দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১১

0
3

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-এগারো
মাহবুবা বিথী

সাগরের উত্তাল ঢেউ আর প্রণয়ের আবেগে আমি ভাসতে লাগলাম। জীবনটাকে অনেক সুন্দর মনে হতে লাগলো। মাহফুজের হাত ধরে সাগরের ঢেউ ভেঙ্গে বহুদূর এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ মাহফুজ সাগরের পানি দুহাতে তুলে আমার চোখে মুখে ছিটিয়ে দিয়ে হাসতে লাগলো। যদিও আচরণটা ওর বয়সের সাথে যায় না তবুও ওর এই আচরণ আমাকে ভীষণ আন্দোলিত করলো। আমিও ওর চোখে মুখে পানি ছিটাতে লাগলাম। যদিও খুব লজ্জা লাগছিলো। ভাবছিলাম এই আচরণটা আমার সাথে যাচ্ছে কিনা। আসলে মাঝে মাঝে জীবনকে উপভোগ করার জন্য সময়ের উল্টোস্রোতে হাঁটতে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যাবার উপক্রম হলো। তৎক্ষণাত মাহফুজ আমাকে ধরে ফেললো। ও যেন এই সুযোগটার অপেক্ষায় ছিলো। এরপর আমাকে নিবিড় করে জড়িয়ে ধরে ঢেউয়ের মাঝে ভাসতে লাগলো। আমার ভীষণ ভয় লাগছিলো। ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললাম,
—-আমার ভীষণ ভয় লাগছে। চলো আমরা পানি থেকে উঠে পড়ি।
—-কিন্তু আমার যে ভীষণ ভালো লাগছে। এই যে তুমি আমাকে শক্ত করে ধরে রেখেছো। এভাবে কবে জড়িয়ে ধরেছো আমার মনে পড়ে না।
—-এখন এতো রোমান্টিসিজমে ভাসতে হবে না। প্লিজ আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি কিন্তু সাঁতার জানি না।আর ঠান্ডাও লাগছে। চল পানি থেকে উঠে পড়ি।
আমার জোরাজুরিতে পানি থেকে তীরে এসে উঠলো। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তোমার মনে পড়ে ভার্সিটিতে বন্ধুরা সবাই একবার কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়েছিলো। ম্যাক্সিমাম নিজেদের গার্লফ্রেন্ডকে সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলো। আমিও তোমাকে নিতে চেয়েছিলাম। তুমি রাজি হওনি। বলেছিলে, আমার সাথে তোমার সম্পর্কটা বৈধ হয়নি। তাই তুমি যেতে পারবে না। তখন ওদের দেখেছিলাম কক্সবাজার সীবিচে কি করে প্রেমিকার সাথে জলকেলীতে লিপ্ত হতে। আজ তোমার সাথে আমার সম্পর্ক সব দিক থেকে বৈধতা পেয়েছে। এভাবে পানিতে তোমায় নিয়ে জলকেলি করার আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো। আজ আমার সেই ইচ্ছেটা পূরণ হলো।
আমি ওর দিকে তাকিয়ে ভাবলাম,সেই কবেকার কথা ঠিক মনে রেখেছে। আসলেই তো ওকে পছন্দ করি বলে ওর সাথে আমার সত্যি বিয়ে হবে কিনা সেটাতো আমি জানি না। তাহলে কেনই বা আমি ওর সাথে যাবো। আর আমি যে শৃঙ্খলার মধ্যে বড় হয়েছি, আব্বু আম্মু আমাকে যেতে দিতে রাজী হতেন না। বরং বাসায় ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো।
ভেজা শরীরে খুব অস্বস্তি হচ্ছে। অস্তরাগে সুর্যটা হেলে পড়েছে। আকাশে সন্ধার আবীর ছড়িয়ে পড়েছে। গাঙচিলরা নীড়ের দিকে উড়ে চলেছে।আমিও আর বীচে থাকতে চাইলাম না। দুজনে মিলে রুমে চলে আসলাম। রুমে এসে শাওয়ার নিয়ে দুজনেই এশার কসরের নামাজ পড়ে খেতে বের হলাম। ডিনার শেষ করে রুমে এসে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মাহফুজও আমার পাশে শুয়ে বললো,
—-এই যে তোমাকে এতো এতো সারপ্রাইজ দিলাম তুমি আমায় কিছু গিফট দিবে না?
আমিও মুচকি হেসে বললাম,
—-আমি তো আমার পুরোটা তোমায় কবে দিয়ে দিয়েছি। আর তো দেওয়ার মতো কিছু বাকি নেই।
মাহফুজ আমার কানের লতিটা আলতো করে কামড় দিয়ে বললো,
—-জানো তো,তুমি হচ্ছো সমুদ্রের মতোন। সমুদ্রের বুকে আল্লাহপাক অফুরন্ত পানি দিয়েছেন। যারফলে ওর তল খুঁজে পাওয়া যায় না তেমনি আল্লাহপাক তোমাকে এতো সৌন্দর্য দিয়েছেন যতোই দেখি তৃষ্ণা মেটে না। বরং উত্তরোত্তর তোমার সৌন্দর্য যেন বাড়তে থাকে।
—-থাক, এতো পটাতে হবে না। তোমার মতলব আমার ভালোই জানা আছে।
মাহফুজ মিটমিট করে হেসে আমায় বললো,
—–তোমাকে এতো দূরে কেন নিয়ে এসেছি জানো,
আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম,
ও আমাকে বুকের সাথে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললো,
—-তোমাকে পুরোপুরি নিজের করে পাবো বলে,
—–কেন, দেশে বুঝি পাওয়া যায় না?
—-পাই কিন্তু বেশির ভাগ সময়ই দেখা যায় তুমি কখন অফিসের কাজে, কখনও বা বাপের বাড়ি, কখনও বা শ্বশুর বাড়ি কারো না কারো ফোনে ব্যস্ত থাকো।

