দর্পণ পর্ব-১৫+১৬

0
106

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৫

ইউসুফ হেলেদুলে সবার শেষে রুম থেকে বের হলো। ডাইনিংয়ে এসে চেয়ার টেনে উসমানের সাইডে বসলো। তার ঘুম কাটেনি এখনো! সে হাই তুললো। সেও চেঁচামেচি শুনেছে তবে বের হয় নি। এ সব এ বাড়িতে এখন ডালভাত। তবে এবারের ডালভাত তাঁর ভালো লেগেছে। এক তো উসমান ভাই আর দিলশাদ আপুকে নিয়ে কাহিনী হচ্ছে। হোক! কাহিনী থেকেই তো ফিল্ম। আর দ্বিতীয় ভাবি! যাক এতোদিনে বুঝি আমাদের হলো।

সে হাই তুলেই বললো — নাস্তা কই ফুপু?

রুবিনা এবার আর তেঁতে উঠলো না । দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো —- ধর আমারে খা! খাইয়া শান্তি হয়। খাওনের সময় তো ফুপু আর সাইড টানোনের সময় ঠিক ভাবি।

— আমি এতো খারাপ মাংস খাইনা ফুপু। তাড়াতাড়ি নাস্তা দাওতো।

— হ! এখন খারাপতো হবোই। ভালোতো ছিলাম তখন যখন হাগা মুতার খেতা ধোঁয়ার মানুষ ছিলো না।

— এহনো নাই ফুপু! বিয়ে তোমার পেয়ারের উমর করছে আমি না। এখন যাওতো।

রুবিনা আর কিছু বললো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে কিচেনের দিকে গেলো। যেতে যেতে বললো, — এইগুলো আমার হাড্ডি জ্বালায় খাইলো । দুঃখে যে একটু বসে বসে শান্তিতে কান্দুম সেই জোগার ও নাই। আমার ভাত কাপড়ের অভাব আছে। এগুলোর জন্য কোথাও যাইয়া মইরাও শান্তি পাই না।

হামিদা বানুও উঠলেন! এই ঝগড়া ঝাটির কারণে সে এখনও হাত মুখও ধুতে পারে নাই।

তাঁরা যেতেই উসমান নিঃশব্দে হাসলো! হেসে ইউসুফকে বললো,— কালকে তুই ঐ বাসায় গিয়েছিলি?
— হ্যাঁ!
— কেন?
— কেন আবার কি। এমনিই! যাওয়া যাবে না নাকি?
উসমান কিছু বললো না। ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো। এই ছেলে কি খিচুড়ি পাকাচ্ছে কে জানে?

তখনি ভোঁতা মুখে উমর আসলো। উমরকে দেখে উসমান বললো,—- ভোঁতা মুখে তুমি ঘুরছো কেন? ঘোরার কথা তো আমার। এক বলেই আউট।

উমর চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, —- তোর ভাবি বোনকে নিয়ে দরজা বন্ধ করে বসে আছে। এতো বেলা হলো। কাজে যাওয়া তো দূরের কথা, বাথরুমেও যায়নি।
— এমন খুশির দিনে বাথরুমে যাওয়ার দরকার কি? খুশিতে তো তোমার সব বন্ধ টন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা।
— কিসের খুশি?
— এই যে ভাবি আজকে এই সংসার কে নিজের বলে এলান করলো।

— সেটা বললেও তাঁর না বললেও তাঁর। এটা খুশির কি হলো? আমি তো আছি অন্য টেনশনে। রাতেও ঢুকতে দেয় কিনা কে জানে?

ইউসুফ, উসমান দু-জনেই হাসলো! উসমান বললো,— তোমার টেনশনে তুমি আছো! এদিকে আমাকে যে রেড কার্ড দেখিয়ে ভাবি একেবারে স্টেডিয়ামের বাইয়ে পাঠিয়ে দিলো।

— ভাবি দিয়েছে! দিলশাদ আপুতো দেয় নি। একটা মেয়েকে পটাতে পারো না। ছিঃ! এমন হাতির মতো শরীর দিয়ে কি লাভ ? ইউসুফ মুখ বাঁকিয়ে বললো।

উসমান দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে মনে মনে বললো, — সে তো আরো এগিয়ে! ভাবিতো স্টেডিয়াম থেকে বের করেছে। সেতো দুনিয়া থেকে বের করার তালে আছে। কাওকে কিছু বলতেও পারিনা। হাহ্! যাকে নায়িকা ভেবে ঘাড়ে তুলে নিয়ে এসেছি। সে আসলে ভিলেন। আর সেই ভিলনকেই মন দিয়ে বসে আছি।

