দর্পণ পর্ব-৪১+৪২+৪৩

0
114

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৪১

দিলশাদ আয়নার দিকে তাকালো! তার গায়ে হালকা বেগুনি রঙের গোল জামা। তার সাথে ম্যাচিং করে কানে ছোট্ট পাথরের এয়ারিং। খোলা চুল! মুখে হালকা মেকাপ। শুধু লিপস্টিক দেওয়া বাকি।
সে লিপস্টক হাতেই এক ধ্যানে আয়নার দিকে তাকিয়ে রইলো। অনেক দিন পর সে নিজেকে একটু সাজালো। সাজানো তো ভালোই এই দের বছরে আয়নার দিকে ভালো করে খেয়ালও করেছে কি না সন্দেহ। আয়নার দিকে তাকালেই বাবা, মার কথা মনে পরে। সে যে তার বাবার কার্বন কপি।

তার ধ্যান ভাঙলো উসমানকে দেখে। সে তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। ভোঁতা মুখে গায়ে পারফিউম স্প্রে করছে। দিলশাদ অনেক কষ্টে হাসি চাপালো।

তারা বর্তমানে আছে কক্সবাজার, হোটেলের সুইট একটা রুমে। আজকে সকালে তারা কক্সবাজার এসেছে। দিলশাদ এর আগে প্লেনে চড়েনি। তবে প্রথম বার হিসেবে তার খুব একটা ভালোও লাগে নি। যার সিটে যে যার মতো। তখন তার মনে হলো গাড়িতে আসলেই ভালো হতো। এক সাথে সবাই হইহই করে আসা যেতে। প্লেনে বসলে এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় অনায়াসেই উড়ে আসা যায়। তবে আসল উড়ার আনন্দ হয়তো মাটিতেই।

তারা এখানে এসেছে সকাল এগারোটার দিকে। রুম আগেই বুকিং দেওয়া ছিলো। হালকা নাস্তা করার পর উমর ভাইয়া বললো, —- কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়া যাক। তারপরে ঘুরতে বের হবো। সেই ভাবেই যে যার রুমে চলে গেলো।

রুমে আর কি? বউ একা পেলে ছেলেদের মাথায় আর কি ঘোরে । তার সব আশায় পানি ঢেলেছে দিলশাদ। সে করুণ মুখে তার সমস্যার কথা বলেছে। সেটা বলতেই উসমান আকাশ থেকে পড়ার মতো করে বললো, — এটা তুমি আমাকে এখন বলছো?

— তো?

— তো আবার কি? কোন দুঃখে তুমি এই অবস্থায় এতো লং জার্নি করতে গেলো। সকালে বললেই দু- দিন পরে আসা যেতো। ইমারজেন্সির তো কিছু ছিলো না।

— তো?

উসমান রেগে গেলো! রেগে বললো —- তো তো করছো কেন?

দিলশাদ হেসে ফেললো! রাগের জাহাজ একটা। হেসে ঢং করে আবার বললো, — তো?

উসমান ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো! কি করবে সে এই মেয়ের। তার রাগ, জেদের কোন ধারই ধারেনা। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছে, – তুমি মিথ্যা বলছো না তো?

দিলশাদের এতোক্ষণ করুণ মুখ ছিলো। এবার কাঁদো কাঁদো হয়ে এমন ভাবে তাকালো! যার অর্থ এটা বলতে পারলেন আপনি?

উসমান হাল ছেড়েছে। বলেছে, — সমস্যা নেই! তবুও এমন ভাবে তাকিয়েও প্লিজ, আমার কলিজা ছিঁড়ে যায়।

দিলশাদ সাথে সাথেই হেসেছে। সে কি আর কারো কলিজা ছিঁড়তে পারে?

সকালের কথা মনে হতেই দিলশাদ ঠোঁট চেপে হাসলো। সে সত্যিই মিথ্যা বলেছে। বললে বলেছে! সে কোন জনমেই সত্যবতী ছিলো। দিলশাদকে বিয়ে করার সাধ বুঝো এখন হুহ্!

সে লিপস্টিক দেওয়ায় মনোযোগ দিলো। লিপস্টিক দিয়ে একবার হা করলো, একবার পাউট করলো, একবার একটু হেসে বাঁকা করে তাকালো। এই সব তার নতুন না। সাজার সাথে সাথে হাজার রকমের ঢং করা দিলশাদের পুরোনো অভ্যাস।

উসমানের হাত থেমে গেছে। সে পারফিউম হাতে নিয়েই হা করে তাকিয়ে আছে। দিলশাদকে দেখতে এতো মিষ্টি লাগছে। সে পলক ফেলতে ভুলে গেলো। সে তো আর এতো কিছু জানে না । তার কাছে সব নতুন। এ যে একঘন্টা ধরে এই মেয়ে আয়নার সামনে বসে আছে। এটা করছে, ও টা করছে। জামা ই চেঞ্জ করেছে তিনবার। পুরো রুমে এটা ওটায় ছড়াছড়ি।

তার বিরক্ত লাগার কথা, অথচো লাগছে না! বরং তার দেখতে ভালো লাগছে। এমনকি গত এক ঘন্টা যাবত সে এই মেয়ের আশে পাশে দিয়ে ঘুরছে। আর কি করছে, না করছে খুব মনোযোগ সহকারে দেখছে। এই মেয়ে তাকে নির্ঘাৎ জাদু করেছে। তা না হলে এতো পাগল সে কি করে হলো?

দীপা আয়নার নিজেকে দেখে নিজেই অবাক হলো। তার গায়ে হালকা গোলাপি রঙের একটা গোল জামা। সে ভেবেছিলো ভালো লাগবে না। বাচ্চা হয়েছে, আগের চেয়ে একটু মোটাও হয়েছে। তবে সে দেখে অবাক হলো। তাকে দেখতে ভালো লাগছে।

সে বিয়ের পরে আর জামা, টামা পরেনি। শাড়ি পরেছে । এখনও অবশ্য পরতো না। এই জামা দিয়েছে দিলশাদ। সে কক্সবাজার আসবে বলে দুনিয়ার শপিং করেছে। শুধু নিজের জন্য না সবার জন্য। উসমান ভাইকে এই মেয়ে দু- দিনেই ফকির করে ফেলবে।

সে দেখে অবাক হয়ে বলেছে, ” এইগুলো আমাকে দিচ্ছিস কেন?

— কেন আবার পরার জন্য।

— আমি কি আর এগুলো এখন পরি?

— কেন? শাড়ি পরার জন্য স্টাম্প পেপারে সাইন করেছো। যে বিয়ের পরে শাড়ি ছাড়া অন্য কিছু পরতে পারবে না।

দীপা হেসে বলেছে, — সে রকম কিছু না। পরি না! এখন পরলে অন্য রকম লাগবে।

— আমি তো সেই অন্য রকম টাই চাই। তাছাড়া বাসায় পরার জন্যতো দিচ্ছি না। ঘুরতে গিয়ে পরবে। ভাইয়া অনেক দিন শান্তিতে আছে। তার শান্তি আমার সহ্য হচ্ছে না। তাই এগুলো পরে ছোট খাঁটো মিনি সাইজের একটা হার্ট অ্যাটাক আমার পক্ষ থেকে তুমি দেবে।

— তুইও না দিলশাদ! যা তো! তুই পরে ফেলিস।

— না! একদম না।

— যাবি?

— না!

— অযথা জেদ করছিস কেন? আর আমি ঘুরতে গিয়ে শাড়ি থেকে জামা পরি, তুই কি পরবি? জামা থেকে জিন্স, টপস।

— ইচ্ছে হলে পরবো সমস্যা কি? তবে দাদু গেলে গ্যারান্টি পরতাম। জিন্স, টপস পরে তার সামনে দাঁড়ালে। উফ্! তার রিয়েকশন! আমি তো কল্পনা করেই শিউরে উঠছি।

দীপা হেসে ফেললো! হেসে বললো,— এত্তো ফাজিলের ফাজিল তুই। যাতো!

