দর্পণ পর্ব-৩৮+৩৯+৪০

0
140

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৮

দীপা দিলশাদের দরজার সামনে এসে অবাক হলো। দরজা খোলা। খোলা মানে চাপিয়ে রাখা। সে অবাক হয়েই ভেতরে আসলো! রুমে কেও নেই।

আজকেও কি উসমানের সাথে ঘুরতে গেছে নাকি? কি জানি! আজকে অবশ্য আর ওতো টেনশন হলো না। কালকে এসে সে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলো। বলতে গেলে ঘাড়ের উপরে চাপিয়ে বিয়ে। যে জেদি মেয়ে। এসে না দেখে তো আঁতকেই উঠেছিলো। রাগ দেখিয়ে কোথায়ও আবার চলে টলে গেলো কি না। সে দৌড়ে গিয়ে উমরকে ঘুম থেকে টেনে তুলেছে।

উমর অবশ্য অতো টেনশন করেনি। সে স্বাভাবিক ভাবেই বলেছে । আগে উসমানকে দেখো সে রুমে আছে কি না।

দীপা এসে দেখে সত্যিই নেই। তার রুমের দরজাও চাপিয়ে রাখা । তবুও তার ভয় কমলো না। তাকে দেখে উমর হেসে বললো, — আগের কথা ভিন্ন ছিলো দীপা। এখন দিলশাদ উসমানের বউ। অন্য রুমে থাকুক আর যাই থাকুক। উসমান তাকে কোথাও যেতে দেবে না। আমরা তিন ভাই আর যাই থাকি নিজেদের জিনিস কিভাবে আগলে রাখতে হয় তা ঠিক জানি।

দীপা মুখ বাঁকিয়ে বলেছে, — হয়েছে! এসেছে আমার তিন ভাই। আকাম করতে উস্তাদ, আবার এতো গর্ব। এখন তাড়াতাড়ি উসমান ভাইকে ফোন দাও।

উমর হেসে সাথে সাথেই ফোন দিয়েছে। দিয়ে ভ্রু নাচিয়ে বলছে, ” কি ঠিক বললাম তো।

দীপা মনে মনে একটু হাসলো। আজকে অবশ্য সে সব হাবিজাবি মাথায় আসলো না। রাগ থাকুক আর যাই থাকুক। সে এইটুকু বুঝেছে, দিলশাদও উসমান ভাইকে অনেক পছন্দ করে। তা না হলে এতো সহজে বিয়েতে রাজি হতো না। তাই এতো সকালে কোথাও গেলে উসমান ভাইয়ের সাথেই গেছে।

সে বাইরে এসে দরজা লক করলো। মেয়েটার ঘুমে কি সমস্যা হয়েছে কে জানে। রাতে যতো দেরিতেই ঘুমাক উঠে পড়ে খুব ভোরে। আলোও ঠিক মতো ফোটে না, সেই ভোরে। সব সময় এমন হলে সমস্যা ছিলো না। সমস্যা হলো বাবা, মা চলে যাওয়ার পরে থেকে এই সমস্যা হয়েছে। ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে কিনা সে ঠিক বুঝতে পারছে না। উমরের সাথে কথা বলতে হবে।

সে দরজা লক করে ঘুরতেই দেখে উসমান দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে অস্বস্তির ছাপ। দীপার ভ্রু কুঁচকে গেলো। উসমান এখানে তো দিলশাদ কই?

সে একটু এগিয়ে চিন্তিত হয়ে বললো, — তুমি এখানে, দিলশাদ কই? আমিতো ভাবলাম তোমার সাথে।

উসমান হালকা হাসলো! হেসে মাথা চুলকালো। দীপা তার ভাবি হলেও উসমান তার সাথে সেভাবে কখনও ওতো ফ্রি হয়নি। তাও সমস্যা ছিলো না। সমস্যা হলো সে তার ভাবির হওয়ার সাথে সাথে দিলশাদের বড় বোনও।

উসমান গলা হালকা ঝেড়ে ঠিক করে বললো,— ভাবি হালকা পাতলা কিছু নাস্তা দেওয়া যাবে?

দীপা হা হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো! সে বলে কি আর উসমান বলে কি? সে তবুও মাথা নাড়লো! এভাবে তো আর উসমান কখনও নাস্তা চায় না। তার সকালে কাজ থাকলে, নাস্তা না করেই বেড়িয়ে যাবে। তবুও কাওকে কখনও বিরক্ত করে না। আর তাকে তো অবশ্যই না।

সে মাথা নেড়ে বললো, —- আমি এক্ষুণি নিয়ে আসছি। বলেই সে যেতে নিলো।

উসমান আস্তে করে বললো,—- দিলশাদ আমার রুমে ভাবি।

দীপা থমকে তাকালো! তবে সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিলো। সামলে কোন রকম বললো, —- আমি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি। বলেই হনহনিয়ে সোজা চলে এলো নিজের রুমে। রুমে এসেই সে হেসে ফেললো। উসমানের অস্বস্তির ব্যাপার টা এখন বুঝতে পারলো।

উমর কম্বলের ভিতর থেকে মাথা বের করলো! দীপাকে হাসতে দেখে বললো, —- কি ব্যাপার আমার মহারাণী? এই সাত সকালে একা একা হাসছো কেন?

দীপা উত্তর দিলো না! দুষ্টুমি করে ভেংচি কাটলো!

উমর হাসলো! হেসে বললো, —- এদিকে আসো! এতো দূর থেকে ভেংচিটা ভালো করে দেখতে পারিনি।

দীপাও হাসলো! হেসে বললো,—- বুড়ো হয়ে গেছো বুঝেছো? পাওয়ার টওয়ার সব শেষ। মানে চোখের! এজন্যই দেখো নাই। তা না হলে ঠিক দেখতে।

— আচ্ছা?
— হুম।
— ভালো, বলেই উমর ঝট করে উঠে দাঁড়ালো! তাকে উঠে দাঁড়াতে দেখে দরজা খুলে দীপা দৌড় দিলো। তা না হলে এই অসভ্য লোক তাকে এখন আটকে ফেলবে। কতো কাজ বাকি।

— এখন পালাচ্ছো কেন?