রুবিনা নাস্তা নিয়ে এলো! উমরকে দেখে বললো,— তোর সামনে তোর বউ আমাকে এতোকিছু বললো। তুই একটা শব্দও বললি না।

উমর কিছু বললো না । দীর্ঘশ্বাস ফেললো! মনে মনে বললো,– এরা ভালো হবার নয়।

বললো ইউসুফ, —- সেটা তো ভাই ভাবির বেলাও চুপ থাকে। তখন তো তোমরা যা খুশি তাই বলো।

রুবিনা আকাশ থেকে পড়ার মতো বললো,— আমরা যা খুশি বলি?

— হ্যাঁ বলোইতো! একটু সুন্দর ভাবে মিলেমিশে থাকো তা না। শুধু খোঁচাখোঁচি।

রুবিনার এদেরকে আর কিছু বলার ইচ্ছা হলো না। কাদের বলবেন তিনি। এই তিনটার শরীর আলাদা হলেও মাথা একটাই। প্রথমটা যে দিকে বাকি দুইটাও সেইদিকে। সে মুখ বাঁকিয়ে চলে গেলো। চলে যেতে যেতে বললেন,— একেকজন যা খুশি তাই করবে। মেয়ে নিয়ে লটরপটরও করবে। আর আমরা কিচ্ছু বলতে পারবো না। না বললাম! যা যা, যা খুশি কর।

— ছাদের কাহিনী কি? উমর উসমানের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।

— কোন কাহিনী নেই! আমি গিয়েছিলাম! গিয়ে দেখি দিলশাদ আগে থেকেই ছিলো। আমাকে দেখে সে চলে এসেছে। ব্যস! এইটুকুই!

উসমান ভ্রু কুঁচকে বললো,—- এইটুকুই?

— অবশ্যই! আর কি হবে?

— তুই তো জীবনও ছাদে যাস না! কালকে কি মনে করে গিয়েছিস?

— জীবনে যাই না বলে, যেতে পারবো না নাকি? আর আমার কথা বিশ্বাস না হলে। তোমার শালীকে জিজ্ঞেস করো। সে তো আবার সত্যবতী। দেখনা সকাল হতে না হতেই সব ব্লাস্ট।

উমর আর কিছু বললো না! তাঁর ঘাড়ে কয়টা মাথা যে আবার জিজ্ঞেস করতে যাবে। সে উঠে আবার রুমের দিকে গেলো। দীপার আবার ঔষুধ আছে। এই মেয়েতো নিজে জীবনেও খাবেনা। কি যে করি? ধুর!

ইউসুফও কিছু বললো না! সে নাস্তা খাচ্ছে আর উসমানের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছে। আর কেও না জানুক, সে জানে! উসমান ভাই যে দিলশাদ আপুকে দেখেই ছাদে গেছে। আর সবচেয়ে বড় কথা সে যেতেই দিলশাদ আপু আসেনি। এসেছে অনেকক্ষণ পরে তাও আবার এক প্রকার দৌড়ে। সে তখন সোফায়ই শোয়া। গেইমস খেলছিলো। অন্ধকারের জন্য তাঁরা কেও খেয়ালই করে নি। দিলশাদ আপুওনা! তাঁর ডানে বামে হুশ ছিলো না। তখন আপুকে দেখে যে কেওই বলে দিতে পারবে। ভাই কোন না কোন গন্ডগল অবশ্যই করেছে।
_____

দিলশাদ দাঁড়িয়ে আছে গেইটের কাছে। আচারওয়ালা যাচ্ছিলো। সে ডেকে দাঁড় করেছে। সে অবশ্য দেখতো না। যদি গেইট খোলা না থাকতো। আজকে সকাল থেকেই গেট পুরোটাই খোলা। খোলার অবশ্য কারণও আছে। সন্ধ্যায় উসমান আর সুমির কাবিন। মানুষ আসছে আর যাচ্ছে। দু- দিন পরে হওয়ার কথা ছিলো। কিন্তু কালকের কাহিনীর পরে হামিদা বানু গো ধরে বসে আছেন। আজকে মানে আজকেই। এক দিনে আলি হোসেন কি আর করবেন। তাই শুধু ফোন করে আত্মীয় স্বজনদের আসতে বলেছেন। এদের আবার বিরাট গুষ্টি । এতো সর্ট সময়ে মধ্যেও ঘর বাড়ি সব ভরে গেছে।