ওর কথাগুলো শুনে মনে মনে আমার খুব হাসি পেলো। কেমন যেন অপরিপক্ক মনে হলো। আমার নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হলো। চারিদিকে এতো ডিভোর্স, পরকীয়ার ভীরে মাহফুজের এই ভালোবাসাটুকু যেন আমার জন্য আমৃত্যু অমলিন থাকে। পরমকরুনাময় আল্লাহপাকের কাছে আমি এই প্রার্থনা করি। তবে আমার নানী বলতো,
—-স্বামীকে ভালোবাসবি কিন্তু পুরো একশতভাগ বিশ্বাস করবি না। কারণ মানুষকে কখনও পুরোপুরি বিশ্বাস করতে হয় না। যতভালোই হোক পাঁচ পার্সেন্ট অবিশ্বাসের খাতায় জমা রাখবি। এই পৃথিবীতে মানুষ নামক প্রাণিটি সবার আগে অবিশ্বাসের কাজ করে। আর স্বার্থ অনুযায়ী গিরগিটির মতো রং বদলাতে থাকে।
আমাকে ভাবনার অতল জলে ভাসতে দেখে মাহফুজ ধাক্কা দিয়ে বললো,
—-মহারানী আপনি কোন জগতে হারালেন? আমাকে কি তীর্থের কাকের মতো বসিয়ে রাখবেন।
—-তোমাকে কে বসে থাকতে বলেছে। ঘুমিয়ে পড়ো।
ও বেডসাইট টেবিলের পাশে লাইটের সুইচটা অফ করে দিলো। ওর ঠোঁট আমার গলা ঘাড় চিবুক স্পর্শ করলো। দুটো মানুষ ভালোবাসার অমৃত সুধা আকন্ঠ ভরে পান করতে লাগলো। একসময় ভালোবাসার মিলনখেলায় আমরা দু,জন দুজনের মাঝে হারিয়ে যাই। ক্লান্তিতে আমাদের দু, চোখ জুড়ে ঘুম নেমে আসে।

