দর্পণ পর্ব-৩২+৩৩+৩৪

0
128

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩২

দিলশাদ দীপার রুমে আসলো! আসতেই তার ভেতর ভারী হয়ে আসলো। সেই ভারী মন নিয়েই সে হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে তার মায়ের সংসারের জিনিসগুলো দেখলো। সে জানে তাদের ফ্ল্যাট ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারপরে আর কাওকে কিছু জিজ্ঞেস করেনি। করতে ইচ্ছেও করেনি । ঘর শুধু চার দেয়াল দিয়ে হয় না, প্রিয় মানুষ দিয়ে হয়। প্রিয় মানুষেরাই নেই, সেই চার দেয়াল দিয়ে দিলশাদ কি করবে।

তাই সে জানতো না আপু কিছু ফার্নিচার নিজের কাছে রেখেছে। তার যদি একটা বাড়ি থাকতো সেও নিশ্চয়ই রাখতো। সে মনে মনে বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মানুষ হারিয়ে যায়, স্মৃতি রয়ে যায় । সেই স্মৃতিগুলোকে আঁকড়ে ধরেই মানুষ বেঁচে থাকে। তাই তার ঘর, বাড়ি না থাকলেও অজস্র স্মৃতি আছে। বাকি জীবন বেঁচে থাকার জন্য তার কাছে এই স্মৃতি গুলোই যথেষ্ট।

দিলশাদ ঘুরে দীপার দিকে তাকালো! সে চুপচাপ জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। এই যে সে এসেছে, সে বুঝেছে। তবে তাকায়নি! তার দৃষ্টি বাইরে।

দিলশাদ এগিয়ে গেলো! সেও জানার পাশে দাঁড়ালো। দীপার একদম সামনে। তারপর বললো,
— কথা বলবে না?

দীপা উত্তর দিলো না। অন্য সময় হলে দিলশাদ ঢং করে বলতো, — না বললে নেই, আমি ওতো কাওকে গনায় ধরি না। তবে আজ বলতে পারলো না। সেই আগের দিলশাকে, দিলশাদ কেন জানি খুঁজেই পায় না। সে আস্তে করে বললো,— চলে যাবো আপু?

দীপা এবার তাকালো! তার চোখ মুখ শান্ত! এতোদিন পরে বোন এসেছে। তার কোন রেশ তার চোখে মুখে দেখা গেলো না। সে শান্ত ভাবেই বললো,— আমাকে জিজ্ঞেস করছিস কেন? আমি নিশ্চয়ই তোর এমন কেও না। আমি থাকতে বললে থাকবি, চলে যেতে বললে চলে যাবি।

— তুমি আমার কি? সেটা তুমি ভালো করেই জানো।

— আচ্ছা! কি আমি ? তুই বল, তোর মুখ থেকেই একবার শুনি?

— এমন করছো কেন?

— তো! কি আশা করিস তুই? তুই নিজের যা মন চায় করবি। করে আমার সামনে আসবি। আমি খুশিতে গদগদ হয়ে কোলে তুলে নেবো।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! বললো,— তুমি যদি আমাকে না বুঝো, তো কে বুঝবে আমাকে ?

দীপা আবার বাইরে তাকালে ! তার চোখে পানি। সে ভেজা কন্ঠে বললো —- তুই আমাকে বুঝেছিস? আমার কথা চিন্তা করেছিস। তোকে একা হোস্টেলে পাঠিয়ে আমি এখানে কিভাবে শান্তিতে থাকবো একবার ভেবেছিস? এই যে এক বছরের উপরে কেমন আছি , একবার খবর নিয়েছিস?

দিলশাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ রইলো! তারপর বললো — পেছনের জিনিস টেনে আর লাভ কি? এই যে দেখো এখনতো সব কিছু ঠিক। এসেছিতো আমি।

দীপা হাসলো! তাছিল্যের হাসি। হেসে বললো —- হ্যাঁ অবশ্যই ঠিক। তবে এই ঠিক আমাদের জন্য হয়নি। নতুন প্রিয় মানুষ, প্রিয় বন্ধু হয়েছে। তাদের জন্য হয়েছে। হয়েছে বলেই আমাদের কাছে আনার জন্য বাহানা তৈরি করে হয়।

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো! এখানে বন্ধু আসলো কোথা থেকে। মানছে সে আসতে চায় না। তবে বন্ধুর কাহিনী কি? সে আবাক মাখা কন্ঠে বললো, —- কিসের বন্ধু?

দীপা স্বাভাবিক ভাবেই ঘুরলো ! সাইডে তার মোবাইল রাখা। সেখান থেকে নিয়ে কিছু বের করে দিলশাদের দিকে বাড়িয়ে দিলো।

দিলশাদ মোবাইল হাতে নিলো না। শুধু তাকিয়ে দেখলো ! তার আর আরমানের ভিডিও। ভার্সিটির সামনে।

ও উসমান তাহলে বোমা এবার এই দিকে মেরেছে। দিলশাদ অবাক হলোনা। তাইতো বলি এতো নিশ্চুপ কেন? পুরো রাস্তা নির্বিকার ভাবে এসেছে। দিলশাদ যে তার পাশে, এমন ভাব সে তাকে চেনেই না।

— কি হলো বল, এসব কি?

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার সাইড থেকে সোফায় গিয়ে বসলো! তার রাগ হওয়ার কথা। অথচো তার একটুও রাগ হলো না। বরং এতোদিন পরে দেখা, উসমান যে পুরো সময় নির্বিকার থেকেছে এটাই তার কেন জানি ভালো লাগে নি। কেন লাগেনি? পুরো রাস্তা সে এটাই ভাবতে ভাবতে এসেছে।

সে বসে শান্ত ভাবে বললো, — কি, তা তো দেখতেই পাচ্ছো।

— হোস্টেলে উঠেছিস এসব করার জন্য?

— কি করলাম আমি?

— না! তুমি তো কখনও কিছু করো না। এই ছেলে তোর পেছনে ঘুরছে, তোকে হুমকি দিচ্ছে। তুই আমাদের বলেছিস? তা বলবি কেন? আমরা তোর কে? আব্বু, আম্মু ছিলো, শেষ। এখন যা মন চায় তাই করবি।

— তুমি যে রকম ভাবছো তেমন কিছু না। আজই প্রথম এসব….

