দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১২

0
80

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-বারো
মাহবুবা বিথী

প্রেমের নায়ে কয়েকদিন আমরা দু,জনে ভেসে নিজেদের কর্মস্থলে ফিরে আসলাম। রংপুরে ফিরতে বেশ রাত হলো। থাইল্যান্ড থেকে ঢাকায় পৌঁছাতে বিকাল চারটা বেজে যায়। এয়ারপোর্টের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সন্ধা সাতটায় নভোএয়ারে করে সৈয়দপুরে পৌঁছালাম। ওখানেই একটা রেস্টুরেন্টে ডিনার করে নিলাম। তারপর একটা গাড়ি ভাড়া করে রংপুরে ডরমেটরীতে পৈাঁছাতে রাত ন,টা বেজে যায়। মাহফুজ আমার সাথে রংপুরে চলে আসাতে একটু সুবিধাই হলো। বাজারটা করে দিতে পারবে। তবে এখানে এসে একটা সুসংবাদ পেলাম। মাহফুজের রংপুর কালেক্টরেট অফিসে পোস্টিং হয়েছে। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। আসলে একা একটা জীবন চালিয়ে নেওয়া বেশ কঠিন। আমি ঢাকা ভার্সিটিতে পড়াশোনা করার সুবাদে বাসা থেকেই ক্লাস করেছি। মাঝে মাঝে পরীক্ষার সময় হলে ছিলাম বটে তবে সেখানেও বাড়িতে যাবার অপশন ছিলো। কখনও আম্মু খাবার রান্না করে পাঠিয়ে দিতেন। কিন্তু এভাবে নিজের দায়িত্ব একা পালন করা এবারই প্রথম।
পরশু থেকে আমার কলেজ শুরু হবে। ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে কাজে হাত লাগালাম। জার্ণি করে আসা ময়লা কাপড়গুলো মেশিনে দিয়ে দিলাম। মাহফুজ বাইরে থেকে পরোটা আর সবজি কিনে আনলো। ঐ দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। কাপড়গুলো মেশিনে ধুতে দিয়ে ঘর পরিস্কার করার কাজে নেমে পড়লাম। মাহফুজকে বাজারে পাঠালাম। ওর দায়িত্ব হচ্ছে বাজার করে নিয়ে এসে তরকারি কুটে দেওয়া বাথরুম পরিস্কার করা। আর কাজের খালা এসে ঘর মুছে দিবে আর থালা বাসন ধুয়ে দিবে। বিছানার চাদরগুলো সব উঠিয়ে নতুন চাদর বিছিয়ে দিলাম। কাপড় দিয়ে সব ফার্ণিচার গুলো মুছে ফেললাম। ততক্ষণে কাপড় ধোয়া হয়ে গিয়েছে। সেগুলো বারান্দার তারে মেলে দিলাম। এরমাঝে মাহফুজ বাজার করে ফিরলো। রুই মাছ বাজার থেকে কেটেই এনেছে। চিংড়ি মাছ, মুরগী, কচুর লতি, পালংশাক, ফুলকপি,টমেটো শিম নিয়ে এসেছে। অন্যসময় হলে কচুরলতি আর পালংশাক আনার জন্য আমার মেজাজ খারাপ হতো। কিন্তু আজ আর খারাপ করলাম না। বেচারা আমাকে সম্পূর্ণ নিজের টাকা খরচ করে এতো সুন্দর একটা ট্রিপ দিলো তার এটুকু আবদার রাখাই যায়। যদিও উনি নিজ দায়িত্বে কচুর লতি কুটতে বসেছেন। আমার মনে মনে বেশ হাসি পেলো। আমি বুঝতে পারছি আমি যেন রাগ না করি সে কারনেই উনি নিজ জ্ঞানে এই দায়িত্ব পালন করছেন।
আমি পালংশাকটা কুটে নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলাম। বেশ সুন্দর করে মাহফুজ লতি কেটে দিলো। কাল আমার কলেজে যেতে হবে। এমনিতেই ছুটি দরখাস্ত দিয়েই মাহফুজের সাথে বেরাতে চলে গিয়েছি। প্রিন্সিপাল ম্যাম বিষয়টি কিভাবে নিবেন কে জানে? তাই ভাবছি তিনদিনের রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিবো। পালং শাক হয়ে আসার পর কচুর লতি চিংড়ি মাছ দিয়ে বসিয়ে দিলাম। এরপর রুই মাছ ভুনা, মুরগীর মাংস, শিম চচ্চড়ি করে সবার শেষে ভাত চাপিয়ে দিলাম। কাজের খালা এসে ঘর মুছে কিচেন পরিস্কার করে দিয়ে চলে গেল। আমি আর মাহফুজ গোসল করে দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। মুহুর্তে চোখে ঘুম নেমে এলো।