ফুপুর ছেলে মেয়ে বউ বাচ্চা সহ উসমানের তিন চাচা, চাচী তাঁদের আন্ডা বাচ্চাও সবাই। যেহেতু কাজিন সেহেতু এক বাসায়ই ঝামেলা করছে। দু- বাসায় দৌড়াদৌড়ির দরকার কি? দু- বাসা বলতেও তেমন কিছু না। পাশাপাশি বাড়ি! তাঁরা আগে নাকি সবাই এ বাসায় ই থাকতো। পরে নিজের পছন্দ মতো পাশাপাশি বাড়ি করে নিয়েছে। আত্মীয় স্বজন তো দু- পক্ষেরই এক। তাই আর আলাদা ঝামেলায়ও যায়নি।

দিলশাদ আচার মুখে দিলো।তখনি সুমি এগিয়ে আসলো। এই বিয়ে এক আজব বিয়ে। বিয়ের কনে এখানে ওখানে দৌড়ে বেড়াচ্ছে আর বর তাঁর নিজের কাজ নিয়ে সকাল থেকে গায়েব। বিয়ে নিয়ে এদের কোন আলাদা মাথা ব্যথা নেই।

— ইশ! একা একা খাচ্ছো?

দিলশাদ কিছু বললো না। বলার মতো অবস্থা অবশ্য তাঁর নেই। তাঁর মুখ ভর্তি আচার। সে আচার ভর্তি হাত এগিয়ে দিলো।

সুমি আচার নিতে নিতে বললো,—- এতো আচার দিয়ে কি করবে? ঘর ভর্তি দুনিয়ার আচার। উমর ভাই ভাবির জন্য কিছু বাকি রাখে।

— সেগুলো স্বাস্থ্যসম্মত। আর শোনো এই দেশে স্বাস্থ্যসম্মত কোন কিছুতে কখনও স্বাদ হয়না। আসল স্বাদ তো এই রাস্তার ধূলোবালিতে।

— বুঝলাম সর্ব বিষয়ে বিশারদ।

— থ্যাঙ্কিউ বিয়ের কন্যা। এখন চলো! যার জন্য নিয়েছি তার কাছে হস্তান্তর করে আসি। তাকে আবার স্বাস্থ্যসম্মত জিনিস খাইয়ে খাইয়ে আধা মেনটাল বানিয়ে ফেলেছে।
— ইশ! মেনটালতো ভাইয়েকে বানিয়ে রেখেছে ভাবি। ডানে বামে কিছু দেখে?

— সেটা এমনিতেই দেখবেনা। জাদু আমাদের রক্তে মেশানো। সেই রক্ত যদি তোমার প্রাণ প্রিয় ভাই চুষে চুষে শেষ করতে থাকে পাগলতো হবেই।

সুমি হেসে ফেললো! হেসে বললো, — তুমি তোমার আপুকে খুব ভালোবাসো তাই না? ইশ! আমারো যদি একটা বড় বোন থাকতো।

— না থেকেই শান্তিতে আছো। কি প্যারা তা তো তুমি জানো না। বলেই দিলশাদ সুমির মুখের দিকে তাকালো। মেয়েটাকে কি আজতে একটু অন্যরকম লাগছে? কি জানি! তারতো আবার সব কিছুকেই অন্যরকম লাগে। তবুও সে জিজ্ঞেস করলো, —- তুমি এই বিয়েতে খুশিতো?

সুমি আবারো হেসে ফেললো! খিলখিলানো হাসি।
— হাসছো কেন?
— সেটা সন্ধ্যার সময়ই বুঝবে?
— এখন বুঝলে সমস্যা কি?
— অনেক সমস্যা মেরি জান।

তখনি আলি হোসেন বাসা থেকে বেরুলেন! দিলশাদ এগিয়ে গেলো। খুব স্বাভাবিক ভাবে বললো,
— আঙ্কেল নিন? আচার খান।

আলি হোসেন চমকালেন! পরক্ষণেই হেসে ফেললেন, — এই মেয়েটাকে তাঁর খুবই পছন্দ হয়েছে। যখন সে এসেছে তখন থেকেই কেমন আশে পাশে ঘুরছে। টুকটুক করে কথা বলছে। কথাও বলে কি মায়া করে। তাঁর মেয়ে নেই। এই মেয়েটাকে দেখে কেমন জানি আফসোসও হচ্ছে। ইশ! তাঁর যদি একটা মেয়ে থাকতো! দীপাও ভালো! তবে সে কখনও নিজে থেকে তাঁর সাথে এভাবে সহজ ভাবে কথা বলেনি।