— চুপ! একদম চুপ! তুই আমার সাথে আর কথাই বলিস না। বোনের বাড়ি বেড়াতে এসেছিস, বেড়া, যতোদিন ভালো লাগে থাক। তারপরে যা মন চায় কর গিয়ে। আমি আর কিছুই বলবো না। আমি বলার কে? দীপা আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছলো। এই শেষ! এই ফাজিলটার জন্য সে আর কাঁদবে না। এখনো দেখো কি নির্বিকার, যেন এসব কোন ব্যাপারই না।

দিলশাদ চোখ বন্ধ করে সোফায় মাথা রাখলো! বড় একটা শ্বাস ফেলে শান্ত ভাবে বললো,—- তুমি কি চাও বলোতো? হোস্টেলে থাকা নিয়ে সমস্যা! ঠিক আছে থাকবো না আমি। এখান থেকেই মাঝে মাঝে ক্লাস এটেন্ড করবো। গাড়িতো আছেই। খুব একটাতো দূরেও না।

দীপার গলা এবার একটু চড়লো —- হোস্টেলে, তুই এখনও হোস্টেলে নিয়েই পরে আছিস?

দিলশাদ এবার সত্যিই অবাক হলো! আপা এতো রিয়েক্ট করছে কেন? সে অবাক হয়েই বললো, — তাহলে সমস্যাটা কি?

দীপা রেকডিং চালু করে দিলশাদের হাতে দিলো। আরমানের কন্ঠ। আশ্চর্য! এগুলো আবার বললো কখন? আর এই ফাজিল উসমান। দিন, রাত মোবাইলে রেকোডিং কি চালু করেই রাখে।

— এখন বল তুই এই ছেলেকে পছন্দ করিস?

— কখনও না।

— এই ছেলেতো বলছে তোরা বন্ধু।

— সে বললেই হবে?

— আচ্ছা! ঠিক আছে। অন্য কাওকে পছন্দ করিস?

দিলশাদ কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো! একটা মুখ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। চোখ ভর্তি জ্বলজ্বলে পানি নিয়ে তাকে আঁকড়ে ধরে আছে । কি গভীর বিষাদ সেই চোখে। কাওকে ভালোবাসলেই বুঝি তার দুঃখে এতোটা দুঃখী হওয়া যায়?

— কি হলো, কথা বলছিস না কেন?

দিলশাদ মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো — না নেই।

ভালো! এখন আমার কথা মন দিয়ে শোন। আমি তোর বিয়ে দিতে চাই। আহান, আহাদের আকিকায় খালমণিদের আসতে বলেছি । আসলেই রায়হানের সাথে তোর বিয়ের কথাবার্তা বলবো। বিয়ে হলেই খালামণিদের বাসায় থাকবি। নিয়মিত ক্লাস করার দরকার নেই। সেখান থেকে শুধু পরীক্ষা দিবি।

দিলশাদ হতম্বভ হয়ে কিছুক্ষণ বসে রইলো! তারপর আস্তে করে বললো,— কার সাথে? কি দেবে?

— কার আবার রায়হানের সাথে! ছোট বেলা থেকে চম্বুকের মতো লেগে আছিস। খালামণিরও খুব ইচ্ছে। আর তাছাড়া অচেনা জায়গার তোকে বিয়ে দিয়ে আমি শান্তি পাবো না । খালামণির কাছে তুই ভালো থাকবি।

দিলশাদ কোন রকম ঠোঁট নাড়িয়ে বললো —- বিয়ে কোন সমস্যার সমাধান না আপু।

— তোর কাছে নাও হতে পারে। তবে আমার কাছে সব সমস্যার সমাধান। এবার যাই হোক। আমি তোকে একা ছাড়বো না।

— আমি এখন বিয়ে করতে চাই না।

— কেন? সমস্যা কি?

— সমস্যা না থাকলেই বিয়ে করতে হবে?

— তোর করতে হবে।

— তুমি বলেছিলে তুমি থাকতে কেও আমাকে জোর করবে না। এখন তুমিই করছো।

— সন্তানের ভালোর জন্য বাবা,মাকেও অনেক সময় কঠোর হতে হয়।

— এতে আমার কি ভালো?

— ঠিক আছে তোর ভালো নেই। মনে কর আমার ভালো, আমার শান্তি। আমার শান্তির জন্য তুই এইটুকু করতে পারবি না?

— ব্লাকমেইল করা কেও তোমার কাছে শিখুক।

— তুই শিখ! ভবিষ্যতে তোর কাছে আসবে।

দিলশাদ আর কিছু বললো না। চুপ হয়ে গেলো। তর্ক করতে আর ভালো লাগছে না। ভোঁতা মুখে কিছুক্ষণ দীপার দিকে নিষ্পলোক তাকিয়ে রইলো! জেদের ক্ষেএে তাদের দু- বোনের কোন জুড়ি নেই।

দিলশাদ উঠে দাঁড়ালো! আর কিছু বলার শক্তি বা ইচ্ছা কোনটাই তার হলো না। আগের দিলশাদ থাকলে কি করতো কে জানে। তবে এই দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেড়িয়ে এলো। তার মাথা ঘুরছে। অবশ্য মাথারই আর কি দোষ। প্রথমে আরমান, তারপর উসমান, এখন আবার আপু, আবার নাকি রায়হানের সাথে বিয়ে। এক দিনে এতো ঝটকা কিভাবেই বা সামলাবে। ধুর! এই বাড়িই তার জন্য কুফা। যখনি আসে ধরে বেঁধে কেও না কেও বিয়ের দিকে ঠেলতে থাকে। কোন দুঃখে সে এখানে মরতে এসেছে।

_______

উসমান হেসে ফেললো! অতি দুঃখে মানুষ পাগল হয়, উসমানেরও সেই অবস্থা।সে হেসে বললো, — কি বললে?

উমর আয়েশ করে সোফায় বসলো! বসে বললো, — যা শুনেছিস তাই বলেছি।

— এতো লম্বা, চওড়া একটা দেবর সামনে তবুও ভাবির চোখে পড়লো না ।

— উঁহু! পড়েনি ।

— আমি তো ভেবেছি ভাবি জানে, আমি দিলশাদকে পছন্দ করি । এমনকি দিলশাদের বিয়ের কথা মাথায় আসলে সর্বপ্রথম আমার কথাই আসবে।

— তোর ভাবি জানে।

— তো! আমি থাকতে কোন দুঃখে ভাবি রায়হানের সাথে তার বোনকে ধরে বেঁধে বিয়ে দিতে চাচ্ছে। সব করলাম আমি, রাস্তা ক্লিয়ার করলাম আমি। আর সেই রাস্তা দিয়ে বউ নিয়ে যাবে রায়হান।

— আসলে তোর ভাবি রিক্স নিতে চায়নি। সে জানে সহজে তো আর রাজি করানো যাবে না । তার মধ্যে আবার যদি তোর কথা শুনে, মানে বুঝিসইতো! প্রথম বারও তো রাজি হয়নি। রায়হানতো তাও বন্ধু। তাদের বন্ডিংও ভালো। তাই সেই দিকেই গেছে।

— দিলশাদ রাজি হয়েছে?

