দর্পণ পর্ব-২৩+২৪+২৫

0
125

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৩

দিলশাদ তাদের গলির মোড়ে আসতেই দেখলো একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে। ভিতর দেখা না গেলেও সে জানে ভিতরে কে আছে। গাড়িটা তার পরিচিত। সে আবাক হলো না। সে ধরেই নিয়ে ছিলো কিছু একটা হবে। সে গাড়ি দেখেও না দেখার ভান করলো। তার কি? যা খুশি করুক। অপাতত তার একটা রিকশা দরকার! সে রিকশার জন্য আশে পাশে তাকালো। বাকি সব জাহান্নামে যাক।

তখনি তার ফোন বাজলো। দিলশাদ পার্স থেকে মোবাইল বের করলো! আর কে হবে? সে স্বাভাবিক ভাবেই ফোন ধরলো। ধরে বললো,— আসসালামু আলাইকুম উসমান ভাই..য়া।

উসমান হাসলো! সে তাঁর জীবনে এতো ফাজিল মেয়ে আর দেখেনি। সে দিলশাদের দিকে দৃষ্টি রেখেই বললো —– ওয়াআলাইকুমুস সালাম।

— কি খবর বলুন তো! সেই যে গেলেন আর খোঁজ খবরও তো নিলেন না।

— নেই নি বলে খুব দুঃখ পেয়েছো বলেতো মনে হয় না। দেখেতো মনে হচ্ছে খুব সুখেই আছো।

— সবই আপনাদের দয়া ! তা না হলে আমাদের কি আর সেই কপাল সুখে থাকবো?

— তোমার সুখ খন্ডাবে এমন মানুষও দুনিয়াতে আছে?

দিলশাদ হালকা হাসলো! হেসে বললো, —- আপনার গাড়িতে আয়না আছে নিশ্চয়ই। সেখানে তাকান, তাহলেই দেখতে পারবেন। আছে কি না।

— এতো সৌভাগ্যবান আমি?

— তা তো অবশ্যই! দিলশাদের ভাইয়া হতেও কপাল লাগে। যাইহোক! তা এতোদিন পরে কি মনে করে স্মরণ করে বাধিত করলেন। যদি একটু তাড়াতাড়ি বলতেন আমার খুব সুবিধা হতো।

উসমান তাঁর ঢংয়ের কথার উত্তর দিলো না। সে এক দৃষ্টিতে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা কিছুক্ষণ আগে চুল ঠিক করার জন্য হাত উঁচু করেছে । হাত উঁচু করতেই উসমানের দৃষ্টি এক জায়গায় আটকে গেছে। সাথে সাথেই তাঁর মেজাজের পারদ আকাশ ছুঁয়ে গেছে। এভাবে নিশ্চয়ই এই ফাজিল মেয়ে হাজার বার হাত উঁচু করবে। তাঁর শরীর জ্বলে গেলো। এই ফাজিল মেয়েটাকে ঠাটিয়ে কয়েকটা চড় লাগাতে ইচ্ছা করলো।

— হ্যালো! হ্যা…লো! আছেন? না জ্ঞান ট্যান হারিয়ে ফেলেছেন?

উসমান রাগের মধ্যেও হেসে ফেললো,— এই দের ইঞ্চির শরীর ভরা শুধু বুদ্ধি আর বুদ্ধি। কিভাবে কাকে জ্বালাতে হবে। সে ঠিক জানে।

দিলশাদের সামনে দিয়ে খালি রিকশা যাচ্ছিলো। সে হাত উঁচু করে থামালো! থামতেই উঠে বসলো।

উসমান দেখলো। কিছু বললো না। সে সিটে গা এলিয়ে দিলো।
— চুপচাপ বসে থাকার জন্য ফোন দিয়েছেন?

উসমান এই কথার উত্তর দিলো না। সে নিজের মতো করেই বললো,—- প্রথম দিন তোমাকে শাড়িতে দেখে আমি প্রেগন্যান্ট ভেবেছিলাম।

— হ্যাঁ! এ জন্যই তার পরের দিন সকালে ঝটকা খেয়েছিলেন।

— কিছুই তোমার নজর থেকে বাদ যায় না। তাইনা!

দিলশাদ হাসলো! কিছু বললো না। সে টেনে রিকশার হুড তুললো। বাতাসে চুল এলোমেলো হচ্ছে। হুড তুলে শাড়িও টেনে পেটের উপরে তুললো।

— তাহলে আমাকে দেখছো না কেন বলোতো ? এই যে জ্বলছি, পুড়ছি, নিঃশেষ হচ্ছি।

দিলশাদ কিছুক্ষণের জন্য থমকালো! সব সময় দুষ্টুমির সাথে তার মনে হলো আজকে কথার মিল নেই। তবে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে অবাক হওয়ার ঢং করে বললো,— ওমা! দেখলাম না কোথায়? এই তো কিছুক্ষণ আগেই তো দেখলাম। আপনি গাড়ি নিয়ে আমাদের গলির সামনে। ভাতিজাদের দেখতে এসেছেন না । ইশ! মিস হয়ে গেলো। আমি আজকে বাসায় নেই। তাহলে নিশ্চয়ই আপনার সাথে দেখা হতো। সমস্যা টা কোথায় বলেন তো ভাইয়া, জ্বলছেন, পুড়ছেন! গ্যাস্ট্রিক বাঁধিয়েছেন নাকি?

উসমান ক্লান্ত স্বরে বললো —– আমি দুপুরের আগে রওনা দিয়েছি দিলশাদ! এখন বিকাল। আমি লাঞ্চ করিনি।
— তো?
— আমি তোমার জন্য বসে আছি?
— আমি আপনাকে বসে থাকতে বলেছি?
— তুমি না আসা পর্যন্ত আমি এখানেই বসে থাকবো।
— থাকেন! নিষেধ করেছে কে? এটা তো আমার বাবার রাস্তা না।
উসমান আর কিছু বললো না। ফোন রেখে দিলো।

দিলশাদ হাসলো! হেসে মেসেজ পাঠালো,
” ঢং বন্ধ করুন। বাসার ভেতরে যান। গেলেই আপনার ভাবি মুখে তুলে লাঞ্চ করাবে। ভাতিজাদের দেখেন। মন, মেজাজ সব ভালো হয়ে যাবে। বাই “।

বলেই দিলশাদ রায়হানকে ফোন দিলো। এই শয়তানটা আসতেই চাইছে না। ফোন দিলেই বলে, একবারেই শিক্ষা হয়েছে। তুই যেখানে, আমি সেখানে নেই। পরে দেখা যাবে সেই বার শুধু কাপড়ের মতো ধুয়েছে। এই বার এসে হাত, পা গুড়াগুড়া করবে।
দিলশাদ হাসলো! মনে মনে বললো,— গুন্ডা! আমার সাথে পারে না, যায় আমার ইয়ের সাথে লাগতে।

