দর্পণ পর্ব-৩৫+৩৬+৩৭

0
135

#দর্পণ
#নুপূর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৫

দিলশাদ শুয়ে ছিলো। এতো মানুষের মধ্যে সে আর বের হয়নি। তখনি এক প্রকার উড়তে উড়তে তিহা আসলো। এসে বললো, — দীপা আপু তোমায় ডাকছে।

দিলশাদ অনিচ্ছা সত্বেও উঠলো! সন্ধ্যা হবে হবে করছে। প্রায় সব মেহমানই চলে গেছে। যারা থাকবে শুধু তারাই আছে। আপু খালামণিকেও যেতে দেয়নি। কতোদিন ধরে রাখে কে জানে?

সে গায়ে ওড়না জড়িয়ে উঠে বাইরে আসলো। বাইরে আসতেই একটু থমকালো। ড্রইং রুমেই সবাই। ব্যাপার কি?

সে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে যেতেই হামিদা বানু বললেন, — সবাই কতো করে বললো! হোস্টেলে যাওয়ার দরকার নেই। তাও গেলা! এহন দেখেছো বড়দের কথা না শুনলে কি হয়?

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে দীপার দিকে তাকালো! তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললো,— কি হয়েছে?

দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, —- তোর মোবাইল কই দেখি।

দিলশাদ সাথে সাথেই বললো, — কেন?

দীপা এগিয়ে এলো! তার হাতে মোবাইল। আর সেটা কার বুঝতে তার এক সেকেন্ডও লাগলে না।

সে উসমানের দিকে তাকালো। সে কিছুই করেনি টাইপ চেহেরা করে তার দিকেই তাকিয়ে আছে।
দিলশাদ বড় একটা শ্বাস ফেললো! আবার কোন গেঞ্জাম পাঁকিয়েছে এই শয়তান লোক কে জানে।

দীপা এগিয়ে ধরলো! দিলশাদ তাকালো! অসংখ্য ম্যাসেজ। আরমান যেমন তাকে মেসেজ দিয়েছে, তেমন দিয়েছে উসমানকেও। বেশি ভাগই খুব নোংরা আর সাথে হুমকি।

ও আচ্ছা! এ জন্যই এই ব্যাটার এতো রাগ উঠেছে। এ তো আবার ধোঁয়া তুলসি পাতা। সে করবে সমস্যা নেই, তবে তাকে কেও একটু খোঁচালেই ডাইরেক্ট হাসপাতালে। কোন দরকার ছিলো আরমান ভাইকে এই সব ভিডিও পাঠানোর ?

— তোর এই বিষয়ে কিছু বলার আছে?

দিলশাদ মাথা নেড়ে বললো,— না নেই।

— তোকে নিশ্চয়ই এমন ম্যাসেজ পাঠিয়েছে?

দিলশাদ উত্তর দিলো না। উসমানের টা ভালোই তারগুলো দেখলে আপু জ্ঞান হারাবে।

দীপা বড় একটা শ্বাস ফেলে বললো —- আমরা আরমানের ব্যাপারে আইনি পদক্ষেপ নেবো। তোর কোন সমস্যা আছে?

দিলশাদ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো। দু- পাশে মাথা নাড়লো যার অর্থ, — না।

সাথে সাথেই কঠিন চোখে উসমানের দিকে তাকালো । গুন্ডামি করে ভাবির সামনে এখন সাধু সেজে বসেছে। এখন আবার আইনি ব্যবস্থা নিবে। আইনি ব্যবস্থার বাকি রেখেছে কি?

উসমানেন দৃষ্টি তার দিকেই। তার ঠোঁটের কোণে এবার মুচকি হাসি।

দীপা একটু থামলো! থেমে কোমল সুরে বললো,– আমি একটা ডিসিশান নিয়েছি দিলশাদ।

দিলশাদ আন্দাজ করতে পারলো! বাবা, মার দুঃখে কাতর হয়েছে। ব্রেইন খুলে তো আর পড়ে যাইনি । সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, — তোমার সমস্যা কি আপু জানো? যে কেও অল্পতেই তোমার ব্রেইন ওয়াশড করতে পারে। অবশ্য এতে তোমার দোষ নেই। যারা ব্রেইনের চেয়ে হ্নদয় বেশি ব্যবহার করে তাদের এই সমস্যা হবেই।

দীপা এতো টেনশনের মাঝেও হেসে ফেললো! এতো বুদ্ধি এই মেয়েটা পেলো কোথা থেকে কে জানে? আরমান দিলশাদ আর উসমানকে নিয়ে পুরো ভার্সিটিতে নোংরা কথা ছড়িয়েছে। আরো ছড়াবে না সে গ্যারান্টি কি? যেহেতু উসমানকে নিয়ে দিলশাদের সমস্যা নেই। তো নোংরা কথার পালে সে আর বাতাস লাগতে দেবে না।

সে এগিয়ে গিয়ে দিলশাদের গালে হাত রাখলো! কোমল সুরে বললো, — একবার এই বোনের উপর বিশ্বাস রাখনা দিলশাদ।

দিলশাদ আবারো বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো! কোন কুক্ষণে এই শয়তান ব্যাটাকে হ্যাঁ বলেছিলো। সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, — আমার কোন সমস্যা নেই। যা খুশি কর।

দীপা খুশি হলো! সে ভেবেছিলো দিলশাদ বেঁকে বসবে। তবে স্বাভাবিক ভাবে রাজি হওয়াতে সে হাঁফ ছাড়লো।

দিলশাদের হ্যাঁ বলতেই দেরি। বিয়ের ব্যবস্থা হতে দেরি হলো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিয়ের সব ব্যবস্থা হয়ে গেলো। অবশ্য হবেই না কেন? সে ভালো করেই জানে, উসমান শয়তান সব কিছু ব্যবস্থা করেই এগিয়েছে। তা না হলে হুট করে এই বিয়েতে বিয়ের শাড়ি আসলো কোথা থেকে। তোর শাড়ির আমি খেতা পুড়ি। বলেই দিলশাদ শক্ত হয়ে বসলো।

বাড়ির সবাইতো ভালোই, দীপাও বুঝিয়ে সেই শাড়ি দিলশাদকে পরাতে পারলো না। সে তার গায়ের থ্রিপিসের ওড়নাই মাথায় জড়িয়ে ঠাঁট হয়ে এমন ভাবে বসলে। যার অর্থ , এভাবে বিয়ে করলে করো না হলে ভাগো।

এই নিয়ে হামিদা বানু এক চোট চেঁচালেন। এই ঘ্যাড়ত্যাড়া মেয়েকে যে তিনি বাগে আনতে পারবেন না, ঠিক বুঝলেন। তবে রুবিনা শান্ত। সে এসেছে পর থেকে দিলশাদের সাথে কোন কথা বলেনি। এখনও বললো না। অবশ্য সে আগেই বুঝেছে, এই বিয়ে হতোই। একদিন আগে হোক আর পরে। এই তিন মাথাকে সে হারে হারে চিনে। একবার একটা জিনিসে নজর পড়লেই হলো। হাসিল না করা পর্যন্ত শান্তি নেই।

দীপার খালা থম মেরে বসে আছে। সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হচ্ছে যে, সে কোন রিয়াক্ট দেখানোর সময়ই পাচ্ছে না।