— এখনও কিছু বলে নি। তবে হ্যাঁ ই হবে। তুই না বললি, ভাবি যা পারবে সেটা আর কেও পারবে না। সত্যিই তাই রে।

— আমার কথা মনে আছে, নিজের কথা নেই। খুব তো বড় গলায় বললে, — ওর ইচ্ছের বিরুদ্ধে কিছু হতে দেবো না। এখন কি হচ্ছে?

— ইচ্ছের বিরুদ্ধে কোথায়? তোর ভাবি মানানোর চেষ্টা করছে। এইটুক তো বড় বোন হিসেবে করতেই পারে।

— হুহ্! বউর কথা আসতেই সুর পালটে গেছে।

উমর ঠোঁট চেঁপে হাসলো! হেসে বললো—- তাতো একটু যা ই! বউ বলে কথা। তাছাড়া বর্তমানে দীপাই দিলশাদের একমাএ গার্ডিয়ান। সে যা চাইবে, তাই বাকি সবাই মানতে বাদ্ধ।

উসমান আর কিছু বললো না। তার রাগ চড়ে গেলো। রাগে সে টিটেবিলকে লাথি মারতে গেলো। সাথে সাথে মনে পড়লো এটা দিলশাদের বাবার বাড়ির। সে দমে গেলো ।

উমর হো হো করে হেসে উঠলো। বললো,– ভাঙ! উপরে তুলে আছাড় মার। এই সাত সকালে শব্দ শুনে দিলশাদ আসুক আর দেখুক তার বাবার বাড়ির ফার্নিচার রেখে তুই আছড়ে আছড়ে ভাঙছিস।

উসমানের শরীর জ্বলে গেলো। তার বড় শত্রুতো তার ভাই। সে হনহনিয়ে ঘর থেকে বেড়িয়ে গেলো। বেড়িয়ে যাওয়ার সময় সব রাগ দরজায় দেখিয়ে গেলো। এটাতো আর দিলশাদের বাবার বাড়ির না।

দিলশাদের ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই । কাল মাথার বারোটা বেজে গেছে। কোন রকম কয়টা খেয়েই সে ঘুমোতে চলে এসেছিলো। সে এতো তাড়াতাড়ি ঘুমায় না। কিন্তু কালকের ক্লান্তিতে শুতেই চোখ লেগে গেছে।

সে ঘুম ঘুম চোখে চিত হলো! শরীরের ক্লান্তি গেছে। কিন্তু মনের কি? ঘুম অনেক ভোরে ভাঙলেও, আজকে আর উঠেনি। উঠতে ইচ্ছে করেনি। অন্য রকম একটা অস্থির লাগছে। আপুকে কি ভাবে বোঝাবে রায়হানকে সে বিয়ে করতে চায় না।

সাথে সাথেই সে চিন্তায় পড়ে গেল। রায়হানকে কে চায় না তো কাকে চায়? তার সমস্যা টা কোথায়? বিয়ে না রায়হান। সাথে সাথে মনে হলো, আচ্ছা উসমান কি শুনেনি তার বিয়ের কথা?

তখনি ঘর বাড়ি কেঁপে শব্দ হলো! দিলশাদ চমকে উঠলো! তাঁর মনে হলো কেও দরজা ভেঙে ফেলছে। আশ্চর্য! এই বাড়ির মানুষ ভালো হবে কবে? সাত সকালেই ভাঙাভাংগি, চেঁচামেচি সব শুরু করে।

সে উঠতে যাবে। শব্দটা আসলে হলো কোথায়? তার আগেই কেও ঝড়ের বেগে এগিয়ে এসে তাকে চেঁপে ধরলো।

দিলশাদ হতম্বভ হয়ে গেলো ! তার ঘুম টুম, ক্লান্তি মুহুর্তেই সব ছুঁটে গেলো। সে বিস্ফোরিত চোখে হা হয়ে তাকিয়ে রইলো। আর সাথে সাথেই প্রথম যে চিন্তটা মাথায় আসলে। তা হলো! দরজা কালকে সে লক করেনি?

উসমান আরেকটু ঝুকলো! দু- হাত শক্ত করে চেঁপে ধরলো। তার রাগের আগুন নিশ্বাস রুপে দিলশাদের চোখে মুখে পড়তে লাগলো । সে চিবিয়ে বললো,— শুনলাম বিয়ে করছো?

দিলশাদ উত্তর দিতে পারলো না। উত্তর দেওয়ার অবস্থায় কি আর তার আছে। তার ভেতর তো ভালোই পুরো শরীর কাঁপছে। আশ্চর্য! সব সময় এমন ঝড়ের মতো আসতে হবে কেন?

উসমান আরেকটু এগুলো! দিলশাদের ঠোঁটের দিকে তাকালো। গোলাপি রঙা ঠোঁট দু- টো তিরতির করে কাঁপছে । সে নিচু হলো একদম ঠোঁটের কাছাকাছি। তবে ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ালো না। তার শুধু এই ঠোঁট না, অধিকার চাই। তার সামনে এই হ্নদয়হীনার পুরোটা চাই।

সে চোখ বন্ধ করলো। বড় বড় কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করলো। তারপর চোখে চোখ শান্ত ভাবে বললো,— দিলশাদ, আমি জীবনে কোন মেয়েকে ভালোবাসিনি। তুমিই প্রথম আর তুমিই শেষ। এই জীবনে যদি তোমাকে না পাই। আমার জীবন বৃথা। আর কাওকে ভালোবাসতে পারবো না। আর কাওকে কাছে টানতে পারবো না । আর বাঁচতেও পারবো না। শেষ হয়ে যাবো! একদম শেষ! আমি তোমার প্রেমে দেবদাস হয়েই গেছি । তাই জোর করছি না। শুধু রিকোয়েষ্ট করছি। আমার হয়ে যাও দিলশাদ। প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ……

চলবে……..

