো ভেঙে।” নবনীর মা বিছানা গুছাতে গুছাতে প্রশ্ন করে, “তা এতো সকাল অব্দি ঘুমিয়ে কি দেখলে?”
“দেখি আমি একটা সুন্দর বাগানে বসে আছি। আর অনেকগুলো প্রজাপতি উড়ছে।”
প্রজাপতির কথা শুনে থেমে যায় নবনীর মা। নবনীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলে, “প্রজাপতি স্বপ্নে দেখা কীসের লক্ষণ জানিস?”
“কীসের?”
“বিয়ের।”
“এ মাহ! এই বয়সে বাবা আবার বিয়ে করবে!”
“মার বো একটা গালে। বেশি বার বেড়েছো তুমি। স্বপ্নে তুমি দেখছো, আর বিয়ে আমার জামাই করবে?”
“তো? আমিতো করব না। আমাকে জোর করলে আবার ঘুমিয়ে প্রজাপতির ডানা ছিড়ে দিবো। হুমম।”
“সেটা দেখাই যাবে। তাড়াতাড়ি মুখ ধুয়ে তোমার নানাভাইয়ের রুমে যাও। সে তোমার সাথে কথা বলবে।”
………
রুমের দরজার সামনে দাড়িয়ে নখ কামড়াচ্ছে শ্যামলী। ভিতরে যাবে কিনা বুঝছে না। আজ খুব ভোরে স্নিগ্ধ বাড়ি ফিরেছে। লম্বা একটা ছুটি নিয়ে এসেছে। হয়ত মুগ্ধকে বিয়ে দিয়েই যাবে।
অনেক দ্বিধাগ্রস্ত হয়েই আস্তে আস্তে কাঠের দরজাটা ধাক্কা দেয়। টিপ টিপ পা ফেলে ভিতরে গিয়ে দেখে স্নিগ্ধ গায়ে কম্বল টেনে ঘুমাচ্ছে। শুধু মুখটা দেখা যাচ্ছে একটু। শ্যামলী তাকিয়ে থাকে এক দৃষ্টিতে। খোদা দুনিয়ার সব সৌন্দর্য দিয়ে নিজ হাতে এই মানুষটাকে বানিয়েছে। পুরুষ মানুষ এত সুন্দর না হলেও পারে।
শ্যামলী হাটু গেরে নিচে বসে। পাশের ছোট টি টেবিলটায় হেলান দিয়ে স্নিগ্ধর দিকে তাকিয়ে একা একা বিড়বিড় করতে থাকে,
“আমি যদি লিখতে পারতাম। আপনার সৌন্দর্য আর ব্যক্তিত্ব নিয়ে লিখতাম। আপনাকে নিয়ে লিখতে গেলে গোটা একটা উপন্যাসও খুব কম হয়ে যাবে। নারীদের রূপের প্রশংসা তো কোনো কবি কম করেনি।”
শ্যামলী একটু থামে। খুব সাবধানে স্নিগ্ধর কপাল ঢেকে রাখা উষ্কখুষ্ক চুলগুলোতে একটু হাত বুলিয়ে দেয়। আবার বলতে শুরু করে,
“তারা হয়ত আপনাকে কখনো দেখেই নি। দেখলে মায়াবতী, রূপবতী এসব শব্দের পুরুষবাচক শব্দ ঠিকই বানিয়ে যেতো। জানেনতো, মাঝে মাঝে আমার নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে ভাগ্যবতী মেয়ে মনে হয়। যে আপনার মতো একজনের স্ত্রী হতে পেরেছে। ভালোবাসা নাই বা পেলাম। অবহেলাতো পাচ্ছি। দুনিয়ায় সবার কপালেতো আল্লাহ সবকিছু দেয় না।”
শ্যামলীর চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়। শ্যামলী চোখ বন্ধ করে খাটে মাথা রাখে কিছুক্ষণ। আল্লাহ এক দিক দিয়ে মানুষকে ছোট করলে অন্যদিক দিয়ে ঠিকই পুষিয়ে দেয়। শ্যামলীর ব্যাপারেও বিষয়টা ব্যতিক্রম না। গায়ের রঙ কালো হলেও, চেহারায় অসম্ভব মায়া জমে আছে।