দীপা সে কথার উত্তর দিলো না। আবারো ভেংচি কাটলো। সে ড্রইং রুমে এসে পরেছে। কথা বললে এখন সবাই শুনতে পাবে।

উমরও আর কিছু বললো না! তবে হাসলো! হেসে ইশারায় বললো, — তোমার খবর আছে! আমি বুড়ো না?

দীপা ইশারায় আবারো বললো, — বুড়ো! বলেই হেসে কিচেনে চলে এলো। কাজের লোকেরা নাস্তার সব আয়োজন করছে। সে আর সেদিকে গেলো না। ঝটপট ডিম পোচ করে পাওয়ারুটি টোষ্ট করে ফেললো। সেগুলো ট্রেতে রেখে গ্লাসে জুস ঢেলে মুক্তার হাতে ধরিয়ে বললো, —- তাড়াতাড়ি উসমান ভাইয়ের রুমে দিয়ে আয়।

উসমান রুমে এসে দিলশাদের কপালে হাত রাখলো।জ্বর এখন কিছুটা কম তবে ছেড়ে যায়নি ।

সে রুমাল ভিজিয়ে কপালে রাখলো! শেষ রাতে দিলশাদের শরীরের তাপে তার ঘুম ছুঁটে যায়। তাকিয়ে দেখে কাঁথা গায়ে জড়িয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছে। সে ঝট করে উঠে বসেছে! জ্বর কেন এসেছে সে বুঝতে পারছে।

সে তখনি দিলশাদকে টেনে বসালো! দিলশাদ চোখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ফেললো। তবে জ্বরের ঘোরে কিছু বলতে পারলো না। সাইডে তাদের জামা কাপড় ছিলো, সেখান থেকে তার টি- শার্ট নিলো। নিয়ে দিলশাদের গায়ে দিয়ে দিলো। যে থ্রিপিস এই মেয়ে পরে তা গায়ে পরানো তার পক্ষে সম্ভব না।

থ্রিপিসের কথা মনে হতেই সে হেসে ফেললো। এই মেয়ে একটা আস্ত পাগল। সেই বেসামাল মুহুর্তেও সে তার জামার টেনশনে মরে যায়। চোখ মুখ ফুলিয়ে বলে, — আমার এতো সুন্দর জামাটা আপনি ছিঁড়তে পারলেন?

উসমানও তখন দ্বিগুণ তেজ নিয়ে বলেছে, — ছিঁড়েছি ভালো করেছি। এতো ফিটিং জামা কেও পরে। আগের সব জামা বাদ। আর একটাও যেনে গায়ে দিতে দেখি না। ফিটিং জামা পরে পরে ছেলেদের মাথা খারাপ করা।

— কার মাথা খারাপ হয়েছে শুনি?
— প্রমাণ তো তোমার সামনেই! আর কার কার কথা শুনতে চাও।

— কি! আপনি এসব দেখতেন? কতো খারাপ আপনি? এজন্যই তো বলি এতো তাকাতাকি কেন? আমি সত্যিই আপনার চোখ গেলে দেবো। না জানি আর কি কি দেখেছেন।

উসমান তখন হেসেছে! কানে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেছে, —- হ্যাঁ দেখেছিতো! জানতে চাও কি কি দেখেছি?

দিলশাদ অবশ্য সে কথার উত্তর দিতে পারেনি। দু- হাত দিয়ে ঠেলে দূরে সরিয়েছে। আর লজ্জায় মুখ লুকিয়েছে। মুখে যতোই পটর পটর করুক। উসমান এখন জানে। এই মেয়েটা যে কতো লজ্জা পেতে জানে।

সেই লজ্জা রাঙা মুখটাই উসমান রাত ভরে দেখেছে। মুগ্ধ হয়েছে। অবশ্য দিলশাদের সব কিছুই তাকে মুগ্ধ করে। এই যে কথায় কথায় গাল ফুলানো, আগুন চোখে তাকানো, ভেংচি কাটা আর এখন যোগ হয়েছে লজ্জা রাঙা মুখ। যতো বার দেখে ততোবারই সে বিমূঢ় হয়ে যায়।

দরজার টোকায় উসমানের ধ্যান ভাঙলো ! মধুর স্মৃতি গুলো হয়তো এমনি হয়। বার বার সেই স্মৃতিতে হারিয়ে যাওয়া যায়।

সে এগিয়ে গেলো। দরজা হালকা খুললো। মুক্তা নাস্তা হাতে দাঁড়িয়ে আছে। সে এগিয়ে গিয়ে নাস্তা হাতে নিলো। মুক্তা চলে যেতেই নাস্তা রেখে দিলশাদকে আবার টেনে তুললো!

দিলশাদ বিরক্ততে চোখ মুখ কুঁচকে বললো,— সমস্যা কি আপনার? বার বার এমন টেনে হিঁচড়ে তুলছেন কেন?

উসমান হাসলো! কিছু বললো না। সে তার পাশে বসে শক্ত করে হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরলো! তা না হলে এই মেয়ে আবার শুয়ে পড়বে।

দিলশাদ শুয়ে না পড়লেও উসমানের কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। মাথা ভার হয়ে আছে তার। সোজা রাখতে কষ্ট হচ্ছে।

উসমান নাস্তা তুলে মুখের সামনে নিয়ে বললো, — হা করো।

দিলশাদ এবার হালকা চোখ খুললো! খুলে মুখের সামনে পাওয়ারুটি দেখেই হাত দিয়ে ঠেলে সরালো। সরিয়ে বললো,— আমি এখন খাবো না।

উসমান কোমল ভাবে বললো, — বেশি খেতে হবে না। একটু খাও! খেয়ে ঔষুধ নাও। তা না হলে সুস্থ হবে না।

— আমার সুস্থ হতে হবে না। সরেনতো!

উসমান এবার কঠিন ভাবে বললো, —- দিলশাদ! আর একটা কথাও না। হা করো!