দিলশাদ গেছে, তবে ব্যাগগুলো নিয়ে যায়নি। রেখে যেতে যেতে বলেছে। তুমি পরবে আপু, অবশ্যই পরবে। তা না হলে খবর আছে তোমার।

দীপা হাসলো! সে অবশ্য নিজেও ভাবেনি পরবে। তবে এখানে এসে তার নিজেই ইচ্ছে হলো।
সে বাথরুম থেকে বেরোলো! আশ্চর্য! তার লজ্জা লাগছে। উমর অবশ্য এখনও খেয়াল করেনি! সে আহান, আহাদ কে রেডি করছে। দীপা নিজেই করাতে চেয়েছিল। কিন্তু উমর দেয়নি! সে বলেছে, ” যে কয়দিন এখানে আছো সব কিছু থেকে তোমার ছুটি।

দীপা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়ালো! নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। কাজল নিয়ে চোখে দেওয়ার জন্য নিচু হতেই তার দৃষ্টি আয়নার ভেতর দিয়েই উমরের উপর পড়লো । পড়তেই হেসে ফেললো!
উমরের হাতে বাচ্চাদের জামা। সেই জামা হাতে নিয়ে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে! ছোট খাঁটো একটা হার্ট অ্যাটাক তার সত্যিই হয়ে গেছে।

দীপা হেসে ফেললো! তখনি দিলশাদ এসে দরজায় ধরাম ধরাম করে দু- টো দিলো। এই মেয়েও না! বলেই দীপা দরজা খুললো। খুলতেই চোখ, মুখ আকাশে তুলে দিলশাদ বললো, — এখনও হয় নি তোমার বলেই ঢেলে ভেতরে ঢুকলো। উমরের দিকে ফিরেও তাকালো না। নিজেই হুড়মূড় করে দীপাকে রেডি করালো। করে টেনে সোজা নিয়ে এলো। সেই যে এলো। এখনও তাকে ছাড়েনি! তার বাহু জাপটে ধরেই বাচ্চা মেয়েদের মতো ঘুরছে। আর ঐদিকে শুধু উমর না, বেচারা উসমানও মুখ ফুলিয়ে বসে আছে।

এই মেয়ে যে এক ঢিলে দু- পাখি মারছে, সে ঠিক জানে। উমরতো ভালোই, আহারে উসমান ভাই! তাকে নিয়ে তার টেনশনই হয়। কি বউ যে সে সেঁধে নিজের ঘাড়ে নিয়েছে সে নিজেই জানেনাই না। এই মেয়ে যাদের দেখতে পারে না, তাদের সাথে কথা বলবে গলে যাওয়া মমের মতো। আর জ্বালিয়ে মারবে প্রিয় মানুষদের।

তখনি ইউসুফ আসলো! সে এসেছে পর থেকে পানিতে। তাকে দেখে আহান, আহাদকে ধরে রাখা মুসকিল । তারাও পানিতে নামবে। উমর, উসমান অনেক কষ্টে দু- টোকে সামলাচ্ছে।

দীপা এগিয়ে যেতে চেয়েছিলো। দিলশাদ টেনে ধরে বলেছে। ছাড়োতো! বাপ, চাচারা আছে না। এতোদিন পরে কোথাও ঘুরতে এসেছো ইনজয় করোতো।

দীপা আর নড়েনি। এই মেয়ে যে আজকে তাকে সহজে ছাড়বে না। সে খুব জানে। রুবিনা, সাবিহা আম্মা, আলি হোসেন ছাতার নিচে বসা।

দীপা ভেবেছিলো রুবিনা ফুপু এই জামা দেখে রিয়েক্ট করবে। তবে তেমন কিছুই হয়নি। বরং তাকে দেখতে খুশি খুশি লাগছে। কিছুক্ষণ আগে সাবিহা আম্মাকে নিয়ে বাচ্চাদের মতো দু- জনে হাত ধরাধরি করে পানিতে হেঁটেছে। ইউসুফ কে দিয়ে দুনিয়ার ছবি তুলেছে। তুলে বলেছে, — এগুলো সব আমার ছেলের বউদের পাঠা। একটাও যেন বাদ না যায়। তারাও দেখুক তাদের আমার দরকার নেই।

দীপা হাসলো! হেসে ইউসুফের দিকে তাকালো।তাকাতেই ইউসুফ বললো, —- তোমরা সত্যিই পানিতে নামবে না?

দীপা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো,— না, বাবা না! আমি সাতার জানি না।

— অল্প নামো! বেশিদূরে না গেলেইতো হয়। দেখো কতো ছোট ছোট বাচ্চারাও তো নেমেছে।

— নারে ভাই দরকার নেই! যে ঢেউ, আমি এমনিতেই ঠিক আছি।

— আর তুমি?

দিলশাদ মুখ বাঁকিয়ে বললো,— আমি আবার কি?

— তুমি আবার কি মানে, নামবে না?

— অবশ্যই নামবো! তবে তোমার ভাই আর আমি প্রাইভেটে প্রাইভেটে। এখন যাও ভাগো! আশে পাশে এতো সুন্দর সুন্দর মেয়েরা। এখনও তো একটা পটাতেও পারলে না। সব ঠিক আছে তো?

দীপা ঠোঁটে ঠোঁট চেঁপে দিলশাদের হাতে হালকা থাপ্পড় দিলো। এই মেয়ের মুখে কিছুই আটকায় না।

দিলশাদের অবশ্য কিছু এলো গেলো না। তবে ইউসুফ হেসে ফেললো ! হেসে হালকা পানিতে নেমে ভেজা বালি ছুঁড়ে মারলো।

দিলশাদ, দীপা দু- জনেই মাখামাখি হয়ে গেলো। তাদের নতুন জামা শেষ।

দীপা হেসে ফেললো! দিলশাদ আঙ্গুল তুলে শাসিয়ে বললো, —- তোর খবর আছে রে ইউসুফ! সত্যিই আছে। আজকে, কালকে লাঞ্চ, ডিনারে শুধু বালি আর বালি। বালি ছাড়া তুই দু- চোখে কিছুই দেখবি না দেখিস।

ইউসুফ এই হুমকিতে ভয় পেলো বলে মনে হলো না! সে এগিয়ে এসে দুই- ভাবিকে টেনে হাঁটু পানিতে নামালো। দীপা ভয়ে শেষ। সে দিলশাদকে আঁকড়ে ধরলো।

উমর সেই আঁকড়ে ধরা দেখলো। দেখে মুখ ভোঁতা করে উসমানকে বললো, —- এই তুই আমার ছেলেকে রাখ। রেখে নিজের বউয়ের কাছে যা। বউ রেখে আমার সাথে লেপটে আছিস কেন?

উসমান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, —- সোনা দিয়ে বাঁধানো কপাল আমার, তাই।

দীপা, দিলশাদ, ইউসুফ হোটেলে ফিরে এলো। ফ্রেশ হয়ে আবার যাবে। ডিনার করে একেবারে ফিরবে।

দীপা রুমে এসে জামা, কাপড় বের করলো। করে বাথরুমে যাবে। তখনি দরজায় টোকা পড়লো। দীপা এগিয়ে গেলো। দরজা খুলতেই হুড়মূড় করে উমর ঢুকলো। ঢুকেই দীপাকে জড়িয়ে ধরলো। দীপার জামার বালিতে উমরও বালিতে মাখামাখি হয়ে গেলো।

দীপা হেসে ফেললো! সে জানতো এই পাগল আসবে। সে হেসেই বললো, —- বাচ্চারা কই?