দিলশাদের আসতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো। সে রিকশা থেকে নামতেই উসমানের গাড়ির দিকে চোখ পড়লো। এখন অবশ্য আগের জায়গায় নেই। সাইড করে রাখা । যাক! ভিতরে গেছে তাহলে।

সে আর ডানে বামে তাকালে না। সোজা হেঁটে চলে এলো। ক্লান্ত লাগছে তাঁর। অবশ্য খুব মজাও হয়েছে। বন্ধুরা একসাথে হবে মজা হবে না। তা কি করে হয়। সে কলিং বেল চাপলো। দরজা এসে খুললো ইউসুফ। তাঁর মুখ কালো। তবে কিছু বললো না।

দিলশাদ গা করলো না। ভিতরে আসলো! এসে অবাক হলো। সব কিছু নরমাল। সে আপুর রুমে উঁকি দিলো। আপু উমর ভাইয়ার সাথে ভিডিও কলে কথা বলছে।

সে সোজা হলো! ব্যাপার কি? সে তাড়াতাড়ি ইউসুফের কাছে গেলো। গিয়ে বললো,— তোমার ভাই আসেনি?

ইউসুফ বিরক্ত নিয়ে বললো,— কোন ভাই?

— ঢং করবে না ইউসুফ, তুমি জানো?

— ঢংয়ের কি আছে? ভাইয়ের কি এখানে আসার কথা?

সাথে সাথেই দিলশাদের ভিতর মুচড়ে উঠলো! সাথে বিরক্তও হলো! ধুর! বলেই সে আবার উলটো দৌড় দিলো।

খাদিজা এদিকে আসছিলো! দিলশাদকে দৌড়ে যেতে দেখে বললো, — আবার কোথায় যাচ্ছিস?

দিলশাদ দৌড়ের উপরেই বলল —- জাহান্নামে।

খাদিজা বিরক্ত হলেন! এই মেয়েকে নিয়ে তিনি আর পারেন না। সে চেঁচিয়েই বললো,—- যা জাহান্নামেই যা! এখানে থেকেও তো কোন লাভ হচ্ছে না। জ্বালিয়ে মারছিস।

ইউসুফও তাঁর দিকে তাঁকিয়ে করুণ সুরে বললো,— শুধু আপনাদের, আমাকেও জ্বালিয়ে মারছে। তাড়াতাড়ি বিদায় করেন ।

খাদিজা হেসে ফেললো! হেসে ইউসুফের চুল এলোমেলো করে দিলো। ইশ! ছেলেটাকে দেখলেই এতো মায়া লাগে।

দিলশাদ রাগে দাঁতে দাঁত চেপে গাড়ির কাচে টোকা দিলো। উসমান সাথে সাথেই দরজা খুলে দিলো। দরজা খুলতেই দিলশাদ শান্ত ভাবে বললো,—- বাইরে আসুন!

উসমানের কোন হেলদোল দেখা গেলো না।

দিলশাদ ঠোঁটে ঠোঁট চেপে রাগ দমালো! আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো, —- দেখুন এসব ভালো লাগছে না । বাইরে আসুন। বাসায় আসবেন? ঢং অনেক হয়েছে।

উসমান বেরুলো না! সে আয়েশ করে গাড়িতেই আরো শরীর এলিয়ে বসে রইলো।

দিলশাদ চিবিয়ে বললো —- কথা কানে যাচ্ছে না নাকি ? বলেই সে আশে পাশে তাকালো। এখানের সবাই তাদের চেনা। সন্ধ্যাও হয়ে গেছে। কেও দেখলে কি ভাববে?

সে গাড়ির ভিতরে গিয়ে বসলো! সে বসতেই উসমান দরজা লক করে ফেললো! লক করে কিছুই হয় নি এমন ভাবে গাড়ি স্টার্ট দিলো।

দিলশাদের রাগ এবার আকাশ ছুঁলো! সে এক প্রকার চেঁচিয়েই বললো,— পাগল হয়েছেন আপনি? কি করছেন? গাড়ি থামান! থামান বলছি।

এবারো উসমানের কোন হেলদোল হলো না। সে নিজের মনেই ড্রাইভ করতে লাগলো।

দিলশাদ রাগে কিছুক্ষণ ফুঁসলো! তাঁর ভুল হয়েছে। বিরাট ভুল! এই শয়তান খাক না খাক, মরুক বাঁচুক তাঁর কি? কোন দুঃখে সে দৌড়ে আসতে গেলো। আল্লাহ! এখন সে কি করবে? এই রাত দুপুরে তাকে কোথায় নেবে কে জানে?

সে হাঁসফাঁস করতে করতে তার টেনশন, রাগ সব মনে মনে দমালো! রাগ জেদে কাজ হবে না। সে নিজেকে মনে মনে শান্ত করলো। করে স্বাভাবিক ভাবে বললো, —- গাড়ি থামান প্লিজ! অনেক হয়েছে। আমাদের ক্লিয়ার ভাবে কথা বলা দরকার।

এবার উসমান সাইড করে গাড়ি থামালো! তারপর স্টিয়ারিংয়ের উপর কনুই রেখে সোজা দিলশাদের দিকে তাকালো।

দিলশাদের অস্বিস্তিতে পড়লো! এভাবে ডাইরেক্ট কারো দিকে তাকায়। সে নিজেকে সামলে বললো — দেখুন! আমি যা করছি বা করেছি। সব কিছু ভুলে যান। আগে কেন করেছি আপনি জানেন। এখন যা সেগুলো দুষ্টুমি। এর বেশি কিছু না। যা হয়েছে অনেক হয়েছে। এখন থেকে আমি আর এমন কিছু করবো না, যাতে আপনার মনে অন্য কিছু আসে। আপনিও যদি এমন কোন পাগলামি না করেন তাহলে আমি খুশি হবো। গাড়ি ঘোরান! বাসায় চলুন প্লিজ! সকাল থেকে নিশ্চয়ই না খেয়ে আছেন। এমন পাগলামি আপনাকে মানায় না।

উসমানও স্বাভাবিক ভাবে বললো — তাহলে কি মানায়?

দিলশাদ অবাক হলো! অবাক হয়ে বললো,— জ্বী?

— ঐ যে বললে না। পাগলামি মানায় না। তাহলে কি মানায়, সেটাই জানতে চাচ্ছি?