#দর্পণ
#নূপুর_ ইসলাম
#পর্ব- ৩৩

উসমান ক্লান্ত ভাবে দিলশাদের কপালে কপাল রাখলো। চোখ বন্ধ করলো! আর কিভাবে বললে এই পাথর কন্যার মন গলবে। পায়ে ধরতে হবে। সে তাও রাজি। তবুও তার হোক। সে তো দিলশাদকে জোর করতে পারবে না। কি কষ্টের মধ্যে দিয়ে মেয়েটা গেছে। সেই কথা মনে হলেই, তার ভেতর কেঁপে উঠে।

এই এক বছর সে ইচ্ছে করেই দিলশাদের সামনে যায়নি। তার জন্য আলাদা কোন কষ্ট বা দুশ্চিন্তা হোক সে চায়নি । সে চেয়েছে দিলশাদ ভালো থাকুক, গুছিয়ে উঠুক, সামলে উঠুক, কিন্তু ছেড়ে দিতে তো সে পারবে না। সে মহৎ ও না, মহাপুরুষ না। সে শেষ হয়ে যাবে, সত্যিই শেষ হয়ে যাবে।

কপালে স্পর্শ পেতেই দিলশাদের সম্বিৎ ফিরলো। হঠাৎ তান্ডবে তার ঘোর লেগে গিয়েছিলো। ঘোর কাটতেই সে ভালো করে উসমানের মুখের দিকে তাকালো। তাঁর চোখ বন্ধ, তবে এখনও খুব কাছে। দু- হাত শক্ত করে চেপে আছে। দিলশাদ হালকা হাসলো! লজ্জা মাখা হাসি। এই হাসিতে কোন ঢং নেই, অভিনয় নেই। এই হাসি দিলশাদের হ্নদয় ছোঁয়ার হাসি। এই হাসি যদি উসমান দেখতো ঠিক অজ্ঞান হয়ে যেত।

আপু পালিয়ে যাওয়ার পর বাবা, মার কষ্ট দেখে সে ঠিক করেছিলো। সে কাওকে কখনও ভালোবাসবে না। কাওকে মন দিবে না। কি মূল্য এই ভালোবাসার। যারা তাদের এই সুন্দর পৃথিবীতে এনেছে, আদর, স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে এতোটা বছর আগলে রেখেছে। তাদের ভুলে যেতে হয়। তাদের কাছে মিথ্যে বলতে হয়। তাইতো সবসময় সে ভালোবাসার শব্দটা থেকে দূরে থেকেছে। আর আজ দেখো, সেই ভালোবাসাই তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে আছে।

দিলশাদ আবারো হাসলো! অবশ্য হাসির মতো কিছু নেই। শরীরের সব শক্তি হাতের উপর ছেড়ে এই লোক বসে আছে। হাত ব্যথায় টনটন করছে। সব সময় এতো জোরাজুরি, চাপাচাপি কেন? ভালো ভাবে কি কথা বলা যায় না। আবার চোখ বন্ধ করে বসে আসে।

আরে গাধা, হাজার হলেও তো আমি মেয়ে। মানছি একটু লাজ, লজ্জা কম। তাই বলে কি একেবারেই নেই নাকি। নাকি এই তালগাছ ভেবেছে। এসে চেপে ধরে রিকোয়েস্ট করে বললেই আমি হাসতে হাসতে বলবো আই ডু জান।

গাধার গাধা! চোখ খুল, খুললেই সব বুঝে যাবি। তা না হলে এতোক্ষণ চেপে ধরে বসে আছিস। ছাল, চামড়া তোর থাকতো?

দিলশাদ আস্তে করে বড় একটা শ্বাস ফেললো। এই গাধার খবর নেই। তবে উসমানের চোখের কোণে পানি দিলশাদ ঠিক খেয়াল করলো। সাথে সাথেই তার ভেতরটা কেন জানি মুচড়ে উঠলো।

এই লোকটা এক সাগর ভালোবাসা নিয়ে তার উত্তরের অপেক্ষায় বসে আছে। সে ফেরাবে কি করে?

দিলশাদ আর এক সেকেন্ডও দেরি করলো না। মাথাটা হালকা উঁচু করলো! উঁচু করতেই উসমানের ঠোঁটের সাথে তার ঠোঁটের হালকা একটু স্পর্শ লাগলো। লাগতেই চোখ বন্ধ করে দিলশাদ ঝট করে মুখ অন্য পাশে ঘুরিয়ে ফেললো।

উসমান ফট করে চোখ মেললো! অবিশ্বাস্য চোখে দিলশাদের দিকে তাকালো । কি হলো এখনও সে বুঝতে পারেনি । আর যখন বুঝলো সে ফট করে দাঁড়িয়ে গেলো। বিস্ময়ভরা চোখে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো!

আর দিলশাদ চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে লজ্জায় অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে রাখলো। ইশ… ইশ.. ইশ….

উসমান হেসে ফেললো! তার ইচ্ছে করলো এই লজ্জা রাঙা মুখটা দু- হাতে তুলে চুমুতে ভরে ফেলতে। তবে খুব কষ্টে নিজেকে দমালো।

সে আবারো ঝুকে নিচু হলো ! এবার চেপে ধরলো না। শুধু কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, — “থ্যাঙ্কিউ আমার দিল। এতো সুন্দর ভাবে হ্যাঁ বলা একমাএ আমার দিলকে দিয়েই সম্ভব। ”

বলেই সে ঝট করে উঠে দাঁড়ালো! সে আর এক সেকেন্ডও ব্যয় করলো না। হনহনিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

দীপা হামিদা বানু কে নাস্তা দিচ্ছিলো! উসমান তার সামনে এসে বললো, — ভাবি!

দীপা উসমানের দিকে তাকালো! সব সময় পরিপাটি, টিপটপ হয়ে থাকা উসমানকে আজ বড় এলোমেলো মনে হলো। সে চিন্তিত হয়ে বললো,— কি হয়েছে?

দীপা উসমানের চেয়ে বয়সে ছোট। তবুও বড় ভাইয়ের বউ। সেই হিসেবেই সব সময় সম্মানের চোখেই দেখে এসেছে। কখনও চোখ তুলে তার দিকে তাকায় নি। তবে আজ তাকালো! হালকা করে দু – হাতের আঙুল গুলো ধরে চেয়ারে বসালো। সেও আরেকটা চেয়ার টেনে তার সামনে বসলো! বসে কোমল সুরে বললো,—

ভাবি আমি দিলশাদকে ভালোবাসি! সেও আমাকে ভালোবাসে। আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। তুমি তার একমাএ গার্ডিয়ান। তাই তোমার কাছে আমি তোমার বোনের হাত চাইছি। তুমি কি তোমার বোনের বিয়ে এই অধমের কাছে দেবে। কথা দিচ্ছি! এক চিমটি লবণের দানা পরিমানও কষ্ট সে আমার কাছ থেকে পাবে না।

দীপা হেসে ফেললো! হামিদা বানু লাঠি তুলে উসমানের বাহুতে বাড়ি দিয়ে বললো,— ঐ হারামজাদা! আমরা মরে গেছি। আমরা মুরব্বিরা থাকতে তুই হাত চাস ক্যা।

উসমান হামিদা বানুর দিকে তাকিয়ে বললো,— এতো সুন্দর সময়টা নষ্ট করোনা তো দাদী। একটু চুপ থাকো প্লিজ! তারপর দীপার দিকে তাকিয়ে বললো, — এই হাসির অর্থ আমি কি ধরবো?