— বাচ্চার বাবা এখানে! তাকে চোখে পড়ে না।

— না! পড়ে না।

— আচ্ছা! তাহলে কাকে পড়ে?

দীপা উত্তর দিলো না! ঢেলে উমরকে সোজা করলো। করে বললো, — কি করলে?

উমর অবাক হওয়ার ঢং করে বললো, — কোথায় কি করলাম?

— নিজের দিকে তাকাও। পুরো বালিতে মেখে গেছো। নিজে তো মাখলে মাখলেই, পুরো রুমও শেষ। আহান, আহাদ এসে পুরো মাখামাখি হবে।

— সেই চিন্তা তোমার করতে হবে না। মাথা নষ্ট করেছো এখন ঠিক করো।

— আমি কিছু করি নি। ওটা তোমার আগে থেকেই নষ্ট।

— আচ্ছা! এসে কোন জ্বালিয়েছি বলো? ভদ্র বাবা, ভদ্র স্বামী হয়ে ছিলাম না?
বলেই উমর আরেকটু এগুলো। ফিসফিস করে বললো, —- তোমার মনে আছে দীপা। তোমার বন্ধুর বিয়েতে তুমি কিন্তু ঠিক এই রঙের জামায় ই পরে গিয়েছিলে। আমার প্রথম দেখার দীপার মতো আজকেও তোমাকে ঠিক সেই রকমই লাগছে। এতোটুকুও বদলাওনি। এই এতোটুকুও না। সেই এক দেখায় যেমন পাগল হয়েছিলাম। দেখো আজকেও ঠিক সেভাবেই হচ্ছি।

দীপা অবাক হলো! সত্যিই তো। এটাকি এমনিতেই মিলে গেছে, নাকি দিলশাদ ইচ্ছে করে করেছে। এই মেয়ের ভরসা নেই। এই মেয়ের একটুখানি মাথায় আরো কতো কিছু আছে কে জানে।

দীপা অবাক হওয়া মুখ দেখে উমর হাসলো! দু- হাতে মুখ নিয়ে বললো,— দীপা।

দীপা উমরের দিকে তাকিয়ে বললো, — হুম।

— স্যরি! সব কিছুই জন্য স্যরি। আগে ভাবতাম যা হয়েছে ভালোই হয়েছে। যদি না হতো তাহলে তোমাকে পেতাম কিভাবে?

সময়ের সাথে সাথে মানুষ বাদলায় দীপা। তোমার ভালোবাসায় আমি বদলেছি। এখন মনে হয়। তোমাকে হয়তো আরো সুন্দর ভাবে পাওয়া যেত। যদি আমার চিন্তা ধারণা অন্য রকম হতো।

আমার যদি বদলানোর ক্ষমতা থাকতো না। আমি সেই সময় গুলো বদলে ফেলতাম। যেই কষ্টের সময়গুলোর ভেতর দিয়ে আমি তোমাকে নিয়ে গেছি। তোমাকে, তোমার পরিবারকে। সেই সময়টা বদলে সব কিছু সুন্দর করে গোছাতাম। সেখানে দীপা নামের মিষ্টি মেয়েটি বিয়ের কথা শুনে লাশ হতো না। বউ সেজে তার পুরো পরিবার নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করতো। লাজুক মুখে এক সমুদ্র আনন্দ নিয়ে কবুল বলতো। তবে আমার সেই ক্ষমতা নেই দীপা। একটা মানুষকে এক সাগর দুঃখে ফেলে, তাকে যতোই সুখের চাদরে মুরিয়ে রাখা হোক, একটা আফসোসের দীর্ঘশ্বাস সারা জীবন থেকেই যায়। আমি সেই দীর্ঘশ্বাসের জন্য ক্ষমা চাইছি। সত্যিই ক্ষমা চাইছি।

দীপার চোখে টলমলে পানি, কিন্তু মুখে হাসি। সে সেই হাসি নিয়েই হাতের কাপড় ফেলে দু- হাতে উমররের গলা জড়িয়ে ধরলো। পা উঁচু করে কপালে, গালে চুমু খেলো। গালে ঠোঁট রেখেই ফিসফিস করে বললো,—- ভালোবাসি উমর। অনেক অনেক ভালোবাসি।

উমরের ঠোঁট অনেক আগেই বিস্তৃত হয়েছে। হবে না কেন? তার দীপা প্রথম বার তাকে ভালোবাসি বলেছে। তার মনে হলো পৃথিবীর কোন সুখ আর পাওয়া বাকি নেই। সে আজ পরিপূর্ণ।

সে দীপাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। তখনি দরজায় টোকা পড়লো।

দীপা হেসে ফেললো! উমর দীর্ঘশ্বাস ফেলে দীপার কাঁধে কপাল ঠেকালো! ঠেকিয়ে বললো, —- নির্ঘাৎ তোমার বোন বুঝেছো। আমার বারোটা বাঁজাতে সে খুব ওস্তাদ।

দীপা কিছু বললো না। তবে হেসে ঠেলে উমরকে দরজা খুলতে পাঠালো।

উমর করুণমুখে দরজা খুললো! খুলতেই হোটেলের বয় খুবই বিনয় ভাবে বললো, — রুম সার্ভিস স্যার! কি করতে পারি বলুন।

উমরের ভ্রু কুঁচকে গেলো! ভ্রু কুঁচকে বললো,— মানে?

হোটেলের বয় আরো বিনয়ের সাথে বললো,—- ম্যাডাম ফোন করে আসতে বললেন। কি নাকি সমস্যা?

উমর দীপার দিকে তাকালো! তাকিয়েই বললো,— তুমি ফোন দিয়েছিলে?

দীপা মাথা নাড়লো! উমর হোটেলের বয় এর দিকে তাকিয়ে বললো,— হয়তো তোমার ভুল হয়েছে। এখান থেকে কেও ফোন দেয়নি।

ছেলেটা কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো! সম্ভবতো তার ভুল হয়েছে কি না মনে করার চেষ্টা করলো। রুম নাম্বার ফরটি টুইতো বললো। তারপর সাথে সাথে বললো, —- স্যরি স্যার! হয়তো শুনতে ভুল হয়েছে। বিরক্ত করার জন্য এক্সট্রিমলি স্যরি স্যার।

উমর আর কিছু বললো না! দরজা লাগিয়ে দিলো। মুডের বারোটা বাঁজিয়ে দিয়েছে।

দীপা ভেংচি কাটলো! কেটে বললো! অনেক হয়েছে ঢং, এখন ফ্রেশ হয়ে নাও। পুরো বালিতে মাখামাখি হয়েছো। আর ঐ দিকে আহান, আহাদ কি করছে কে জানে।

উমর সে কথা শুনলো বলেও মনে হয় না। এগিয়ে ঝট করে দীপা কোলে তুলে নিলো। বেডের দিকে এগুতেই, আবার দরজায় আবার টোকা পড়লো।

উমর চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপচাপ সে ভাবেই রইলো । দীপা এবার হাসলো না! খুব কষ্টে হাসি চাপিয়ে রাখলো। উমর রেগে গেছে! সেই রাগই সামলানোর চেষ্টা করছে।

আবার টোকা পড়লো! উমর দীপাকে আস্তে করে বেডে বসালো। বসিয়ে দরজা খুললো! খুলে মাথা বের করে আবাক হলো! এই মাথায়, ঐ মাথায় কেও নেই। সাথে সাথেই তার ভ্রু কুঁচকে গেলো। একটু ভাবতেই সে হেসে ফেললো, সব রাগ গলে পানি হয়ে গেলো। মনে মনে বললো,— দিলশাদ।

চলবে…..