দিলশাদ আগুন চোখে তাকালো! এই বদজাত যে তাঁর কথা সিরিয়াসলি তো ভালোই কানেও নেয়নি তা ঠিক বুঝলো।

উসমান ঠোঁট চেপে মুচকি হাসলো! হেসে বললো,— মুখে মধু চোখে বিষ। ঠোঁটে কি? নেশা!

— আপনাকে এতোক্ষণ আমি কি বললাম?

— শুনেছি আমি কি বলেছো! আমি তোমার সব কিছু মনোযোগ দিয়ে শুনি, দেখি। এই যে রাগে তোমার শরীর থরথর করে কাঁপচ্ছে। সেটাও দেখছি। বিরক্ত হয়ে এক দাঁতের পাটি দিয়ে আরেক পাটির দফারফা করছো ।সেটাও দেখছি। তখন শাড়ির আঁচলের আড়ালে আমার ধ্বংসও দেখলাম আর এখন এই যে অদৃশ্য এক জাদুতে কাছে টানছো, সেটাও দেখতে পারছি।

— আপনি ভালো হবেন না! না? এই তো দু-দিন হলো আপু আর ভাইয়ার সব ঠিক হলো। এখন যদি আমি আপনার এসক কির্তি আপুকে বলি। আপনি বুঝতে পারছেন কি হবে?

উসমান মৃদু হাসলো! হেসেই এক টানে দিলশাদকে কাছে টানলো। শুধু টানলো না! কোমর ঝাপটে ধরে প্রায় কোলে তুলে নিলো।

দিলশাদ হতম্বভ হয়ে গেলো! সে এই পহাড় – পর্বতের কোলে! পিঠ লেপটে আছে এর বুকে। আর পুরো শরীর দু- হাতের মধ্যে বন্ধি। তাঁর পুরো শরীর শিরশিরিয়ে উঠলো।

সে কোন রকম দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বলল, — শুধু একবার হাতটা ছাড়াতে পারি। তোর থোতা আমি ছুটিয়ে ফেললো। অসভ্যের অসভ্য! জোর করে চুমু খাওয়া, জোর করে কোলে তোলা। মেয়ে দেখলেই শরীর নিসপিস করে, না? তোর শরীরে যদি আমি আগুন না দিয়েছি আমি দিলশাদ না।

উসমানের মুখে হাসি! সে হাসি নিয়েই দিলশাদের কাঁধে মাথা রাখলো। গালের সাথে গাল মিলিয়ে বললো,—- সেটা তুমি দিতেই পারো! আমার পায়ের আঙ্গুল থেকে চুলের আগা পর্যন্ত সব তোমার নামে করে দিয়েছি। তাই তুমি তোমার জিনিস কে যা খুশি করতেই পারো। আর মেয়ে দেখলে শরীর নিসপিস করে না আমার দিল। তোমাকে দেখলে করে। কি ঝড় যে ওঠে। সেটা যদি তুমি বুঝতে তাহলে আর এতো দূরে দূরে থাকতে না। ঝরনার মতো এই খরখরে পাহার – পর্বতের বুকে আছড়ে পরতে।

— আমি আপুকে সব বলে দেবো।

— আচ্ছা দিও! এমনিতে তো আগে পরে বলতেই হবে।

— আপনি যেটা চাচ্ছে সেটা কখনও হবে না।

— কেন? দিল্লির লাড্ডু চাই?

দিলশাদ রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো! মনে মনে বললো,—- ইউসুফের বাচ্চা তোকে তো আমি ছাড়বো না।
— আফসোস! তোমাকে বাংলার রসগোল্লা দিয়েই কাজ চালাতে হবে। বলেই উসমান মোবাইল বের করলো। ক্যামেরা অন করে বললো,—- বলতো জান চিজ… বলেই পটাপট কয়েকটা ছবি তুললো।

দিলশাদ তাচ্ছিল্যের হাসি হাসলো! হেসে বললো,— ছবি দিয়ে কি করবেন? ব্লাকমেইল।

— আরে না! ব্লাকমেইল করবো কেন? তুমি কি ব্লাকমেইল করে পাওয়ার জিনিস। তুমি তো আমার মনের রাণী। রাণী কে আনতে হয় দশ গ্রাম জানিয়ে, ঢোল ঢক্কোর পিটিয়ে, সোনার পালকিতে চড়িয়ে। এটা তো শুধু সেফটি হিসেবে রাখলাম। দিন দিন যে আগুন সুন্দরী হচ্ছো। তাঁর মধ্যে আবার ভার্সিটিতে যাচ্ছো। কতো জনকে আর এক ভিডিও পাঠাবো।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! কোন দুঃখে সে এই পাগলের সাথে লাগতে গেছে। সে ক্লান্ত ভাবে বললো,— ছাড়বেন?

এবার উসমান ঢং করে বললো —- কেন? এভাবে কষ্ট হচ্ছে তোমার? আমারতো খুব ভালো লাগছে।তোমার জন্য সেই সকাল থেকে বসে বসে এতো কষ্ট করলাম। আর আমার জন্য এতোটুকু কষ্ট করতে পারবে না?

দিলশাদ উত্তর দিলো না! সে মুখ ঘুরিয়ে নিলো। হঠাৎ টানে তাঁর শাড়ির বেহাল অবস্থা। কোমরের কাছ থেকে সব খুলে গেছে। ভাগ্যিস গাড়ির লাইট অফ করা।

উসমান আরেকটু শক্ত করে বুকে চেপে ধরলো!

দিলশাদ কিছুই বললো না। সে শক্ত হয়ে চুপচাপ বসে রইলো।

উসমান কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো,—- আজকের পরে যেন আর শাড়ি পরতে না দেখি। কালো তো অবশ্যই না। কালো রং তোমার জন্য নিষিদ্ধ ঘোষনা হলো। আর তোমার তরফ থেকে দুষ্টুমি, দুশমনি হলেও। আমার তরফ থেকে শুধু ভালোবাসা।

প্রথম দিন তুমি আমার শার্টের এক একটা বোতাম খুলোনি। খুলেছো হ্নদয়ের এক একটা দরজা। সেটাই তোমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল। তুমি কি ভেবেছো? তোমার ওই ঢং দেখে আমি প্রেমে পড়েছি। উসমান এতো সস্তা?