উমর হাই তুলে উসমানের পাশের চেয়ারে বসলো! বসে বললো, — তুই আম গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ। যেটা ভালো লাগে সেটা ধর। ধরে জড়িয়ে বসে থাক। তবে আপাততো আমার বউয়ের হাত ছাড়।

উসমান ঠোঁট চেপে উমরের দিকে তাকালো!

— আরে এভাবে তাকাচ্ছিস কেন? আমাকে তো তোর ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। আমি যদি সকালে তোর পেছনে আগুন না লাগাতাম। তাহলে এতো সুন্দর ভাবে ব্লাস্ট হতি ?

উসমান এবার আবাক হলো! অবাক হয়ে বললো,—- মানে?

— মানে আবার কি? আমি আগেই বলেছি। যদি কিছু হয় দিলশাদের ইচ্ছায়ই হবে। তার ইচ্ছা টা কি জানতে তো হবে নাকি। তুই এক ঘ্যাড়ত্যাড়া, ওটা আরেক ঘ্যাড়ত্যাড়া। কি থেকে কি করবি ঠিক আছে। তাই আমাদের মাঠে নামতে হলো। দেখ এক বলেই ছক্কা।

উসমান ফুস করে শ্বাস ফেলে বললো, —- রায়হানকে কে নিয়ে দিলশাদকে যা বলেছো সব এমনিই।

— হ্যাঁ! ব্রেইন নিয়ে শুধু সে ই খেলতে পারে নাকি। আমরাও পারি।

উসমান দীপার দিকে তাকালো! তাকিয়ে বললো,— তুমিও।

দীপা হেসে বললো— দেখো আমার কোন দোষ নেই! আমি যা বলেছি তা সিরিয়াস হয়েই। আমি তোমার নামই নিতাম। তবে রায়হানের নাম নিয়ে গিট্টু পাঁকনোর আইডিয়া তোমার ভাইয়ের।

উসমান উঠে দাঁড়ালো! যেতে যেতে বললো,—- আমার বিয়ে থেকে তোমরা সব বাদ।

হামিদা বানু ভেংচি কাটলো! কেটে বললো, — ইশ! ঢং! আমার বিয়ে থেকে সব বাদ। বেশি করবি তোর বিয়া থেকে তু ই বাদ। আর শোন খবরদার কোন দরজার লগে ত্যাজ দেখাইছোস তো। সকালে আমি মরতে মরতে বাঁচছি। আল্লাহগো, এভাবে কেও দরজা লাগায়। আমিতো ভয়ে শ্যাষ। ভাবছি ভূমিকম্পে বুঝি সব ভাইঙ্গা চুইরা পড়তাছে।

দীপা হামিদা বানুর কথায় হেসে ফেললো! হেসে উমরের দিকে তাকালো।

উমর তার দিকেই তাকিয়ে ছিলো। দীপা হাসলে সে চোখ ফেরাতে পারে না। চোখে চোখ পড়তেই উমর চোখ মারলো।

______

সারাদিন দিলশাদ আর রুম থেকে বেরুনি। হঠাৎ করেই দুনিয়ার লজ্জা তাকে ঘিরে ধরেছে। দুপুরে দীপা টেনে তাকে খাবার টেবিলে নিয়েছে। ভাগ্যিস উসমান ছিলো না। তবে ইউসুফের খুশি দেখে কে? সে এক গাদা হাবিজাবি খাবার, টাবার নিয়ে হাজির। সব দিলশাদের পছন্দের। তার হাতে দিয়ে বলেছে, — এভাবে সব সময় হাসো আপু। তুমি না হাসলে, আমার হাসতে ইচ্ছে করে না।

দিলশাদ অবাক হয়ে তাকিয়েছে। সে কখনও কারো কাছে ভালো হওয়ার জন্য কিছু করেনি। বরং খারাপ হওয়ার মতোই অনেক কিছু করেছে। তবুও এই মানুষ গুলো তাকে এতো ভালোবাসার কারণ কি?

দিলশাদ ইউসুফের মাথা এলোমেলো করে বলেছে, — আমি এতোটাও ভালো না ইউসুফ।

ইউসুফ হেসে বলেছে, — তোমার ভালো হওয়ার দরকার কি? তুমি যেমন আছো তেমনি থাকো। এই দিলশাদ আপুকেই আমার ভালোলাগে।

দিলশাদ হেসেছে, প্রাণখোলা হাসি। ইশ কতোদিন পরে সে এভাবে হাসছে।

তখনি তার ফোন বেজে উঠলো। সে জানে কার ফোন। উসমান সকাল থেকে এই পর্যন্ত হাজার বার ফোন দিয়েছে। সে ধরেনি! বাজুক! হ্যাঁ বলেছে বলেই কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?

উসমানও এপাশ থেকে হাসলো। এই যে ফোন ধরছে না। তার একটুও রাগ হচ্ছে না। সে জানে দিলশাদ কেন ফোন ধরছে না। মেয়েটা হ্যাঁ তো বলেছে তাবে লজ্জা পাচ্ছে। এই লজ্জাটাও তার ভালো লাগছে। সে আবার কল দিলো।

দিলশাদ এবারো ধরেনি! সে ম্যাসেজ পাঠালো। একটা না, পরপর কয়েকটা। আর সব গুলোতেই একটা বাক্য,

“ভালোবাসি আমার দিল। অনেক অনেক ভালোবাসি। ”

ম্যাজেস সেন্ড করার মধ্যেই তার ফোনে রিং হলো। নাম্বারের দিকে তাকাতেই সাথে সাথে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো । তবে সেও ফোন রিসিভ করলো না। দিলশাদ আর তার ছবি পাঠালো আর সাথে ম্যাসেজ লিখলো, —

এটা তোমাদের ভাবি! ভালোভাবে একটু চিনে রেখো তো! একই ভার্সিটিতে আছো। বিপদে আপদে খোঁজ খবর নিতে পারবে ।