#দর্পণ
#নুপূর_ইসলাম
#পর্ব- ৪২

উসমান দরজায় নক করলো! সবাই খেতে গেছে। এই মেয়ের খবর নেই। ফোন দিতেই বললো, সে খাবেনা। সবাই জিজ্ঞেস করতেই বললো,— সন্ধ্যায় বিচে ফুচকা খেয়েছে, তাই খিদে পায়নি। তোমরা অযথা টেনশন করো নাতো, নিশ্চিন্তে খাও।

উসমানের গলা দিয়ে আর খাবার নামে নি। দিলশাদ ঠিক আছে তো। সে কোন রকম কয়টা খেয়েই চলে এসেছে।

সে আবার দরজায় নক করলো। করছে কি মেয়েটা?

দিলশাদ দরজার ওপাশ থেকেই বললো, — কি চাই?

উসমান স্বস্থির নিশ্বাস ফেললো! বললো — এখানে তুমি ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই, দরজা খোলো।

— না।

উসমান ভ্রু কুঁচকে বললো —- কেন?

— এমনিই।

উসমান ক্লান্ত ভাবে বললো,—- দরজা খোলো দিলশাদ। এভাবে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। কেও দেখলে কি ভাববে?

— ভাবুক! অন্যের ভাবনায় দিলশাদের কি?

— অন্যের ভাবনায় না থাক, আমায় ভাবনায় নিশ্চয়ই আছে। নাকি নেই?

দিলশাদ দরজা খুললো! পুরো রুম অন্ধকারে ডুবে আছে। উসমান ভেতরে এসে বাতি জ্বালালো! জ্বালাতেই থমকে গেলো।

দিলশাদ দরজার সাইডে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। চুলগুলো এক সাইড করে রাখা। তার গায়ে লাল টকটকে শাড়ি। পাড় নেই, কারুকাজ নেই, সিম্পল পাতলা শাড়ি। সে পাতলা শাড়ি ভেদ করে বাকানো কোমরে চিকন সোনালী একটা চেইন উঁকিঝুঁকি মারছে। উসমান নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে রইলো। এই মেয়ে তাকে বাঁচতে দেবে না।

দিলশাদ উসমানের দিকে ফিরেও তাকালো না। সে চুল হাত দিয়ে উড়িয়ে গটগট করে বেড়িয়ে গেলো। দিলশাদ যেতেই উসমানের হুশ ফিরলো। এমন মাথা নষ্ট করা টাইপ লুক নিয়ে রাতের বেলা এই মেয়ে যাচ্ছেটা কোথায়? সে তাড়াতাড়ি দরজা লক করেই দিলশাদের পেছনে ছুঁটলো। সারা জীবন কেও ঊনিশ, বিশ করলেই সে টাইট করেছে। আর এখন দেখো এই মেয়ে তাকে টাইটের উপর টাইট করে দৌড় লাগাচ্ছে। ভাবা যায়?

দিলশাদ শাড়ি উঁচু করে পানিতে পা রাখলো। তার টুকটুকে ফর্সা পায়ে সমুদ্রের ঢেউ এসে আঁছড়ে পড়তে লাগলো। সে এসেছে একটু সাইডে । এখানে মানুষের শোরগোল একটু কম। সে হাতে আঁচল পেঁচালো। বাতাসে শাড়ি সামলানো মুশকিল। তার মধ্যে আবার চুল ছাড়া। দাঁড়িয়েও থাকা মুশকিল।

হামিদা বানু থাকলে এতোক্ষণে এই বিচ মাথায় তুলে ফেলতো। চেঁচিয়ে বললো, — নয়া নবেলি বউ কোন আক্কোলে তুমি এই রাতের বেলা চুল ছেড়ে বাইরাইছো। তাও আবার লাল টকটকে শাড়ি পইরা। মাথা কি গেছে নাকি?

দিলশাদ মলিন ভাবে হাসলো! কক্সবাজারে এবার তার প্রথম আসা । ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে থাকতে সবাই মিলে কক্মবাজার আসার প্ল্যান করলো। কি যে খুশি। আকাশে দু- ডানা মেলে উড়ার মতো খুশি। বাবা, মা প্রথমে রাজি না হলেও শেষ মেষ মেয়ের খুশির কাছে হার মানলো।

মা কে নিয়ে সে দুনিয়ায় শপিং করলো। তার মধ্যে টুকটুকে একটা লাল শাড়িও ছিলো। সব বান্ধুবীরা মিলে প্ল্যান করেছিলো, লাল শাড়ি, মাথায় ফুলের ক্রাউন দিয়ে সমুদ্রের পাড়ে হাঁটবে, ছবি তুলবে, অনেক অনেক মজা করবে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য আসা হয়নি। হঠাৎ করেই দাদু মারা গেলেন। সবাইকে সেখানে যেতে হলো।

অতিরিক্ত আনন্দের ব্যাপারগুলো মানুষের কাছে খুব সহজে এসে ধরা দেয় না। হারিয়ে যায়! এই যে তার বাবা, মা। তারাই তো ছিলো তার সব খুশি, সব আনন্দ। তারাও হারিয়ে গেলো। সেই সমুদ্র, সেই দিলশাদ, সেই আনন্দ, সেই লাল শাড়ি পরার স্বপ্ন সবই পূণ্য হলো। শুধু যাদের পাশে নিয়ে স্বপ্ন গুলো দেখা তারা নেই।

দিলশাদ আকাশের দিকে তাকালো। আকাশে বেশ কয়েকটা ফানুস উড়ছে। উড়তে উড়তে সমুদ্রে দূর সীমানায় গিয়ে মিশে যাচ্ছে। মানুষের জীবটাও কি এমন না। তারা পারি দিতে চায় অথচো মাঝে এসেই নিজের অজান্তেই হঠাৎ করে বিলীন হয়ে যেতে হয়।

উসমান এসে ঠিক দিলশাদের পাশে দাঁড়ালো! দিলশাদের আঁচলে পেছানো হাত নিজের হাতের মধ্যে নিলো। দিলশাদ আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকলেও, সে তাকিয়ে রইলো তার লাল টকটকে শাড়ি পরিহিত প্রেয়সীর মুখের দিকে। হালকা আলোতে সমুদ্রের পানি চিকচিক করছে। তার সাথে চিকচিক করছে তার প্রেয়সীর চোখও।

দিলশাদ আকাশের দিকে চোখ রেখেই আস্তে করে বললো,— উসমান!

উসমান চমকালো! দিলশাদের মুখে প্রথম তার নাম। না চমকে থাকা যায়। সেও আস্তে করে বললো — হুম!

— এক্সিডেন্টের পরে আমার মা কিছুক্ষণ জীবত ছিলো। তাকে হসপিটালে নেওয়ার পরে, সেখানে একমাএ তুমি ছিলে। আমার মায়ের শেষ কি কোন কথা ছিলো?

উসমান দীর্যশ্বাস ফেললো! হাত ছেড়ে পেছন থেকে দিলশাদকে এক হাতে জড়িয়ে কাছে টেনে আনলো। দিলশাদ তাকে তুমি করে বলছে। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আগের মতোই বললো, — হুম।

দিলশাদ শরীর এলিয়ে দিলো! মাথা রাখলো বুকে, ভেজা কন্ঠে বললো, — আমার মায়ের শেষ কথা কি ছিলো উসমান?