মায়াবতী শব্দটা মূলত কালো মেয়েদের জন্য। ওদের চেহারায় যেই মায়া জুড়ে থাকে সেটা ফর্সা মেয়েদের মাঝে থাকে না।
শ্যামলী উঠে দাড়ায়। এসেছিল স্নিগ্ধকে জিগ্যেস করতে চা আনবে নাকি। তবে এত সুন্দর ঘুম ভাঙতে ইচ্ছে করছে না। সে উঠে গিয়ে চলে আসতে নিতেই হঠাৎ পেছন থেকে কেউ তার শাড়ির আচলটা টেনে ধরে। শ্যামলী কিছু বুঝে উঠার আগেই স্নিগ্ধ এক টানে ওকে একদম নিজের উপর এনে ফেলে।
শ্যামলীর লম্বা লম্বা চুলগুলো দিয়ে স্নিগ্ধর দুপাশ ঢেকে গিয়েছে। স্নিগ্ধ ওকে শুইয়ে ওর বাহুর দুপাশে হাত রেখে ভর দিয়ে, ঠিক ওর মুখের উপর বরাবর নিজের মুখটা রাখে। শ্যামলী লজ্জায়, ভয়ে চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে আছে। স্নিগ্ধ কিছুক্ষণ তাকিয়ে ওকে দেখে।
মেয়েটাকে প্রথম প্রথম যত খারাপ লাগত, মেয়েটা মোটেও তেমন না। আর এই কয়দিনে শহরে তার জীবনে যা যা ঘটেছে, তাতে সে এতটুকু নিশ্চিত যে। মানুষের বাহ্যিক সৌন্দর্য আসলে কিছুই না। স্নিগ্ধ এতক্ষণ চোখ বুঝে মেয়েটা কি বলছিল সব শুনেছে। শ্যামলীকে ভয়ে চোখ বন্ধ করে রাখতে দেখে সে বলে,
“এত লজ্জা কেন পাচ্ছো? আমি কি দূরের কেউ?”
শ্যামলী তাও কিছু বলে না। এখনো চোখ বন্ধ করে আছে। ভয়ে জ্ঞানও হাড়িয়ে ফেলতে পারে কিছুক্ষণের মধ্যে। এমন কেন করছে স্নিগ্ধ।
“কি হলো বলো? তোমাকে তো ছোট বাচ্চা মনে করতাম। আমার হাটুর বয়সী মেয়ে। এখনতো দেখছি তুমি অনেক কিছু বুঝো।”
আরো লজ্জা পায় শ্যামলী। স্নিগ্ধ আরেকটু কাছে এসে একটা হাত শ্যামলীর বাম গালের উপর রাখে। সাথে সাথে হু হু করে কেদেঁ উঠে শ্যামলী। স্নিগ্ধ পুরু ভেবাচেকা খেয়ে যায়। সাথে সাথে দূরে সড়ে যায়।
“এই মেয়ে কাদছো কেন? আমি কি কিছু করছি?”
শ্যামলী কিছু না বলে স্নিগ্ধকে সরিয়ে কাদতে কাদতে দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। আসলে মেয়েটার বয়সও বা কতটুকু। ততকিছু এই ছোট্ট মাথায় ডুকবেও না। হঠাৎ কোনো পুরুষমানুষ একটা কাছে চলে আসায় খুব ভয় পেয়ে গিয়ছিল। স্নিগ্ধ বোকাবনে বসে থাকে।
কি হলো কিছু বুঝতে না পেরে সেও শ্যামলীর পিছে পিছে যায়। এদিকে শ্যামলী কাদতে কাদতে দৌড়ে বসার ঘরে এসে একদম মুগ্ধর সামনে গিয়ে পরে। মুগ্ধ শ্যামলীকে দেখে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে ভাবী? কাদছো কেন?”