এখন বুঝতে পারছে ইউসুফ কেন এতো পাগল হয়েছে। এই মেয়ের জন্যই সেইদিন ইউসুফ তাঁর কাছে গিয়েছিলো। সে তো শুনেই রাগ। একজন গিয়েছে আবার আরেকজন! তাঁরমধ্যে আবার সুমির সাথে বিয়ের দিন তারিখ সব ঠিক হয়ে গেছে। এবার কথার খেলাফ হলে, মা, ভাইদের মুখ দেখাবে কি করে। আর সবচেয়ে বড় কথা, উসমানের এই বিয়ে নিয়ে সমস্যা নেই। মিয়া বিবি রাজি তো ছোট ভাইয়ের নারাজিতে কি আসে যায়।

তবুও ইউসুফ নাছোড় বান্দা! উসমানও নাকি এই মেয়েকে পছন্দ করে। সে তাঁর ছেলেদের ভালো করেই চিনে। পছন্দ হলে আবার এই বিয়েতে মত দেয়?

ইউসুফ তাঁকে হুমকি দিয়ে এসেছে। যদি এই বিয়ে হয়। তবে সে তাঁর ঐ বাড়িতে আগুন দিয়ে দিবে। এই বাড়িতেও দিতো শুধু ভাবি আছে বলে মাফ।

সে কোন কিছুই গনায় ধরেনি! কিন্তু সমস্যা হয়ে গেছে আরেক যায়গা থেকে । তারমধ্যে কালকের কাহিনী। ইউসুফ আবার তাকে চেপে ধরেছে। এই বার তিনি আর না করতে পারেনি। বাবা হওয়ার অনেক জ্বালা। আর পারেনি বলেই দুনিয়ার প্রেসারে আছে। কেমনে কি করবে ভাই। সেই আইডিয়াও ইউসুফই দিয়েছে। এই ছেলের পড়ালেখা বাদে সব কিছুতেই মাথা চলে রকেটের গতিতে। তবে খাঁটা খাঁটনি সব আবার তার। এই ছেলেদের জন্য তাঁর আরো কতো কিছু করতে হবে কে জানে? বয়স হয়েও শান্তি নাই। ইশ! একটা মেয়ে থাকলে বাপের দুঃখ ঠিক বুঝতো।

মন মনে এক রাশ আফসোস নিয়ে সে হাত বাড়িয়ে আচার নিলো! সে তাঁর ইহো জীবনেও আচার মুখে তুলেনি। এটা তাঁর কাছে অখাদ্য। তবে আজ নিলো, মেয়েটা এতো মিষ্টি করে বলছে। আর নিতেই পুরো শরীর ঝাকিয়ে উঠলো।

সুমি আর দিলশাদ খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। তাদের হাসি সাথে এই শান্ত, শীতল, নিস্তেজ বাড়িটাও যেন ঝলমলিয়ে উঠলো।

আর সেই ঝলমলানো বাড়ির গেইটের সামনে ঠিক তখনি একটা গাড়ি এসে থামলো। হাসতে হাসতেই দিলশাদের সেখানে নজর পড়লো। ভেতর থেকে কেও বের হতেই সে বিস্ময়ে হা হয়ে গেলো, হাত থেকে সব আচার নিচেও পরে গেলো।

চলবে…….

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ১৬

দীপার রুমে আজ নিশ্বাস ফেলারও জায়গা নেই। তাঁর ফুপাতে, চাচাতে সব জা আজকে তাঁর রুমেই।আজকে অবশ্য নতুন না। বাড়িতে যেই অনুষ্ঠানই হোক, কেন জানি তারা তার রুমকে সবার আগে বেছে নেয়। এমন না দীপাকে তারা পছন্দ করে। বরং তাকে পুরো গুষ্টিতে শহুরে অহংকারী, নাক উঁচু মেয়ে হিসেবেই চেনে। চিনবেই না কেন? সে তো কারো সাথে সেভাবে কখনও মিশেইনি।

না মিশলেও, পছন্দ না করলেও এই বাসায় আসলেই সবার আগে দীপার রুমই এদের দখলে। তাই আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গল্প, আড্ডা, হাসি তামাশায় পুরো ঘর মুখরিত। দীপা এদের মাঝেই চুপচাপ বসে আছে। তাঁর ভালো লাগছে না। পেটে কেমন চাপ অনুভব হচ্ছে। সাথে অস্থিরও লাগছে। ডাক্তার অবশ্য বলেছে সমস্যা নেই। নয় মাস থেকে এরকম নাকি হয়। সে খিঁচে বসে রইলো। কি বা করবে সে। উমর পাশে থাকলে অবশ্য ভালো হতো। তাকে কিছু বলতে হয় না। কিভাবে যেন সব বুঝে যায়।