উসমান শান্ত ভাবে বললো — দীপার সবাই আছে। আমি জানি তাকে সবাই আগলে রাখবে। আমার দিলশাদের কেও নেই, ওকে দেখে রেখো।

দিলশাদের চোখ বেয়ে টুপটাপ করে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো। গড়িয়ে উসমানের বুকের টির্শাট ভিজে গেলো। উসমান বাঁধা দিলো না। কাঁদুক! কাঁদলেই হালকা হবে।

অনেকটা সময় গড়ালো! দুপুরের পর থেকে সমুদ্রে জোড়ার ভাটা হয়। দুপুরে কমতে থাকে, রাত যতো হয় পানিও বাড়তে থাকে । তারা অল্প পানিতেই দাঁড়িয়েছিলো। এখন প্রায় হাটু পানি। দিলশাদ অনেক আগেই শাড়ি ছেড়ে দিয়েছে। পানিতে ভিজে চুপচুপে। উসমান আস্তে করে বললো,— দিলশাদ!

— হুম!
— চলো! রাত হয়েছে অনেক।
দিলশাদ কঠিন করে বললো — না!

উসমান মৃদু হাসলো! হেসে বললো, —- তাহলে কি করবে, এভাবে পানিতে দাঁড়িয়ে থাকবে?
— হ্যাঁ!
— সমুদ্র আমাদের টেনে নিয়ে যাবে।
— যাক! দু- জনে একসাথেই হারিয়ে যাবো।

উসমান হাসলো! তারছেড়া বউ তার! আসতো, বলেই উসমান দিলশাদকে সোজা করলো! হাত ধরে প্রায় টেনে আনলো।

দিলশাদ মুখ ভার করে বললো —- হোটেলে যেতে ইচ্ছে করছেনা।

— তো কি করবে, আশে পাশে দেখো মানুষ নেই বললেই চলে।

— না থাক! তুমি আর আমি থাকবো।

— এটা সেইভ না দিলশাদ। মেয়েদের জন্যতো অবশ্যই না। আমি তোমাকে নিয়ে কোন রিক্স নেবো না।

— তুমি আছো কি জন্য? পাহাড়- পর্বতের মতো শরীর। একটা মাএ বউ, তাকেও সিকিউরিটি দিতে পারো না। হুহ্! কি হয় এমন ছাতার মাথার শরীর দিয়ে।

উসমানের ঠোঁটে মুচকি হাসি! হাসি নিয়েই বললো, — রুমে চলো, তখন দেখাচ্ছি কি হয় শরীর দিয়ে। এমনিতেই তোমার দুনিয়ায় শাস্তি পাওনা। মিথ্যা বলেছো তুমি।

দিলশাদ কিছু বললো না। মুখ ভার করে অন্য পাশে তাকালো।

উসমান দীর্ঘশ্বাস ফেললো ! ফেলে ঘড়ির দিকে তাকালো! প্রায় একটা বাজে। কি করবে সে এই পাগলকে নিয়ে। এখন জোর করে নিলেও রুমে গিয়ে মুখ ফুলিয়ে রাখবে। সে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো, — আধা ঘন্টা দিলাম। এর উপরে এক মিনিটও না।

দিলশাদ মুখ বাঁকালো! বাঁকিয়ে কিটকট চেয়ারে বসে পড়লো। যখন এসেছিলো একটাও খালি ছিলো না। এখন প্রায় সবগুলোই খালি।

উসমান চেয়ারের লোক ডেকে টাকা দিলো। দিয়ে সেও দিলশাদের পাশে বসলো। সে বসতেই দিলশাদ কাত হয়ে উসমানের বুকে মাথা রাখলো। তার দৃষ্টি সামনে সমুদ্রের দিকে।

উসমানও কিছু বললো না! এক হাতে দিলশাদ কে জড়িয়ে ধরলো। সেও দিলশাদের মতো চুপচাপ সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছু কিছু সময় শব্দের প্রয়োজন হয় না। অনূভূতিরাই যেন সব বলে দেয়।

তাদের একটু দূরে একদল ছেলে বসা। অন্ধকারে কাওকে স্পষ্ট দেখা যায় না। কিছুক্ষণ পরেই সেখান থেকে গিটারের টুং টাং শব্দ ভেসে আসলো। তার সাথে পরিচিত একটা কন্ঠ। দিলশাদ চমকে উঠলো। ঝট করে পাশে তাকালো। অন্ধকারে তেমন কিছুই বুঝলো না। তবে তার মনে হলো দুটি চোখ তার উপরই নিবদ্ধ।

তখনি উসমান শান্ত ভাবে বললো,—- আরো থাকতে চাও?

দিলশাদ উসমানের দিকে তাকালো! কিছু বলতে পারলো না।

উসমান তাকালো না! সে উঠে দাঁড়ালো! উঠে দাঁড়িয়ে শান্ত ভাবে শুধু বললো,— চলো! ঝামেলা করে এই সুন্দর স্মৃতি গুলো নষ্ট করতে চাচ্ছি না। কালকে আমরা ব্যাক করছি।

_____

সকালে ইউসুফ মুখ ভোঁতা করে নাস্তার টেবিলে বসলো। আজকে নাকি চলে যাবে। মাএই তো আসলো। ধুর! অন্তত পক্ষে চার দিনতো থাকবে নাকি?

সে মন খারাপ করে কিছু বলতে চাইলো! কিন্তু দুই ভাইয়ের শান্ত মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আর সাহস হলো না। দুই – ভাইতো ভালোই তার দু- ভাবিরও মুখ আজ গম্ভীর ? ব্যাপার কি?

সে আর কিছু ভাবার আগেই উমর শান্ত ভাবে বললো, — কারো কোন কেনাকাটা বাকি থাকলে, সকালের মধ্যেই সেরে ফেলো। বিকেলে আমরা বেড়িয়ে যাবো।

— এভাবে হঠাৎ করে, কোন সমস্যা হয়েছে নাকি? আলি হোসেন জিজ্ঞাসা করলেন।

উমর হালকা হেসে বললো, — না, বাবা! কি সমস্যা হবে? আহান, আহাদের এই আবহাওয়া হয়তো সুট করছে না। রাতে জ্বর হলো, আর উসমানেরও নাকি কি কাজ পড়েছে।

— ওহ!

— আমি আগেই বলেছিলাম! বাচ্চাদের এতো দূরে নিয়ে আসার দরকার নেই। কে শুনে কার কথা। রুবিনা মাথা নাড়াতে নাড়াতে বললো।

ইউসুফ আহান, আহাদের দিকে তাকালো। তারা অতি উৎসাহে খাবার দু- হাত দিয়ে ছেনাবেনা করছে। তাদের দেখে কেও বলবে না, রাতে জ্বর হয়েছে। কোন একটা সমস্যা নিশ্চয়ই হয়েছে। সে বড় একটা শ্বাস ফেললো, ফেলে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো, —- আমি বিচ মার্কেটে যাবো, যাবে? আসার আগে কতো প্ল্যান করলাম। কতো কিছু কিনবো। কিছুতো হলো না।

দিলশাদ শান্ত ভাবে বললো—- তুমি যাও ইউসুফ! আমার ভালো লাগছে না।

— প্লিজ।

দিলশাদ তাকিয়েই রইলো! কি বলবে সে বুঝতে পারলো না। আরমান এখানে, কেন ? এমনি হঠাৎ, নাকি? সে আড়চোখে উসমানের দিকে তাকালো! উসমান কালকে থেকে শান্ত। একেবারেই শান্ত! এমনকি রুমে এসেও তেমন কথা বার্তা বলেনি। শুধু বলেছে, ” ফ্রেশ হয়ে ঘুমিয়ে পর। তার শান্ত রুপটাকে দিলশাদের ভালো লাগে না। প্রচন্ড ঝড় হওয়ার পূর্বে পরিবেশ যেমন শান্ত হয়ে যায়, উসমানও তেমন। এই আরমান ব্যাটার কপালে এবার দুঃখ আছে। সত্যিই দুঃখ আছে।