দিলশাদ মুখ ফুলিয়ে আগুন চোখে উসমানের দিকে তাকালো! কি ফাজিল লোক। তোর জন্যই আমার এই অবস্থা। একবার খালি সুস্থ হয়। তোর তেজের আমি দফারফা করবো।

উসমান হাসলো! হেসে জোর করে খাবার মুখে ঢুকিয়ে বললো,— এভাবে তাকিয়েও না দিলশাদ! ভেতর মুচড়ে উঠে। আমি এমনিতেই তোমার আগুনে জ্বলে পুড়ে শেষ। চোখের আগুন আর কি করবে।

ইউসুফ চেয়ার টেনে বসে আশে পাশে তাকালো! তাকিয়ে বললো, —- দিলশাদ আপু কই? নাস্তা করবে না।

উসমান খুক খুক করে কাশলো! তবে কিছু বললো না। বললো দীপা, —- দিলশাদ এখনও উঠেনি। তুমি নাস্তা করো।

ইউসুফ ভ্রু কুঁচকে বললো, —- আপুতো খুব ভোরে উঠে। আজ ঘুমাচ্ছে! আপু ঠিক আছে তো?

দীপা হাসলো! হেসে বললো, —- তোমার আপু একদম ঠিক আছে। টেনশন করো না। নাও তাড়াতাড়ি নাস্তা খাও। কলেজে যাবে না?

ইউসুফ মুখ ভোঁতা করলো! বললো, —- পড়ালেখা আর ভালো লাগছে না ভাবি! বোর হয়ে যাচ্ছি! চলো সবাই মিলে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।

উমর ইউসুফের পিঠে থাবা মারলো! মেরে বললো, — আইডিয়া খারাপ না! দু- ভাবিকে পটাতে থাক। কি বলিস উসমান?

— হুম! এক সাথে সেভাবে তো কখনও কোথাও যাওয়া হয়নি। গেলে খারাপ হয় না।

— কি খারাপ হয় না। বললেই হলো! বাচ্চারা ছোট, ইউসুফের কলেজ, দিলশাদ ক্লাসে না যাক পড়া তো আছে। আর এটা কি ঘুরে বেড়ানোর সময়? একটায় একটা কিছু বললেই হলো, বাকি দু- জনও পুতুলের মতো মাথা নাড়তে থাকে। দীপা প্রায় ধমকে বললো।

উমর বড় একটা শ্বাস ফেলে ইউসুফের দিকে তাকিয়ে বললো, — এজন্যই তো বললাম দু- ভাবিকে পটা। আমাদের সমস্যা নেই।

ইউসুফ আফসোসের ভঙ্গি করে মাথা দোলালো ! তবে এখন আর কিছু বলার সাহস হলো না। তার দু- ভাবি হচ্ছে বিদ্যাসাগরের চেলা। পটাবেই বা কিভাবে?

চলবে…..

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৩৯

দিলশাদের ঘুম ভাঙলো এগারোটারও অনেক পরে। সে উঠে অবাকই হলো। ইশ! কতোদিন পরে সে এভাবে বেলা করে ঘুমালো।
সে আস্তে আস্তে উঠে বসলো! জ্বর নেই তবে মাথা ভারী হয়ে আছে। তখন উসমান ঠেলে ঠুলে পুরো নাস্তাই শেষ করেছে। করে ঔষুধ খাইয়ে গায়ে কাঁথা টেনে কোমল সুরে বলেছে, ” ঘুমাও।

দিলশাদ অবশ্য কোন দ্বিমত করেনি। সে চুপচাপ শুয়ে পড়েছে। সে এমনিতেই চোখ টেনে খুলতে পারছিলো না, তার মধ্যে উসমান আবার ধীরে ধীরে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে। কখন ঘুমিয়ে গেছে বুঝতেই পারেনি।

সে উঠে বাথরুমে গেলো! বাথরুমে যেতেই আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই হেসে ফেললো! তার গায়ে উসমানের টি শার্ট। এক টি শার্টেই জামা, পায়জামার কাজ হয়ে গেছে। জামা পায়জামা কথা মনে হতেই তার খেয়াল হলো। এই রুমে তার জামা কাপড় নেই। ধুর! বলেই দিলশাদ দরজা আবার খুললো! খুলতেই উসমান কে দেখলো!

সে মাএই রুমে এসেছে। তাকে দেখেই দিলশাদের মেজাজ খারাপ হলো। ব্যাটা ফুল বাবু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। বলতে গেলে এই লোক সারা রাতই নির্ঘুম। বসে বসে দিলশাদের মাথায় জল পট্টি দিয়েছে। এই নির্ঘুম রাতের তিল পরিমাণও রেশও তার মধ্যে দেখা গেলো না। বরং চোখ মুখ উজ্জল! খুশিতে যেন চিকচিক করছে।

উসমান এগিয়ে এসে বাথরুমের সামনে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো! দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তার জীবনে সকাল এসেছে হাজার বার। এমন মিষ্টি, সুন্দর, স্নিগ্ধমাখা সকাল কি আর এসেছে?

দিলশাদ বিরক্ত মুখে কিছুক্ষণ টি শার্ট নিচের দিকে টানাটানি করলো। পা বেড়িয়ে আছে তার অস্বস্তি হচ্ছে। তারপর অস্বস্তি লুকানোর জন্য এগিয়ে গিয়ে ধরাম করে উসমানের মুখের উপরই দরজা লাগিয়ে দিলো।

উসমান হাসলো! তবে কিছু বললো না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার মাঝেই দিলশাদ আবার দরজা খুললো। উসমানকে সেই জায়গায়ই দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে রাগে ঠোঁটে ঠোঁট চপলো। চেপে ধাক্কা মারলো! মেরে সাইড দিয়ে চলে যেতে নিলো।

উসমান হাত দিয়ে পেটে আঁকড়ে উঁচু করে আবার ঠিক সামনে নিয়ে আসলো।

দিলশাদ প্রথমে হা হয়ে গেলো ! তারপর বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো,

— সমস্যা কি?
— তুমি!
দিলশাদ বিস্ময়মাখা কন্ঠে বললো, — আমি?
— হুম! আমার সব সমস্যা কারণ তুমি। একবার নিজেই ভালোবাসার সম্মতি দাও। আবার নিজেই পালটি মারো। আবার নিজেই দৌড়ে বুকের মাঝে আসো, আবার নিজেই দৌড়ে পালাও।

দিলশাদ নির্বিকার ভাবে বললো, — আমি এমনিই! এই আমি ভরা সমস্যাকে নিয়ে সমস্যা হলে, সমস্যাকে ধাক্কা দিয়ে দূরে ফেলে দিন। ঝাপটে ধরে আছেন কেন?