তবে সব সময় ফিটফাট থাকা উসমান, আজও ফিটফাট হলো। সাদা শুভ্র পাঞ্জাবিতে তাকে অসাধারণ লাগলো। তার ফুপাতো, চাচাতো ভাইয়ের ভাবিবা কিছুক্ষণ খোঁচাখোঁচি করলো। সুমিকেও কতোক্ষণ খেপালো।
কি ছেলে সে হাত ছাড়া করেছে। তবে সুমির কোন হেলদোল হলো না। সে লেবুর টুকরা হাতে নিয়ে হাঁসফাঁস করছে। বিয়ে টা দেখতে চায় সে। তবে পেট যেভাবে মুরাচ্ছে। কখন না জানি সব ঢেলে ভাসিয়ে দেয়।

দিলশাদ কবুল বললো, সাদাসিধে ভাবেই। তার লজ্জা সরম ছোট বেলা থেকেই কম। তবে সেইদিন সকালে হ্যাঁ বলার পরে উসমানকে দেখে কিছুটা লজ্জা করেছে । তবে রাগের জন্য সেইটুকু লজ্জাও এখন ঠিকঠাক আসছে না। তবে সাইন করার সময় সে কেঁদে ফেললো। বিয়ের জন্য না। বাবা,মার কথা মনে করে। এমন কপাল নিয়েই তারা পৃথিবীতে এসে ছিলো। দু- টো মেয়ে একটার বিয়েতেও তারা থাকতে পারলো না।

দীপা এসে দিলশাদকে জড়িয়ে ধরলো। তার চোখেও পানি।
উমর, উসমান দু- জনেই দীর্ঘশ্বাস ফেললো! এই দুই রমনীর চোখের পানি দু- জনের ভেতরই পুরো নাড়িয়ে দেয়।

দিলশাদ সাদাসিধে ভাবে কবুল বললেও উসমানের কবুল বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো। সাইন করতে গিয়ে হাতও কাঁপলো। তার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এই দুষ্ট, ফাজিল মেয়েটা অবশেষে তার হচ্ছে।

বিয়ের ঝামেলা শেষ করে রাতের খাবার খেতে সবার দেরি হলো। সেই দেরির পরে সব ভাবিরা হাতের কাছে যা পেলো তাই দিয়ে বাসর ঘর সাজালো। সেই সাজানো ঘরে পানি ঢাললো দিলশাদ। সে কোন ফাকে নিজের রুমে গিয়ে দরজা দিয়েছে কেও খেয়ালই করেনি। সে দরজা হাজার ডাকাডাকির পরেও খোলা গেলো না।

সবাই একটু মনক্ষুন্ন হলো। তবে উসমানের ভয়ে কেও কোন শব্দ করলো না। সবাই জানে এর মাথা গরম। তার বউকে কিছু বললে সে ছেড়ে কথা বলবে না। তবে খোঁচাখোঁচি বন্ধ করলো না। সেই খোঁচাখোঁচির জবাবে উসমান হেসে একটা কথাই বললো,—- আমার বউর যেমন, যেখানে, যেই রুমে ভালো লাগবে সেই রুমেই থাকবে। আমারতো সমস্যা নেই। যেই ভাবির সমস্যা সে যেন তার জনকে নিয়ে আমার বাসর ঘরে চলে যায়।
এই কথা শুনার পরে আর একটাও আশে পাশে থাকেনি। লজ্জায় সব কয়টা ভেগেছে।

আর সবচেয়ে বড় কথা হামিদা বানু! যে এতোক্ষণ দিলশাদ কে বকে তুলোধুনো করলেও, এখন হাসছে! হেসে সবাইকে বলছে, —- নয়া বউরা একটু আকটু করবোই। আমি নিজেও কতো ওগো দাদারে দেইখা, এই রুমে ঐ রুমে পালাইছি। নিজের বউরে পোষ মানাইয়া, খাঁচায় যদি বন্ধিই না করতে পারলো। তো কিসের পুরুষ মানুষ।

রুবিনা সব ব্যাপারে চুপ থাকলেও, এটা নিয়ে অসন্তুষ্ট হলেন। হয়ে ওভাবে কিছু না বললেও বিরবির করতে লাগলো,— বিয়ে হতে না হতেই ঢং শুরু হয়েছে। বিয়ে করতে পারছে এক রুমে থাকতে ঢং। আর এই মেয়েকেই বিয়ের জন্য মরে যাচ্ছিলো। এখন থাকো বিয়ে করেও বউ ছাড়া।

আর এই সব ব্যাপারে একেবারেই চুপ থাকলো দীপা। সে উসমানের ভাবি হলেও দিলশাদের বড় বোন। একটা সংকোচ থেকেই যায়। সে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেলো। সারাদিনের ক্লান্তিতে সে বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। আহান, আহাদ তার দাদা, দাদীর কাছে। সাবিহা সব সময় তাদের আগলিয়েই রাখে। সে চোখ বন্ধ করতেই একটা হাত তার চুলে বিলি কাঁটতে লাগলো।

দীপা হালকা হাসলো! হেসে হাত টেনে গালে রাখলো। রেখে বললো,— সারাদিন এতো দৌড়াদৌড়ি করলে। এখনো বসে আছো কেন? ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়ো।

উমরও দীপার সাইডে সাথে সাথেই শুয়ে পড়লো! শুয়ে দীপার মাথা বুকে টেনে আনলো। দু- হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো,— এই যে আমার সব ক্লান্তির ঔষুধ।

দীপা হাসলো! হেসে মুখ উঠিয়ে উমরের বুকে থুতনি রেখে বললো,— উসমান ভাই কই?

— দেখলাম তো রুমে গেলো।

দীপা কিছু বললো না। মুখ টিপে হাসলো!

উমর দীপা চুলে বিলি কাঁটতে কাঁটতে বললো, —- হাসছো কেন, হাসি কন্যা?

— তোমার ভাইয়ের কথা চিন্তা করে হাসছি।

— বিয়েটা ধীরে সুস্থেও দেওয়া যেত। আজকেই এমন ধরে বেঁধে দিলে কেন? বেচারি দিলশাদ! শুধু তোমার মুখের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বলেছে।

— ইশ! শালীর জন্য পুড়ে যাচ্ছে।

— শালী হলে পুড়তো না। বোন মনে করি তো তাই পুড়ে। তুমিও কম কিসে, দেবরের দুঃখে তো গাড়াগড়ি খেলে।

দীপা হেসে ফেললো! দুপুরের পর উসমান ভাই তার কাছে আসলো। কাতর ভাবে বললো, — আমার সব কিছুর বিনিময়ে তোমার বোনকে চাইছি। তাকে আমার করে দাও ভাবি। আমাদের মা নেই। মা বলো ভাবি বলো আছতো তুমিই। তাই তোমার কাছেই আবদার করলাম। দিলশাদের বোন না, আজ একটু আমাদের হয়ে ভাবো।

দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করলো। এতোদিনের সম্পর্কে এই প্রথম দিলশাদ এই বাড়ির হয়ে কোন ডিসিশান নিলো। অবশ্য আরমানের ব্যাপারটাও প্লাস পয়েন্টে। আর তাছাড়া যে তার সব কিছুর বিনিময়ে তার বোন কে চাইতে পারে। তাকে সে ফিরিয়ে দেবে কি করে। এর চেয়ে ভালো আর তার বোনের জন্য কে হবে?