আমিতো প্রেমে পড়েছি, সেই প্রথম দিন! শান্ত, স্নিগ্ধ, কোমল একটা মুখ দেখে। ওই মুখে কোন মিথ্যা ঢং ছিলো না। আমিতো প্রেমে পড়েছি সেই রাতে, যখন মনে এক রাশ ঘৃণা নিয়েও গভীর মমতা নিয়ে আমার ভাইয়ের কপালে হাত রেখেছো। কোনটা অভিনয়, কোনটা সত্য তোমার কি ধারণা সেইটুকু বোঝায় বয়স আমার হয়নি মিস দিলশাদ।

দিলশাদ ফিরে তাকালো! তার চোখে মুখে বিস্ময়।

উসমান সেই বিস্ময়ভরা চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, — তাই যা কিছু তোমার ভালো মনে হয় করো। আমি আগেই বলেছি। তোমাকে আমি কোন কিছুতেই আটকাবো না। তবে এই ভালোবাসা থেকে মুক্তিও দেবোনা।

বলেই উসমান হাত ঢিলে করলো । ঝট করে দিলশাদকে সিটে বসিয়ে দিলো। বসিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই আবার গাড়ি স্টার্ট দিলো।

দিলশাদ হাঁফ ছাড়লো! এতোক্ষণ সে নিশ্বাস নিতেও পারেনি, খিঁচে ছিলো। সে ক্লান্ত ভাবে সিটে গা এলিয়ে দিলো।

উসমানের মুখে মুচকি হাসি! সে সেই হাসি নিয়েই বললো,—– পানি খাবে?

দিলশাদ কন্ঠে জেদ নিয়েই বললো, — না! আমি বাসায় যাবো।

— অবশ্যই যাবে।

— তো গাড়ি সামনে নিচ্ছেন কেন?

— খিদে পেয়েছে আমার। ভালো একটা রেস্টুরেন্টের নাম বলো তো আমার দিল।

দিলশাদ কিছু বললো না। সে চোখ বন্ধ করলো। তাঁর ভেতর এখনও কাঁপছে।

চলবে…..

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৪

দীপা হাসলো! উমর মুখ ভোঁতা করে সবার সাথে ড্রইং রুমে বসে আছে। আর কিছুক্ষণ পর পর করুণমুখে দীপার দিকে তাকাচ্ছে। তাকাবেই না কেন? সে এসেছে পর থেকে এই মুরব্বিদের মধ্যেই ভাজাভাজা হচ্ছে। দীপার সাথে কথা বলার সুযোগ পায়নি।

তাদের ছোট্ট ফ্ল্যাট! তাদের বাড়ির সবাই, আমাদের বাড়ির সবাই। তাঁর মধ্যে আম্মু আবার এক হাতে কাজ সামলাতে পারবেনা বলে খালামণিদেরও খবর দিয়ে এনেছে। পুরো ফ্ল্যাট মানুষে গমগম। শুধু উসমান আসেনি। তার নাকি কাজ আছে।

দীপা রুমে আসলো! কিছু কিছু জিনিস এখনও গোছানো হয়নি। আজকে সে চলে যাবে! নিজের সংসারে যাবে ভালো লাগছে। আবার বাবার বাড়ি থেকে চলে যাবে খারাপও লাগছে । আজব এক জীবন মেয়েদের। কোন দিকের টানই ছিন্ন করতে পারে না।

দীপা গোছাতে গোছাতে দিলশাদের দিকে তাকালো। সেও মুখ ভোঁতা করে মোবাইল টিপছে। ব্যাপার কি?
শুধু এখন না। সে খেয়াল করেছে, দুদিন আগে ঘুরতে গেলো সেইদিন থেকে। গেলো হাসিখুশি, ফিরলো মুখ কালো করে। আম্মু তো সেই বকাবকি! বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো। সে প্রথমে ভেবেছে ক্লান্ত তাঁর মধ্যে আম্মুর বকাবকি। সেই জন্যই হয়তো মন খারাপ। কিন্তু এখন তাঁর অন্য কিছু মনে হচ্ছে।

সে দিলশাদের পাশে গিয়ে বসলো! মাথায় হাত বুলিয়ে কোমল সুরে বললো,—- কি হয়েছে তোর?

দিলশাদ উঠে বসলো! বসে মলিন ভাবে হেসে বললো, — কি হবে?

— সেটাই তো জানতে চাচ্ছি? আমার ফড়ফড়ে প্রজাপতি এমন নিশ্চুপ কেন?

দিলশাদ দীপার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো! তার ভালো লাগছে না। ওই পাহাড় – পর্বতের সব কির্তি তার বলতে ইচ্ছা করলো। তবে বললো না! এই সুযোগটাই তো শয়তানটা নিচ্ছে। কারণ সে ভালো করেই জানে, আপুর সুখ শান্তি নষ্ট হবে এমন কিছু আমি কখনও বলবো না। বললেই উমর ভাইয়ার সাথে আবার ঝামেলা সৃষ্টি হবে। সে মনে মনে দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

দীপা দিলশাদের মাথায় হাত বুলিয়ে বললো—- কি হলো? কথা বলছিস না কেন?

— তুমি, আমার বাবারা চলে যাচ্ছো! তো কি করবো, নাচবো?

দীপা হাসলো! হেসে বললো,— তাহলে তুইও চল!

— দু-দিন পরে আমার রেজাল্ট আউট হবে। তারপরে কতো কাজ জানো?

— যখন হবে তখন চলে আসবি! দূরুত্ব তো বেশি না।

দিলশাদ মুখ বাঁকিয়ে বললো, —- হয়েছে আর বলতে হবে না ! তোমাদের বাড়ি গিয়ে শখ মিটে গেছে আমার । একবার যেতে না যেতেই ধরে বেঁধে বিয়ে হয়ে যাচ্ছিলো। বড় বাঁচা বেঁচেছি। দ্বিতীয় বার গেলে আর রক্ষে নেই।

— আমি আছি না! আমি থাকতে কারো ক্ষমতা আছে আমার বোনকে জোর করে বিয়ে দেবে।

দিলশাদ করুণ মুখে বোনের দিকে তাঁকালো! মনে মনে বললো,—- তুমি জানো না আপু! জোর করে কতো কিছু হচ্ছে। এখন তো আমার ভয়ই করে। কোন দিন না আবার এক্স ওয়াই জেড সব হয়ে যায়। এই গন্ডারকে আর বিশ্বাস নেই ।
আল্লাহ! এর পিছু ছড়াবো কিভাবে? একবার মুক্তি দিয়ে দাও। জীবনে আর মানবদরদী হতে যাবো না। সামনে জ্বরতো ভালোই ক্যান্সার হয়ে ছটফট করে মরলেও কাওকে আর ধরতে যাবো না।

তখনি দিলশাদের মোবাইলে মেসেজ আসলো। সে ওপেন করে দীপার মুখের সামনে নিয়ে বললো,—- তোমার এই পাগল জামাই নিয়ে কি করি বলতো? কিছুক্ষণ পর পর মেসেজ দিচ্ছে। বউ নিতে এসেছে। কিছুক্ষণ পরে নিয়ে চলেও যাবে। তবুও একটু ধৈর্য্য নেই।

