দর্পণ পর্ব-৭+৮

0
140

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৭

সুমি অবাক হয়ে বললো! তুমি বিয়ের জন্য হ্যাঁ করে দিয়েছো?
— হ্যাঁ! বলেই উসমান আয়নার সামনে দাঁড়ালো। সে মাএই গোসল করে বেড়িয়েছে। তাঁর এক বাজে অভ্যাস! সকালে ঘুম থেকে উঠেই গোসল করা। গোসল না করলে তাঁর ভালো লাগে না।

— এভাবে দুম করে কিভাবে হ্যাঁ বললে?

উসমান বিরক্ত হলো! বিরক্ত হয়ে বললো, — তুই এভাবে দুম করে হ্যাঁ বলিস না। ঢোল ঢক্কোর পিটিয়ে সাত গ্রামের মানুষ একএে করে তারপরে বলিস।

সুমির রাগ হলো! সে বংশের একমাএ মেয়ে। তিন চাচার আদরের দুলালী। আর সবচেয়ে বড় কথা হামিদা বানুর কার্বন কপি। যদিও সে হামিদা বানুকে দেখতে পারে না। সে এগিয়ে গিয়ে দুম করে উসমানের পিঠে কিল বসিয়ে দিলো।

উসমানের খালি গা, আধা ভেজা শরীর। সে আগুন চোখে তাকালো। তাকিয়ে বললো, — কি সমস্যা?

সুমি তাঁর দিকে আঙুল উঁচিয়ে বললো—- সমস্যা তুমি?
— কেন? কি করেছি?
— বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছো কেন?
— বললে সমস্যা কি?
— আমি তোমাকে বিয়ে করবো না।
— ভালো কথা করিস না। সেটা আমাকে বলছিস কেন? তোর বাপ, চাচা আর পেয়ারের দাদীকে গিয়ে বল।

— ঐ বুড়িকে আমি একদিন ঠিক বালিশ চাপা দিয়ে মেরে ফেলবো দেখো?

— যা খুশি কর তবে আমার রুম থেকে আপাততো বিদায় হ।

তখনি দিলশাদ তাঁদের রুমের সামনে দিয়ে গেলো। দু – পাশে সারিবদ্ধ রুম হওয়ার কারণে যেতে হলে অন্য রুমের সামনে দিয়েই যেতে হয়।

সুমি অবাক হয়ে বললো,— এই হুরপুরী কে?
উসমান গায়ে টিশার্ট দিতে দিতে বললো,— ভাবির বোন?
— ওমা! কবে আসলো? দেখছো তোমরা আমাকে কেও বললাও না।

— এটা বলার কি হলো?

সুমি ভেংচি কাটলো! বেড়িয়ে যেতে গিয়ে আবার ফিরে এসে বললো,– চোখের সামনে এমন হুরপরী রেখে আমাকে বিয়ের জন্য হ্যাঁ বলেছো কেন?

উসমান হাসলো! হেসে বললো,— কারণ আমি জানি তুই কখনও এই বিয়ে করবি না। তোর কি ধারণা, ভার্সিটিতে গিয়ে কি করিস সেই খবর বুঝি কেও জানে না।

সুমিও হাসলো! হেসে বললো,– বিয়ে না করলেও, নাক আমি তোমার ঠিকিই কাটবো। এটা মনে রেখ।

— কাট! এই নাক কাটা নিয়েই রাম, রাবণের যুদ্ধ শুরু হলো। লঙ্কা জ্বলে বিনাশ হয়ে গেলো। আর আমার না হয় অন্য কিছু হোক।

সুমি ভ্রু নাচিয়ে বললো,— অন্য কিছু টা কি?
উসমান কিছু বললো না। রহস্য ভাবে হাসলো।
____

দরজার টোকার শব্দে উমরের ঘুম ভাঙল। কটা বাজে এখন ? সে চট করে ঘড়ির দিকে তাকালো। আট টা! দীপার রাতে ঘুম হয় না। বাইরে বসে থাকে। দীপার সাথে সেও জেগে থাকে। দীপার ঘুম আসে না আর দীপাকে ছাড়া তাঁর ঘুমোতে ইচ্ছে করে না। রুমে না আসা পর্যন্ত সে জেগেই থাকে। তাই সকালে আর তাড়াতাড়ি উঠা হয় না। তবে দীপার মতো অতো বেলা পর্যন্তও অবশ্য সে ঘুমায় না। নটা সারে নটার মধ্যে উঠে যায়।