ফোনের শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো। মাহফুজ মোবাইলের স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখে আমার শ্বশুর আব্বা ফোন দিয়েছে। ও ধড়মড় করে বিছানা থেকে উঠে ফোন রিসিভ করলো।
ওপাশ থেকে শ্বশুর আব্বা বেশ গম্ভীর স্বরে বললেন,
—বাবা, বিয়াতো মনে হয় আমি করি নাই। তুমি একলাই বিয়া করছো।
মোবাইলে যেহেতু লাউডস্পিকার দেওয়া আছে তাই উনার কথা শুনে আমি মনে মনে বললাম,
শ্বশুর আব্বা বিয়াতো আপনি করছেন,বাচ্চাও ফুটাইছেন। সেজন্য তো আমিও আপনার ভোলাভালা পোলাটারে নিয়া সংসার করতেছি। আমি দেখলাম,আমার শ্বশুর আব্বার কথায় মাহফুজ খুব বিরক্ত। ও পাল্টা প্রশ্ন করলো,
—-কি বলবেন সরাসরি বলেন। এতো ঘুরানো প্যাঁচানো কথা শুনতে ভালো লাগে না।
—-তুমি কি ফেনীতে না রংপুরে।
—-রংপুরে।
—-তুমি যে থাইল্যান্ডে ট্যুর দিয়া বাবা হিসাবে আমাকে তো জানাইয়া যাইতে পারতা? আমি কি তোমাকে বেঁধে রাখতাম? আমার তো তোমার শ্বশুরের কাছে শুনতে হইলো তুমি আর বৌমা থাইল্যান্ডে গিয়েছো। এটা কি ভালো হলো?
—খারাপ কি হলো আমি তো বুঝতে পারলাম না?
—থাক,বুঝতে পারছি। বিয়া কইরা তোমার মাথা পুরাই আওলা হয়ে গেছে। আর একটা কথা,আমি দুপয়সা চাইলে তখন বলো,তোমার হাতে টাকা নাই। এখন তোমার দেশের বাইরে ট্যুর দেওয়ার টাকা কোথা থেকে আসে? যাক টাকা না দাও সমস্যা নাই অন্তত যেখানে যাও আমারে বলে যেও। তোমাকে আমি বেঁধে রাখবো না। তা তুমি ফেনী কবে যাবে?
—-আমার রংপুরে বদলি হয়েছে।
—-কবে হলো সেটাও তো জানানোর প্রয়োজন মনে করলে না।
—-বাবা,আমি আজকেই শুনলাম। রাতে তোমাকে সবকিছু জানাতাম। তার আগেই তুমি ফোন দিলে। খুব দ্রুতগতিতে যাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম তাই তোমাক জানাতে পারিনি। আর দেশের বাইরে থেকে ফোন দিতে পারতাম কিন্তু তোমার মোবাইলে সে ব্যবস্থা তো নাই।
—যাক এখন আর এসব বলে লাভ নাই। তবে ভবিষ্যতে এমন কাজ আর করো না।
আমারও মনে হচ্ছে কাজটা ঠিক হয় নাই। খুব সঙ্কোচ লাগছে। ফোন রাখার পর মাহফুজকে বললাম,
—-আসলেই কাজটা ঠিক হয় নাই। বাবা মনে কষ্ট পেয়েছে।
—-শোনো, আমার বাবা তো, আমি উনাকে ভালো করে চিনি। আগে জানালে যাওয়াই হতো না। সবার আগে বলতো বৌমারে নিয়া তোর একলা যাওয়া ঠিক না। নিরাপত্তার একটা ব্যাপার আছে। আমরা সবাই একসাথে যাবো। এই কারনে বলি নাই।
যাক আমার আর এই বিষয়ে মাথা ঘামাতে ইচ্ছা হলো না। আমি ওজু করে আসরের নামাজ পড়ে নিলাম। খুব টায়ার্ড লাগছে। বিছানায় শুয়ে পড়তে আবার দুচোখে ঘুম নামলো। মাগরিবের আজানের সময় মাহফুজ ডেকে দিলো। তাড়াতাড়ি শোয়া থেকে উঠে নামাজ আদায় করে নিলাম। মাথাটা খুব ধরেছে। আমি চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকলাম। মাহফুজ চা বানিয়ে আমাকে ডেকে দিয়ে বললো,
—-চা,টা খাও মাথা ধরা সেরে যাবে।
চায়ে চুমুক দেওয়ার সাথে সাথে মাথা ব্যথাটা কমে আসতে শুরু করলো। আসলে এখন মনে পড়ছে সকালে কাজের চাপে চা খাওয়া হয়নি। মাহফুজ আবার দুধচা ভালো বানায়। একটু আদা,লবঙ্গ দারুচিনি দিয়ে পানিটা ফুটিয়ে চাপাতা ছেড়ে দেয়। এই চা,টা খাওয়ানোর জন্য ওকে ধন্যবাদ জানালাম। রাতে তাড়াতাড়ি ডিনার করে শুয়ে পড়লাম।