শ্যামলী কিছু বলে না। চুপচাপ রান্নাঘরের দিকে চলে যায়। রান্নাঘরে মুগ্ধর মাও ছিল। সেও শ্যামলীকে কাদতে দেখে খুব উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে প্রশ্ন করে,
“কি হয়েছে মা? তোর চোখে পানি কেন?”
এমন সময় স্নিগ্ধ ধরা পড়ে যাওয়া চোরের মতো মুখ করে এদিকে আসে। মুগ্ধর মা স্নিগ্ধকে দেখে খুব চটে যায়।
“এই স্নিগ্ধ। সত্যি করে বলতো তুই ওকে কি বলেছিস। বাচ্চা মেয়েটাকে সাত সকালে না কাদালে তোর হয় না।”
“আমি কিছু করিনি মা বিশ্বাস করো।”
“চুপ। একটা মিথ্যা কথা বললে থাপ্পড় খাবি। এইটুকু মেয়েকে কম কষ্ট দিস না তুই। তোর কি মনে হয় আমাদের চোখে কিছু পড়ে না? বিয়েতো হয়েই গিয়েছে। এখন এসব না করলে হয় না বুঝি?”
“আমি এখন কীভাবে তোমাদের বুঝাবো যে কিছু করিনি। দূরর। ভাল লাগে না।”
স্নিগ্ধ মুখ গোমড়া করে নিজের রুমের দিকে চলে যায়। মাকে কীভাবে বুঝাবে, বিয়ে হয়ে গিয়েছে বলেই তো এসব…। নাহ। মেয়েটা আসলেই বেশি করে ফেলল। মেয়েটাকে একা পাই শুধু একবার।
এদিকে শ্যামলী লজ্জায় কিছু বলতেও পারছে না কি হয়েছে। সাথে নিজের কাছে নিজেকে খুব খারাপও লাগছে। এভাবে রিয়েক্ট করা ঠিক হয়নি। আসলে হঠাৎ স্নিগ্ধর এমন ব্যবহারে ও কি করবে বুজতে পারেনি। তবে এখন মনে হচ্ছে একটু বেশিই করে ফেলছে। না জানি মানুষটা কত রাগ করল।
মুগ্ধ এসব দেখে মুচকি মুচকি হাসছে আর ফোন টিপছে। সে কিছুটা আন্দাজ করতে পারছে ব্যাপারগুলো। তার ভাই যে এখন বৌকে মেনে নিতে চায় তা মুগ্ধ আগেই জানত। স্নিগ্ধর সাথে সবসময় ফোনে কথা হয় ওর। ঢাকায় যে জামেলা হয়েছে স্নিগ্ধর জীবনে, তারপর আর ভুলেও শহরের মেয়ের নাম মুখে আনবে না।
তবে হঠাৎ বিকালে যে তাকে রেস্টুরেন্টে যেতে হবে সেটা ভেবে হাসিটা গায়েব হয়ে যায়। কি যে করবে গিয়ে কে জানে। মুগ্ধ রান্নাঘর থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে উঠানের দিকে পা বাড়ায়। বড় পুকুরটার পাশে গিয়ে বসে। সকাল সকাল কি সুন্দর ঠান্ডা সতেজ বাতাস। মনটা ভরে যাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়ে যায় সেদিন বৃষ্টিতে ভিজতে দেখা মেয়েটার কথা।
কি মিষ্টি চেহারা! না চাইতেও বারবার মনে পড়ছে। মুগ্ধ একা একাই বলে উঠে,
“কাম অন মুগ্ধ। এসব কি ভাবছিস? বাদ দে তো।”
এরপর ভাবতে থাকে সামনের ইলেকশনের কথা। বাবাকে এবার যেভাবে হোক জেতাতে হবে। স্কুলটারও কাজ করতে হবে। নতুন করে কৃষকদের ঘর বাধিয়ে দিতে হবে। কত কাজ! তার এখন মেয়েমানুষ দিয়ে ভাববার সময় নেই। একদমই না।
#চলবে….