আর স্যরি হ্যাঁ! ফোনটা এখন রিসিভ করতে পারছি না। একটু ব্যস্ত আছি। বুঝতেই পারছো। তোমাদের ভাবি বাসায়। ভাবি বাসায় থাকলে ভাইয়েরা কেন ব্যস্ত থাকে। বুঝেছো নিশ্চয়ই?
অবশ্য অবশ্যই বুঝবে। সিনিয়র বন্ধু বলে কথা।

ইউসুফ যেতেই দিলশাদ ম্যাসেজ দেখলো! তার ঠোঁটের কোণে মুচকি হাসি। এই লোকের মাথা নির্ঘাৎ খারাপ হয়ে গেছে। এতো বার বলতে হয় ভালোবাসি। সে হেসেই বালিশে মুখ লুকালো।

সেই হাসি অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী হলো না। তার ফোন বাজতে লাগলো।

প্রথমে সে ভাবলো উসমান। পরে দেখলো আরমান। সে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। ধরবে না, ধরবেনা করেও শেষ সময়ে এসে ধরলো। কানে রাখতেই আরমান চিবিয়ে বললো , — শুয়েছিস তুই ওর সাথে?

দিলশাদ প্রথমে বুঝলো না! সে ভ্রু কুঁচকে বললো,— কি বললেন?

আরমান এবার চেঁচিয়ে উঠলো, — শুয়েছিস তুই ওর সাথে? শোয়া বুঝিস না, না? ন্যাকা সাজা। চুমু খাচ্ছিস, কোলে উঠে বসে আছিস। আবার শোয়া বুঝিস না।

দিলশাদ হতম্বভ হলো সাথে রাগও । তবে সে চেঁচালো না। শান্ত ভাবে বললো, — আরমান ভাই, মন দিয়ে শুনুন! আপনার আর আমার মধ্যে এরকম কোন সম্পর্ক কখনও ছিলো না, যে আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলবেন। আর রইলো বাকি কথা, যেগুলো আপনার সামনে আমার মুখেও আনতে বাঁধছে। সেগুলো আমি যার সাথে ইচ্ছা তার সাথে করবো সেটা আপনার কি? আপনি আর কখনও আমাকে ফোন দিবেন না। বলেই দিলশাদ ফোন কেটে দিলো।

কেটে অবশ্য লাভ হলো না! আরমান ফোন দিতেই থাকলো। দিতেই থাকলো। সে নাম্বার ব্লক করে কপালে হাত রেখে শুয়ে পড়লো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে তার।

কিছুক্ষণ যেতেই আবার ফোন বাঁজলো। আননোন নাম্বার! সে বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়ে রিসিভ করলো। রিসিভ করে প্রায় চেঁচিয়ে বললো,— বলেছিনা আর আমাকে ফোন দিবেন না।

আরমানের কন্ঠ এবার নরম। সে কোমল সুরে বললো, দিলশাদ স্যরি, স্যরি। আমার ভুল হয়েছে। তোমার ছবি ও কু*বাচ্চার সাথে দেখে মাথা খারাপ হয়ে গেছে। দেখো তোমার অতীত নিয়ে আমার কোন সমস্যা নেই। তবুও তুমি রাগ করো না। প্লিজ।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো,—- এগুলো আমার অতীত না আরমান ভাই। বর্তমান, ভবিষ্যৎ। আপনি আমাকে ভুলে যান। এটাই আমাদের জন্য ভালো। রাখি! আশা করি আর বিরক্ত করবেন না।

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৪

দিলশাদ করুণমুখে তার খালামণির দিকে তাকালো। সে চোখ মুখ ভাসিয়ে নাক টেনে কাঁদছে। এটা নতুন না! তিনি ভালো মন্দ সব বিষয় নিয়েই এক চোট কাঁদেন। দিলশাদের তবুও খারাপ লাগলো। আজকাল কেন জানি অল্পতেই মন সিক্ত হয়।

আজ আহান, আহাদের আকিকা। বড় অনুষ্ঠান করেই করা হচ্ছে। যার কারণে আজকে এই বাড়িতে আত্মীয় স্বজনের মেলা। দীপার দিক থেকে শুধু খালামণিই এসেছে। বাবা, মা নেই! বাকি আত্মীয় – স্বজনের সাথে তেমন ভাবে পরিচয় হওয়ারই বা সময় পেলো কই। তবুও সবাইকে বলা হয়েছে। এখন আসা না আসা যার যার ব্যাপার।

দীপার খালামণি সাহেদা কাঁদতে কাঁদতেই কাপড়ে একচোট নাক ঝাড়লেন। দিলশাদ অন্য দিকে তাকিয়ে ঢোক গিললো। ঢোক গিলতে গিয়ে তার প্রায় বমি আসার জোগার। সে কোন রকম টিস্যু পেপার এগিয়ে দিয়ে শান্ত ভাবে বললো,— হয়েছো তো, আর কতো কাঁদবে?

— আশ্চর্য! তোদের জন্য এখন কাঁদতেও পারবো না?

— ঘর ভর্তি দুনিয়ায় মানুষ। কেও এসে দেখলে কি ভাববে বলোতো?

— যা ভাবার ভাবুক! আমার মনে কষ্ট, আমি কাঁদবোই।

দিলশাদ কিছু বললো না! মুখ ভোঁতা করে বসে রইলো। যখন থেকে উসমান আর তার কথা শুনেছে। শুরু হয়েছে খালামণির প্যানপেনানি। ভাগ্যিস তাও তারা রুমের মধ্যে। বাড়ি ভরা দুনিয়ার মানুষ। তা না হলে একেকজন প্রশ্ন করে করে মাথা খেয়ে ফেলতো।

এমনিতেই উসমান আর তার ব্যাপার নিয়ে আত্মীয় স্বজনের মধ্যে হট টপিক সে। গ্রামের যতো মেহমানই আসছে। একবার না একবার এই রুমে উঁকি দিচ্ছে। কেও হেসে কিছুক্ষণ গল্প টল্প করছে। তারা তাকে চেনে। তার ব্যাপারে সব জানে। আগেও একবার দেখেছে। তবুও দেখা যাচ্ছে তার ব্যাপারে তাদের খুব আগ্রহ। বিজ্ঞের মতো এটা সেটা জিজ্ঞেসও করছে। সে বুঝতে পারে না। এতো অল্প সময়ে এতো মানুষের জানাজানি হচ্ছে কিভাবে?

খালামণি আবার একচোট নাক ঝাড়লেন! দিলশাদের পেট মুড়িয়ে উঠলো। সে অসহায় ভাবে তাকালো। মনে মনে বললো,— আল্লাহ রক্ষা করো।

আল্লাহ তার দোয়া কবুল করলো! তখনি দীপা আসলো। এসে অবাক হয়ে বললো,— আল্লাহ, খালামণি তুমি এখনও কাঁদছো?