দীপা মেসেজের দিকে তাকালো! তাঁকিয়ে হেসে ফেললো! সেখানে লেখা, —- এমন শালী থেকে লাভ কি? দুলাভাইকে শুকনো মুখে বসে থাকতে হয়।

দীপা হেসেই বললো, — যা দুলাভাইয়ের গলা ভিজিয়ে আয়।

দিলশাদ উঠতে উঠতে বললো,—- তাঁর গলা কি আর আমাতে ভিজবে? তাঁর তো বউ চাই, বউ বলেই বেড়িয়ে গেলো।

দিলশাদ যেতেই দীপা বাথরুমে ঢুকে দরজা লাগিয়ে দাঁড়ালো। এখন উমর আসবে সে ঠিক জানে।

হলোও তাই! উমর কিছুক্ষণের মধ্যেই দরজায় টোকা দিলো।দিয়ে বললো,— তুমি যদি ইচ্ছা করে বাথরুমের ঢুকে থাকো। তাহলে আজকে তোমার খবর আছে।

দীপা মুখ চেপে হাসলো! হেসে রেগে যাওয়ার ভান করে বললো,— বাথরুমের কোন মানুষ জোর করে আসে। নিজের প্রয়োজনে নিজের ইচ্ছায়ই তো আসে। নাকি তোমাকে বাথরুমের কেও জোর করে পাঠায়?

— তুমি আর সময় পেলে না।

— আশ্চর্য! বাথরুমে আসার জন্যও দিন, সময় দেখতে হবে নাকি। তুমি তাই দেখেই যাও ?

— আমার সাথে কথার গুলগুটি খেলবে না দীপা, বলে দিলাম।

— আজব মানুষতো তুমি! এখানে গুলগুটি খেলার কি হলো? একটা মানুষ প্রয়োজনে বাথরুমে এসেছে। তাও জ্বালিয়ে মারছো।

উমর বিস্ময়ভড়া কন্ঠে বললো, — আমি জ্বালাচ্ছি!

দীপা হাসি চেপে বললো —– হ্যাঁ ! অবশ্যই।

— তোমার অবশ্যইর খেতা, কম্বল পুড়ি। জ্বালিয়ে মারছো তো তুমি আমাকে। পাপ লাগবে পাপ দীপা! স্বামী হক দিচ্ছো না।

— এই তুমি যাওতো! বাথরুমে এসেও শান্তি নেই।

— কিসের শান্তি? তোমাকে আমি চিনিনা বুঝি! ভালোয় ভালোয় বাইরে আসো দীপা।

দীপা পেট ফেঁটে হাসি চলে এলে। সে হাসি দমিয়ে বললে —- যাও তো! আমার সময় লাগবে।

— প্লিজ! এই একমিনিট! শুধু একটু জড়িয়ে ধরবো। বুকটা জ্বলছে দীপা।

— তুমি যাবে?

— দীপা…উমর করুণসুরে বললো।

— উমর…. দীপা বললো তেজ নিয়ে।

উমরের আর শব্দ পাওয়া গেলো না! দীপা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হাসলো! কি এক পাগল তার কপালে এসে পড়েছে। সে হেসে দরজা খুলে একটু মাথা বের করতেই উমর তাকে ঢেলে ভিতরে ঢুকে গেলো।

দীপা হা হয়ে গেলো! বাড়ি ভর্তি মানুষ! কেও যদি বুঝতে পারে। ছিঃ লজ্জায় আর কাওকে মুখ দেখাতে পারবে না।
_____

দিলশাদ রুবিনার পাশে বসলো। সেই দিনের ঝগড়ার পরে সে আর দিলশাদের সাথে কথা বলে নি। তাঁর কোলে আহাদ! আহান রয়েছে সাবিহার কোলো। হামিদা বানু, আলি হোসেন, রাজ্জাক সাহেব গল্পে মুশগুল। তাদের এদিকে খেয়াল নেই।

দিলশাদ গলা হালকা খাঁকারি দিলো! দিয়ে বললো,— আপনি ভালো আছেনতো ফুপু?

রুবিনা দিলশাদের দিকে তাকালো না। দায়সারা ভাবে বললো, — ভালো।

— কোন সমস্যা হচ্ছে নাতো?

— না।

— যাক! না হলেই ভালো। আমরা গরীর মানুষ। আপনাদের মতো তো আর বিশাল বাড়িতে থাকি না। তাই জানতে চাওয়া। বলেই দিলশাদ কোমর ধরে গেছে এমন ভাবে নড়েচড়ে বসলো।

রুবিনা ফট করে তাকালো! সাথে সাথেই তাঁর ভ্রু কুঁচকে গেলো। মেয়েটা এভাবে বসে আছে কেন? পেট টা কি একটু উঁচু উঁচু লাগছে। আল্লাহগো! তার মাথা ঘুরে চক্কর দিয়ে উঠলো। ছাদের ঘটনা জানি কতো তারিখে হলো। সে হিসেব মেলাতে পারলো না। সে বিস্ফারিত চোখে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো।

দিলশাদ মনে মনে হাসলো! হেসে করুণ মুখে বললো, — কি আর বলবো ফুপু! আজকাল শরীলটা ভালো যাচ্ছে না। কিছুই খেতে টেতে পারি না। মাথা ঘুরে। এই অবস্থায় কিভাবে যে পরীক্ষা দিলাম একমাএ আল্লাহই জানে? যাগ এসব কথা থাক! আপনাদের খবর বলেন? উসমান ভাইয়ার কি খবর? আজকে আসলোনা কেন? আহারে বিয়েটা ভেঙে গেলো। বিয়ে নিয়ে ছেলেদের কতো স্বপ্ন থাকে।

রুবিনা উত্তর দিতে পারলো না! তাঁর অস্তির লাগছে। এই মেয়েকে উসমানের ঘাড়ে সে কখনও চাপতে দিবে না। কোন দিনও না। অস্ত এক ফাজিল! দু- দিনেই সংসারে আগুন লাগিয়ে দিয়েছিলো। তখন বিয়ের জন্য রাজি হয়নি। এখন আবার যেচে খবর নিচ্ছে। কার বাচ্চা কে জানে? এখন নিশ্চয়ই উসমানের ঘাড়ে ফেলতে চাইছে। এ সে হতে দেবে না। কোন দিনও না। উসমান কে সে বিয়ে করাবে। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। না আর দেরি করবে না। আজকেই বাসায় গিয়ে মাকে বলবে।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, —- কোন সমস্যা হলে বলবেন ফুপু, হ্যাঁ! আগের কোন কিছু মনে রাখবেন না। আমি নাদান মানুষ। নাদান মানুষদের দোষ ত্রুটি মনে রাখতে নেই। আমিতো তো আপনাদের মেয়ের মতোই।

