দর্পণ পর্ব-০২

0
126

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০২

চোখ বন্ধ করে উসমান কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইলো। জ্বর নেই তবে শরীর দুর্বল। সে চোখ খুললো। তাঁর সামনে আট নয় বছরের এক মেয়ে। কে এই মেয়ে সে জানে না। তবে চোখ খুলেই সে এই মেয়েকে দেখেছে। যে কিনা অতি আগ্রহে টুকটুক করে তাঁকে দেখছে।

সে আশে পাশে একবার তাঁকালো। কটা বাজে এখন? সে কাল রাতে রুমের আগা মাথা কিছু বুঝতে না পারলেও এখন ঠিকিই দেখলো। টিপটপ করে গোছানো ছোট্ট একটা ড্রইং রুম। একপাশে দুইটা বেডরুম অন্য পাশে কিচেন আর বাথরুম। ফ্ল্যাট বাসায় অবশ্য এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা যায় না। সে একটু নড়েচড়ে বসে কপালে আঙুল ছোঁয়ালো। মাথা ভার হয়ে আছে।

— তুমি ঠিক আছো?

উসমান মাথা তুললো। মধ্য বয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে আছে। এটা যে ভাবির বাবা সে বুঝতে পারলো। না ভাবির চেহেরার সাথে মিল নেই। তবে ঐ মেয়েটার সাথে আছে। কি যেন নাম। ভাই বলেছিলো। তবে সে এখন মনে করতে পারলো না। নাম মনে না হলেও কাল রাতের কথা ঠিকিই তার মনে পড়লো। সে জ্বরে নিস্তেজ হলেও পুরোপুরি জ্ঞান হারায়নি। তাঁর অস্বস্তি হতে লাগলো। তবে সে বুঝতে দিলো না। সে হালকা হেসে উঠে দাঁড়াতে চাইলো। হাজার হলেও মুরুব্বি মানুষ। সালামও দেওয়া দরকার। তবে সব কেমন জানি জট পাকিয়ে গেছে।

— না না উঠতে হবে না, বস। বলেই রাজ্জাক সাহেবও অন্য পাশে বসলেন। তাঁর নিজেও একটু অস্বস্তি হচ্ছে। যেখানে মেয়েই পর। সেখানে বাকি সম্পর্ক গুলো বেমানান। তবে হঠাৎ করে আসার কারণ সে বুঝতে পারছে না। কাল রাতে দিলশাদ ফোন দিলো। ঝড় বৃষ্টির জন্য কথা তেমন বুঝা গেলো না। তবে বুঝতে পারলো কেও এসেছে। তাঁদের তাড়াতাড়ি বাসায় আসতে বলছে। এই ঝড় বৃষ্টির মধ্যে কি আর চাইলেই তাড়াতাড়ি আসা যায়। তাঁদেরও আসতে আসতে দেরি হলো। এসে দেখে এই ছেলে জ্বরে প্রায় বেহুশ হয়ে আছে। দিলশাদ অবশ্য তাঁর সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এই মেয়েটা তাঁর ভারী লক্ষী। কখন কি করতে হবে এই মেয়েকে কখনও বলে দিতে হয় না। আর যা করবে একেবারে মন থেকেই করবে।

উসমান হালকা মাথা দোলালো। তবে কিছু বললো না ! তাঁর গায়ে ফুলতোলা মেয়েদের চাদর। চাদরটা কার সে বুঝতে পারছে। সে সেটা ঠিক করে গায়ে জড়িয়ে বসলো। কারণ তাঁর গায়ে প্যান্ট থাকলেও শার্ট নেই। মেয়েটা শার্ট খুলেছে তবে সম্ভবতো প্যান্টে হাত দেওয়ার মতো সাহস করে উঠতে পারেনি। তবে ব্রেইন ব্যবহার করেছে সর্বোচ্চ। তার নিচের অংশ কাঁথা দিয়ে পেঁচিয়ে মারমেইডের লেইজ বানিয়ে রেখেছে। যাতে কাঁথা প্যান্ট থেকে পানি শুষে নিতে পারে। এরকম ইউনিক আইডিয়া মেয়েদের মাথা থেকেই আসা সম্ভব।

সে মনে মনে বড় একটা শ্বাস ফেললো! শ্বাস ফেলতেই একটা মুখ তাঁর চোখে সামনে ভাসলো। নির্বিকার, শান্ত, শীতল একটা মুখ। একদম কাছে! পরম যত্নে তাঁর মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। এভাবে শেষ বার কে তাঁর যত্ন করেছে সে মনে করতে পারলো না। তাঁর অস্বত্বি আরো বাড়তে লাগলো। এরকম ঝামেলায় পড়বে জানলে আসতোই না। শুধু ভাইয়ের জন্য আসা। তা না হলে তোমার বউ, তোমার শুশুর বাড়ি, ঝামেলা পাকিয়েছোও তুমি। আমার কিসের ঠেকা।