দীপা আবার চোখ খুললো! মাথা তুলে উমরের দিকে তাকিয়ে চিন্তিত হয়ে বললো, —- ছেলেটা আবার দিলশাদের কোন ক্ষতি করবে নাতো?

উমর হাসলো! হেসে বললো, —– সে শুধু এখন তোমার বোন না দীপা! সে উমর শেখের বোন, উসমান শেখের বউ। দিলশাদের গায়ে ফুলের টোকাও দেওয়ার আগে আমাদের সামনে পাবে। তবে আর কিছু করবে বলে মনেও হয় না।

দীপা ভ্রু কুঁচকে বললে —- কেন?

উমর আবারো হাসলো! হেসে দীপার কপালে চুমু খেলো।

দীপা মুখ ফোলালো! ফুলিয়ে বললো,—- তোমার এই একটা ব্যাপার আমার একদম অপছন্দ। অর্ধেক কথা বলে বাকি কথা পেটে রেখে দাও।

— আচ্ছা! বলেই উমর ঝট করে দীপাকে ঘুরিয়ে ফেললো! হাতের আঙুলের ভাজে হাত রেখে খাটে চেপে ধরে বললো, —- বাকি সব পছন্দ তো?

দীপা হেসে ফেললো! খিলখিলানো হাসি ! বোনকে নিয়ে এতোদিন যে দুশ্চিন্তায় ছিলো, আজ যেনো তার অবসান হলো। সে হেসে বললো, — উঁহু! কিচ্ছু পছন্দ না, একদমই না।

চলবে…..

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৬

আজকেও দিলশাদের ঘুম ভাঙলো খুব ভোরে। ঘুমিয়েছে বলেতে গেলে একেবারে শেষ রাতে। এই বড় জোর দু- তিন ঘন্টার মতো। কেন জানি আগের মতো শান্তির একটা ঘুম দিতে পারে না।

সে উঠে বসলো! এখনো আলো ফোটেনি। চারিদিক থেকে আযানের শব্দ ভেসে আসছে। সে উঠে ওযু করে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষ করে সে জানালার পাশে দাঁড়ালো।

এই বাসায় কোন রুমের সাথেই বারান্দা নেই। রুম করেছে বিশাল বিশাল, তবে বারান্দা নেই। দিলশাদের আবার বারান্দা পছন্দ। হুট, হাট বসে দূর- দূরান্তে হারিয়ে যাওয়া যায়।

আর এখনতো গ্রামে। গ্রাম যতোই শহরের প্রতিচ্ছবি হোক। শহরের সকাল আর গ্রামের সকালের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। গ্রামের সকালটা হয় নরম, কোমল, স্নিগ্ধ। শহরের টা শুরু হয় কেমন যান্ত্রিক শব্দে। তাই একটা বারান্দা থাকলে, এই স্নিগ্ধ সকালটার সৌন্দর্য মন ভরে নেওয়া যেতো।

তাখনি তার ফোন বাজলো! এই ভোর রাতে তাকে আবার কার প্রয়োজন পড়লো। সে এগিয়ে গেলো। মোবাইলে চোখ রাখতেই একটু অবাক হলো। উসমান! এতো ভোরে! ঘুমায় নেই নাকি?

সে সাথে সাথেই মুখ বাঁকালো! না ঘুমালে নেই। তার কি?

ফোন রিং হতে হতে ক্লান্ত হলো! দিলশাদ ফোন রিসিভ’ই করলো না। তার রাগ এখনও কমেনি। এই হঠাৎ বিয়ের সব নাটের গরু যে উসমান, সে জানে। তাই ফোন নিয়ে’ই তুই বসে থাক।

কল কেটে গেছে। সাথে সাথেই আবার ম্যাসেজ আসলো! দিলশাদ দেখলো, লেখা — আমি গেইটের কাছে অপেক্ষা করছি।

দিলশাদের ভ্রু কুঁচকে গেলো! গেইটের কাছে অপেক্ষা করছি মানে কি? কেন করছিস রে পাহাড়- পর্বত। আমি বলেছি করতে ?

তখনি আবার ম্যাসেজ এলো! এখন অবশ্য তেমন কিছু লেখা নেই। শুধু একটা শব্দ, ” দিলশাদ “।

ম্যাসেজের যান্ত্রিক শব্দে কি অনভূতি বোঝা যায়। কি জানি? তবে তার মনে হলো, হ্নদয়ের ব্যাকুলতা নিয়ে উসমান তাকে ডাকছে।

সে ঝিম মেরে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তার এক মন বললো, ” চলো দেখি কেন এতো ডাকাডাকি। আবার অন্য মন বললো, ” জাহান্নামে যাক।

আবার পরক্ষণেই কেমন অস্থির লাগতে শুরু করলো । আর এই অস্থিরে, সে নিজের প্রতি নিজেই বিরক্ত হলো। ধুর! বলেই ভালো করে মাথায় থেকে গায়ে ওড়না জড়ালো। জড়িয়ে বেড়িয়ে আসলো। মানুষ কেন যে ভালোবাসে। এই ভালোবাসাই হচ্ছে সব অশান্তির মূল। যদি ভালোবাসা না থাকতো মানুষ সব সময় সুখে থাকতো।

সে রুম থেকে বেরুলো বলতে গেলে একেবারে নিঃশব্দে। অবশ্য তার নিঃশব্দের চেয়ে পুরো বাড়িই বেশি নিঃশব্দ! কালকে সবাই অনেক রাতে ঘুমিয়েছে। তাই এতো সকালে কারো ওঠার কোন চাঞ্চই নেই। সে ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। ড্রইং রুম পুরো অন্ধকার। তবে কাঠের দরজা চাপানো। উসমান বেড়িয়েছে তাই হয়তো।

সে বাইরে আসলো। আধো আলো আধো অন্ধকারে দেখলো গেইটের সামনে উসমান বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এতো সকালে এই বান্দা যাচ্ছে টা কোথায়?

দিলশাদ আস্তে আস্তে এগুলো। আর আশ্চর্য হলো! তার এখন আবার লজ্জা করছে। শুধু যে লজ্জা তা না। ভেতরটা হালকা কাঁপছে। কি যন্ত্রনা দেখতো। একে কি সে নতুন দেখছে?

দিলশাদ কোন রকম ঢোক গিলে উসমানের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ অন্ধকারের জন্য ভালো ভাবে দেখা যায় নি। তার গায়ে কালো টিশার্ট আর টাউজার। এতো সকালেও সে ফিটফাট বাবু সেজে বসে আছে।

সে এগুতে এগুতে একবার নিজের দিকে তাকালো! গায়ে গতকালকের থ্রিপিস! এলোমেলো, কুঁচানো। ভাগ্য ভালো মাথা ঢেকে এসেছে। তা না হলে চুল হয়ে আছে কাকের বাসা।

তার বিরক্ত আবার ফিরে এলো, — ছেলে মানুষের এতো ফিটফাট হয়ে থাকতে হবে কেন? তারা হবে এলোমেলো, অগোছালো। তাদের তো গুছিয়ে দিবে তাদের প্রেয়সীরা।সে চোখে মুখে এক রাজ্য বিরক্ত নিয়ে উসমানের সামনে দাঁড়ালো!