দিলশাদের চুল এলোমেলো হয়ে আছে! উসমান হাত দিয়ে গুছিয়ে দিতে দিতে বললো, — আমি এই সমস্যা কেই ভালোবেসেছি, ভালোবাসি, সারা জীবন ভালোবাসতে চাই।
— ভালো! এখন ছাড়েন।

— ছাড়েন না আমার দিল! বলো ছাড়ো।

দিলশাদ ভ্রু উঁচিয়ে তাকালো! তাকিয়ে বললো, — বদহজম হবে আমার! একদিনে পোলাও, মাংস, ভাত, মাছ, দই, মিষ্টি সব ঠেলে একদিনেই খাওয়াতে চান নাকি ?

— হ্যাঁ ! ঘুরালেতো কম না। আর কতো? এখন আমার সব চাই।

— সরেনতো, আমি ফ্রেশ হবো! ঐ রুমে যাবো।

— ফ্রেশ হওয়ার জন্য ঐ রুমে যেতে হবে কেন? এই রুমে বাথরুম নেই?

— বাথরুম আছে! তবে আমার জামা কাপড় নেই।
অবশ্য আপনি চাইলে আবারো আমি আপনার টিশার্টই পরতে পারি। পরে পুরো বাড়ি ঘুরতে পারি। এতে আপনার দাদী, ফুপু হার্ট এ্যাটাক করলে আমার দোষ নেই।

উসমান দিলশাদের ঘাড়ে মুখ রাখলো! ইশ! শরীরটা এখনও হালকা গরম।
সে গালের সাথে গাল মিলিয়ে বললো, —- এক আমার সামনেইতো অস্বস্তি, লজ্জায় শক্ত হয়ে আছো। আবার পুরো বাড়ি ঘুরবে?

— কে বললো? কোন দিনও না। শরীর আর এমন কি? মাটির দলা। এখন মরলে কিছুক্ষণ পরেই পচে গলে গন্ধে একাকার । তাকে নিয়ে আবার এতো ঢং। এই ঢং দিলশাদ করে না।

— আচ্ছা?

— হ্যাঁ ! অবশ্যই।

— তাহলে কে যেন কালকে দু- হাত দিয়ে মুখ ঢেকে বললো, ” বাতি নেভান প্লিজ, বাতি নেভান।

দিলশাদের এবার রাগ হলো! উসমানকে দেখে দিলশাদের সত্যিই লজ্জা লাগছে। আর এই ফাজিল লোক ঠিক বুঝেছে। বুঝে ইচ্ছে করে তাকে আরো লজ্জা দিচ্ছে। সে রেগে হাত উঁচু করে উসমানের চুল টেনে ধরতে চাইলো।

উসমান হেসে ফেললো! হেসে বললো, — আর্মি কাটিং দেওয়া, চুল পাবে কোথায়?

দিলশাদ মুখ ফোলালো! উসমান মৃদু হেসে দিলশাদের সেই ফোলা গালে গভীর ভাবে ঠোঁট ছোঁয়ালো! ছুঁয়ে বললো,—- কাল রাত থেকে তোমার সব কিছু আমার হয়ে গেছে দিলশাদ । তোমার এই লজ্জাও। তাই এতো কষ্ট করে লুকানোর দরকার নেই।

দিলশাদ কেঁপে উঠলো। চোখ বন্ধ করে খিঁচে রইলো। অসভ্য ফাজিল লোক। সব এতো বুঝতে হবে কেন?

উসমান সেই কাঁপনও ঠিক টের পেলো। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। তারপর হেসে বললো — তুমি ফ্রেশ হতে যাও, আমি কাপড় নিয়ে আসছি। বলেই দিলশাদকে ছেড়ে দিলো। দিয়ে বেড়িয়ে গেলো।

বেড়িয়ে যেতেই দিলশাদ হাঁফ ছাড়লো। সে নিজের অবস্থা দেখে নিজেই অবাক হচ্ছে। আশ্চর্য! এতো লাজুকপাতা সে কবে হলো?

দিলশাদ ফ্রেশ হয়ে বাইরে আসলো! দীপা দেখে স্বাভাবিক ভাবেই বললো, —- সকালের নাস্তাই দেবো, নাকি ভাত খাবি?

দিলশাদ চেয়ার টেনে বসতে বসতে বললো, —- ভাতই দাও! এখন আর রুটি, পরোটা খেতে ইচ্ছে করছে না।

দীপা সব এগিয়ে এনে দিলো! রুবিনাও কিচেনে ছিলো। মুখ বাঁকিয়ে বললো, — এখন কি তুমি মেহমান? বারোটায় ঘর থেকে বেরুচ্ছো। এসে বড় বোনকে ফরমায়েশ করছো। দীপা যে মায়া করে, তার অর্ধেকও তো মনে হয় তুমি করো না। ছোট ছোট দু- বাচ্চা নিয়ে খেঁটে যাচ্ছে। একটু হাত বাটাতেও তো পারো।

দিলশাদ কিছু বললো না! সে খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। তবে বললো দীপা! সে শান্ত ভাবে হালকা হেসে বললো, —- আপনার একটু ভুল হয়েছে ফুপু। আমার ছোট ছোট দু- বাচ্চা না। চারটা! দিলশাদ, ইউসুফ, আর তাদের পরে আহান, আহাদ। দয়া করে আমার সামনে আমার কোন বাচ্চাকে হেয়ও করে কিছু বলবেন না। আমি আমার সব চুপচাপ হজম করবো। তবে আমার বাচ্চাদের ব্যাপারে কিছু না।

রুবিনা আর কিছু বললো না! হাতে চামচ ছিলো! ঠাস করে রেখে হনহনিয়ে কিচেন রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।

হামিদা বানু রুবিনার যাওয়ার দিকে অবাক হয়ে তাকালেন! সে মাএই রুম থেকে বেরুচ্ছিলো। তার শরীলটা ভালো যাচ্ছে না। তাই আজ সকাল থেকে আর বের হয়নি। নাস্তাও খেয়েছে রুমে! এখন আর ভালো লাগছিলো না। তাইতো বেড়িয়ে এলো। এক রুমে এতো বসে থাকা যায়?