— চুপ! তুই হচ্ছিস যতো নষ্টের গোড়া।

দীপা হাসলো!

— আবার হাসিস! খালামণির মনে কষ্ট দিয়ে আবার হাসিস? তারপর দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো। ও তো আগেরই শয়তান। তুই পারলি? পারলি কিভাবে আমার ছেলের সাথে এমন করতে। ছোট বেলা থেকে চিঙ্গামের মতো চুলে এঁটে রইলি। আর বড় হয়ে ফুরুৎ। কতো আশা করেছি! তুই আমার ছেলের বউ হবি। এখন হচ্ছিস বোনের দেবরের। খালামণিতো এখন পর।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! দীপা সাহেদাকে সাইড থেকে জড়িয়ে ধরলো! কাঁধে মাথা রেখে বললো,— কে বলেছে পর? এই যে মা নেই! তোমাকে জড়িয়ে ধরেইতো মায়ের গন্ধটা নেই। এখন তুমি যদি আমাদের না বুঝো তাহলে আমরা কোথায় যাবো?

এই কথায় সাহেদা আরো কেঁদে ফেললো! কেঁদে বললো,”- ছাড় আর ঢং করতে হবে না। খালামণির তো একটু খবরও নিতে দেখি না। আমি ফোন করে করে মরি। দু- টো বোন ছিলাম আমরা। সেই বোনের স্মৃতি তোরা। তোদের জন্য কতোটা পুড়ে তোরা বুঝবি না।

দিলশাদ মলিন ভাবে হাসলো! হেসে সেও এগিয়ে গেলো। এই সাইড থেকে সেও সাহেদা কে জড়িয়ে ধরে ঝরঝরিয়ে কেঁদে ফেললো! বাবা, মার কথা উঠলেই তার দম বন্ধ হয়ে আসে।

সাহেদা এবার থামলো! পরম মমতায় দুই ভাগ্নিকে দু- হাতে আগলে ধরলো।

তখনি ইউসুফ আসলো! তার হাতে কোলে আহান, আহাদ। বিরক্ত মুখে বললো, —- তাড়াতাড়ি ধরো তো ভাবি। এই দু- টো আমার জান খেয়ে ফেললো।

দীপা, দিলশাদ দু- জনেই চোখ, মুখ মুছলো। মুছলো সাহেদাও। মুছে দীপা বললো,— এতো কলিজা কলিজা করিস। এখন দু- মিনিটেই এই হাল।

— ছোট ছিলো ভালো ছিলো ভাবি! এখন দম বের করে ফেলে। এই দেখো, সর্বশক্তি ক্ষয় করেও বাগে আনতে পারছি না।

দীপা হাসলো! দিলশাদ এগিয়ে গেলো। তাকে দেখলেই এই দু- টো উলটে দৌড় মারে। সে দু- টোর হাত ধরে টেনে নিজের কাছে আনলো। এনে জোর করে দু- টোর গালে দু- টো চুমু বসিয়ে দিলো।

তখনি উমর আসলো! এসে বললো,— ব্যাপার কি শালী সাহেবা। আমার ছেলেদের উপর এতো জোরজবরদস্তি, এতো অত্যাচার কেন?

— আপনার ছেলে, কই? এখানেতো সে রকম কাওকে দেখছি না।

— আচ্ছা! জাপটে ধরে যে বসে আছো। তাহলে এই বিচ্ছু দুটো কে?

— আচ্ছা! আচ্ছা! এই দু- টোর কথা বলছেন। কিন্তু এই দু-টো তো আমার আব্বু।
বলতেই দিলশাদ থেমে গেলো। কতোদিন আব্বু বলে কাওকে ডাকে না। তার সাথে একটু অবাকও হলো। সে আগের মতো দুষ্টুমি করছে।

দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! উমর বুঝলো! সে আবহাওয়া স্বাভাবিক করার জন্য তাড়া দিয়ে বললো, —- তোমরা কি খালামণিকে নিয়ে রুমেই বসে থাকবে? ঐ দিকে সবার খাওয়া দাওয়া শেষ। তোমরা খাবে না?

দীপা উঠলো! সাহেদা আর দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো, — হ্যাঁ আসো! আমি ডাকতেই এসেছিলাম। এসে গল্পে মজে গেছি। আসো খালামণি, এই দিলশাদ আয়।

সবাই বেরোলো! বেরুতেই রুবিনার সামনে পড়লো। সে সকালেই এসেছে। সে দিলশাদের দিকে একবার তাকালো। সে এসেছে পরে দিলশাদের সাথে তেমন কথা বার্তা বলে নি। দিলশাদও আগ বাঁড়িয়ে যায়নি।

দিলশাদ থেকে চোখ ফিরিয়ে উমরকে বললো, — এই বিচ্ছু দু- টোকে আমার কাছে দিয়ে যা। তাহলে শান্তিতে খেতে দেবে না।

উমর দু- টোকে দিয়ে এগুলো! দুপুরের খাবারের আয়োজন আজকে বাইরে। ঘরের ভিতরে আর ঝামেলা করেনি। দিলশাদ ও তাদের সাথে এগুলো।
এগিয়ে বসতেই সুমি এলো! গাল ফুলিয়ে বললো,—- হুম! হুম! সব দেখছি। আজকাল আর কেও খবর নেয় না।

দিলশাদ হাত ধরে টেনে পাশের চেয়ারে বসালো। বসিয়ে সেও বললো,—- হুম! হুম! আমিও দেখছি। জামাই রেখে আমাদেরও কে, কতো খোঁজ খবর নিচ্ছে।

সুমি হেসে ফেললো! হেসে বললো,— হ্যাঁ! আমিও দেখবো আমাদের উসমান ভাইকে রেখে আপনিও কতো খোঁজ খবর নেন।

দিলশাদ ভ্রু উঁচিয়ে বললো, — কেন? তোমার উসমান ভাই বুঝি দু- শিং ওয়ালা। যে তাকে রেখে কারো খোঁজ খবর নেওয়া যাবে না।

— সেটাতো কয়েকটা দিন পরেই বোঝা যাবে। রাখা যাবে, না যাবে না।

— আচ্ছা! দেখো। এখন বলো, কোথায় ছিলে? সেই প্রথমদিন যা দেখলাম । আর তো আসলেই না।

— শরীলটা ভালো যাচ্ছে না। তাই আসি নি।

দিলশাদ ভ্রু নাচিয়ে বললো,— গুড নিউজ নাকি?