বলেই এপাশে ঘুরলো! ঘুরতেই মুচকি হাসলো। হেসে ধীরে ধীরে চলে এলো । নে বেটা পাহাড়- পর্বত তোর বিয়ের রাস্তাও ক্লিয়ার করে দিলাম।

সে নাচতে নাচতেই আব্বুদের রুমে আসতেই ইউসুফের সাথে দেখা হলো। সে মুখ ভার করে বসে আছে।
দিলশাদ দেখেও না দেখার ভান করে সোফায় বসলো। বসে মোবাইলে মনোযোগ দিলো।

ইউসুফ মুখ ভার করে দিলশাদের দিকে তাঁকিয়ে রইলো। সে দিন রাতে বাসায় আসার পর থেকে দিলশাদ আপু তাঁর সাথে আর কথা বলে নি। এই যে আজকে চলে যাচ্ছে। তাঁর খারাপ লাগছে। তবুও একবার ফিরেও তাকাচ্ছে না। সে মুখ ভার করেই বললো,—- স্যরি!

দিলশাদের মধ্যে কোন হেলদোল হলো না।

ইউসুফ উঠে তাঁর পাশে বসলো! বসে বললো,— স্যরি বললাম তো? আর কখনও ভাইয়ের সাইডে থাকবো না। সব খবরা খবর বন্ধ, প্রমিজ।

দিলশাদ ইউসুফের দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো,— আচ্ছা?

ইউসুফ মাথা নাড়ালো!

দিলশাদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো — মাথা নাড়ানোতে তো কাজ হবে না। প্রমাণ দিতে হবে।

— কিসের প্রমাণ?

দিলশাদ হাসলো! হেসে বললো,— তোমার ভাইয়ের কাছে আমার একটা ভিডিও, কিছু ছবি আছে। সব ডিলিট করতে হবে।

ইউসুফ অবাক হয়ে বললো, — কিসের ভিডিও? কিসের ছবি?

— থাপড়ে দাঁত ফেলে দেবো ভাইয়ের চামচা! আমার সামনে নাটব করবি তো।

ইউসুফ মুখ ভোঁতা করে বললো,—- মেজো ভাইকে তো চেনো না। আমাকে শেষ করে ফেলবে।

— সেটা তুমি জানো! এখন কি করবে! সন্ধি না আঁড়ি।

ইউসুফ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো,— আচ্ছা একটা কথা বলতো, মেজো ভাইকে তোমার এতো অপছন্দ কেন?

দিলশাদ স্বাভাবিক ভাবেই বললো, — অপছন্দ হবে কেন?

ইউসুফ অবাক হয়ে বললো, — অপছন্দ না?

— না।

— তাহলে বিয়ে করতে সমস্যা কোথায়?

— আজব তো! পছন্দ হলেই বিয়ে করবে হবে?

— তা নয়তো কি? মানুষ তো পছন্দ হলেই বিয়ে করে।

— আচ্ছা! আমিতো তাহসান, অল্লু অর্জন,জাস্টিন বিবার, ভিকি কৌশল কেও পছন্দ করি। তো এদের সবাইকেই বিয়ে করবো?

ইউসুফ হা হয়ে গেলো! বলে কি এই মেয়ে। সে কোন রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো,
— এদের সাথে তুমি ভাইকে মেলাচ্ছো কেন? ভাই তোমাকে ভালোবাসে। এরা কি তোমাকে ভালোবাসে?

— সেটা আমি কিভাবে বলবো! যাও তাদের গিয়ে জিজ্ঞেস করো। বাসলে বাসতেও পারে। দিলশাদ বলে কথা। দিলশাদ কে, কেও না ভালোবেসে থাকতে পারে?

ইউসুফ বোকার মতো বসে রইলো । দিলশাদ সে দিকে তাকালো না। সে বেড়িয়ে গেলো! তাঁর মন ভালো নেই। বাকি সবাই শান্তিতে থাকবে কেন? শান্তির কথা মনে হতেই তাঁর অতি প্রিয় দুল্লাভাইয়ের কথা মনে পড়লো। আরে সে কোথায়? দু- মিনিটের কথা বলে ঘন্টা পেড়িয়ে গেলো।

চলবে…….

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ২৫

দিলশাদ রুমে এসে দেখলো তাঁর বড় খালামণি হাত, পা ছড়িয়ে খাটে শুয়ে আছে। সে ভ্রু কুঁচকে আশে পাশে তাকালো।একবার বারান্দায় ও উঁকি দিলো। ব্যাপার কি? তাঁর আপু কোথায়? আপু তো যেমন তেমন তাঁর পেয়ারের দুল্লাভাই কোথায়? এই রুমেই না আসলো।

তাকে উঁকি ঝুঁকি মারতে দেখে সাহেদা বললো, —- কিরে কি খুঁজিস?

— আপু কে দেখেছো?

— নারে! এসেছি পর থেকে তোর মা কিচেন থেকে বেরুতে দিলে তো দেখবো? মেয়েটা চলে যাবে। তাইতো আসলাম একটু কথা বলতে। এসে দেখি রুম ফাঁকা। তো কি করবো। ভাবলাম একটু হাত পা সোজা করে নিই।

দিলশাদ চিন্তিত হলো! দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নখ খুঁটতে লাগলো। মনে মনে বললো,— গেলোটা কোথায়?

তখনি তাঁর মোবাইলে মেসেজ আসলো। উমর ভাইয়ার। সে দেখতেই তাঁর চোখ চড়কগাছ। সেই চড়কগাছ চোখ নিয়েই বাথরুমের দিকে তাকালো। তাকিয়েই হেসে ফেললো।

দীপা মেসেজ সেন্ড করে কঠিন চোখে উমরের দিকে তাকালো।
উমরের অবশ্য কোন হেলদোল হলো না! তার মুখে হাসি। হাসি নিয়েই ফিসফিস করে বললো,— হাম তুম এক কামড়ে মে বান্ধ হো।

দীপা রাগে উমরের বাহুতে কয়েকটা কিল ঘুষি মারলো! মেরে রাগ নিয়ে ফিসফিস করে বললো,—- এই অবস্থায়ও তোমার ফাজলামি বন্ধ হয় না?