সে সোফায় বসতে বসতে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বললো,— ওই ছেমরি রুবিনার কি হইছে?

দিলশাদ খেতে খেতেই উত্তর দিলো —- ছ্যাঁকা খেয়েছে দাদু!

— হ্যায় হ্যায় কয়কি! কেমনে?

— আগুনে দাদু! জেনে বুঝে হাত দিয়েছে। ছ্যাঁকা তো খাবেই।

হামিদা বানু বিরবির করলো ! এই মাইয়াও না। দেইখা শুইনা কাজ করবো না।

তখনি উসমান রুম থেকে বেড়িয়ে আসলো! তার কাজ আছে। দিলশাদের জন্য সকাল বেলা বের হয়নি। এখন সে অনেকটাই সুস্থ। সে বাইরে যেতে যেতে একবার দিলশাদের দিকে তাকালো। সে আপন মনে খাচ্ছে। উসমানের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুঁটলো! এই হাসি তৃপ্তির, স্বস্থির, ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার।

হামিদা বানু ভ্রু কুঁচকে উসমানের যাওয়া দেখলো! সে যে এখানে বসা এই বান্দায় মনে হয় দেখেও নাই। দেখবো কেমনে? নয়া বউ চোখের সামনে। ডানে বামের হুস আছে। সে আবার চেঁচিয়ে বললো,— এই ছেমরি উসমান আজকে এতো দেরিতে গেলো ক্যা। শরীল ভালো না।

দিলশাদের খাওয়া শেষ! সে উঠে বেসিনে হাত ধুয়ে হামিদা বানুর পাশে এসে বসলো। তা না হলে এই এই ছেমরি, এই ছেমরি বলে বলে চেঁচাতেই থাকবে। সকাল থেকে বন্ধ ছিলো এইতো কতো। তাইতো বলি এতো শান্তিতে এতো বেলা পর্যন্ত কিভাবে ঘুমালাম।

সে বসে বললো, — তা আমি কিভাবে বলবো দাদু? সে তো আমাকে বলে কয়ে আসে যায় না।

হামিদা বানু বিরক্ত মুখে বললো, —- যায় না কেন? কেমন বউ তুমি? দীপারে দেহো। জামাইরে আঁচল দিয়া বাইন্ধা রাখছে। তুমি পারো না কেন? এতো পড়া লেখা জাইনা লাভ হইলো কি? জামাইরে কিভাবে হাত করতে হয় তাইতো জানো না।

দিলশাদ ঢং করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, —- পারি না তো দাদু! কিভাবে পারবো বলেন, যে ঘ্যাড়তেড়ার ঘ্যাড়তেড়া। ডানে বললে বামে যায়। বামে বললে যায় ডানে।

হামিদা বানু মাথা নাড়লো! মনে মনে বললো, — কথা অবশ্য সত্য। এইডার ঘাড়ের রগ সত্যিই তেড়া। সে নিজেও উসমাইনারে কিছু বলতে গেলে দুই বার ছাড়া তিন বার ভাবে।

সে মাথা নেড়ে বললো, —- হইছে! আজ বললা, বললা। এর পরে যেন মুখে এসব না শুনি। জামাই যেমনই হোক। জামাইগো মাথায় করে রাখতে হয়। বুঝছো। আর আমার নাতিরা তো সোনার টুকরা।

দিলশাদ মনে মনে ভেংচি কাটলো। হুহ্! সোনার টুকরা না ছাই।

— জামাই বাসায় আইলে আশে পাশে দিয়া ঘুরবা। বুঝছো। রং ঢং করবা। রং ঢং পারো তো নাকি? না আবার আমারেই শিখাইতে হইবো।

দিলশাদ নাদান বাচ্চার মতো দু- পাশে মাথা নাড়লো! যার অর্থ না।

— যাক কিছুতো পারো। আজকাল মেয়েরাও জামাইরে গনায়ই ধরে না। এহন যাও! গিয়া সুন্দর কইরা একটা শাড়ি পরো তে। এই সব কামিজ টামিজ কোন কাপড় হলো। একটা কথা মনে রাইখো, যতো হাবিজাবি ই পরো। বেডাগো আসল মাথা খারাপ তো শাড়িতে দেখলেই হয়।

দিলশাদ হেসে ফেললো! তখনি ধপ করে ইউসুফ তার পাশে বসলো। সে কলেজে গিয়েছিলো। এই মাএই আসলো।
দিলশাদ ভ্রু কুচকে বললো, —- কয়টা বাজে? এতো তাড়াতাড়ি এলো কেন? ফুল ক্লাস করোনি?

— আরে ধুর রাখো তো। শুধু পড়া আর পড়া।

— তো কি করবো? বউ এনে দেবো। যেনো বউ বউ করতে পারো।

— হ্যাঁ! তোমার ঐ বোনটাকে নিয়ে এসো। কোলে পিঠে পেলে নেবো।

দিলশাদ ইউসুফের কান টেনে ধরলো! ধরে বললো, — দুনিয়ার আর কোন মেয়েকে তোরা চোখে দেখিস না। আমরা সব বোনেরা কি এক বাসায়’ই এসে মরবো।

— আসলে সমস্যা কি! আমাদের তিন ভাইয়ের মতো আর কাওকে পাবে?

— এটা সত্য, পাবো না। তোমরা তিন ভাই হচ্ছো কালের বিবর্তনে হারিয়ে যাওয়া ডাইনোসর। তা কি আর ইচ্ছে হলেই খুঁজে পাওয়া যায়?