দরজায় আবার টোকার শব্দ হলো। সে উঠে বসলো! কে হতে পারে সে বুঝতে পারলো না। এই বাসায় হাজার দরকারেও সকালে তাঁদের কেও ডিস্টার্ব করে না। সে দীপার দিকে তাকালো! কম্বলমুড়ে শুয়ে আছে। ঘুমালে দীপাকে একেবারে বাচ্চা মেয়ের মতো লাগে। সে হাত বাড়িয়ে এসির পাওয়ার কমালো। গায়ে টি- শার্ট জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো।

উমর দরজা খুলে দেখলো দিলশাদ দাঁড়িয়ে আছে। সে অবাক হলো। সাথে সাথেই চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো! কোন সমস্যা হয়েছে দিলশাদ?

দিলশাদ মাথা নিচু করে দু- পাশে মাথা দোলালো। মনে মনে বললো,— সমস্যা আমার না, হবে আপনার । বিয়ে করেছেন, শালা – শালির প্যারাতো এখনও খাননি। খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হন। কিন্তু মুখে কোমল সুরে আস্তে করে বললো,— আমি আপুর কাছে যাবো।

উমর স্বাভাবিক ভাবেই বললো —- দীপাতো ঘুমাচ্ছে! কাল দেখলেইতো কতো রাতে ঘুমায়।

দিলশাদ আগের চেয়েও গলে গিয়ে বললো — আমি জানি!
— তাহলে!
— তাহলে কি? আপু ঘুমিয়ে আছে আমিতো না। তাহলে আমি যেতে পারবো না কেন?

উমর কিছুক্ষণ ঠোঁট টিপে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর নিরবে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালো।

দিলশাদ হাসলো! তাঁর সেই মিষ্টি মাখা হাসি। হেসে এগিয়ে গেলো।

পুরো ঘরে গুমোট ভাব। জানালা টানালা সব বন্ধ।
তাঁর মধ্যে ভারী পর্দা। এসির ঠান্ডা হাওয়ায় ঘর শীতল হয়ে আছে। দিলশাদ এগিয়ে গিয়ে পর্দা টেনে সরালো। জানালার গ্লাস খুললো। পুরো ঘরে ঝলমলে আলো আর মুক্ত বাতাস আসতে লাগলো।

চোখে আলো পরতেই দীপা চোখ কুঁচকে ফেললো। তবে ঘুম ভাঙলো না। উমর দীর্ঘশ্বাস ফেললো! ফেলে সোফায় বসলো! তাঁর এখনও ঘুম কাটেনি। সে দিলশাদের দিকে তাকালো। এই মেয়েটার সম্পর্কে কিছুটা হলেও তার ধারনা আছে। যখন দীপার সাথে ফোনে কথা বলতো। দীপা প্রায়ই এর সম্পর্কে এটা সেটা বলতো। তাই সে অবাক হলোনা। যা খুশি করুক দীপা ভালো থাকলেই হলো।

দিলশাদ খাটে উঠে দীপার পাশে বসলো। তাঁর হাতে যে পানি গ্লাস উমর খেয়াল করেনি। সে ঝিম মেরে বসে আছে। আজ তাঁর প্রথম মনে হচ্ছে শালা শালীর অনেক প্যারা।

চোখে ঠান্ডা কিছু অনুভব হতেই দীপা চমকে তাকালো। তাঁর পাশে দিলশাদ বসে আছে। তাঁর চোখমুখ গম্ভীর। সে ভয় পেলো! কিছু কি হয়েছে? সে উঠার জন্য নড়তেই দিলশাদ আগলে ধরলো। ধীরে ধীরে উঠে বসালো। বসতেই উদ্বিগ্ন হয়ে দীপা উমরের দিকে তাকিয়ো বললো,— ওর কি হয়েছে ওর উমর ! এভাবে বসে আছে কেন?

উমর চমকে গেলো! এতোটাই চমকেছে যে সে হা করে দীপার দিকে তাকিয়ে রইলো! দীপা তাঁর সাথে কথা বলছে। তাও আবার নিজে থেকে।

দীপা উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হলো! সে দিলশাদের দিকে তাকিয়ে গালে হাত রেখে নরম সুরে বললো, — কি হয়েছে তোর! কেও কিছু বলেছে?

দিলশাদ উপর নিচে মাথা নাড়ালো।
দীপার রাগ হলো! সে রেগে উমরের দিকে তাকালো!