উসমান হাসলো! হেসে ওই বিরক্তমাখা মুখের দিকেই মুগ্ধচোখে তাকিয়ে রইলো। ওড়নায় মোড়ানো গোলগাল ছোটখাঁটো মুখটা এতো আদুরে লাগলো। নানার দুষ্টু ইচ্ছে মাথায় ঘোরপাক খেতে লাগলো।

দিলশাদ লজ্জা পেলো! তবে বুঝতে দিলো না। কন্ঠে বিরক্ত ঢেলের প্রায় ধমকে বললো —- এভাবে তাকিয়ে আছেন কেন? খোঁচা মেরে চোখের গুটি বের করে দেবো বলে দিলাম।

উসমান আবারো হাসলো। এই মেয়ে পারে ও। সেই হাসি নিয়েই বললো —- আচ্ছা করো! তুমি না বললেও আমি জানি। এটা তোমার অনেক দিনের ইচ্ছা।

— হ্যাঁ থাকবে না! প্রথম দিন থেকেই তো শুরু করেছেন এই তাকাতাকি। শুধু আমি বলে সয়ে গেলাম।
— এটা অবশ্য ঠিক বলেছো, শুধু তুমি বলেই।
— আমি বলেই তো কি?
— অন্য কিছু।
— কিসের অন্য কিছু?
— সেটা তুমি ভালো করেই জানো দিলশাদ।

দিলশাদ ভ্রু কুঁচকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, —- মাথা জানি আমি আপনার! এসব ফাজলামি করার জন্য এই সাত সকালে এখানে আসার জন্য মেসেজ দিয়েছেন?

— তো, তুমি কি অন্য কিছু করবো ভেবেছিলে?

দিলশাদ ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো । তবে কিছু বললো না! কোন দুঃখে সে এসেছিলো। সে চলে যেতে নিলো।
উসমান ডাকলো, —- দিলশাদ।

দিলশাদ ঘুরে দাঁড়ালো! তবে মুখে কিছু বললো না।

তবে বললো উসমান! হ্নদয়ের সব টুকু আবেগ ঢেলে বললে — আই লাভ ইউ।

দিলশাদ থমকালো! হ্যাঁ বলার পর থেকে উসমান এই শব্দ কতোবার যে বলেছে তার হিসেব নেই। ম্যাসেজের পর ম্যাসেজ দিয়েছে শুধু এই শব্দ দিয়ে। তবুও তার কোথায় যেন ছুঁয়ে গেলো। রাগ টাগ ধুয়ে সব শেষ হয়ে গেলো। সাথে এও বুঝলো মেয়েরা পটে লাট্টু হয় কিভাবে? ঠিক এই ভাবেই! এই ভাবেই পটিয়ে ভালোবাসার মতো সর্বনাশা জালে আটকে ফেলে। সে নিজেকে সামলে কোনরকম বললো, — আমি যাচ্ছি।

— যেতে দিলে তো!
— কি করবেন? তুলে নিয়ে যাবেন? এসব তো আপনারা আবার খুব ভালো পারেন।

উসমান হাসলো! হেসে বাইকে উঠে বসলো। বসে বললো, — আরো অনেক কিছুই ভালো পারি দিলশাদ। সুযোগ দিচ্ছো কই? এখন আসতো! সূর্য উঠে গেলে ভালো লাগবে না।

দিলশাদ কিছুক্ষণ ঠোঁট কামড়ে তাকিয়ে রইলো। যাবে কি যাবেনা দু- মন দুয়াসায় ভুগলো। পরে মন বললো, ” যা, যা হবার হবে। এমনিতেও রুমে গিয়ে ঝিম মেরে বসেই থাকতে হবে।

সে এগিয়ে গিয়ে বাইকে উঠলো। তবে এক সাইডে পা ঝুলিয়ে না। উসমানের যে ভাবে বসেছে তার মতো করেই। তবে কাঁধে হাত রাখলো না। তার টানটান স্ত্রী করা টিশার্ট দু- হাতে মুচড়ে পেছনে শক্ত করে ধরে বসলো।

উসমান আবারো হাসলো! হেসেই বাইক এক টান দিলো। ভালো স্পিডেই দিলো। দিলশাদের অবশ্য তেমন সমস্যা হলো না। এর আগে রায়হানের সাথে সে হাজার বার বাইকে উঠেছে। এই আর কি। বরং তার ভালো লাগছে। সেই ভালো লাগা থেকে কখন যে তার হাত মুচড়ে ধরা টিশার্ট থেকে উসমানের কাঁধে উঠে গেছে, সে খেয়ালই করে নি।

চারিদিকে আধো আলো, আধো অন্ধকার। কোমল স্নিগ্ধ বাতাস। উসমান এসেছে গ্রামের শেষের দিকে। ঘর বাড়ি নেই বললেই হয়। রাস্তার দু- পাশে শুধু ক্ষেত আর ক্ষেত।

দিলশাদের এতো ভালো লাগলো। তার মনে হলো সে হাওয়ায় ভাসছে। সে উসমানের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। এক হাত দিয়ে গায়ে থেকে ওড়না সরিয়ে এক সাইডে রাখলো । মাথার এলোমেলো খোঁপা খুলে চুলগুলো বাতাসে মুক্ত করে দিলো। এক হাত উসমানের কাঁধ শক্ত করে চেপে আরেক হাত পাখির ডানার মতো মেলে চোখ বন্ধ করলো। ইশ! কতো দিন! কতো দিন পরে তার এতো ভালো লাগছে। মনের যতো গুমোট অন্ধকার এই ভোরের স্নিগ্ধ, কোমল বাতাসে যেন সব উড়ে গেলো।

আর উসমান! বাইকের মিররে সে আটকে গেছে।
সাথে সাথেই সে আস্তে করে ব্রেক মারলো। সে নিজের মধ্যেই নেই। বাইক চালাবে কি?

দিলশাদের ভ্রু কুঁচকে গেলো। সে চোখ মেলতেই দেখলো উসমান বাইকের আয়নায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এই দৃষ্টির ভাষা দুনিয়ায় সব মেরেরাই বুঝে। আর সে তো দিলশাদ!

সে মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে বাইক থেকে নামলো! দিলশাদ কে বিয়ে করেছিস রে ব্যাটা। এতো অল্পতে হা হলে চলবে। নতুন নতুন রুপ দেখতে দেখতে তো ঝাঁঝরা হয়ে যাবি ।

সে নেমে আশে পাশে তাকালো। সূর্য উঠছে! কি সুন্দর দৃশ্য। তার মন ভরে গেলো। সে নিজের অজান্তেই খিলখিল করে হাসলো! হেসে কিছু বলতে যাবে, তখনি ঝড়ের গতিতে কেও এসে তাকে ঝাপটে ধরলো। তার আশে পাশের কোন জ্ঞান নেই, হুশ নেই। সে এখন সে পুরোপুরি এলোমেলো, অগোছালো, বরই বেসামাল। এই বেসামাল লোকটাকে দিলশাদ সামাল দেবে কিভাবে?