ইউসুফ হাসলো! হেসে বললো, —- ডাইনোসরের বোন, বউ, ভাবি এদের কি বলে বলোতো আপু। তুমিতো আবার সব জান্তা। তোমার মুখ থেকেই শুনি।

দিলশাদ মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে বললো, — যা ভাগ।

— আচ্ছা যাও ভাগছি। তার আগে আমার একটা আবদার রাখো।

— কিসের আবদার?

ইউসুফ হাসলো! মন ভোলানো হাসি।
দিলশাদ অবশ্য ভুললো না! তাকে ভোলানো এতো সোজা নাকি। সে ভ্রু উঁচিয়ে নির্বিকার তাকিয়ে রইলো। তারপর বললো, — এই হাসি ফাসিতে দিলশাদ ভুলে না। ডাইরেক্ট কাজের কথায় এসো।

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৪০

ইউসুফ দীপার পেছন পেছন ঘুরছে। এখন না প্রায় অনেক্ষণ ধরেই। দীপা যেদিকে যাচ্ছে, গুনগুন করতে করতে সেও সেই দিকে যাচ্ছে।

দিলশাদকে সে গলাতে পারেনি। সে শুনে হাই তুলে নির্বিকার ভাবে বলেছে, তার এখন অনেক কাজ। ভার্সিটিতে একবার যেতে হবে। কিছু নোট কালেক্ট করতে হবে। পায়েল অবশ্য সব পড়া, ভার্সিটির সকল আপডেট দিচ্ছে । তবুও একবার তার নাকি যেতেই হবে। হোস্টেল ছাড়তে হবে। তার বইটই জিনিসপএ সব আনতে হবে। তাই এখন ঘুরতে যেতে টেতে সে পারবে না।

দিলশাদের পেছনে গুনগুন করতে তার আর সাহসে কুলোয়নি। তাই এসেছে দীপার কাছে। এই এখন শেষ ভরসা। তবে শক্ত ভরসা! এ একবার রাজি হলে কারো সাধ্য নেই মানা করার।

দীপা বিরক্ত হলো! সে রান্না চড়িয়েছে। কাজের লোক সব করে টরে দিলেও, রান্নাটা সে নিজে হাতেই করে। উমর এরা ছোট বেলা থেকে মায়ের, দাদীর, ফুপুর হাতের রান্না খেয়ে অভ্যস্ত। কাজে লোকে রান্না করলে এরা অবশ্য কিছুই বলবে না। খাবার নিয়ে খুঁত ধরা এদের অভ্যাসে নেই। তবে দীপার ভালো লাগে। প্রিয় মানুষদের জন্য এইটুকুই যদি না করতে পারে তবে কিইবা করলো। তাই কষ্ট হলেও নিজেই করে।

সে কোমরে হাত রেখে ইউসুফের দিকে তাকালো। বললো, —- গালে থাপ্পড় বসাবো ইউসুফ। পেছন পেছন ঘুরছো কেন?

ইউসুফ গাল পেতে বললো, — নাও মারো! তবুও রাজি হয়ে যাও।

— কিসের রাজি! এখন কি ঘুরে বেড়ানোর সময়?

— ঘুরে বেড়ানোর জন্য কোন সময় লাগে না ভাবি। মন চাইলেই হয়।

— সেটাইতো তো! মন কি চাইছে আমাদের?

— তোমাদের না চাক, আমার তো চাইছে। আমার জন্য এতোটুকু করতে পারো না।

— না, পারিনা! এখন যাও গোসল করো। তোমার ভাইয়েরা কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে পড়বে। খাবার খাবে।

ইউসুফ গেলো না! মুখ ফুলিয়ে দাঁড়ালো। বললো, — হ্যাঁ ! তা পারবে কেন? হাজার হলেও দেবর। নিজের আপন কেও হলে সব পারতে।

দীপার হাত থেমে গেলো। সে অবাক হয়ে তাকালো। সাথে সাথেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলল। এটা দেখেছিস?

ইউসুফ দীপার হাতের দিকে তাকালো। তার হাতে লম্বা এক চামচ। সে বিন্দু মাএও ভয় পেলো না। সে ভালো করেই জানে দুনিয়া উল্টে গেলেও ভাবি তার গায়ে হাত তুলতে পারবে না । তবে দিলশাদ আপু হলে চিন্তার বিষয় ছিলো। তার দ্বারা সব সম্ভব।

— আরেক বার এসব বলেছিস না। ছাল, চামড়া সব তুলে নেবো ফাজিল!

— তাহলে রাজি হচ্ছো না কেন?

— যাবি এখান থেকে, না সত্যিই বাড়ি মারবো।

ইউসুফ মন খারাপ করে চলে এলো। তার সব আশা শেষ। তবে তার মন খারাপ অবশ্য বেশি সময় স্থায়ী হলো না। দীপা খারাপ টেবিলে উমরকে বললো, —- চলো আশে পাশে কোথাও থেকে ঘুরে আসি। বেশিদিনের জন্য না। এই এক – দু দিন।

ইউসুফ নেচে উঠলো! তবে হামিদা বানু তেঁতো উঠলো, —- এই ছোট ছোট বাচ্চা নিয়া কিসের ঘুরাঘুরি। মাথা খারাপ হইছে তোমার?

দীপা কিছু বললো না। অবশ্য হামিদা বানুর কোন কথায় দীপা কখনও কিছু বলে না। বয়স হয়েছে! বাড়ির মুরব্বি। তাই সে চায় না শেষ সময় এসে মনে কোন কষ্ট নিয়ে যাক।

দীপা কিছু না বললেও, উমর বললো, —– কেন সমস্যা কি? আম্মা আছে, ফুপু আছে আর আমরা তো আছিই।

দুপুরের ঘটনা থেকে রুবিনার মুখ ভার! তাই সুযোগ পেয়ে সেও ছাড়লো না। মুখ কালো করে বললো,— আমারে কেও গনায় টনায় ধইরো না। আমি কালই ছেলের ওখানে চলে যাবো। পরের বাড়ি বোঝা হয়ে আর কতোদিন থাকবো? এখন আর সেই দিন নাই। এখন ভালো বললেও আমরা খারাপ। যখন যার মুখে আসে তাই বলে। তাই বাপু আমি আর এই সবে নাই।

তার কথায় কারোই কোন প্রতিক্রিয়া হলো না। শুধু হামিদা বানু ধমকে বললেন, — ক্যা যাবি কা? এডা তরও বাড়ি। এই বাড়িতে বাকি সবাই বোঝা হইতে পারে তবে তুই না।

সুন্দর ভাবে সুখের সাথে তাল মিলিয়ে দশ জন থাকলেও গায়ে লাগে না। তবে সুখের মধ্যে বেঘাৎ যে সৃষ্টি করে, সে যতোই প্রিয় হোক ধীরে ধীরে তার প্রতি তিক্ততা এসেই পরে। রুবিনা ক্ষেএেও তাই হয়েছে। সে অবাক হয়ে সবার দিকে তাকালো!