উমরের কথা মনে পড়তেই তাঁর কেন জানি তাকে দেখতে ইচ্ছা করলো। কালকে সে তাকে আর ঘরে ঢুকতে দেয়নি। কেন দেবে? তাঁর সামনেই যতো ঢং। বড় বড় কথা। বাড়ির মানুষের সামনে ভেজা বেড়াল। কখনও উচিত বলে না। সে বলেনা তাঁর সাইড নিয়ে কথা বলুক। তবে যেটা ন্যায়, সঠিক সেটাই বলুক। তাও বলবে না! তাই যা করেছে তাঁর জন্য ঠিকিই আছে।

ঠিক থাকলেও কেন জানি তাঁর মন মানছে না। এই দু- বছরে এক রাতের জন্যও উমর কোথাও থাকেনি। যতো রাত হোক, যতো কাজ থাক। ঘুমাবে দীপার পাশে এসে। কাল রাতে কোথায় ছিলো কে জানে। সকালে একবার অবশ্য শুকনো মুখে উঁকি দিয়েছিলো। ছোট, বড় ভাইয়ের বউদের দেখে ভেতরে আসার আর সাহস করেনি।

তখনি হন্তদন্ত হয়ে দিলশাদ আসলো! সে হাঁপাচ্ছে! তবে চোখে মুখে অন্য রকম একটা খুশির ঝিলিক ।

সবাই অবাক হয়ে তাকালো! দীপাও!
দিলশাদ অবশ্য কারো দিকে তাকালো না। সবাই কে ডিঙিয়ে দীপার পাশে আসলো। এসে দু- হাতে চোখ ধরে বললো, — আস্তে আস্তে উঠে আসোতো আপু! তোমার জন্য বিশাল একটা সারপ্রাইজ আছে।

দীপা হাসলো!— এভাবে কেও আসে? আমিতো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। আবার না জানি কি হলো?

— উফ্ ! এতো কথা বলো নাতো! উঠো! তাড়াতাড়ি উঠো।

দীপা দিলশাদের হাত ধরেই আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালো। চোখ বন্ধ করেই আস্তে আস্তে এগিয়ে গেলো। ড্রইং রুমে এসে দাঁড়াতেই দিলশাদ চোখ থেকে হাত সরিয়ে বললো, — সারপ্রাইজ!

দীপা চোখ খুলতেই থমকে গেলো! ড্রইং রুমে এক গাদা মানুষের মধ্যে সোফায় বসা দুটো মানুষকে দেখে। তার ভেতর ভারী হয়ে এলো। চোখ ভর্তি টলমলো পানি নিয়ে কাতর নয়নে দীপা তাকালো সেই মানুষ দুইটার দিকে।

খাদিজা দীপাকে দেখে উঠে এলো! তার চোখ ভর্তিও পানি। কি অবস্থা হয়েছে তাঁর মেয়ের। সে এসেই দীপাকে জড়িয়ে ধরলো।

ধরতেই দীপা হাউমাউ করে বাচ্চা মেয়ের মতো কেঁদে উঠলো। কতো দিন! কতো দিন পরে সে এই শান্তির জায়গাটা পোলো।

কাঁদলো খাদিজাও! তাঁর প্রথম নাড়ী ছেঁড়া ধন। চোখ মুছলেন রাজ্জাক সাহেবও। সে তো ভাবতেই পারছেনা, তাঁরা এখানে এসেছে। অবশ্য সব সম্ভব হয়েছে আলি হোসেন নামক মানুষটার জন্য। কাল রাতে হঠাৎ করে তাঁর ফোন। সে ফোন করে খুবই বিনয়ী ভাবে বললো,— ভাই সাহেব, ছেলে মেয়েরা যা করার করছে। আর মনে দুঃখ পুষে রেখে লাভ কি? আমাদের নাতি নাতনীরা আসছে। তাদের কথা চিন্তা করে হলেও এদের মাফ করে দেন। কাল আমার ছোট ছেলের কাবিন। বিশ্বাস করেন ভাই, সময় পাই নাই তাহলে অবশ্যই বাড়িতে গিয়ে দাওয়াত করতাম। তাই এখন মনে কোন কষ্ট না রেখে এই ফোনের দাওয়াত টা গ্রহন করেন।