— কি হলো আপু? চলো না।

ইউসুফের সাথে সাবিহাও বললো,— আরে চলো তো! আজকে দিনটাইতো। আর আমি একটু শুটকি বাজারে যাবো। কক্মবাজার আসলাম শুটকি মাছ নেবো না, তা কি করে হয়।

দিলশাদ অসহায় ভাবে এবার উমরের দিকে তাকালো! উসমানের দিকে তাকানোর তার সাহস হলো না।
উমর হালকা হাসলো! ভরসা মাখা হাসি। হেসে সবার দিকে তাকিয়ে বললো, —- তাহলে চলো আমরা সবাই একসাথেই যাই। আশে পাশে একটু ঘুরে, কেনাকাটা করে একেবারে লাঞ্চ করেই না হয় ফিরবো। তারপরে সব কিছু গুছিয়ে নেওয়া যাবে।

উসমান, দীপা কিছুই বললো না। বাকি সবাই একমত হলো, খুশিও হলো। আত্মীয় – স্বজন আছে। সবার জন্যই তো কিছু না কিছু নিতে হবে।

মার্কেটে এসে যে যার মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলো। সকালে দিলশাদ শান্ত থাকলেও, এখন সেই শান্তশিষ্টের ছিটেফোঁটা দেখা গেলো না। সে এটা সেটা খুব আগ্রহের সাথে দেখছে। এই মেয়ে কেনাকাটায় খুব ওস্তাদ। উসমান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। আরমান খারাপ, কতোটুকু খারাপ দিলশাদ জানে না। রায়হান ভালো ছেলে, তাই পছন্দ করা সত্বেও দিলশাদের ভালো যেভাবে সেটা চিন্তা করেই চুপচাপ সরে গেছে। তবে আরমান মনে হয় না সরবে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলতেই দিলশাদ ঘুরে তার দিকে তাকালো। ভ্রু কুঁচকে বললো,— কি হয়েছে? এতো বড় বড় শ্বাস ফেলছেন কেন? বউ ভেগেছে?

উসমান উত্তর দিলো না। ফাজলামির মুড নেই তার।

— এমন পেঁচা মুখ করে আমার সাথে ঘুরতে পারবেন না। ভাগেন! আমার বডি গার্ডের প্রয়োজন নেই।

— তাহলে কাকে প্রয়োজন?

দিলশাদ মুচকি হাসলো! এসে একটু এগিয়ে ফিসফিস করে বললো,— রোমান্টিক হাসবেন্ড।

— রোমান্টিক হাসবেন্ড আসলে তখন তো পালাই পালাই করো। কি সুন্দর মিথ্যা বললে।

দিলশাদ ভেংচি কাটলো! কিছু বললো না। সে সামনে এগিয়ে গেলো।

উসমান তার একটু পেছনে। সেও ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো। বললো, — আবার আপনিতে এসেছো কেন?

— কালকে এতো সুন্দর করে তুমি বললাম। কিছু গিফ্ট তো করলেন না, তাই।

— তুমি বলার জন্যও গিফ্ট লাগবে?

— হ্যাঁ!

— কি চাই?

দিলশাদ থামলো! একটু পিছিয়ে আবার ফিসফিস করে বললো, —- হাসি! আমার রোমান্টিক হাসবেন্ডের রোমান্টিক হাসি।

উসমান হাসলো! ঢংগি একটা। রাগ করাও যায় না।

দিলশাদও হাসলো! হেসে বললো, —- হেসেছেন তো ফেসেছেন?

— আবার আপনি ?

দিলশাদ কিছু বললো না। বললো উসমানই, — ফাসিয়েছো তো অনেক আগেই। আর নতুন করে কি ফাসবো।

— কিছুক্ষণ পরেই বুঝতে পারবে।

— কি ?

দিলশাদ থেমেছে একটা শামুকের দোকানের সামনে। বড় একটা শামুক হাতে নিয়ে বললো,— আজকে তুমি ফকির হয়ে যাবে মিষ্টার উসমান শেখ।

উসমান আবারো হাসলো! হেসে দিলশাদের পাশে দাঁড়ালো। ফিসফিস করে বললো,— তোমাকে ভালোবেসে আমি নিজ ইচ্ছায় ফকির হতেও রাজি মিসেস উসমান শেখ।

চলবে…..

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ৪৩

দীপা অবাক হয়ে উসমানের হাতের দিকে তাকালো। তার দু- হাত ভর্তি ব্যাগ। এই মেয়ে সত্যিই উসমান ভাইকে পথে বসাবে। আর উসমান ভাইও, এই মেয়েকে কিচ্ছু বলেনা, মাথায় তুলছে, পরে বুঝবে এর ঝাল। সে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো, — মার্কেটের বাকি জিনিসগুলোও রেখে এসেছিস কেন? সেগুলোও নিয়ে আসতি।

দিলশাদের হাবভাব কোন পরির্বতন হলো না, সে স্বভাবিক ভাবেই বললো, — আনতে চেয়েছিলাম তো, তোমার দেবরের প্রতি মায়া হলো। আহারে! হাতে তো আর জায়গা নেই। আমার অতি প্রিয় দেবরটাকেও আশেপাশে দেখলাম না। তা না হলে আরো কিছু কেনা যেত। ইশ! কতো কিছু পছন্দ হলো নিতেও পারলাম না।

দীপা ঠোঁটে ঠোঁট চেপে তাকালো! উসমান হাসলো। এই মেয়ের সাথে কথায় কেও পারবে।

দিলশাদ আগের মতোই বললো, —- এভাবে তাকাচ্ছো কেন? আমার মতো বউ কেও এমনি এমনি পাবে? তোমার দেবরের ভাগ্য ভালো। তা না হলে অন্য জায়গায় বিয়ে করতে গেলে, দুনিয়ায় খরচ লাগতো। কতো খরচ বাঁচিয়ে দিয়েছি। হুহ! শুধু কি আমি, তুমিও কি দাওনি। দু- ভাই ই কিপটার কিপটা, ফায়ে ফায়ে কেটে পড়েছে, বলেই উমরের দিকে তাকালো।

উমর করুণমুখে বললো, —- এর মধ্যে আমাকে টানিস নারে মা। আগুনতো লাগাস, নিভাতে আমার দম বেড়িয়ে যায়।

দিলশাদ মুখ বাঁকালো । উসমান খুক খুক করে কাশলো। না, বাবাকে বলতে হবে। তা না হলে এই মেয়ে সারা জীবন খোটা দিয়ে দিয়ে তাকে ঝাঝড়া বানিয়ে ফেলবে।

দিলশাদ উসমানের দিকে ফিরেও তাকালো না। এই আর কি? আমার হয়ে যাও, আমার হয়ে যাও বলে বলে মাথা খেয়ে ফেলেছে। এখন লও ঠেলা। কাশতে কাশতে লিভার, কিডনি হাতে নিয়ে ঘুরো।

সে তো তাকালো তার অতি প্রিয় দুল্লাভাইয়ের দিকে। তাকিয়ে কষ্ট পাওয়ার ঢং করে বললো — – আমি আগুন লাগাই? আমি! এই কথা বলতে পারলেন ভাইয়া? বলেই দীপার দিকে তাকালো, যার অর্থ তুমি দেখেছো কি বলছে।

তাকিয়েই আবার উমরের দিকে ফিরে বললো, — এই যে কক্সবাজার ঘুরতে এলাম। হয়েছি আপনার ভাইয়ের বউ। তো? আগেতো শালী নাকি। দশ টা না, পাঁচ টা একটা মাএ শালী। একবার জিজ্ঞেস করেছেন কিছু লাগবে কি না। এই যে আশেপাশে কতো কিছু, একটা কিছু কিনে তো গিফ্টও করলেন না। আবার বলেন আগুন লাগাই। আগুন লাগানোর হলে মনের দুঃখ মনে চেপে রাখতাম না। আপুকে গিয়ে ঠিক বলতাম। বলেন, বলেন আপনি? বলেছি কিছু?