উসমান এখনও বাসায় আসে নি। আলি হোসেন, সাবিহা খেতে বসে নি। তারা আহান, আহাদের সাথে সোফায় বসা। সোফা তো খাবার টেবিল থেকে বেশি দূরে না। তারা যেমন শুনেছে, তেমনি বাকি সবাইও শুনেছে। তবে কেও কিছুই বললো না।

রুবিনার চোখে পানি এসে গেলো! সে কথার কথায় বোঝা বলেছে । তবে তার মনে হলো, এখন এই বাসায় সত্যিই সে বোঝা। শুধু যে এখানে তা না। নিজের ছেলেদের বাসায়ও। তার ছেলেরা তাকে বড় মুখ করেই নিয়েছিলো। বউর বাচ্চা হবে, মা না থাকলে হয়। তবে কিছুদিন যেতেই তারা অসহ্য হয়ে গেলো। তারা এই যুগের ছেলে মেয়ে। এটা করবে না, ওটা করবে না। এসবে তারা বিরক্ত। অবশ্য মুখে কেও কিছুই বলে নি। তিনি বুঝেছেন এখানে এসে। কথা ছিলো আকিকার অনুষ্ঠান দু- দিন পরে আবার যাবে। কিন্তু তার ছেলেরা আর আগ্রহ দেখায়নি। এমনকি ফোন করে আর যেতেও বলেনি। যেন এখানে আসাতে তারা বেঁচে গেছে।

সে খাবার রেখে উঠে যেতে চাইলো! থামলো দীপার কথায়।

দীপা খেতে বসেনি! সবাইকে এগিয়ে দিচ্ছে। সে রুবিনার প্লেটে তারকারি দিতে দিতে বললো, —- এটা কেমন হয়েছে দেখেনতো ফুপু! দিলশাদ রান্না করলো। সে ওতো রান্না টান্না তেমন পারে না। আমার মতোই। আমিওতো বিয়ের পরে তেমন রান্না বান্না পারতাম না। সব আপনার কাছেই তো শিখলাম। এখন দিলশাদের পালা। দিলশাদের পরে ইউসুফের বউ আসবে। আপনি চান আর না চান। এতো সহজে আমরা আপনার পিছু ছাড়ছি না।

রুবিনা দীপার দিকে অবাক হয়ে তাকালো! কিছুক্ষণ আগে চোখে পানি থাকলেও এখন বিস্ময়! অথচো এই মেয়েটাকে সে কতো কটু কথা বলেছে।উঠতে, বসতে খুঁত ধরেছে। উপরে কিছু না বললেও তার ধারণা ছিলো, দীপা তাদের দেখতে পারে না। সুযোগ পেলেই আগাছার মতো তাদের ছেঁটে ফেলবে। সে, তার মা যতোই বড় গলায় কথা বলুক আসলে সংসারটা তো দীপারই।

দিলশাদও খেতে খেতে ঢং করে বললো — আজকাল মেয়েদের তো চেনেন না ফুপু! তারা কাজ টাজ তো ভালোই, রান্নার ধারের কাছেও যায় না। যতোই খুঁজেন আমাদের দু- বোনের মতো আর একটাও পাবে না। তাই আরো খেয়ে দেয়ে পরিপুষ্ট হোন। ইউসুফের কপালে না জানি কি আছে? তার বউ মানুষ করতেও তো আপনাকে দরকার। তাই যাওয়া টা আরে দশ বারো বছর পরে হলে ভালো হয়। তাহলে আমরা একটু নিশ্চিন্ত হতাম আর কি।

রুবিনা ঠোঁট চেপে কঠিন চোখে দিলশাদের দিকে তাকালো! তবে কঠিন চোখে তাকালেও তা শুধু উপরে। এই প্রথম এই মেয়ে দু- টির জন্য তার অন্য রকম অনূভূতি হলো।

উমর, আলি হোসেন মনে মনে হাসলো! এই সংসার নিয়ে তাদের আর কোন টেনশন নেই। এরাই সব সামলে নিতে পারবে।

ইউসুফ মাথা চুলকালো! চুলকে বললো, — বাবাগো তোমাদের কথা শুনে আমার তো বিয়ের কথা চিন্তা করতেই ভয় লাগছে। না জানি কপালে কোন শাকচুন্নি আছে। না বাবা না! বিয়ে টিয়ের মধ্যে আমি নেই।

সবাই হেসে ফেললো! রুবিনা না হাসলেএ তার মন থেকে পাথর নেমে গেলো। দিলশাদ হাসতে হাসতে ইউসুফকে ইশারা করে ফুপুকে দেখালো। তারপর হালকা ঝুকে ফিসফিসিয়ে বললো, —- টেনশন নট ইয়ার, ফুপু ইজ হিয়ার।

উসমান আসলো সন্ধ্যার ও পরে। এটা অবশ্য নতুন না। সে প্রায়ই দুপুরে বাসায় থাকে না। সে একবার ড্রইং রুমের দিকে তাকিয়ে সোজা নিজের রুমে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে গেলো।

সে প্রথমে ভেবে ছিলো ভাবি। এ রকম সুতির শাড়ি শুধু ভাবিই পরে। দিলশাদ যে পরবে তার কল্পনারও বাহিরে ছিলো। সে পলক ফেলতে ভুলে গেলো। উসমানের মনে হলো ওখানে বাসন্তী রঙের শাড়ি পরা দিলশাদ বসা না। বাসন্তী রঙের একটা ফুল ফুঁটে আছে।

হামিদা বানু মুখ বাঁকালেন ! বাঁকিয়ে বললেন, বুড়ি বইলা কেও দাম দেইনা। এহন দেহ কথা কেমনে ফলে। আজকাল মেয়েরা শাড়ির নামই শুনতে পারে না। শাড়ি পরতে বললে এমন ভাব, যেন শাড়ি না গলায় ফাসি পরতে বলসে। এহন দেহো, সে ঝাঁঝের সাথে বললো, —- কিরে কি হইছে, এমন তবদা খাইয়া দাঁড়ায় আছো ক্যা?