উমর প্রথম ধাক্কা এখনও সামলে উঠেনি! দীপা আগুন চোখে তাকাতেই আবার মুখ থুবড়ে পড়লো। হচ্ছে কি আজ? যেই মেয়ে সাত চরে রা করে না। সে আজ তেজ দেখাচ্ছে? তাও আবার উমরকে! যার সাথে সে ভালো করে কথাই বলে না। রাগ, জেদ, অভিমানতো দূরের কথা।

দীপার কান্না পাচ্ছে। তাঁকে বলে, বলে। তাই বলে তাঁর বোনকেও। সে কাঁপা কাঁপা কন্ঠে বললো,— কে বলেছে?

দিলশাদ দীপার কাঁধে মাথা রেখে করুণ মুখে বললো,— বাদ দাও! দরকার নেই ঝামেলার! দু-দিনের জন্য এসেছি। আর পরের কথা বলে কি লাভ। নিজেন বোনের জামাই যেখানে পর। বোনের কাছে আসতে গেলেও তাঁর অনুমতি নিতে হয়।

উমর প্রায় লাভ দিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো! কি বলে এই মেয়ে।সে দীপার দিকে করুণ ভাবে তাঁকালো।

দীপাও তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে! উমরের করুণ দৃষ্টি তাঁর চোখে পড়লো না। তাঁর চোখে মুখে বিস্ময়।
উমর আমতা আমতা করে বললো,— কি বলো দিলশাদ?

দিলশাদ কিছু বললো না! বললো দীপা, — তুমি দিলশাদকে আমার কাছে আসতে মানা করেছো?

— এমন কিছু না দীপা! তুমি ঘুমিয়ে ছিলে…..

দীপা ফুঁসে উঠে বললো — আমি ঘুমে ছিলাম তো কি হয়েছে? তাই বলে….

— আপু! ডাক দিয়ে দিলশাদ দীপাকে থামালো! থামিয়ে বললো,— বাদ দাও আপু! এতো হাইপার তোমার শরীরের জন্য ঠিক না। বলেই উমরের দিকে একবার তাকালো।
উমর বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কি হচ্ছে এখনও সে বুঝতে পারছে না। দিলশাদের খুব মজা লাগলো। তারপর দীপার দিকে তাকিয়ে তাকে ধরে বললো,
— উঠো আপু! ফ্রেশ হও! আমার খিদে পেয়েছে। একসাথে নাস্তা করবো। বলেই আবার উমরের দিকে তাকিয়ে বললো,— একটু কষ্ট করে আমাদের নাস্তাগুলো এখানে দিয়ে যেতে বলুন। প্লিজ…. আমরা দু- বোন একসাথে আপনার রুমে নাস্তা করলে নিশ্চয়ই আপনার সমস্যা নেই?

এই কথা শুনে দীপা আবার ফুঁসে উঠলো! উঠে উমরের দিকে আগুন চোখে তাকালো। যার অর্থ, — সমস্যা আছে তোমার ?

উমর হরবর করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো। যেতে যেতে বললো, —- আমি এখনি নাস্তা পাঠিয়ে দিচ্ছি!

উমর হতম্বভের মতো নাস্তার টেবিলে এসে বসলো! সে এতো সকালে কখনো নাস্তা খেতে আসে না।
হামিদা বানু অবাক হলেন! অবাক হয়ে বললেন, — ওমা সূর্য আজকে কোন দিকে উঠছে?

উমর উত্তর দিলো না! সে মুক্তাকে ডেকে দীপা আর দিলশাদের নাস্তা ভিতরে দিয়ে আসতে বললো।

হামিতা বানু আরো অবাক হলো। বললেন, —- আরে বাহ্! নবাবের নবাবজাদি আজকে এতো সকালে! ব্যাপার কি? এই কে আছিস? আমাকে কেও একটু চিমটি কাট। স্বপ্ন দেহি নাতো?

উমরও দীর্ঘশ্বাস ফেললো! মনে মনে বললো,— কেও পারলে আমাকেও একটু চিমটি কাটো । মনে তো হচ্ছে স্বপ্নই দেখছি।

উসমান এসে উমরের সাইডে বসলো! তাঁর পিছু পিছু সুমিও এসেছিলো! দীপা আর দিলশাদের কথা শুনে সেদিকে যেতে লাগলো।

হামিদা বানু চেঁচিয়ে উঠলেন!
— ঐ কই যাস? নাস্তা খাবি! এদিকে আয়।

সুমি শুনেও শুনলো না। সে এখন হুরপরীর সাথে পরিচয় হবে। সে ভেংচি কেঁটে এগিয়ে গেলো।

— দেখলি! দেখলি কেমন শয়তান! প্রত্যেকটা নাতি নাতনি হয়েছে শয়তানের হাড্ডি। একটাও আমারে দাম দেয় না।