রাজ্জাক সাহেব ফোন পেয়েই হতবাক হয়ে গেছেন। দাওয়াতের ব্যাপারে কি বলবেন বুঝতে পারলেন না।

তখন আবার আলি হোসেন ই বললেন, — আমি কালকে সকালে গাড়ি পাঠাবো ভাই! যদি আপনার আসেন তাহলেই আমি মনে করবো আপনারা আমার সম্মান রেখেছেন।

এর পরে আর কিছু বলার থাকে না। হাজার হলেও মেয়ের শুশুর। নিজ থেকে এগিয়ে এসেছে। সেখানে আর তারা বসে থাকবে কেন? সকালে গাড়ি পৌঁছাতেই তাঁরা চলে এসেছে।

দিলশাদের খুশি আজ দেখে কে! সে এগিয়ে গিয়ে আলি হোসেন হাত ঝাপটে ধরলো! ধরে বললো,— থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ, থ্যাঙ্কিউ আঙ্কেল। আজ আমি অনেক, অনেক, অনেক খুশি। এই খুশির জন্য আপনি যা চাইবেন আমি তাই দিয়ে দেব।

আলি হোসেন হাসলেন! স্নেহ ভরা চোখে এই পাগল মেয়েটার দিকে তাকালেন। সে যা করেছে ইউসুফের কথায়! তবে এখন মনে হচ্ছে যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। এই কাজটা তাঁর আরো অনেক আগে করা উচিত ছিলো।

এতো এতো খুশির মধ্যে হামিদা বানু আর রুবিনা মুখ কালো করে বসে আছে। তাঁরা ছেলে পক্ষ! তাঁরা কেন নিচু হবে। নিচু হবে তো এরা। তা না! ফোন করে পায়ে ধরে গাড়ি পাঠিয়ে আনা । সেটা এরা মানতে পারছে না।

তাঁদের পাশেই উমর দাঁড়ানো! সে বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে আছে। সে এখনও বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে? বাবা নিজে থেকে এদের আনিয়েছে! অথচো মিডিলক্লাস ফ্যামেলি বলে সবচেয়ে বেশি সমস্যা ছিলো তাঁর।

সাথেই সাথেই দিলশাদের দিকে তাকালো! দিলশাদ বাবার হাত ধরে দাঁড়িয়ে আছে! এও সম্ভব! তাঁর কাঠখোরা বাবা জীবনে নিজের ছেলেদের হাত ধরেছে কিনা সন্দেহ আর আজ পরের মেয়ের হাত ধরে এমন ভাবে দাঁড়িয়ে আছে, যেন বাচ্চা মেয়ে! হাত ছাড়লেই হাড়িয়ে যাবে।

সেই সময় উসমানও আসলো! সকাল থেকে সে বাসায় ছিলোনা। রাজ্জাক সাহেব আর খাদিজাকে দেখে রিতিমতো ঝটকা খেলো। সেই ঝটকার উপরে মটকা ভাঙলো দিলশাদ। তাঁর দিকে চোখ পড়তেই চোখ মেরে বসল । এতো মানুষের মধ্যে উসমান ঝট করেই অন্য দিকে তাকালো! এই মেয়ের ভরসা নেই। নিশ্চয়ই কোন গিট্টু লাগানোর নতুন পায়তারা করছে।

দিলশাদ হেসে ফেললো! সে আজ খুব, খুব, খুব খুশি! সে টেনশনে ছিলো! কিভাবে বাবা,মা কে এখানে আনবে। তবে তাঁর সব সমস্যার সমাধান করে দিলো আঙ্কেল। এখন আর আপুকে নিয়ে যাওয়া কোন ব্যাপারই না। তাই সে ঠিক করলো এই বিয়েতে আর কোন ঝামেলা পাকাবে না। যতো তাড়াতাড়ি বিয়ে হবে ততোই ভালো। বিয়ের ঝামেলা শেষ হলেই আপু এই জেল খানা থেকে মুক্তি, মুক্তি, মুক্তি।

বিয়ে সন্ধ্যার পরপরই! আশেপাশের মানুষও আসছে। পান মুখে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে চলে যাচ্ছে। জামাই বউ তাদের আগেই দেখা। তাই তাদের দিকে আকর্ষণ না থাকলেও। কে কি করছে না করছে ঘুরে ঘুরে দেখছে। বিয়ে বাড়ির এই তো মজা।