দীপা এতোক্ষণ দিলশাদকে বকলেও, এবার কঠিন চোখে উমরের দিকে তাকালো। যার অর্থ সত্যিই বলেছো একবার আমার বোনকে ?

উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! লেগে গেছে আগুন। হার মেনে বললো, —- সত্যিই বড় ভুল হয়েছে গেছে আমার। এখন বলেন শালী সাহেবা কি লাগবে আপনার?

দিলশাদ হাসলো! তার মিষ্টি মাখা হাসি। হেসে এগিয়ে গিয়ে বললো, —- আসেন ভাইয়া! ওখানে যাই। দেখি কি কেনা যায়। ঐ সাইট টা তো দেখলামই না, বলেই উমরকে টেনে নিয়ে গেলো।

উসমান হাসলো! হেসে দীপাকে বললো,— তোমার বোন তোমাকে এক হাটে বিক্রি করে আরেক হাট থেকে কিনে নিয়ে আসবে জানোতো।

দীপাও হাসলো! দিলশাদের ঢং সে বুঝে। থাক! তার এই ঢংগি বোনটাই থাক। এভাবেইতো ভালোলাগে। চুপচাপ, শান্ত ব্যাপারটা দিলশাদকে মানায় না।

— আমি একটু হোটেলে যাচ্ছি ভাবি। এতোকিছু নিয়ে ঘোরা সম্ভব না। আরো কি কি কিনবে কে জানে। দিলশাদকে তোমার কাছেই রেখো। এক সেকেন্ডের জন্যও একা ছেড়ো না।

দীপা মাথা নাড়লো! আরমানের ব্যাপারে শুনেছে। শুনেছে পর থেকে তার একটু ভয় ই করছে। আজকাল ছেলেদের বিশ্বাস নেই। কি থেকে কি করে। আইনি ব্যবস্থা সে আগেই নিতে চেয়েছিলো। কিন্তু আরমানের বাবার অবস্থাও ভালো। সে নিজে ফোন করে উমরকে রিকোয়েস্ট করলো, আইনি ব্যবস্থায় না যেতে। সে তার ছেলেকে সামলে রাখবে। এই তার রাখার নমুনা। দীপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

কেনাকাটার পরে আবার সবাই বিচে আসলো। ইউসুফ আসতেই পানিতে নেমে গেলো। যাওয়ার আগে একবার গোসল করবে না, তা কি করে হয়। আলি হোসেন, রুবিনা, সাবিহা গেছে শুটকি মার্কেটে। তারা এখনও আসেনি। আহান, আহাদ বালিতে বসে গেছে। তাদের পাশে দীপা, উমর। তাদের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক। দিলশাদ সে দিকে তাকিয়ে রইলো। এই হাসি খুশি পরিবারকে দেখতে তার ভালো লাগছে।

সে এগিয়ে গিয়ে একটা কিটকাট চেয়ারে বসলো। কেনাকাটা করতে করতে তার পা ব্যথা হয়ে গেছে। সে জুতা খুলে আরাম করে বসলো। বসে ব্যাগ থেকে মোবাইল বের করলো। করে বেশ কয়েকটা ছবি তুললো।

এর মধ্যেই তার ফোন বেঁজে উঠলো। আননোন নাম্বার! দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে জানতো ফোন আসবে। সে স্বাভাবিক ভাবেই ফোন রিসিভ করলো।

তুমি বললে আজ দুজনে
নীল রঙা বৃষ্টিতে ভিজবো
রোদেলা দুপুরে একসাথে
নতুন সুরে গান গাইবো
শেষ বিকেলের ছায়ায়
নীল আকাশের বুকে আমি
লাল রঙা স্বপ্ন আঁকবো।

দিলশাদ কিছু বললো না। আরমান হাসলো! হেসে বললো, —- আমার গানে তুমি আর মুগ্ধ হও না দিলশাদ।

দিলশাদ স্বাভাবিক ভাবেই বললো, —- হই। শুধু আপনার গান কেন? আমি আরো অনেকের গানেই হই। গানতো মুগ্ধ হওয়ারই জিনিস।

— আমি আর সবাই কি এক হলাম?

— আমার কাছেতো একই।

— এক না দিলশাদ। কিছুতো একটা আলাদা অবশ্যই আছে। এই যে আমার ফোনেই তোমার চেহেরার রং চেঞ্জ হয়েছে। সবারটাই নিশ্চয়ই এমন হবে না?

দিলশাদ আশে পাশে তাকালো! তাকাতেই দেখলো অনেকটা দূরে ঝাউ গাছে হেলান দিয়ে আরমান দাঁড়িয়ে আছে, দৃষ্টি তার দিকে।

দিলশাদ চোখ ফিরিয়ে নিলো। নিয়ে বললো —– কারণ আপনি আমাকে বিরক্ত করছেন আরমান ভাই। এটা রং না বিরক্ত।

— আমার হয়ে যাও তাহলে আর বিরক্ত করবো না।

দিলশাদের মেজাজ খারাপ হলো! ইচ্ছে হলো ঠাস ঠাস করে কয়েকটা আরমানের গালে লাগাতে । সে দাঁতে দাঁত চেপে বললো, — আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করুন আরমান ভাই। এটা কখনও সম্ভব না। আগেও ছিলো না। আর এখনতো আমি অন্য কারো।

আরমান আবারো হাসলো! সে দিলশাদের কথার উত্তর দিলো না। নিজের মতো করে বললো, —- তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছে দিলশাদ। একেবারে পরীর মতো। বিয়ের পরে মেয়েরা সুন্দর হয়। তোমাকে না দেখলে তো বিশ্বাসই করতাম না। কাল রাতে যখন লাল শাড়িতে দেখলাম। কিছুক্ষণের জন্য আমার হার্টবিট থেমে গিয়েছিলো জানো? এই সুন্দরটা আমার ছোঁয়ায় হলে কি হতো দিলশাদ?

দিলশাদ আগুন চোখে আরমানের দিকে তাকালো!

— এভাবে দেখোনা দিলশাদ, জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হই।

দিলশাদ দাঁতে দাঁত চেপে বললো, —- আপনি খুবই নিকৃষ্ট একটা লোক।

— জানি।

— আপনি আমাকে আর কখনও ফোন দেবেন না।

— দেবো।

দিলশাদ হাল ছাড়লো! ছেড়ে বললো, — চাচ্ছেন টা কি আপনি বলেতো?

— তোমাকে।

— আমার বিয়ে হয়ে গেছে আরমান ভাই।

— হোক! আমার সমস্যা নেই। একটা কেন দশটা হলেও সমস্যা নেই।

— ছিঃ!

— চলে এসো দিলশাদ। যখনি ভাবি এই চোখ, এই ঠোঁট, এই দিলশাদকে অন্য কেও ছুঁইছে। আমার মাথা নষ্ট হয়ে যায় । তখন ওই উসমান খুন করে ফেলতে ইচ্ছে করে। কালকে যখন ওর বুকে তুমি মাথা রাখলে। কতো কষ্টে নিজেকে দমিয়েছি জানো।

দিলশাদ হেসে ফেললো! হেসে বললো, —- ইচ্ছায়ও সামর্থ্য অনুযায়ী করতে হয় আরমান ভাই। উসমানের একটা চুলও বাঁকা করতে পারবেন না আপনি? সেটা আপনি ভালো করেই জানেন। জানেন বলেই সামনে আসছেন না।

আরমানের চোয়াল শক্ত হলো! দাঁত চিবিয়ে বললো,– তুমি চাও আমি সামনে আসি?