রুবিনা নাস্তা নিয়ে আসলো! টেবিলে সাজাতে সাজাতে বললো,— এই শয়তানকেই এই বাসায় আনার জন্য মরে যাচ্ছো। একবার আসুক! ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করবে।

হামিদা বানু তাচ্ছিল্য করে বললেন—- হুহ! হামিদা বানুকে বের করা এতো সোজা না। বলেই ভিতরে চলে গেলেন। তাঁর নাস্তা করা আগেই শেষ! বইসা বইসা এই ফাজিলগো চেহেরা দেইখা লাভ কি?

ইউসুফ আসলো হেলে দূলে! এসে উসমানের সামনে গিয়ে বললো,— তুমি ঐ চেয়ারে যাও।
উসমান কিছু বললো না! চুপচাপ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর পাশের চেয়ারে বসলো। সে বসতেই ইউসুফ দু- ভাইয়ের মাঝে বসে পড়লো। এভাবে বসতে তাঁর ভালো লাগে। অবশ্য সব সময় এভাবে বসা হয় না। কারণ তিন ভাইয়ের নাস্তার সময় ভিন্ন।

— ভাবি ঠিক আছে তো ভাইয়া! এতো সকালে উঠেছো?

উমর ইউসুফের দিকে তাকিয়ে হাসলো! হেসে বললো,— হুম একদম ভালো!

রুবিনা ভেঙি কেঁটে বললো, —- ঢং! দিন ভরে শুয়ে বসে আর কি হবে? আর ভাবির দেবররা ! যতো টেনশন তোরা ভাবির জন্য করিস না । তাঁর এক ভাগও যদি সে করতো তাহলেতো ভালোই হতো। অথচো সারাদিনে একবারো তো খবর নিতে দেখি না।

উসমানের রাগ হলো! যেই মানুষটা কখনও কাওকে কিছু বলে না। সেই মানুষটাকেই নিয়ে প্রতিদিন এ বাড়িতে হাজার কথা হয়। সে দাঁত চিবিয়ে বললো,— আমরা কোন ছোট্ট বাচ্চা না যে আমাদের নিয়ম করে খোঁজ খবর নিতে হবে। আর সে ভাইয়ের বউ, আমাদের ভাবি! আর এটা তাঁরও বাড়ি। তাই তাঁর যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে থাকবে। প্রতিদিন এগুলো নিয়ে এতো কথা কেন?

— হ্যাঁ! এখনও তো জবান ফুটবই! বড় হইছো! নিদানের দিন শেষ। এখন কি আর ফুপুগো লাগে।

উসমান চেঁচিয়ে উঠলো—- নিদানের দিনে পাশে ছিলেন বলে এখন যা খুশি তাই করতে পারো না।

— উসমান! উমর ধমকে উঠলো। কি হয়েছে আজ সবার।
উসমান উমরের দিকে তাকালো না! তাঁর মুখ থমথমে! রাগে সে ফেঁটে পড়ছে। সে নাস্তা না করেই উঠে গেলো।

ইউসুফেরও উঠে চলে যেতে ইচ্ছে করলো! তবে বড় ভাইয়ের কথা চিন্তা করে উঠলো না। ভাই কষ্ট পাবে। তাঁর হাতের কাছে পানির গ্লাস। সে সেটা সবার চোখের আড়ালে ধাক্কা দিয়ে উলটে দিলো।
হায় হায় করে, রুবিনা লাফিয়ে উঠলো! সব পানি তাঁর কাপড়ে পড়েছে।

চলবে……

#দর্পণ
#নূপুর_ইসলাম
#পর্ব- ০৮

উমর একটু ভয়ে ভয়েই রুমে আসলো! তাঁর ফ্রেশ হওয়া দরকার। সকালে হাত মুখ না ধুয়েই নাস্তা করেছে। এখন তো আর রেডি না হয়েই কাজে যেতে পারে না। বাজারে তাঁদের বড় মার্কেট আছে। সেই মার্কেটের উপরেই তাঁদের অফিসরুম। সে অফিস রুমেই যাবতীয় জমির বেঁচা কেনার কাজ করা হয়।অন্য সব ঝামেলাও মেটানো হয়। সেখানে আগে বাবা বসতো। এখন বসে উমর! বাকি সব কাজটাজ দেখে উসমান। বাবা এখন সব কিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। যেখানে শুধু দরকার সেখানেই থাকে।
উমর রুমে এসে মনে মনে হাঁফ ছাড়লো। দিলশাদ নেই! এই মেয়ে একদিনেই তাকে ঘোল খাইয়ে ফেলেছে। বাবারে কি থেকে কি হলো সে তো এখনো ঠিক বুঝতেই পারছে না ।