— তোমার নামটা যেন কি?
— উসমান।
— নারায়ণগঞ্জ প্রথম এসেছো?
— না! তবে এই দিকটায় প্রথম।
— ও! তোমরা থাক কোথায়? বলেই রাজ্জাক সাহেবের মনটা খারাপ হয়ে গেলো। মেয়ের বিয়ে হয়েছে দু- বছরের উপরে অথচো তাঁরা জানেই না। মেয়ের শুশুর বাড়ি কোথায়।

উসমান রাজ্জাক সাহেবের মনের অবস্থা বুঝতে পারলো। না বোঝার অবশ্য কিছু নেই। এই সব ভাইয়ের জন্য। এরা জানে না ভালোবাসা হয়তো দু-জনের পক্ষ থেকেই ছিলো। তবে বিয়েটা হয়েছিলো জোরজবরদস্তি।

— রায়বাজার।
রাজ্জাক সাহেব ভ্রু কুঁচকালো।
— এটা কোথায়?
— ঢাকার মধ্যেই।
— কোন থানায় পড়েছে এটা?
— নবাবগঞ্জ।
— ও আচ্ছা! নবাবগঞ্জ! এই জায়গার কথা অবশ্য শুনেছি। নবাবদের এলাকা।

উসমান হাসলো। তবে কিছু বললো না।
তখনি খাদিজা আসলো বিরস মুখে। উসমানের দিকে তাঁকিয়ে নিরস ভাবে বললো, — তুমি বরং ফ্রেশ হয়ে নাও। যা বলার নাস্তা খাওয়ার পরে শোনা যাবে। এই তিহা যা ভাইয়ার শার্ট নিয়ে আয়। আর দিলশাদকেও ডেকে তুল। আর কতো ঘুমাবে?

উসমান উঠে দাঁড়ালো। সত্যিই তাঁর ফ্রেশ হওয়া দরকার। সে এগিয়ে গেলো। তবে তার মাথায় একটা নাম ঘোরপাক খেতে লাগলো, দিলশাদ।

খাবার টেবিলে তেমন আর কথা হলো না। রাজ্জাক সাহেব উসমান আর ঐ পিচ্চি মেয়ে চুপচাপ নাস্তা শেষ করলো। খাদিজা বেগম চুপচাপ এটা সেটা এগিয়ে দিলেন। এই মহিলার মুখ দেখেই উসমার বুঝতে পারলো। এখানে আসায় লাভ তেমন হবে না। সে অবশ্য ভাই কে আগেই বলেছিলো। যে আমাকে না পাঠিয়ে বরং নিজে যাও। তাহলে হয়তো তাঁরা কিছুটা হলেও সহজ ভাবে নিবে। তবে সবচেয়ে ভালো হতো বাবা আসলে। তবে দুনিয়া উলটে গেলেও সে আসবে না। কারণ! তিনিও এই বিয়ে মেনে নিতেই পারেন নি। শুধু ভাইয়ের জন্য কিছু বলেন না।

নাস্তা শেষে আবার তারা ড্রয়িং রুমে এসে বসলো। বসতেই উসমান ঝটকা খেলো। দিলশাদ কে দেখে। দিলশাদের গায়ে থ্রি পিস। ঘুম থেকে উঠার কারণে চোখ, মুখ ফুলে আছে। আর সবচেয়ে বড় কথা। পেটের উঁচু ভাব নেই। পেটে পিঠে থ্রিপিস আটঁসাঁট ভাবে লেগে আছে। আর তাঁকে দেখে লাগছে একদম বাচ্চা মেয়ের মতো। সে হতম্বভ হয়ে গেলো। কালকে দেখা নারীর সাথে এই মেয়ের কোন মিল নেই।

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকালো। লোকটা যে তাঁকে দেখে ঝটকা খেয়েছে সে ঠিক বুঝলো। কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারলো না। আজব এক লোক! এক বাসায় এসেই কথা নেই, বার্তা নেই বেহুশ। আর এই বেহুশ পাহাড়- পর্বতকে নাড়াতে চড়াতে তাঁর শরীরের হাড্ডি গুড্ডি নড়ে চড়ে গেছে। সে ভ্রু কুঁচকেই রাজ্জাক সাহেবের পাশে দাঁড়ালো।