— কি জানি ভাই এখনও জানি না।

— তাহলে জানো কি?

— তাও জানি না।

দিলশাদ হাসলো! হাসতেই তার নজর গেলো গেইটের কাছে। উসমানের গাড়ি ঢুকছে। সে একটু অবাক হলো। উসমান বাসায় ছিলো না নাকি? উসমানের সাথে তার আর সামনাসামনি দেখা হয়নি। অবশ্য সে ইচ্ছে করেই রুম থেকে খুব একটা বেরুইনি।

তার ফোনও বন্ধ! আরমান ভাই জ্বালিয়ে মারছে। সোজা ভাবে বলার পরও কলের উপরে কল করছে। শেষ মেষ বিরক্ত হয়ে সে ফোন অফ করেই রেখেছে। ফোন অফ করার কারণে উসমানের সাথেও আর কথা হয়নি।

সে দীপার দিকে তাকালো। সে তার পাশেই বসেছে। উমর ভাইয়া অবশ্য বসেনি। সে এটা সেটা এগিয়ে দিচ্ছে।
দিলশাদ দীপাকে বললো,—- উসমান ভাই বাসায় ছিলোনা?

দীপাও অবাক হয়ে তাকালো! তাইতো! উসমান ভাই কই! এতো ঝামেলায় সে খেয়াল করেনি। আর ছেলেরা সব বাইরে ব্যস্ত ছিলে। তাই ভেবেছে হয়তো সেখানেই ছিলো। সে উমরের দিকে তাকালো!

উমর অপ্রস্তুতের একটা হাসি দিয়ে বললো, —- তোমরা খাও! হ্যাঁ! আমি একটু আসছি। বলেই হরবর করে চলে গেলো। দীপা অবাক হলো! হলো দিলশাদও। সে উমরের যাওয়ার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

দিলশাদ রুমে এসেই ফোন চালু করলো।করতেই একের পর এক মেসেজ আসতে লাগলো। সে শেষ ম্যাসেজটা ওপেন করলো। এটা এসেছে আজ সকাল আটটায়। এর পরে আর আসেনি। সেখানে লেখা, — তোমাকে আমি খুন করবো দিলশাদ। সত্যিই করবো। তুমি শুধু আমার নয়তো কারো না।

দিলশাদ কিছুক্ষণ নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে রইলো।
তারপর আরমানের নাম্বারে ফোন দিলো। ফোন বন্ধ! তারপর সে পায়েলের নাম্বারে ফোন দিলো। রিসিভ হতেই বললো, —- আজকে ভার্সিটি গিয়েছিলে।

— হ্যাঁ! কেন, কি হয়েছে?

— আরমান ভাই কে দেখেছিলে?

— আরে কি হয়েছে জানো না। একদল লোক নাকি আরমান ভাইকে তুলোধুনো করেছে। শুধু তাকে না। তার সাঙ্গ পাঙ সবাই কে। তারা তো সবাই হসপিটালে। ভার্সিটিতে দেখবো কিভাবে। পুলিশ টুলিশ নিয়ে নাকি হুলুস্থল ব্যাপার।

দিলশাদ আর কিছু বলতে পারলো না! সে ফোন রাখলো। ফোন রেখে পেছনে ফিরতেই চমকে গেলো। উসমান দরজার সাইডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। সব সময়ের মতো টিপটপ। চুল হালকা ভেজা। দেখতে ফ্রেশ লাগছে। এসে সম্ভবতো এর মধ্যে গোছলও করে ফেলেছে।

দিলশাদ কিছু বললো না! সে স্বাভাবিক ভাবেই খাটে বসলো। উসমানও এগিয়ে আসলো! হাটু গেড়ে দিলশাদের ঠিক সামনে বসলো। বসে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।

দিলশাদের অস্বিস্তি হলো! সে উঠতে চাইলো।
উঠতে পারলে তো। উসমান দু- হাত দিয়ে আঁটকে ফেললো ! তার ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

দিলশাদ বিরক্ত হলো ! বিরক্তি নিয়ে বললো, — হাত সরান।
— কেন?
দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে বললো, —- কেন মানে কি? হাত সরান।
— যদি না সরাই।
— সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না ।
— ফাজলামি করছি তোমাকে কে বললো ?

দিলশাদ ঠোঁট চেপে বিরক্ত মুখে কিছুক্ষণ বসে রইলো। ঘর ভর্তি দুনিয়ার মানুষ। হঠাৎ হঠাৎ একেজন এসে হাজির হচ্ছে। কেও এসে এভাবে দেখলে কি ভাববে?

সে আবারো বললো, — এখান থেকে উঠুন! দরকার পড়লে ঐ সামনের চেয়ারে গিয়ে বসুন।

— আমার যেখানে দরকার, আমি সেখানে আছি।

দিলশাদ ঠোঁট মুখ চেপে আবার কিছুক্ষণ বসে রইলো। মনে মনে নিজেকে শান্ত করলো। এই ঘ্যাড়ত্যাড়া কে ত্যাড়া করে কিছু বললে কখনও শুনবে বলে মনেও হয় না। সে আস্তে করে বললো,

— সামনে থেকে উঠুন প্লিজ।
— কেন, কি সমস্যা?
— বাড়ি ভর্তি মানুষ! বাইরে যান। কেও দেখলে অন্য কিছু ভাববে।
— অন্য কিছু নেই।
— না নেই।
— দু- দিনেই ডিসিশন চেঞ্জ?
— হ্যাঁ !
— জানতে পারি কেন?
— আমার কোন গুন্ডার সাথে অন্য কিছু হবে না।
— সত্যিই?

দিলশাদ চোখ তুলে তাকালে। উসমান তার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে সেই চোখের দিকে তাকিয়েই বললো, — তিন সত্যি।

উসমান হাসলো! হেসে বললো,— যা হওয়ার হয়েই গেছে দিলশাদ। সেটা আর চেঞ্জ হবে না। এখন তুমি চাইলেও না।
— হতে কতোক্ষণ?
উসমান হাসলো! হেসে বললো — সেই সুযোগ আর আমি তোমাকে দেবো না মিস দিলশাদ।
— কেন? কি করবেন?
— পাগলামী! সেটা তো এখনও দেখলেই না।

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে তাকালো! উসমান দিলশাদের মুখ দেখে হেসে ফেললো! হেসে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললো, — চিন্তা করো না। এই একটু করবো। তোমার সাথে বেশি কিছু করার চিন্তা করতেও আমার কলিজা কেঁপে উঠে ।

চলবে…..