সে এগিয়ে এলো। দীপা খাটে বসে আছে চুপচাপ। মুখ ফ্রেশ লাগছে। মাথায় পরিপাটি করে বেণী করা। সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠার কারণে চোখে মুখে কোন ক্লান্তির রেশ দেখা গেলো না। বরং আগের চেয়ে উজ্জল লাগছে। উমরের এতো ভালো লাগলো।

নিশ্চয়ই দিলশাদের কাজ। তা না হলে নিজের যত্ন তো দূরের কথা গত দু- বছরে এই মেয়ে আয়নার সামনে কতবার দাঁড়িয়েছে সে গুণে বলে দিতে পারবে।

সে মনে মনে ঠিক করলো! সে জীবনেও আর তাঁদের দরজা লক করবে না। আর দিলশাদ কে বলবে। “তোমার যখন খুশি, যখন ইচ্ছা এসো! নক করারও প্রয়োজন নেই। ”

এমনিতেও দীপা তাঁকে ধারে কাছে ঘেষতেও দেয় না। তাই দরজায় লক করলেই কি, না করলেই কি। আগের ব্যাপার অন্য ছিলো! জোর করে হলেও বুকে টেনে এনে শোয়াতো। আর এখন দীপার গায়ে হাত দিতেও তাঁর ভয় হয়। যদি ব্যথা লাগে।

উমর এসে দীপার পাশে বসলো! সাথে সাথেই দীপার মুখ শক্ত হলো। সে ঠিক বুঝলো। তবে সে জানে এখন দীপা কিছুই বলবে না।সকালে হয়তো বোনের করুণ মুখ দেখে নিজের অজান্তেই আগের ফর্মে ফিরে গিয়েছিলো। তবে উমর চায়! দীপা স্বভাবিক হোক! তাঁর সাথে হাসুক, রাগুক, অভিমান করুক! দরকার পড়লে রেগে চুল ছিঁড়ে ফেলুক। তবুও স্বাভাবিক হোক।

দীপা হাত উঁচু করলো! তাঁর হাতে একটা কাগজ। উমর খেয়াল করেনি। সে দীপাকে দেখায় ব্যস্ত ছিলো।
উমর হাত বাড়িয়ে কাগজ নিলো। তাঁতে কয়েকটা নাম লেখা। সে জিজ্ঞাসা দৃষ্টিতে দীপার দিকে তাকালো।
দীপা একটা শ্বাস ফেলে অল্প আওয়াজে বললো —- এগুলো হাদিস বইয়ের নাম! দিলশাদ আনতে বললো।

উমর হালকা হাসলো!

— ফেরার সময় আমি অবশ্যই নিয়ে আসবো। সাথে সাথে মনের ভিতরে একটু শান্তি লাগলো। মেয়েটা দিনভরে উদাস হয়ে বসে থাকে। বইগুলো পড়লেও সময় কাটবে। দিলশাদকে মনে মনে ধন্যবাদ দিলো।

দীপা কিছু বললো না। সে জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। কেন জানি তাঁর ভালো লাগছে। খুব খুব ভালো। এই বই গুলো দিলশাদ কেন আনতে বলেছে সে জানে। এই বইগুলো তাঁর চেনা। তাদের বাসায় আছে। তাঁদের মা এগুলো সবসময় পড়তো। তাদেরও পড়তে বলতো। বলতো এগুলো পড়লে সময়ও কাটে, অনেক কিছু জানা যায়। সেই অনুযায়ী আমলও করা যায়। আর আমলে মনে আসে শান্তি। তাঁরা অবশ্য সেই কথা কানে নিতো না। এই বই গুলো যে মা আনতে বলেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই।

দীপা চোখ বন্ধ করে খাটে মাথা রাখলো! কেমন আছে তার বাবা, মা। ইশ কতোদিন কথা হয় না, দেখা হয় না। এ সব উমরের জন্য। উমরের জন্যই তার জীবন এমন এলোমেলো হয়ে গেলো। শুধু কি উমরের জন্য, তারও কি দোষ নেই?