— আমি আপনার ব্যাপারে কিছুই চাই না। দয়া করুন আমার উপর। বিরক্ত করা বন্ধ করুন।

— আমার হয়ে যাও দিলশাদ। তুমি আমার না হলে আমি অন্য কারো হয়ে থাকতে দেবো না। তুমি বললে না, আমি উসমানের কিছু করতে পারবো না।আমি তাকে কিছু করতে চাইও না। আমি তো হাত দেবো তার কলিজায়।

দিলশাদ দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে বললো, — আমি এখানেই আছি। আসুন! দেখি আপনি কি করেন? আমি সাধারণ ফ্যামেলির মেয়ে হতে পারি আরমান ভাই। তবে ভীতু না। দিলশাদকে ভয় পাওয়ানো এতো সহজ না। আর এখনতো আমি উসমান শেখের বউ, উমর শেখের ছোট বোন, ইউসুফ শেখের মা,ভাবি, বোন, যা খুশি ভাবতে পারেন । আমার আশে পাশে আসলেই আপনাকে এরা ছাতু বানিয়ে ফেলবে।

আরমান বিশ্রি একটা গালি দিলো! দিয়ে বললো, — — তোর এই অহংকার আমি শেষ করে ফেলবো।

— আসুন! আমি এখানেই আছি বলেই দিলশাদ ফোন কেটে দিলো। সত্যিই তার অসহ্য লাগছে ।

আরমান আবারো ফোন দিলো! দিলশাদ ধরলো না, বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়ে আগুন চোখে আরমানের দিকে তাকালো।

আরমান হাসলো! সে আর ফোন দিলো না। তার পাশে দুজন- ছেলে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের কাছ থেকে কালো কিছু একটা নিয়ে শার্ট উঁচু করে পেছনে রাখলো। রেখে তার দিকেই এগিয়ে আসতে লাগলো।

দিলশাদ হতম্বভ হয়ে তাকিয়ে রইলো! কালো জিনিসটা কি তার বুঝতে এক সেকেন্ডও লাগলো না। সে উঠে দাঁড়ালো।

আরমান সামনে আসলো। তবে দিলশাদের কাছে যেতে পারলো না। যাওয়ার আগেই উমর দিলশাদের সামনে দাঁড়ালো। তার মুখ গম্ভীর, চোয়াল শক্ত হয়ে আছে।

আরমান হাসলো! ফিচলে হাসি! হেসে বললো, — ভালো আছেন ভাইয়া?

উমর উত্তর দিলো না। শান্ত ভাবে বললো, —- পাবলিক প্লেস আরমান। কোন ঝামেলা করবে না। এখান থেকে যাও।

— আরে ঝামেলা করবো কেন ভাইয়া! দিলশাদের সাথে দেখা করতে আসলাম। সেই বললো আসতে। বিশ্বাস না হলে আপনার আদরের শালীকেই জিজ্ঞেস করেন। বলেই মাথা কাত করে উমরের সাইড দিয়ে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে বললো,— তাই না দিলশাদ।

দিলশাদ কিছু বলবে তার আগেই ইউসুফ এসে দাঁড়ালো। সে দাঁড়াতেই দিলশাদ পুরোপুরি আড়াল হয়ে গেলো। এই দেয়াল টপকানো এতো সোজা না।

আরমান বিরক্তিতে ঠোঁটে ঠোঁট চাপলো।

ইউসুফ হাসলো! সে মাএই পানি থেকে উঠে এসেছে। তার পুরো শরীর ভেজা। সে ভেজা চুলে আঙুল চালিয়ে ঠিক করতে করতে একবার পেছনে তাকালো। দিলশাদ আপু আগুন চোখে আর ভাবি ভয়ে চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সামনে আহান, আহাদ বালিতে খেলছে। তাদের অবশ্য কোন দিকে হুশ নেই।

সে আবারো হাসলো, হেসে আবার সামনে তাকালো। ও, এই হচ্ছে সমস্যা ।

সে নির্বিকার ভাবেই বললো, —- আরে এটাতো ভালো কথা। আপুর সাথে দেখা করতে এসেছেন। আসুন, বসুন, এতোক্ষণে মেজো ভাইও এসে পড়বে। তারপরেই তো ঝমবে মজা।

উমর ঠোঁটে ঠোঁট চেপে ইউসুফের দিকে তাকালো। এ কি বলছে সে ভালো করেই জানে। পাবলিক প্লেস! সে সত্যিই কোন ঝামেলা চায় না। এখানে কিছু হলে পুরো দুনিয়ায় নিউজ হবে। আর কিছু হলে কেও সত্য জানতে আসে না। আঙ্গুল তুলে আগে মেয়েদের দিকেই। তাছাড়া দিলশাদ শক্ত হলেও দীপা এসব হজম করতে পারবে না। তাই উসমান আসার আগেই এখান থেকে যেতে হবে। সে আরমানের দিকে একবার তাকালো তারপর ইউসুফের দিকে তাকিয়ে শান্ত ভাবে বললো, — যা আহান, আহাদ নে। আমি আসছি। হোটেলে ফিরবো।

ইউসুফ হাসলো! মজার হাসি। তার ইচ্ছে হলো না যেতে। তবুও বড় ভাইয়ের আদেশে ঘুরে দিলশাদের হাত ধরে বললো, — এসো।

আরমান পেছনে হাত নিতে গেলো। উমর এক আঙ্গুল উঁচু করে কঠিন করে তাকালো। যার অর্থ, — না।

আরমান দাঁতে দাঁত চিবিয়ে বললো, —- দিলশাদ কোথাও যাবে না। আমার কথা এখনও শেষ হয়নি। তা না হলে ফল খুব খারাপ হবে বলে দিলাম।

উমর এক পা এগুলো! আরমানের ঠিক সামনে দাঁড়ালো। একেবারে মুখোমুখি হয়ে চোখে চোখ রেখে শান্ত ভাবে বললো , —- যে জিনিস নিয়ে এতো ভাব নিচ্ছো। এগুলো উমরের হাতের ময়লা আরমান। তাই এই সব ফালতু জিনিসের ভয় অন্য কাওকে দেখানোর চেষ্টা করো। তা না হলে যে বাপের ক্ষমতায় এসব করছোনা। তারও ক্ষমতা থাকবে না কিছু করার বলেই ইউসুফের দিকে তাকালো।

ইউসুফ আর দাঁড়ালো না। সে দিলশাদকে টেনে নিয়ে গেলো।

ইউসুফ যেতেই উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে আগের মতোই শান্ত ভাবে বললো,—- আজকাল ছেলেদের সমস্যা কি আমি বুঝি না। ভদ্রতাকে তারা দূর্বলতা মনে করে। যেমন তুমি? আমাদের সম্পর্কে একটু খোঁজ খবর নিলেও পারতে, যাই হোক আসি! আশা করি তুমি ভালো থাকবে।

আরমান হাসলো! হেসে বললো, —- আমার ভালোর জন্য চিন্তা না করে, নিজেদের জন্য ভাবুন। সব সময় পাবলিক প্লেস থাকবে না।

উমর উত্তর দিলো না। কিছুক্ষণ নিশ্চুপ তাকিয়ে রইলো। তার দৃষ্টি অবশ্য আরমানের দিকে না। আরমানের ঠিক পেছনে অনেকটা দূরে। যেখানে দু- হাত পকেটে পুরে উসমান দাঁড়িয়ে আছে। তার মুখও উমরের মতো শান্ত, নিশ্চুপ, নির্বিকার।

চলবে……