সে নিজেই লজ্জায় কুঁকড়ে গেলো! এই লোক শুধু নিজে না, তার হাত মুখ আজ সব বেসামাল। দিলশাদ তার অসাড় হয়ে যাওয়া হাত দিয়ে ঠেলে কিছুক্ষণ ব্যর্থ চেষ্টা করলো। ফলাফল আরো খারাপ! উসমান আরো চেপে ধরলো। ইশ! মেরে ফেলবে নাকি নাকি।

তখনি উসমানের ফোন বাজলো। সে বিরক্ত হলো! তবে ধরার কোন আগ্রহ দেখা গেলো না। ফোন বাজতে বাজতে শেষ হয়ে গেলো। শেষ হতেই আবার বাজলো! এবার উসমানের হাত আলগা হলো। আলগা হতেই দিলশাদ ঝট করে দূরে সরে গেলো। তাড়াতাড়ি টেনে জামা, ওড়না ঠিক করলো। সে অন্য পাশে মুখ ঘুরিয়ে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলতে লাগলো ।

উসমানের অবশ্য কোন হেলদোল হলো না। সে দিলশাদের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়েই ফোন ধরলো। ফোন ধরতেই উমর চিন্তিত ভাবে বললো,—- দিলশাদ কি তোর সাথে?

— হুম।

— বলে যাবি তো নাকি? তোর ভাবি রুমে না দেখে টেনশনে শেষ।

উসমান হালকা হাসলো! হেসে বললো,— টেনশন করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবো। বলেই সাথে সাথে ফোন রাখলো।

দিলশাদ অন্য দিকে তাকিয়ে আছে। লজ্জায় তার চোখ, মুখ লাল হয়ে আছে। উসমান তা দেখে হাসলো! হেসে আবার এগুলো।

এগুতেই দিলশাদ দু- কদম পিছিয়ে গেলো। পিছিয়ে বললো,—- আবার আসলে খবর করে ফেলবো বলে দিলাম।

উসমান হো হো করে হেসে উঠলো! হেসে বললো, — এসো! কয়টার খবর করতে চাও। আমি সব সময় রেডি। বলেই এগুতে লাগলো।

তাকে এগুতে দেখে দিলশাদ আর দাঁড়ালো না। এক দৌড় দিলো।

সে দৌড়ের দিকে উসমান মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মনে হলো, এই স্নিগ্ধ সকালের সোনালি রোদের মাধ্যে একটা বুনো প্রজাপতি উড়ে যাচ্ছে। এই প্রজাপতিটা তার। একান্তই তার।

সে তার একান্ত প্রজাপতির দিকে চেঁচিয়ে বললো, — পালাও! যতোখুশি পালাও! দেখি কতোদিন পালিয়ে থাকতে পারো।

দিলশাদ উত্তর দিলো না। পেছনে ফিরেও তাকালো না। সে নিজের মতোই যেতে লাগলো। কি আশ্চর্য! সব কিছু এমন রঙিন লাগছে কেন?

বাসায় দিলশাদ মনে মনে প্রস্তুতিই নিয়েই আসলো। সে জানে বাসায় যাওয়ার সাথে সাথে সবাই তাকে জেঁকে ধরবে। হলোও তাই! তার ফুপাতো, চাচাতো ভাবিরা দিলশাদ কে ঘিরে ধরলো। ঘিরে ধরে বললো,— ব্যাপার কি? আমরা কতো করে বললাম। তখনতো দরজা খোলার নামই ছিলো না। আমাদের দেবর রাতে চুপিচুপি এমন কি করলো। যে একাই চলে গেলে।

দিলশাদ কথা বলতে পাললো না! সে গোলগোল চোখে তাকিয়ে রইলো। পেছন থেকে বললো উসমান, —- কি করেছি, কোন ভাবি জানতে চায়। আমার কাছে আসেন। চেহেরাটা একটু দেখি। তারপরে ডিটেলসে বলছি।

সবাই দিলশাদকে ছেড়ে উসমানকে ঘিরে ধরলো। দিলশাদ হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। সে আর ডানে বামে তাকালো না। সোজা ভিতরে চলে গেলো। আর মনে মনে বললো, — মরে গেলেও আর উসমানের ডাকে বের হবে না।

দেখতে দেখতেই দু- দিন চলে গেলো। খালামণিরা আজ সকালে নাস্তা করেই বেরিয়ে গেলো। আপুর ইচ্ছে ছিলো, আরো কিছুদিন রাখার। তবে তিহার স্কুল আছে তাই আর বাঁধা দিলো না। উসমানের ফুপাতো, চাচাতো ভাবিরা গেলো বিকেলে। রুবিনা অবশ্য সাথে যায় নি। সে ঠিক করেছে কিছুদিন পরে যাবে।

বাড়িটা বলতে গেলে আজ ঠান্ডা। সন্ধ্যা পরে প্রায় সবাই ড্রইং রুমে এসে বসলো। দীপা আর সাবিহা চা, আর হালকা নাস্তা নিয়ে এলো। উসমান, ইউসুফ অবশ্য নেই। উসমান গেছে দুপুরের খাবারের পরপরই আর ইউসুফ কিছুক্ষণ আগে। ঘরে তার মন বসে নাকি।

উমর দিলশাদের দিকে তাকালো! সে আহান, আহাদের সাথে বসেছে নিচে। তাদের সাথে খেলছে। মেয়েটা একটু একটু করে স্বাভাবিক হচ্ছে। আরো আগেই হতো। যদি একা হোস্টেলে না থেকে সবার সাথে থাকতো। উমর দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো,—- দিলশাদ।

দিলশাদ তাকালো!
— তুমি কি আর হোস্টেলে যেতে চাও?

দিলশাদ কিছু বলার আগেই, হামিদা বানু ফুঁসে উঠলো! বললো,— হোস্টেলে যাইবো ক্যা! বাড়িতে থাইকা পড়ন যাইনা। একবার যাইয়া যে কাহিনী পেছনে বাজাইছে। আবারো বাজবো না গ্যারান্টি কি? কোন দরকার নাই হোস্টেলে যাওয়ার।

উমর বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো,— আমি তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি? মুখ বন্ধ রাখো তো। বিয়ে হয়েছে মানেই এই না। দিলশাদের উপর সব চাপিয়ে দিবে। ওর যেমন ইচ্ছা হয় তেমনি থাকবে।

এবার রুবিনা বললো,— যেমন ইচ্ছা তেমনি তো থাকছে। আমরা কোন কিছুতে চাপ দিচ্ছি। এই যে বিয়ের পরেও থ্রিপিস পরে, নিজের মতো ডিং ডিং করে ঘুরছে , নিজের মতো আলাদা রুমে থাকছে। অন্য সব শুশুর বাড়িতে পারতো। অথচো দীপা বিয়ের পর থেকেই শাড়ি পরেছে।

উমর বিরক্ত হয়ে ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো! চেপে দীপার দিকে তাকালো! এভাবে হুট করে বিয়ের ডিসিশান টা না নিলেও পারতো। এ বাড়ির মানুষদের সে চেনেনা? রাজিতো হয়েছিলোই। বিয়েটা ধীরে সুস্থে দেওয়া যেতো। মেয়েটার উপরে এখন চাপ পড়বে।

সে বিরক্ত মাখা কন্ঠে একটু উঁচু ভাবেই বললো, — দীপা পরেছে বলে তাকেও পরতে হবে, এমন কোন কথা নেই। দীপা তখন কোন দ্বিমত করেনি। যদি করতো, তাহলে তাকেও আমি জোর করে পরাতাম না। আর রইলো অন্য রুমে থাকা। সেটা উসমান বুঝবে! এই বিষয় নিয়ে আমি দ্বিতীয় বার কোন কথা শুনতে চাই না।