তাঁর আর উমরের প্রথম দেখা তাঁর বান্ধুবীর বিয়েতে। সে যেমন বান্ধুবীর বিয়েতে গিয়েছিলো, তেমনি উমরও এসেছিলো বরের সাথে। উমরকে সে দেখেনি। দেখার কথাও না। সে ছোট বেলা থেকেই চুপচাপ। সবার সাথে খুব একটা মিশতে পারে না। তাঁর সব বন্ধু – বান্ধুবীরা মজা করলেও সে সাইডে সাইডেই ছিলো। আর এতো এতো মেয়ের মাঝে উমরের নজর তার উপরে কখন, কিভাবে পড়লো দীপা জানে না।

জানলো দু- দিন পরে। ভার্সিটিতে গিয়ে। বাকি বন্ধুরা বলাবলি করলো। তাঁর নাম্বারের জন্য নাকি একটা ছেলে হুলস্থল করে ফেলেছে। দীপা অবাক হলো! কই সেতো খেয়াল করে নি।

সেদিন রাতেই ফোন এলো! সে জানতো আসবে। যে নাম্বারের জন্য এতো হুলস্থুল করেছে। ফোন করবে না তা কি করে হয়। মাঝখানে দু-দিন যে চুপচাপ বসে ছিলো এইতো অনেক।
দীপা ঠিক করলো ফোন ধরবে না। অচেনা যেই নাম্বারই হোক সে ধরবেনা। আর করলোও তাই ! ফোন বাজতে বাজতে এক সময় ক্লান্ত হয়ে গেলো। তবুও দীপার মন গললো না। কি দরকার অযথা ঝামেলার।

সে প্রতিদিন ভার্সিটিতে একাই যায়। তারপরেদিনও যাচ্ছিলো। কানে ইয়ারফোন লাগিয়ে রিকশায় বসে। গান শুনতে তাঁর খুব ভালো লাগে। জ্যামে রিকশা থামতেই হুট করে কোথা থেকে এক লোক রিকশায় উঠে বসলো। লম্বা, চওড়া, সু- স্বাস্থের অধিকারী। এক রিকশা তাঁরই লাগার কথা।

দীপা গান শোনায় মগ্ন ছিলো। হঠাৎ করে বসতেই সে পড়ে যেতে নিলো। ভয়ে আঁতকে উঠলো। কিন্তু সে পড়ে যাওয়ার আগেই এক বলিষ্ঠ একটা হাত তাঁকে আঁকড়ে ধরলো। ধরলো দীপাও! তার শরীর কাঁপছে। হঠাৎ আঁকড়ে ধরাতে লোকটার হাত দীপার নখের আঁচড়ে এফোঁড় ওফোঁড় হয়ে গেলো।

এতে অবশ্য লোকটার মাথা ব্যথা দেখা গেলো না। মাথা ব্যথা হলো দীপার। সে ঘোর কাটতেই রেগে ফেঁটে পড়লো। শুধু সে না সাথে রিকশাওয়ালাও। এভাবে ওঠার মানে কি?

রিকশাওয়ালা অবশ্যই বেশিক্ষণ দম দেখাতে পাড়লো না। লোকটা চোখ রাঙালো! তবে দীপা দমলো না। দীপার দমা না দমাতে অবশ্য তাঁর কিছু এলো গেলো না। সে নির্বিকার ভাবে বসে রইলো। আর কোমড় ধরে রাখা হাত আরো শক্ত হলো।

দীপার মেজাজ তখন তুঙ্গে। সব শক্তি দিয়ে ছাড়াতে চাইলো। সে ব্যর্থ! এই গন্ডারের সাথে তো তাঁর পারা সম্ভব না। সে হাঁফ ছাড়লো! শান্ত ভাবে বললো,— অসভ্যতামি করছেন কেন? হাত সরান, প্লিজ।

এই শান্ত কথায় কাজ হলো। উমর হাত সরালো, সোজা হয়ে চেপে বসলো। বসে রিকশাওলাকে চলার জন্য ইশারা দিলো। রিকশাওলাও যেন হাঁফ ছাড়লো। এমন ঝামেলার পেসেঞ্জার সে এখন নামাতে পারলেই বাঁচে।

দীপা সারা রাস্তা কোন কথা বললো না। শক্ত হয়ে বসে রইলো। কে এই লোক সে বুঝতে পারছে না। এভাবে তার রিকশায় ওঠারই বা মানে কি?