খুব ভোরে উঠে ফজরের নামাজ আদায় করে মাহফুজকে নামাজ পড়ার জন্য ডেকে দিলাম। কিচেনে গিয়ে চা বানিয়ে নিয়ে টোস্ট বিস্কুট দিয়ে ভিজিয়ে খেলাম। মাহফুজ নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়েছে। কলেজে যাওয়ার সময় ওকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বললাম,
—শুকনো কাপড়গুলো ভাঁজ করে রেখো। ফ্রিজে ফ্রোজেন পরোটা আছে ভেজে ডিমভাজি দিয়ে খেয়ে নিও।
—-তুমি অত ভেবো না। আমি সব করে নিবো। ঘুম পাচ্ছে। তাড়াতাড়ি রওয়ানা দাও। আমি দরজা লাগিয়ে আরো একটু ঘুমোবো।
আমি তাড়াতাড়ি বের হয়ে একটা অটো নিয়ে কলেজে রওয়ানা হলাম। প্রিন্সিপাল ম্যামের সাথে দেখা করে ছুটির বিষয়ে বিস্তারিত বললাম। উনি আমার ছুটি নিয়ে তেমন মাথা ঘামালেন না। কিন্তু একটা অন্যায় আবদার করে বসলেন। আমার সাবজেক্টে এক ছাত্রী ফেল করেছে। ওকে আমার পাশ করিয়ে দিতে হবে। আমি ম্যামের দিকে তাকিয়ে খুব অবাক হয়ে বললাম,
—-এটা কিভাবে সম্ভব। একদুই মার্ক কম হলে দেওয়া যায়। এতো দশ মার্ক কম পেয়েছে। এতো মার্ক কিভাবে মেকাপ করবো।
—মিসেস ফারাহ্,এখন সময়টা এমনই চলছে। চাকরি করতে গেলে কম্প্রোমাইজ করে করতে হয়। ঐ ছাত্রীর ভাই রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতা।
—-একজন ছাত্র নেতার কাছে ম্যাম আপনি নতি স্বীকার করবেন?
—-গদি টিকিয়ে রাখতে করতে হবে।
—-ম্যাম আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার পক্ষে এটা করা সম্ভব নয়।
—-এর জন্য যদি মাশুল দিতে হয় তার জন্য আপনি প্রস্তুত তো?
—ম্যাডাম আমি জানি না ভবিষ্যতে আমার জন্য কি অপেক্ষা করছে? কিন্তু আমি অন্যায়ের কাছে মাথানত করতে পারবো না।
এমনসময় সেই ছাত্রীর ভাই প্রিন্সিপালের রুমে বিনা অনুমতীতে প্রবেশ করে বললো,
—-আপনি তো ফারাহ্ ম্যাম।
—-জ্বী, তাহলে আপনি তো জানেন আপনাকে কি করতে হবে?
—-আপনি প্রিন্সিপাল ম্যামের সাথে কথা বলেন।
আমি রুম থেকে বেরিয়ে আসি। ফাস্ট ইয়ারের একটা ক্লাস করেই আমি বাড়ীর পথে রওয়ানা দিলাম। মনটাও খারাপ এবং মেজাজটাও খারাপ হয়ে আছে। একটু আগেই বাসায় চলে আসলাম। কলিং বেল বাজালাম। কিন্তু কোনো সাড়াশব্দ নাই। ঠিক মাহফুজ এখনও ঘুমিয়ে আছে। আরো দুবার চাপ দেওয়াতে মাহফুজ ধড়মর করে উঠে দরজা খুলে দিলো। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে বেশ বুঝতে পারছি। ঘরে ঢুকেই বুঝলাম, যা ভেবেছি ঠিক তাই হয়েছে। মাহফুজ কাপড়গুলো ভাঁজ করেনি। রাইস কুকারে ভাত চাপিয়ে দেয়নি। আমাকে দেখে কাঁচুমাচু হয়ে বললো,
—তোমার তো দুটোর সময় আসার কথা। এখন তো কেবল বারোটা বাজে। ক্লাস করাতে ইচ্ছা হয়নি। মনটা খুব খারাপ। তুমি কাপড়গুলো ভাঁজ করোনি কেন? শোনো তোমার কাজ তোমাকেই করতে হবে। আমি কিন্তু করে দিবো না। নিজের কাঁধে সব কাজের দায়িত্ব নিতে আমি আমার মাকে দেখেছি। সেই কারনে আম্মুকে সারাজীবন ঘরের কাজগুলো একাই করতে হয়েছে। আব্বু কখনও ঘরের কাজে হাত লাগায়নি। আব্বু কিন্তু ঘরের কাজ ভালোই করতে পারে। দাদীকে ভালোই সহযোগিতা করতো। দাদী আমাকে বলেছে। অথচ আম্মুকে সেভাবে কখনও আব্বু সাহায্য করেনি। তাই নিজের সংসারে আমি শুধু আমার কাজটুকুই করবো। এর বাইরে একটা কাজও বেশী করবো না। সুতরাং কাপড়গুলো তোমাকেই ভাঁজ করতে হবে আর রাইসকুকারে ভাতও তোমাকেই চাপাতে হবে।

চলবে