উসমান দ্রুত নিজেকে সামলে নিলো। এই বাসায় আসা থেকে শুরু করে এই পর্যন্ত সব এমন এলোমেলো হচ্ছে কেন সে বুঝতে পারছে না। অথচো সব কাজ নিঁখুত ভাবে করার তাঁর সুনাম আছে। সে নিজেকে ধাতস্থ করে রাজ্জাক সাহেবের দিকে তাঁকিয়ে বললো,— আঙ্কেল ভাবি অসুস্থ! অসুস্থ মানে সে রকম কিছু না। মানসিক ভাবে অসুস্থ। সে মা হতে চলেছে। বুঝতেই পারছেন! এই সময় মেয়েদের অবস্থা কিরকম হয়। তাছাড়া তাঁর প্রেগন্সিতে সমস্যাও আছে। টুইন বেবি প্লাস তাঁর মাতৃত্বকালীন ডায়াবেটিস ধরা পরেছে। তাঁর শারীরিক অবস্থাও খুব একটা ভালো না। এই সময় শুশুরবাড়ির মানুষ হাজার পাশে থাক তবুও বাবার বাড়ির মানুষদের ভরসাই আলাদা। ভাই অবশ্য নিজেই আসতে চেয়েছিলো । ভাবির অবস্থা দেখে আর ভরসা পায়নি। তবে ভাই খুব ভয় পাচ্ছে । ভয়েরও অবশ্য কারণ আছে। আমাদের মাও এই রকম এক অবস্থায় মারা যায়। বলেই উসমান থামলো।

মায়ের কথা টানতে তাঁর ভালো লাগছে না। তবুও কি করার। এই অবস্থায় ভাবিকে যদি কেও বোঝাতে পারে তা হলো এই বাসারই কেও। ভাবি ভাই কে ভালোবাসলেও,ভাই বিয়ে করেছিলো জোর করে। কি কারণে জোর করতে হয়েছিলো সে জানে না। তবে ভাবি বিয়েটা কখনও মন থেকে মেনে নেয় নি। যার কারণে ভাইও হয়ে গেলো কঠোর। ভাবির সব সম্পর্ক থেকে তাঁকে আলাদা করে ফেললো। অযত্নে অবহেলায় ভাবি নিজেকে শেষ করেছে ধীরে ধীরে । এর মধ্যে আবার তাঁর মা হওয়া। তাঁর অবস্থা সত্যিই খারাপ। ভাই আর যাই করুক ভাবিকে সত্যিই ভালোবাসে। তাইতো সে এখানে। সে চায় ভাই ভাবি দু- জনেই ভালো থাকুক। এদের সম্পর্ক যদি কেও ঠিক করতে পারে তা হলো ভাবির আপনজন। আর এদেরকে ভাবির কাছ থেকে দূরে রাখা এটাই ভাইয়ের ছিলো সবচেয়ে বড় ভুল।

রাজ্জাক সাহেব কিছু বললেন না। সে চুপচাপ উঠে ভিতরে চলে গেলেন। খাদিজা বেগম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। তাবে স্বাভাবিক আছে দিলশাদ। সে এখনও ভ্রু কুঁচকে তাঁকিয়ে আছে। উসমানের এই প্রথম মনে হলো মেয়েটা অন্য রকম। শুধু অন্যরকম না। দেখতে ভোলাভালা টাইপ হলেও আসলে সেরকম না। আর সে একশ পার্সেন্ট শিওর এই মেয়ে কিছু না কিছু একটা ধরে ফেলেছে।

উসমান খুক খুক করে একটু কাশলো। মেয়েটা কিছু না করেও কিভাবে যেন তাঁকে সহজেই এলোমেলো করে দেয়। সে কেশে স্বাভাবিক ভাবে বললো, — আমাকে যেতে হবে। ঝামেলায় ফেলানোর জন্য আমি দুঃখিত। তবে ছোট্ট একটা রিকোয়েষ্ট। ভাবি আপনাদের সন্তান। সন্তানেরা হাজার ভুল ভ্রান্তি করলেও সন্তানের বিপদে বাবা, মা মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারে না। আশা করি আপনারাও রাখবেন না।

উসমান উঠে দাঁড়ালো! তাঁর যাওয়া দরকার। এর চেয়ে বেশি আর কি করবে। এদের দিকটাও ভাবতে হবে। এভাবেইতো আর সব ভুলে যেতে পারে না। তাও হোত যদি কোন মুরব্বী এসে মিটমাটের চেষ্টা করতো। সে বেরুবে এমন সময় দিলশাদ বললো, — আরেকটু বসুন প্লিজ! আমি আপনার সাথে যাবো। আমার রেডি হতে সময় লাগবে না।

উসমান অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ালো। এটা সে আশা করে নি। একদম ই না।

চলবে……