— তুমি পাশে থাকলে আমি সব অবস্থায় সব করতে পারি। বলেই চোখ মারলো।

— খবরদার যদি আমার সাথে ডাবল মিনিংয়ের কথা বলেছো।

উমর অবাক হওয়ার ভান করে বললো,— আশ্চর্য! তোমার সাথে আমি ডাবল মিনিংয়ের কথা কেন বলবো। তোমার সাথে কি আমার ডাবল মিনিংয়ের সম্পর্ক? তোমার সাথে তো ডাইরেক্ট সম্পর্ক। ডানেও নেই বামেও নেই। তাই যা বলবো, যা করবো একদম ডাইরেক্ট।

— একবার শুধু বেরুই তোমার সব ডাইরেক্ট আমি বের করবো ?

— আমিতো চাই’ই তুমি সব বের করো । করো কোথায়? সেই তো সব আমারি করতে হয়।

দীপা চোখে মুখে বিরক্ত নিয়ে তাকিয়ে রইলো। তবে আর কিছু বললো না। এর সাথে কথা বলাই বৃথা। এখন কি করবে সে ? টেনশনে তার হাত পা ঘামতে লাগলো।

উমর হাসলো! দীপা আজ লাল রঙের সুতির শাড়ি পরেছে। প্রেগনেন্সি, সিজার এসবের ধকল অনেটাই কেটে গেছে। তাকে দেখতে একদম নতুন বউদের মতো লাগছে। সে শাড়ির আঁচল হাতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে দীপাকে টেনে বুকে আনলো।

দীপা আবার রাগ নিয়ে তাকালো! তাঁকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বললো,—- এখনো পাগলামীর ভুত নামেনি?

— পাগলামী করতে পারলাম কোথায়? তখনি তো তোমার খালামণি হাজির। আর তোমার ছটফটানি শুরু।
— ছটফটাবো না? কোন দুঃখে তুমি বাথরুমে আসতে গেলে।
— আমার বউ যেখানে আমিও সেখানে।

— হ্যাঁ ! এখন থাকো বাথরুমে বসে ! বউ যেখানে সেও সেখানে।

বলেই দীপা মুখ ভার করলো! ভালো লাগছে না তার।

উমর মৃদু হাসলো। হেসে দীপার কপালে চুমু খেলো। তারপর বুকে জড়িয়ে কোমল সুরে বললো,— এতো টেনশন করছো কেন? আমরা কি প্রেমিক – প্রেমিকা। লিখিত দলিল করা স্বামী স্ত্রী । যেখানে খুশি সেখানে থাকবো। আর তাছাড়া বাইরে তোমার অতি বুদ্ধিমতি বোন আছে। সে সব সামলে নিবে।

দিলশাদ সাহেদার পাশে বসলো। বসে বললো,— সব মুরুব্বিরা ওখানে! তুমি এখানে হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছো। কেমন দেখায়?

সাহেদা দিলশাদের দিকে কাত হলো। হাতের মধ্যে মাথা রেখে বললো,— কেমন দেখায় মানে আবার কি? এতোক্ষণ ছিলাম না। আর ভালো কথা, দীপার ফুপু শাশুড়ি এমন তুম্বি কেন? কেমন গাল মুখ ফুলিয়ে বসে আছে। মনে হচ্ছে গরম তাওয়ার উপরে কেও জোর করে বসিয়ে রেখেছে।

দিলশাদ মুখ টিপে হাসলো! গরম তাওয়ার উপরে সে নিজেই বেচারীকে বসিয়ে এসেছে।

— তবে সৎ হলেও শাশুড়িটা ভালো বুঝলি। কি অমায়িক ব্যবহার। আর দাদী শাশুড়ি! বাবাগো মুখ তো না মেট্রো ট্রেন। বুলেটের গতিতে ছুটছে। তবে জামাই পেয়েছে মাশাআল্লাহ। উঁচা, লম্বা, দেখতেও তো সুন্দর। আরে হ্যাঁ! ভালো কথা, দীপার দেবরের জন্য নাকি তোর হাত চেয়েছিলো?

দিলশাদ মুখ টিপে উপর নিচে মাথা দোলালো।

— খবরদার দিলশাদ! তুই শুধু আমার বাড়ির বউ হবি। তোম খবিশ বাপে যদি টাকা পয়সা দেখে রাজিও হয়ে যায়, তুই হবিনা। মানছি রায়হান আর তুই সমবয়সী। এখনও সে কিছু করে না। তবে ভবিষ্যতে তো করবে! করবে না? আর আমাদেরও কম আছে নাকি। একমাএ ছেলে আমার। যা আছে সব তাঁর।

দিলশাদ গাল ফুলানোর ঢং করে ওড়না হাতে পেঁচাতে পেঁচাতে বললো,—- তুমি বললেই হবে? ঐ দিকে তোমার ছেলেতো আমার খবরও নেয় না। ফোন দিলেও উরাধুরা ঝারি। আমাকে তো ডাইরেক্ট বলে দিয়েছে। তোর সাথে কোন সম্পর্ক নেই। আউট!

সাহেদা ফট করে উঠে বসলো! বসে বললো, —- বলিস কি? হারামজাদা ছোট বেলা থেকে চম্বুকের মতো লেগে থেকে বড় বেলা এসে বলে আউট।

— হুম!

— কিন্তু কেন? ওতো তোকে খুব পছন্দ করতো।

— ছোট বেলার পছন্দ কি আর আসল পছন্দ। এখন অন্য কাওকে মনে ধরেছে। ঐ যে কিছুদিন আগে ছেচা খেলো। সেটা তো অন্য মেয়ের পেছনে ঘোরার জন্যই তো।

সাহেদা অবাক হয়ে বললো, —- বলিস কি?

আমাকে যে বললো, অন্য ছেলেদের সাথে নাকি কি নিয়ে গেঞ্জাম হয়েছে।

— ছাই হয়েছে! তোমাকে সত্য বলবে?

তখনি তিহা আসলো! এসে তড়িঘড়ি করে বললো, — আম্মু বাথরুমের যাবো!

সাহেদা বিরক্ত হয়ে বললো,—- বাথরুমের যাবি আমাকে বলসিছ কেন! এই বাসায় কি বাথরুমের অভাব? যা ঐটায় যা।

দিলশাদ লাফিয়ে উঠলো! উঠে বললো,—- এটায় যাওয়া যাবে না।

সাহেদা ভ্রু কুঁচকে বললো —– কেন?

দিলশাদ কিছুক্ষণ হা করে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইলো! কেন? তাই তো! তারপর কোন রকম বললো,— নষ্ট! বাথরুম নষ্ট।

— বাথরুম আবার নষ্ট হয় কিভাবে?