দিলশাদ মিষ্টি রংয়ের ভারী কারুকাজের একটা গোল লং জামা পরলো। সে বিয়ে খাওয়ার মতো জামা কাপড় আনেনি। তবে তাঁর বুদ্ধিমতি মা নিয়ে এসেছে। ভাগ্যিস এনেছে। সে চোখে গাঢ় করে কাজল দিলো! ঠোঁটে হালকা লিপস্টিক আর সাথে পিঠময় চুল ছেড়ে দিলো। ছেড়ে আয়নায় নিজের দিকে তাঁকালো! এপাশ ওপাশ করে ঘুরে বললো, — হায়! আমি তো নিজেই নিজের প্রেমে পড়ে গেলাম।

দীপা হেসে ফেললো! হেসে মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে বললো,—- এই পাগলের পাগলামী বন্ধ হবে কবে?
খাদিজাও হাসলেন! হেসে বললো, — যার নয় তে হয় না তাঁর নব্বইতেও হয় না। তাই আশা ছেড়েই দিয়েছি।

দিলশাদ তাদের কে ভেংচি কাটলো! কেটে বের হয়ে আসলো! এসে আশেপাশে তাকালো! তাকাতেই তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেলো। সুমি কই? সে সুমিকে লাস্ট বার দেখেছে সেই সকালে। বাবা, মা আসায় সব মাথা থেকে বেড়িয়ে গেছে। এই মেয়ে কখনও এখানে, কখনও ওখানে। দু- মিনিটও এক জায়গায় চুপচাপ বসেনা। কোথায় আছে কে জানে? সবাই সেজে গুজে রেডি। অথচো যার বিয়ে তারই খবর নেই।

সাথে সাথেই তাঁর আরেকটা কথা মনে হলো। ইউসুফ কই? এই বান্দাকে সকাল থেকে একবারও দেখেনি। আজব এক বিয়ে ইয়ার! কেও এখানে, কেও ওখানে।

সে দরজার সামনে আসতেই উমরের সাথে দেখা। সে ভোঁতা মুখে দাঁড়িয়ে আছে। নেয়ে ঘেমে একাকার। সকাল থেকে অবশ্য আছে দৌড়ের উপরে। ভাইয়ের বিয়ে বলে কথা। তাঁর মধ্যে আবার বেচারা কাল থেকে বউয়ের ধারের কাছেও যেতে পারছে না।

দিলশাদের হাসি পেলো!আহা বেচারা! তবে এ তো শুরু! এই পথের দূরুত্ব এখন বাড়বে তো বাড়বেই। শেষ না হবে কভু।

সে উমরের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো! মিষ্টি করে হেসে বললো,—- আমাকে কেমন লাগছে বলুন তো?

উমর হালকা হাসলো! হেসে বললো,—– একবার তাকালেই যে কোন ছেলের মাথা ঘুরে যাবে? অন্ধ হয়েও যেতে পারে । আবার মাথার নাট বল্টু খুলে পাগলও হতে পারে, ঠিক সেই রকম।

— আচ্ছা! কই আপনার তো ঘুরছেনা? নাট বল্টুও তো আশে পাশে দেখছি না।

— সেটা ছেলেদের জন্য।

দিলশাদ অবাক হওয়ার ঢং করে বললো — হায় আল্লাহ! আপনি তাহলে ছেলে না। ও মাই গড, ও মাউ গড।

উমর হো হো করে হেসে উঠলো! এত্তো দুষ্টু এই মেয়ে। হেসে বললো,—- তোমার জন্য আমি অবশ্যই ছেলে না! আমি হচ্ছি ভাই। বোনের সৌন্দর্যে ভাইদের মাথা ঘুরে না।

দিলশাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো! তারপরে বললো,— ভাই?

উমরও এবার দিলশাদের দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — হ্যাঁ! ভাই।

দিলশাদ কিছু বললো না। অন্য পাশে তাকালো! তার মনটা আদ্র হয়ে এলো। অবশ্য বেশি স্থায়ী হলো না। সে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো। এরা মুখের কথায় অনায়াসেই চিরে ভিজিয়ে ফেলে। সে তো ভিজবে না। সে কি আপুর মতো বোকা। যে একটু মধুর কথা কি বলেছে, ডানে বামে না দেখে ভালোবাসার সাগরে টুপ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। এ জন্যই তো তার কপালে এতো ভোগান্তি।

— একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
— একটা কেন দশটাও করতে পারেন। আজ আমার মন খুব ভালো।
— সাবিহা! মানে উনাকে আনার বুদ্ধি বাবাকে তুমি দিয়েছো?