রুবিনা অবাক হলো! উমর কখন দীপার জন্যও এভাবে কথা বলে নি। সে রাগ নিয়েই দিলশাদের দিকে তাকালো। এই মেয়েটার জন্যই সে বার বার কথা শুনছে। কি জাদু জানে, কে জানে? উসমানতো ভালোই বাড়ির সবাইকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে।

আলি হোসেন চায়ে চুমুক দিলেন! দিয়ে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে কোমল সুরে বললেন, — তুমি বলো তো মা, তুমি কি চাও। তুমি যেটা চাইবে সেটাই হবে। সব বাড়িরই কিছু নিয়ম থাকে। সেটা মেয়েরা না মানলেও, বউদের মানতে হয়। তবে সেটা জোর করে অবশ্যই না। তখন দীপার ঘাড়ে সব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিলো। তখন সময় ভিন্ন ছিলো। হয়তো আমরাও। সময় বদলায়, মানুষ বদলায়। তাই তোমার উপরে চাপাচ্ছি না। যখন তোমার মন চাইবে তখন থেকেই সব মেনো।

দীপা হাসলো! কৃতজ্ঞতা ভরা দৃষ্টিতে আলি হোসেনের দিকে চাইলো। তার ডিসিশানে তার আর কোন আফসোস নেই।

হাসলো দিলশাদও! সে হেসে উমরের দিকে তাকিয়ে বললো, —- হোস্টেলে আর যাবোনা ভাইয়া। আমি আপনাদের সাথে থাকতে চাই। এটা আমি কোন চাপে পড়ে বলছি না। মন থেকেই বলছি। আর রইলো ভার্সিটি সেটা আমি ম্যানেজ করে নেবো।

হামিদা বানুর মুখে হাসি ফুটলো! যাক মেয়েটার সুবুদ্ধি হয়েছে তাহলে। তার সাথে সাথে বাকি সবাই ও হাসলো।

চলবে…….

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৭

দিলশাদ চেয়ার টেনে হামিদা বানুর পাশের চেয়ারে বসলো! এই চেয়ার তো সাধারণ চেয়ার না। এটা হলো হামিদা বানুর সিংহাসন। এই সিংহাসনে বসেই তিনি তার যাবতীয় চিৎকার চেঁচামেচির কাজ সুন্দর ভাবে সমাপ্ত করেন।

দিলশাদ সেই সিংহাসনের পাশে বসতে বসতে একটু ভদ্রতার হাসি হাসলো! অবশ্য দিলশাদ ভালো করেই জানে, তার হাসিতে পুরো দুনিয়া ঘায়েল হলেও, ইনি হবেন না। ইনি হচ্ছে বুনো ওল, তার মতো বাঘা তেতুল চটকে চটকে এই পর্যন্ত এসেছেন। আর তার হাসি কোন ছাতার মাথা।

সে হেসে আরাম করে বসলো। এই বসারও অবশ্য একটা কারণ আছে। কারণ টা হলো উসমান। উসমান একটু আগে বাসায় এসেছে। এই বান্দা বাসায় এলে দিলশাদ তার চোখ কান একটু সজাগ করে রাখে। রুমেও থাকে একটু ভয়ে ভয়ে। কেননা এই ব্যাটার ভরসা নেই। কোন ফাঁকে ঢুকে যাবে কে জানে। তাইতো চলে এলো। সে অবশ্য একটু আগেই এসেছে। এখনও রাতের খাবারের জন্য কেও আসেনি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। তাই আপাততো এই বুনো ওলই ভালো।

সে বসতেই হামিদা বানু ভ্রু কুঁচকে বললো, — এখানে হাত, পা গুটায়ে বইসা পড়লা ক্যা। বোনের হাতে হাতে একটু সাহায্যেও তো করতে পারো।

দিলশাদ ঠোঁট টিপে হাসলো! সে সত্যিই ভালো হতে চায়। তবে কেও সুযোগই দেয় না। সে মনে মনে হেসে বড় একটা শ্বাস ফেলে করুণমুখের ঢং করে বললো,— করতেই তো চাই দাদু! বোনের হাতে হাতে করবো না, কার করবো? কিন্তু আপনার নাতি জন্য পারছি কই?

হাবিদা বানু চট করে দিলশাদের দিকে ফিরে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো, — বউ মানুষ নিজের সংসারের কাজ করবা, এখানে জামাইয়ের কারবার কি?

— সব কারবারতো তারই দাদু! এই যে আলাদা রুমে থাকছি। সবাই আমাকে দোষে, কিন্তু সত্য তো কেও জানে না। প্রথম দিন লজ্জা পেয়েছি। পেতেই পারি নতুন বউ। কিন্তু আপনার নাতি ডাকার সাথে সাথে দরজা খুলেছি না। বলেন? আপনিই বলেন?

হামিদা বানু উপর নিচে মাথা নাড়লো।

— তারপরেই তো শুরু হলো আসল কারবার দাদু। আমি নাকি নোংরা, লাজ লজ্জা সেই। তারমধ্যে সকালে বানিয়েছিলাম একটু চা। গায়ের সাথে নাকি টকটক গন্ধ। আপনি বলেন চায়ের আবার টকটক গন্ধ কি? আপনারা যে দুনিয়ার ধান, টান নিয়েছেন আপনাদের সাথে কি ধান, ধান গন্ধ হয়েছে?

হাবিদা বানু হা হয়ে গেলেন। সাথে দু- পাশে মাথাও নাড়লেন।

— এখানেই তো শেষ না দাদু! কড়া করে এও বলেছে, ‘ রান্না ঘরে টরে যাওয়া টাওয়ার দরকার নেই। স্কিন নষ্ট, হাত নষ্ট, গায়ে তো সব সময় আদা মশলার গন্ধও । তার নাকি এসব একদম অপছন্দ। তাই সব বাদ। তাই আমি আর কি করবো? কোন দিকে যাবো, আপনিই বলেন, স্বামী না সংসার? অন্য রুমেই বা আর থাকবো কতোদিন? দেখেন না কি সুন্দর দিব্যি ঘুরে বেরাচ্ছে। তার কোন মাথা ব্যথা আছে? শুধু শুধু আপনারা আমাকে দোষেন। হুম!

তখনি ইউসুফ এসে বসলো দিলশাদের পাশে! বসে বললো, — কে, আবার কাকে দুষলো?

হামিদা বানু কথা বললো না! সে মুখ চেপে বসে রইলো। ভেতরে ভেতরে সে রাগে ফাঁটছে ! হারামজাদা! তলে তলে এইসব করে বেরাচ্ছে।এজন্যই তো বলি। এতো পাগল পাগল হয়ে বিয়ে করলো। বউ অন্য ঘরে, এর কোন তালই নেই। দিব্যি কাজকারবার দেখছে, হাসছে, খেলছে। তোর হাসা খেলা আমি বের করছি। আহারে! মনে মনে বলেই তিনি দিলশাদের দিকে তাকালেন। রুপতো বাইয়া ছাইয়া পড়ছে তাও জামাই ফিরা তাকাইয়া না। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর আছে?