খুব ভোরে আমার ঘুম ভাঙ্গলো। নিজেকে মাহফুজের বাহুডোরের ভিতর আবিস্কার করলাম। আলতো করে ওর হাত সরিয়ে দিয়ে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলাম। ওয়াশরুমে গিয়ে গিজার চালু করে কুসুম কুসুম গরম পানিতে শাওয়ার নিলাম। এরপর ফজরের নামাজ আদায় করে গায়ে একটা পাতলা শাল জড়িয়ে লনে এসে ইজিচেয়ারটায় বসলাম। দূরে সাগরের ঢেউ দেখা যাচ্ছে। এখানকার সাগর আমাদের বঙ্গোপসাগরের মতো অতটা উত্তাল নয়। তাই সেই গর্জনটা শোনা যায় না। দূরের ঝাউ গাছটায় দুটো শালিক খেলা করছে। কখনও বা একজন আরেকজনের পাশে এসে বসছে কখনও বা দূরে চলে যাচ্ছে। যাই করুক দু,জনে একসাথেই থাকছে। আসলে স্বামী স্ত্রী একসাথে থাকলে সময়গুলো খুব মুল্যবান হয়ে উঠে। জীবনের স্রোতটা স্বাচ্ছন্দে বয়ে যেতে পারে। সেটা মানুষ, বনের প্রাণী কিংবা পক্ষীকূল। সবাই এই সুখটা পেতে চায়। দূরে সাগরের বুক চিরে জাহাজগুলো গন্তব্যের পথে এগিয়ে চলেছে। সাগরের ঠান্ডা হিমেল হাওয়ায় আমার শরীরের সব ক্লান্তি যেন দূর হয়ে গেল। মাহফুজ কখন এসে আমার পিছনে দাঁড়িয়েছে টের পাইনি। আমার মাথার উপর ওর থুতনিটা বসিয়ে বললো,
—-কখন উঠেছো? আমাকে ডাকলে না কেন?
—-খুব আরাম করে ঘুমাচ্ছো বলে ডাকতে ইচ্ছে হলো না।
—-আজকে পাতায়ার কোরাল আইল্যান্ডে যাবো। তুমি তাড়াতাড়ি রেডী হয়ে নাও। আমি এখুনি শাওয়ার নিয়ে আসছি।
মাহফুজ শাওয়ার নিতে চলে গেল। আমিও জিন্স প্যান্টের সাথে সবুজ রঙের লেডিস পাঞ্জাবী পড়ে মাথা সবুজ হেজাব দিয়ে মুড়িয়ে নিলাম। গলায় একটা ওড়না ঝুলিয়ে নিলাম। মাহফুজ ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে এসে নীল ডেনিম জিন্সের সাথে ফুল স্লিপ সাদা শার্ট পড়ে নিলো। শার্টের হাতাটা গুটিয়ে নিলো। বেশ মানিয়েছে ওকে।দুজনেই কেটস পড়ে হোটেল থেকে বেরিয়ে গেলাম। দশটার মধ্যে গাইড উপস্থিত থাকতে বলেছে। হোটেলের লাগোয়া একটি রেস্টুরেন্টে ব্রেকফাস্ট সেরে পাতায়াতে চলে গেলাম। আমি সাথে একটা ব্যাগ নিয়েছিলাম। কারণ পানিতে নেমে একটু হেঁটে স্পীড বোটে উঠতে হবে। জুতোগুলো ব্যাগে ভরে নিলাম। নিদিষ্ট সময়ের মধ্যে পাতায়াতে পৌঁছে স্পীড বোটে উঠে কোরাল আইল্যান্ডের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। বেশ ভয় লাগছিলো।এখানে আরো কয়েকজন কাপল ছিলো। চাইনিজ, ইন্ডিয়ান, লঙ্কার একজোড়া কাপল ছিলো। সবারই গায়ে লাইফ জ্যাকেট। বড়বড় ঢেউ এসে পানির ঝাপটা দিয়ে আমাদের ভিজিয়ে দিতে লাগলো। স্পীড বোটটা ঢেউয়ের ধাক্কায় মাঝে মাঝে দুলতে লাগলো। এক ভয়ঙ্কর সুন্দর সময় পার করে দুপুর একটার সময় কোরাল আইল্যান্ডে পৌঁছে গেলাম। স্পীড বোট থেকে নেমে আবারও সেই পানি মাড়িয়ে দ্বীপে উঠলাম। পা ধুয়ে আমরা দুজনে কেডস পড়ে নিলাম। গাইড আমাদের বলে দিলো,আমরা যেন ঠিক তিনটায় নিদিষ্ট স্থানে চলে আসি। আমার কাছে জায়গাটা অনেকটা আমাদের ছেঁড়া দ্বীপের মতো লাগছে। ওরা সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছে আর আমাদেরটা অগোছালো হয়ে আছে। দ্বীপে ঘুরে ডাব খেলাম। তবে আমাদের দেশের ডাবটা বেশী মিষ্টি। মাছ ভাজা আর সালাদ দিয়ে দুপুরের ভাত খেয়ে নিলাম। কিছু সুভ্যিনুর কিনলাম। ফটোশুটও বাদ যায়নি। ওখানে এক বাঙ্গালী ফটোগ্রাফার পেলাম। বাড়ি সন্দীপ। আমাদের ছবি তুলে দিলো। এবং ঘন্টাখানিক সময়ের মধ্যে বাঁধাই করে দিলো।
ঘোরাঘুরি শেষ করে দুপুর তিনটার দিকে আমাদের স্পীড বোটে গিয়ে বসলাম। সাগরের উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে সন্ধা ছ,টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম।
পাতায়াতে খুব সুন্দর জীবনের এক মুল্যবান সময় কাটিয়ে আমি আর মাহফুজ ঢাকার পথে রওয়ানা হলাম। মনে হলো ভালোবাসাটাকে আবার একটু নতুন করে সাজিয়ে নিলাম। কোথায় যেন পড়েছিলাম ভালোবাসাকে অনেক যত্ন করে লালন করতে হয়। তাকে হৃদয়ের ভাঁজে অনেক সাবধানে রাখতে হয়।

চলবে