দিলশাদের ঠোঁটের কোণে আবারো হাসির রেখা দেখা গেলো। দুষ্ট হাসি! সে সেই হাসি দমিয়ে আকাশ থেকে টুপ করে পড়ার মতো ভাব নিয়ে বললো,—- কি যে বলেন না আপনি? আমি বুদ্ধি দেওয়ার কে বলুনতো? অবুঝ ছোট্ট বাচ্ছা একটা মেয়ে আমি।

— তুমি মানুষের বুদ্ধি দেওয়ার কেও না হলেও মানুষের ব্রেইন নিয়ে খেলতে পারো।

দিলশাদ ভাজা মাছ উলটে না খাওয়া টাইপ চেহেরা করে বললো,—- এটা বলতে পারলেন? খুব কষ্ট পেলাম।
— কষ্ট পাও আর যাই পাও তবে কথা সত্য। বাবাকে ইনিয়ে বিনিয়ে তাকে এখানে আনার আইডিয়া তুমিই দিয়েছো।

— ইশ! এখন সব দোষ আমার না ? আমি তো শুধু ওনাকে বললাম,– এতো সুন্দর অনুষ্ঠান আয়োজন। একা মানুষটা ওখানে বসে বসে কি করবে? ছেলে মেয়েও তো নেই। নিশ্চয়ই মন খারাপ করে বসে আছে। আপনারা মানেন আর না মানেন। সে তো আপনাদেরই মা। আহা! বেচারি। এসে কিই না খুশি! খুশি হবেই না কেন? প্রথম বার শুশুর বাড়িতে পা রাখলেন। আর এতো সুন্দর একটা পরিবার থাকতে একা একা বনবাসের মতো থাকার মানে হয়? আহারে ! বলেই দিলশাদ বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে করুণ ভাবে মাথা নাড়ালো। যেন তার দুঃখে তার বুক ফেটে যাচ্ছে।

উমর আর কিছু বললো না। দীর্ঘশ্বাস ফেললো ! এই মহিলাকে তাঁরা সহ্য করতে পারে না। এই মহিলার অবশ্য কোন দোষ নেই। দোষতো তাঁর বাবার! এই মহিলা এই জায়গায় না থাকলে অন্য কেও থাকতো। তবুও! নিজের বাবার পাশে নিজের মা ছাড়া অন্য কাউকে মানা যায় না। সে এতো মানুষের মাঝে বাবাকে কিছু বলতে পারছে না। বিশেষ করে আজ আবার দীপার বাবা, মা আছে। তাদের সামনে কোন সিনক্রিয়েট সে করতে চায় না।

তবে উসমানের সাথে বাবার একচোট কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। তবে ইউসুফের জন্য উসমান দমে গেছে। সে হঠাৎ করে বাবা, এই মহিলার এতো নেওটামি করছে কেন কে জানে? সে সোজা ভাবে বলেছে, তিনি যদি চলে যান সেও চলে যাবে।

আর এই দিকে দিলশাদ! হেঁসে হেঁসে সবাইকে বাশ দিচ্ছে। মেয়েটা আসলে চাচ্ছে কি? সে আর ভাবতে পারলো না। তাঁর মাথা ঘুরছে। সারারাত সে দু- চোখ এক করে নি। কি করে করবে? দীপাকে ছাড়া তাঁর ঘুম আসে না। ঘুম যেমন তেমন। চোখের দেখাতো দেখতে পারছে না। তখন ড্রইং রুমে দূর থেকে দেখলো। তার মনে হলো দীপা ঠিক নেই। তাকে তো ডেকে বলবেও না। সে যে যাবে সে উপায়ও নেই।

দিলশাদ চিন্তিত ভাবে পুরো বাড়ি সুমিকে খুঁজলো! গেলো কোথায় মেয়েটা? আর তখনি তাঁর মোবাইলে মেসেজ আসলো!অচেনা নাম্বার! সে মেসেজ অপেন করে চোখ রাখলো।

তুমি আমার কাছে মেঘের মতো
গাঢ়, গভীর, চোখ জোড়ানো সুন্দর
কিন্তু কাছে গিয়ে ছোঁয়ার সাহস হয় না
যদি হারিয়ে যাও……….

দিলশাদ হাসলো! হেসে মনে মনে বললো, — ব্যাটা বদমাইশ ! বিয়ে করছে একজনকে লাইন মারছে আরেকজনকে। শুধু ভালোয় ভালোয় একবার বিয়েটা হোক। তারপর সুমিকে এমন ডোস দিয়ে যাবো, তার পেদানিতে বাকি জীবন একটা গানই গাইবি, ” ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি।

চলবে……..