দিলশাদ হালকা হাসলো! হেসে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে চোখ মারলো।

ইউসুফ হেসে ফেলে বললো,— কোন আগুন লাগাচ্ছো বলতো?

দিলশাদ কিছুই হয়নি এমন ভাবে বললো, — আমাকে কি ম্যাচের কাঠি মনে হয়, ঘষে ঘষে শুধু এখানে সেখানে আগুন লাগাবো।

— তুমি তার চেয়েও ডেনজারাস! আমার তো মেজো ভাইয়ের জন্য টেনশনই হয়।

— তো! এই টেনশন আগে কোথায় ছিলো। রাজি হয়ে যাও আপু, রাজি হও প্লিজ ! বলে বলে পেছনে পেছনে ঘুরতে ঘুরতে মুখে তো ফেনা তুলে ফেলেছিলে। এখন এসেছে আবার ঢং করতে।

ইউসুফ হাসলো! তখনি উমর আর আলি হোসেন এসে বসলো। উমর ভ্রু নাচিয়ে বললো, — কিসের ঢং?
— সেটা তোমার না জানলেও চলবে! এটা আমার আর দিলশাদ আপুর সিক্রেট।

এবার হামিদা বানু মুখ খুললো! বিরক্ত মুখে বললো,
— আপু কিরে হারামজাদা! মেজো ভাবি ক।

ইউসুফ মুখ বাঁকিয়ে বললো,—- আমার যেটা ভালো লাগবে, সেটাই বলবো তোমার কি?

— হ, হ! সবই আমার কি? তোগো যা মন চায় তাই কর। আমিতো এখন ছাতার মাথা। কামের সময় কাম কইরা দুনিয়া আনধার কইরা ফালাইলাম। জীবনে কেও কিছু কইলো না। বিয়া হয় নাই দু- দিন, এহনি আদা- মশলার গন্ধ।

দিলশাদ মনে মনে হাসলো! উমর, আলি হোসেন কিছুই বুঝলো না। ইউসুফ মাথা চুলকে বললো, — কিসের মধ্যে আবার কি বলো? কিসের আদা – মশলা?

হামিদা বানু হুংকার দিয়ে বললো, —- তুই চুপ, হারামজাদা! তোর এতো কথা কিসের? ছোট ছোটর মতো থাক।

ইউসুফ হাত দিয়ে চেইন আটকানোর মতো করে মুখ বন্ধের ঢং করে বললো, — আই চুপ! এখন তুমিও চুপ। শান্তিতে খেতে দাও তো।

হামিদা বানু লাঠি তুলতে গিয়েও তুললো না। ইউসুফের আগে দিলশাদ বসা। লাঠির বাড়ি যদি আবার এই মাইয়ার গায়ে লাগে। এই তিন মাথা আবার বাড়িতে আগুন লাগায়ে ফেলবো। সে রাগে ফুঁসতে লাগলো।

দীপা, সাবিহা সবাইকে খাবার তুলে দিলো! তারা অবশ্য নিজেরা বসলো না । আহান, আহাদ আছে। কেও একজন তাদের কাছে থাকতে হয় । রাতে প্রায় সব সময় উমরই থাকে। সকালে দুপুরে যাই থাক রাতে সে আর উমর এক সাথেই খায়।

তবে আজ আছে রুবিনা । রুবিনা একা খাবে নাকি। তাই দীপা বসলো না। উমর অবশ্য কয়েকবার চোখ দিয়ে ইশারা দিয়েছে। দীপা দেখেও দেখলো না। এক সংসারে থাকতে গেলে অনেক কিছুই মেনটেইন করতে হয়।

সবার শেষে আসলো উসমান! হামিদা বানু তাকে দেখে মুখ বাঁকালো। উসমান ভ্রু কুঁচকে তাকালো! তবে ওতো গা করলো না। এই বুড়ির মাথা খারাপ! এটা আর নতুন কি?

খাবার পরে সবাই চলে গেলেও দিলশাদ বসে রইলো! দীপা, রুবিনা, সাবিহা খেলো। তাদের সাথে গল্পও করলো। খাবার শেষে তাদের হাতে হাতে সব গুছিয়ে রাখলো।

দীপা সম্ভবতো বুঝলো! ছোট বোন তার, হারে হারে চিনে। তবে রুবিনা খুশি হয়ে গেলো। বাড়ির সব বউরা এভাবে থাকলে দেখতেও ভালো লাগে ।

সব কাজ শেষে দিলশাদ দীপার সাথে তাদের রুমেই গেলে। আহান, আহাদের সাথে অনেকক্ষণ খেললো! এরা অনেক রাতে ঘুমায়। ঘুম না আসা পর্যন্ত তাদের সাথেই থাকলো।

উমর স্বাভাবিক, তার কোন মাথা ব্যথা দেখা গেলো না। কিন্তু দীপা আড়ালে মুখ টিপে হাসলো। মনে মনে বললো,— আহা রে বেচারা উসমান ভাই! তোমার অনেক ধৈর্য্যর পরীক্ষা দিতে হবে ।

দিলশাদ রুমে সামনে আসলো বারোটারও পরে। এসে অবাক হলো, তার রুমের দরজা খুলছে না।

সে কয়েকবার দরজার নব ধরে ঝাকাঝাকি করলো। ফলাফল শূণ্য! সে অনায়াসেই বুঝলো কার কাজ ।

সে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলো। ভ্রু কুঁচকে উসমানের দরজার দিকে তাকালো। সেটা চাপানো। মনে মনে কয়েকটা ভয়ংকর গালি দিলো। দিয়ে সোজা হেঁটে গেলো। দিলশাদ কে তুই কি মনে করিস ব্যাটা। এতোই সোজা!

সে আসলো ছাদে ! এসে ভালো ভাবে দরজা ভেতর থেকে লাগালো। এই ব্যাটার ভরসা নেই। এখানেও আসতে পারে।
সে আশে পাশে তাকালো! গেইটের লাইটের আলো কিছুটা ছাদে এসেছে। তা না হলে পুরোই অন্ধকার। তার একটু ভয় ভয় করতে লাগলো। হাজার হলেও অর্ধেক রাত। মোবাইলটা থাকলে অবশ্য এতো ভয় করতো না। সেটা খাওয়ার সময় রুমেই রেখে এসেছিলো।

সে আস্তে আস্তে ছাদের এক কর্নারে গিয়ে দাঁড়ালো! আবহাওয়া গুমট! এ বছরে এখনও বৃষ্টি শুরু হয়নি। ইশ! বছর কতো তাড়াতাড়ি ঘুরে। এ সময় গত বছরাটা অন্যরকম ছিলো। আর এ বছর কতোটা ভিন্ন।

সে চোখ বন্ধ করলো! বন্ধ করতেই মনে হলো পেছনে কেও এসে দাঁড়িয়েছে। আর কে, সে জানে। সে বড় একটা নিশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো,— আপনি আমার আগেই ছাদে ছিলেন?