হামিদা বানুর কথায় উমর, ইউসুফ, দিলশাদ তিনজনেই ঘুরে তাকালো। তাদের তির মাথা ছিলো একখানে। তারা প্ল্যান করছে, কি করে কি করা যায়। এতো গুলো মানুষ। তাছাড়া প্রথমে ঠিক করে ছিলো আশে পাশে কোন রিসোর্টে যাবে। তবে ইউসুফ গো ধরলো। সে কক্সবাজার যাবে। তা না হলে নেই। পরে আর কেও দ্বিমত করেনি।

উমর ঠিক করেছে প্লেনে যাবে। তা না হলে এতো লং জার্নি বাচ্চাদের কষ্ট হবে। তাছাড়া বাবা আছে, তার বয়সও হয়েছে। তাই এটাই ভালো হবে। দাদী অবশ্য যাচ্ছে না। উমর বলেছিলো কোন সমস্যা হবে না, চলো।

দাদী রাজি হয়নি! পানি দেখার জন্য এতো টাকা খরচ করে কষ্ট করে যাওয়া তার কাছে বিলাসিতা। সে এই বিলাসিতায় সায় কখনও দেবে না। তবে সবাই রাজি দেখে কিছু বলেও নি। তবে সে যাবেও না। যে কয়দিন তারা ওখানে থাকবে সে জসিমের কাছে চলে যাবে।

হামিদা বানুর কথায় উসমানের সম্বিৎ ফিরলো। ফিরতেই থতমতো খেয়ে গেলো। বড় ভাই, ছোট ভাইকে দেখে সে একটু লজ্জায়ই পেলো। নিচু হয়ে নাকটা হালকা চুলকে বিব্রত ভাবে একটু হাসলো। হেসেই হনহনিয়ে নিজের রুমে চলে গেলো।

তারা তিনজন তার যাওয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো। তারপর ইউসুফ আর দিলশাদ একে অপরের দিকে তাকিয়ে ঠোঁট ওলটালো। যার অর্থ, এর আবার কি হলো?

তবে উমর মনে মনে হাসলো! এই দু- গাধায় না বুঝলেও সে ঠিক বুঝেছে। উসমান আসলে ঝটকাটা কেন খেয়েছে।

দিলশাদ রুমে আসলো কিছুক্ষণ পরেই। তার হাতে নাস্তার ট্রে। আপু দিয়ে পাঠালো। সে নাস্তার ট্রে টিটেবিলে রেখে খাটে বসলো। উসমান ওয়াশরুমে! সম্ববতো গোসল করছে। দিন নেই, রাত নেই শুধু গোসল আর গোসল। এতো গোসল করতে এই বান্দার কেমন লাগে কে জানে?

তখনি দিলশাদের সাইডে চোখ গেলো। খাটের কর্নারে একটা ব্যাগ রাখা। এটা উসমান এনেছে তখন সে দেখেছে।
সে হাত বাড়িয়ে কাছে আনলো। তখনি উসমান বেরুলো! দিলশাদ অবশ্য সেই দিকে ফিরেও তাকালো না। সে নিজের মতো ব্যাগের ভেতরের জিনিস বের করলো। পুরো একসেট গহনা। সে দেখেই আগের মতো রেখে দিলো।

উসমান আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে মাথা মুছতে মুছতে বললো, — পছন্দ হয়নি?
দিলশাদ ঢং করে বললো, — আমাকে বলছেন?
— তুমি করে বলোনা দিলশাদ। আপনি শুনতে শুনতে কান পচে যাচ্ছে।

দিলশাদ মুখ বাঁকালো! উসমান হাসলো! হেসে নিজেই এগিয়ে এলো। দিলশাদের পাশে বসতেই দিলশাদ স্প্রিংয়ের মতো দাঁড়িয়ে গেলো। এই লোকদের ভরসা নেই। অসভ্যের হাড্ডি। সে চলে যেতে নিলো।

উসমান শাড়ির আঁচল টেনে ধরলো। দিলশাদ রাগি চোখে ফিরে তাকালো। উসমান হেসে বললো, — ঢং করে রাগ দেখাতে হবে না। বসো!

— আমি ঢং করি?
— হ্যাঁ! অবশ্যই। ঢং করে করেই তো আমার মতো ভালো মানুষের মাথাটা খারাপ করেছো।

দিলশাদ বসলো! উসমানের গা খালি! অস্বিস্তির জন্য এতোক্ষণ তাকায় নি, এবার তাকালো। তাকিয়ে বললো, — আমার নামে আপনার আর কতো অভিযোগ আছে। বলুন! আজকে সব বলুন। দেখি আর কি কি করেছি আমি আপনার?

উসমান হাসলো! একটু এগিয়ে ব্যাগ থেকে নাকফুলটা বের করে পরাতে পরাতে বললো — আমার পুরো স্বত্তায় তুমি বিরাজ করো। এই স্বত্তা যখন আলাদা হয়ে যাবে। তখন আমি শেষ হয়ে যাবো। আবার এই যে আমার জন্য প্রথম তুমি শাড়ি পরলে। আমার ভেতরের অনূভূতি কি, তুমি কি জানো? তুমি এখন চাইলে আমি হেসে হেসে নিজেকে নিজে শেষ করে দিতে পারবো। এখন তুমিই চিন্তা করো দিলশাদ। কি করেছো তুমি।

চলবে……