ভার্সিটির সামনে রিকশা থামতেই দীপা ঝট করে নেমে গেলো। নামলো উমরও। নেমে ভাড়া দিলো তাও তিন ডাবল।

রিকশাওয়ালা অবাক হলো। হলো দীপাও! তবে কিছু বললো না। যা খুশি করুক! সে চলে যেতে নিলো। কিছুদূর যেতেই তাঁর ফোন বাজলো। সে ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখলো কালকের নাম্বার। সে কাটতে যাবে তাঁর আগেই চোখ পড়লো উমরের দিকে। তাঁর কানে ফোন। দীপা অবাক হলো! সাথে এও বুঝে গেলো কে এই লোক।

তার আর ফোন কাটার সাহস হলো না। উমর চোখ দিয়ে ফোন ধরার ইশারা করলো। দীপা ফোন ধরে কানে রাখতেই বললো,—- আশা করি এর পরে আর আমার কল কেঁটে দেবে না।

— হুমকি দিচ্ছেন?
— না! রিকোয়েষ্ট করছি।
— এটা আপনার রিকোয়েষ্টের ধরণ?
— না! রাত ভরে কল দিতে দিতে মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। এটা তাঁরই লক্ষণ।
— আর যদি ফোন না ধরি।
— আবার মাথা খারাপ হয়ে যাবে।

কলেজ ভর্সিটিতে পড়া মেয়েরা ফ্যান্টাসিতে ভুগে। আসল দুনিয়া সম্পর্কে তাঁদের ধারণা কম। দীপারও হয়তে ছিলো। সে ভাবলো না। যেই ছেলে রাস্তার মাঝখানে এমন সিন ক্রিয়েট করতে পারে সে সব কিছুই পারে। সে উমরের ফোন ধরলো! সেই ধরা একদিন দু-দিন করে নিয়মিতো হলো। সেই নিয়মিত থেকেই তাঁদের প্রেমের শুরু হলো।

দীপা কখনও প্রেম করেনি,কাওকে ভালোবাসেনি। তাঁর কাছে সব নতুন। উমরের কথা, উমরের হাসি, উমরের পাগলামী, উমরের কেয়ার, উমরের দেওয়া বিভিন্ন রকমের গিফ্ট। সব কিছুতে সে ভেসে বেড়াচ্ছিলো। বাসার কেও বুঝতেও পারলো না। সাদা সিধে চুপচাপ থাকা মেয়েটা ভেতরে ভেতরে কি চলছে ।

এভাবেই যাচ্ছিলো দিন। দীপা তখন উমরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছিলো। এর মধ্যে দীপার জন্মদিন আসলো। উমর তাঁকে দেখা করতে বললো। দেখা করা, ঘোরা তাঁদের জন্য নতুন না। দীপা আগ্রহ নিয়েই গেলো। গাড়িতে বসতেই উমর চোখ বেঁধে ফেললো। দীপা ভয় পেলো না। আজ তাঁর জন্মদিন। সারপ্রাইজ আসবে সে জানতো। উমরের হাত ধরে সে খুশি খুশিই এগিয়ে গেলো। চোখ খুলতেই অবাক হলো! পুরো রুম জুড়ে জন্মদিনের ডোকেরেট করা। লাল, নীল বেলুন, ফুলে পুরো রুম জুড়ে আছে। মাঝে কেক! তাঁর মধ্যে সুন্দর করে লেখা, হ্যাপি বার্থডে ভালোবাসা।

তবে সে কোথায় বুঝতে পারলো না। তবে একটা ফ্ল্যাট সে ঠিক বুঝলো। সে উমরকে ভালোবাসে, বিশ্বাস করে। তবুও তাঁর মনে কোথায় একটু খটকা লাগলো। কারণ সে যতোই প্রেম করুক, ঘোরাঘুরি করুক, প্রেমিকের সাথে একটা ফ্ল্যাটে আসা তাঁর মন কেন জানি সায় দিলো না।

সে কেক কেঁটে তাড়াতাড়ি ফিরতে চাইলো। উমর বিরক্ত হলো। বিরক্ত হয়ে বললো,— এমন করছো কেন?

— আমি বাসায় যাবো।

উমর দীপাকে টেনে কাছে আনলো! কোমল সুরে বললো,— সেটা তে যাবেই। আমি কি সারা জীবন এখানে আটকে রাখবো নাকি । বলেই দীপাকে জড়িয়ে ধরলো। গলায় মুখ ডোবালো।

দীপা কেঁপে উঠলো! তাঁর ভিতর ছটফটিয়ে উঠলো! সে ঠেলে উমরকে সরাতে চাইলো। কিন্তু উমরের সাথে পেরে উঠলো না। শেষ মেষ না পেরে শক্ত করে উমরের চুল টেনে ধরলো। উমর বিরক্ত নিয়ে মুখ উঠাতে দীপা জোরে ধাক্কা মারলো। উমর সরতেই সে দৌড়ে বেরুতে চাইলো। কিন্তু উমর তাঁর হাত টেনে ধরলো। বিরক্ত মাখা কন্ঠে বললো,— এমন করছো কেন?