উসমান মৃদু হাসলো!
— হুম!
— আইডিয়াটা ভালো ছিলো।
— বুদ্ধিমতি বউর সংস্পর্শে আসছি ! আইডিয়াতো ভালো হবেই।

দিলশাদ ঘুরলো! ঠোঁটে ঠোঁট চেপে সোজা তাকালো। সেই দিনের মতোই তাদের মাঝে দূরুত্ব এক হাতের। তবে সেই দিন দিলশাদের চোখে মুখে ছিলো ঢং। আজকে অবশ্য তেমন কিছুই নেই! তবে কঠিন হওয়ার চেষ্টায় আছে।

উসমান হাসলো! হেসে বললো,—- তোমার ওই চোখে খুন হই বারে বারে।

দিলশাদ কিছু বললো না! এই ফাজিল লোক আস্তে আস্তে কোন দিকে যাবে সে জানে। সুন্দরী মেয়ে আর নতুন বউ সামনে থাকলে ছেলেদের সব চিন্তা এক জায়গায়ই এসে শেষ হয়।

সে আড়চোখে দরজার দিকে তাকালো। খোলা থাকলে এক দৌড়ে চলে যাওয়া যেতো। কিন্তু গাধামি সে নিজেই করেছে। উপরে নিচে সব লাগিয়েছে।

উসমান দিলশাদের মনোভাব বুঝলো। বুঝে হালকা হাসলো! হেসে বললো, — দাদীকে কি বলেছো?

দিলশাদ অবাক হওয়ার ঢং করে বললো,— কি বলবো?

— সেটাইতো জানতে চাচ্ছি।
— আমি কিছু জানি না।
— আচ্ছা? দাদী যেন কি বললো! আদা, মশলা। রুমেও নাকি নিচ্ছি না।

দিলশাদ ভেংচি কাটলো!

উসমান এবার হেসে ফেললো! মুখ ভরা হাসি। হেসে আরেকটু কাছে আসলো। ঝুকে বললো, —- দেখি কোথায় কোথায় গন্ধ।

দিলশাদ সরে গেলো! উসমান অবশ্য নড়লো না। সে বুকে হাত বেঁধে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো । দাঁড়িয়ে বললো, — ধরলাম না, ছোঁলাম না, বদনাম ঠিকিই হয়ে গেলাম। মাইর খাওয়ার ভালোই ব্যবস্থা করেছো।

দিলশাদও এবার হেসে ফেললো! খাবারের পরে হামিদা বানু যে উসমানকে ডেকে রুমে নিয়েছে সে দেখেছে।

উসমান নীরব তাকিয়ে রইলো! এই মেয়ে যতোবারই হাসে, সে ততোবারই প্রেমে পড়ে। সে শান্ত ভাবে বললো, — দিলশাদ!

দিলশাদ কিছু বললো না। ফিরে তাকালো।

— কাওকে ভালোবাসতে বুঝি কারণ লাগে?

দিলশাদ স্বাভাবিক ভাবেই বললো,—- আমি জানি না।
— তাহলে খুঁজছো কেন?
দিলশাদ কিছু বলতে পারলো না। সত্যিই কি সে খুঁজছে।

উসমান এগিয়ে দিলশাদের সামনে আসলো। চোখে চোখ রেখে বললো,—- আমি যেমনি দিলশাদ, ভালো কি বা খারাপ। এই দুনিয়ায় কেওই সাধু না। আমিও না। এই খারাপ মানুষটাকে যখন ভালোবেসেই ফেলেছো। তাহলে স্বীকার করার জন্য এতো কারণ খুঁজছো কেন? আমাকে ভালোবাসো শুধু এইটুকু অনুভব করো। তাহলেই দেখবে সব কিছুই ঠিক। পাগলের মতো তোমাকে এই ভালোবাসার মানুষটাও ঠিক।

— হয়তো ঠিক! তবে মারামারা, গুন্ডামি এসব আমার একদম পছন্দ না। আপনি যা করছেন ওগুলাই আমাকে কারণ খুঁজতে বাধ্য করছে।

উসমান নিশ্চুপ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। সব বলে বোঝানো যায়। তবে ভালোবাসা না। সেটা অনুভব করতে হয়। দিলশাদ যদি বুঝতে না পারে তাহলে আর কিছুই করার নেই।

সে বড় একটা শ্বাস ফেললো! ফেলে আস্তে করে দরজার দিকে এগিয়ে গেলো। গিয়ে সব লক খুললো! খুলে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে আবার বললো, —- তুমি যেমন আমি তোমাকে ঠিক সেই ভাবেই ভালোবাসি। আমাকেও ঠিক সেই ভাবেই ভালোবেসো দিলশাদ। আমি তোমার জন্য অপেক্ষা করবো । আজীবন! আমার মন আর রুমের দরজা সব সময় খোলা থাকবে। যখন তোমার ইচ্ছে হয়, তখনি এসো। বলেই উসমান চলে গেলো।

দিলশাদ সেখানেই দাঁড়িয়ে রইলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে হেসে ফেললো! ইশ! ছেলেরা এতো পটাতে পারে। কি ভাবে মন গলাতে হবে ঠিক জানে। সে দাঁড়িয়েই চোখ বন্ধ করলো। গুমট ভাবটা কাটছে। মৃদু বাতাস তার গায়ে লাগছে।

সে নিচে আসলো অনেকটা সময় পরে! দ্বিধা দন্ড এতো সহজেই বুঝি শেষ হয়। সে তার রুমের দিকে তাকালো। এখন দরজা খোলা! কিন্তু সে সেখানে গেলো না। দাঁড়ালো উসমানের দরজার সামনে এসে । আলো জ্বলছে তবে দরজা আগের মতোই চাপানো। তার বুক টিপটিপ করছে।

সে কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা হালকা ধাক্কা দিলো। দরজা খুলতেই সে স্তব্ধ হয়ে গেলো। তার মনে হলো, সে দাঁড়িয়ে আছে তাদের সেই ছোট্ট ফ্ল্যাটের তার নিজের রুমের সামনে। যেখানে তার জীবনের সবচেয়ে সুখের মূহুর্তগুলো কেটেছে। সেই সুখের মুহুর্তগুলো ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই বুঝি উসমানের এতো আয়োজন।

দিলশাদের চোখে পানি এসে গেলো। কি দেখেছে সে, যে এতো ভালোবাসতে হবে। সব কিছু উজার করে দিতে হবে। এই ভালোবাসার বিনিময়ে সে কি দেবে। কি আছে তার।

উসমার দরজার সাইডেই হেলান দিয়ে দাঁড়ানো। তার ঠোঁটের কোণে হাসি। বিশ্ব জয় করার হাসি। সে সেই হাসি নিয়েই বললো, — কোন কান্দুনি বুড়িকে আমার রুমে ঢুকতে দেবো না। আমার রুমে আসতে হলে, সব চোখের পানি বাইরে রেখে আসতে হবে।

দিলশাদ কিছু বলতে পারলো না। সে দৌড়ে গিয়ে উসমানকে ঝাপটে ধরলো।

উসমান প্রথমে থমকে গেলো। পরক্ষণেই হেসে ফেলো। হেসে সেও দিলশাদকে দু- হাতে আগলে ধরলো। ধরে শূণ্য তুলে ফেললো! পা দিয়ে ঢেলে দরজা লাগিয়ে ফিসফিস করে বললো,— সব দোষ তোমার দিলশাদ, সব দোষ তোমার। তোমাকে দেখলেইতো আমি বেসামাল। সেখানে বুকের ভেতরে চলে এসেছো। এর দায়ভার কিন্তু সব তোমার।

চলবে……