— আরে না না বাথরুম নষ্ট না। কল নষ্ট! পানি আসছে না।

— তোর বাপের আক্কেল দেখ! মেয়ে এসেছে, মেয়ের জামাই আসছে আর যাচ্ছে। আর এই রুমেরই নাকি কল নষ্ট। তোর কিপটে বাপ আর জীবনে ভালো হবে না। শুধু আমার বোন বলে সংসার করে গেলো। আয়! ঐ রুমে নিয়ে যাই। বলেই তিহার হাত ধরে চলে যেতে নিলো।

দিলশাদ হাঁফ ছাড়লো! ছাড়তেই সাহেদা দরজার সামনে থেকে আবার ফিরে এলো।

দিলশাদ মুখ ভোঁতা করে বললো, — আবার কি হলো?

— শোন! ভুলেও বিয়ের জন্য রাজি হবি না। আর আমি ঐ হারামজাদাকে দেখছি। এতো বড় সাহস! আমার ভাগ্নিকে বলে আউট। আউট তো আমি ওকে করবো।

— আচ্ছা… আচ্ছা… করো! বলতে বলতে দিলশাদ হাত ধরে বাইরে নিয়ে বললো, এখন যাওতো! তাড়াতাড়ি ওকে বাথরুমের নিয়ে যাও।

সাহেদা চলে গেলে! সাহেদা যেতেই দিলশাদ হাসলো! হেসে বাথরুমের দরজা বাইরে থেকে লক করে দু- বার টোকা দিলো।

উমরও হাসলো! হেসে ভেতর থেকে বললো,— কি চাই শালী সাহেবার?

— এতো বড় উপকার করলাম! কিছুতো চাই ই।

— সেই দিনতো পুরো মানিব্যাগই দিয়ে দিলাম। কই কিছুইতো নাওনি। তো আর কি চাই আমার শালী সাহেবার।

— প্রমিজ।

— প্রমিজ! কিসের?

— সেটা সময় আসলেই জানবেন।

— আচ্ছা! ঠিক আছে। এই করলাম প্রমিজ… আমার শালী সাহেবা যখন কিছু চাইবে আমি জান প্রাণ দিয়ে তা পূরণ করতে বাধিত থাকিব।

দিলশাদ হাসলো! হেসে দরজা খুলে দিলো। দিয়েই ফুরুৎ করে চলে এলো। কারণ সে জানে ভাইয়ার কিছু না হলেও, তাকে দেখলে আপু লজ্জায় শেষ হয়ে যাবে।

সন্ধ্যার আগে আগে দীপারা চলে গেলো। যাওয়ার সময় দীপা মা, বাবাকে জড়িয়ে কেঁদে ফেললো। কাঁদলো খাদিজা, রাজ্জাক সাহেবেও। নাতিদের কোলে নিয়ে চুমু খেলো। এতোদির এখানে ছিলো। ঘর বাড়ি ভরা ছিলো।

ইউসুফ যাওয়ার আগে খাদিজা, রাজ্জাক সাহেবকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করলো। খাদিজা তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে বললো,— ভালো থেকো বাবা! যখনি মন চায় চলে এসো।

ইউসুফ হাসলো! হেসে মাথা নাড়ালো । তারপর দিলশাদের দিকে এগিয়ে গেলো। গিয়ে বললো,— আসি আপু!

দিলশাদ ইউসুফের এক আঙ্গুল ধরলো! যেভাবে ছোট ভাইয়েরা বড় বোনের আঙ্গুল ধরে হাঁটে, ঠিক সেভাবে। সেভাবে ধরেই বললো,—- আমার আপুর খুব ভাইয়ের শখ ছিলো। আমি হওয়াতে তাই খুব রাগ হয়েছিলো। এখন দেখো তাঁর কাছে দু- দুইটা ভাই। সেই দুটো- ভাইকেই বলছি। আমার আপুর খেয়াল রেখো।

ইউসুফ হাসলো! প্রাণ খোলা হাসি! হেসে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো,— দুই ভাই কোথায় পেলে, বলছো তো একজনকে।

— তোমাকে বলা আর ঐ খাম্বাকে বলা একই কথা। পাই টু পাই সব তো পাচার করবেই।

ইউসুফ মুখ ভার করে বললো,—- তুমি যে ভাইকে কতো হাবিজাবি বললে। অন্য কেও হলে খবর ছিলো।

দিলশাদ মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে বললো, — তোমার ভাই যা যা করেছে না, শুধু আপুর দেবর বলে বেঁচে যাচ্ছে। তা না হলে তারো খবর ছিলো।

ইউসুফ বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — থাক বাদ দাও।

দিলশাদ ইউসুফের দিকে তাকালো! বয়সে ইউসুফ তার ছোট হলেও, হাইটে বড়। মাথা নিচু করে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। তার আঙুল এখনো তার আঙুলের মাঝে। দিলশাদের খারাপ লাগলো! না চাইতেও এরা কেমন তাদের মায়ায় জড়িয়ে নিয়েছে।

সে নরম সুরে বললো — আমার কখনও ভাই টাইয়ে শখ ছিলো না। আমার এক আপুতেই আমি খুশি ছিলাম। তবে এখন মনে হয়, ভাই ওতোটাও খারাপ না।

ইউসুফ মাথা তুলে তাকালো! তার ঠোঁটের কোণে হাসি।

— তাই আপুকে একটা থ্যাঙ্কিউ দিতেই হবে। তার জন্য আমিও….

ইউসুফ আর দিলশাদকে বলতে দিলো না। তাড়াতাড়ি হাত ছাড়িয়ে নিলো! সাথে সাথে বললো,—- এখন আবার তুমি বলো না। ভাবির সুবাদে সেই দু-জন কে তুমিও মনে প্রাণে ভাই করে নিয়েছো।

— কেন? করতে পারি না।

— পারো! তবে শুধু একজন কে।

দিলশাদ হাসলো! হেসে এই পাগল ছেলেটার দিকে তাকালো! তাকিয়ে ঢং করে বললো, —- আরে না! আমার কি আর আপুর মতো দুইটা হবে । আমার তো হবে তিন তিনটা। উমর, উসমান, ইউসুফ।

ইউসুফ মুখ ভোঁতা করলো! করে বললো, — মাঝের টা মাইনাস করো বুঝেছো। আর এতো গন্ডায় গন্ডায় ভাই দিয়ে করবে টা কি? ইউসুফের মতো একটা থাকলেই যথেষ্ট। বলেই সে হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো।
সেই যাওয়ার দিকে দিলশাদ অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো! না তার কথায় বা চলে যাওয়াতে না। তার মনে হলো, ইউসুফের চোখের কোণে পানির ছোঁয়া ছিলো।

চলবে…..