দীপা রেগে গেলো! এগিয়ে গিয়ে ঠাস করে উমরের গালে চড় বসিয়ে দিলো। দিয়ে বললো,— এগুলোকে তুই ভালোবাসা বলিস? এই তোর ভালোবাসার নমুনা। ছিঃ! নিজের প্রতিই ঘেন্না হচ্ছে। তোর মতো নিচ মানুষকে ভালোবেসেছি। ছাড়! আমার হাত ছাড় জানোয়ার! বলেই দীপা চেঁচিয়ে উঠলো।

উমর ছাড়লো না! এতো বড় হওয়া অবধি তার গায়ে কেও হাত তুলেনি। তারমধ্যে চড়, গালি এসব কথায় তাঁর মাথায় আগুন ধরে গেলো। সে দীপাকে ধাক্কা দিয়ে দেওয়ালে চেপে ধরলো। টেনে গায়ে থেকে ওড়না ফেলে দিলো। গাল চেপে ধরে চিবিয়ে বললো,— আমি নিচ, আমি জানোয়ার, তুই কি? আমি জোর করে এখানে এনেছি তোকে। নিজের ইচ্ছায় এসেছিস। নিজের ইচ্ছায় আমার প্রেমের ডাকে সারা দিয়েছিস। সারা দিয়ে প্রেম করে এখন সতী সাজা। বলেই উমর ভয়ংকর এক কাজ করে ফেললো।

দীপা শক্ত হয়ে গেলো। তাঁর সব ছটফটানি বন্ধ হয়ে গেলো। শুধু অস্ফুটভাবে বললো,— তুমি তোমার মাকে নিশ্চয়ই ভালোবসতে, সম্মান করতে। সেই ভালোবাসায় দোহাই, সেই সম্মানের দোহাই। তোমার বাসনা শেষ হলে আমাকে মেরে ফেলো। আত্মহত্যা আমি করতো পারবো না। এর পরে আর বেঁচেও থাকতে পারবো না।

উমর ছিটকে দূরে সরে গেলো। খাটে বসে দু- হাতে মুখ ঢেকে ফেললো। রাগে জিদে কি করছিলো সে? দীপা যে ভয়ে এমন আচরণ করেছে তার এমন কোন ইন্টেনশন ছিলোই না। সে শুধু দু- জনে কিছু সুন্দর মূহুর্ত চেয়েছিলো।

সে কতোক্ষণ চোখ বন্ধ করে চুপচাপ সেভাবেই বসে রইলো। তারপর ঝট করে উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে নিচে থেকে ওড়না তুলে দীপার গায়ে দিলো। জামা ঠিক করলো। তারপরে হাত ধরে টেনে বললো, — চলো! বাসায় পৌচ্ছে দিচ্ছি।

দীপা নড়লো না! শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। এই পাপের বোঝা নিয়ে সে বাবা, মায়ের সামনে যাবে না। কখনও না।

উমর রাগে চেঁচিয়ে উঠলো!
—- আসছো না কেন?

দীপা তবুও নড়লো না।

—- এমন কি হয়েছে যে এমন ভাব নিচ্ছো। যা হয়েছে ভুলে যাও। আমি আর তোমাকে বিরক্ত করবো না।

দীপা চোখ তুলে তাকালো! তাঁর চোখে টলমলে পানি। শুধু কি পানি? ভাগ্যিস চোখের পানির মতো ঘৃণাও টপটপ করে ঝড়ে পড়ে না।

উমর ঢোক গিললো! কেন জানি তার ভিতর কেঁপে উঠলো। সে কি করবে বুঝতে পারলো না। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নরম সুরে বললো,– বাসায় চলো দীপা। এখন যদি না চলো! আমি চলে যাবো। যাওয়ার আগে তোমার বাবাকে ফোন দিয়ে যাবো। সে এখানে আসলে তাঁকে তুমি কি জবাব দেবে সেটা তুমি জানো। একটু থেমে আবার বললো, — আমি কোন মার্ডারারও না, রেপিস্টও না। আর আমার এমন কোন ইচ্ছাও ছিলোনা। যা হয়েছে ভুলে যাও। এই মুখ আর তুমি কখনও দেখবে না।

চলবে……