#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-তেরো
মাহবুবা বিথী
খুব ভোরে মোবাইলের অ্যালার্মটা বেজে উঠলো। আমিই অ্যালার্ম সেট করেছিলাম। ফজরের নামাজটা প্রায় প্রতিদিন ক্বাজা হয়ে যায়। পাশে মাহফুজ অঘোরে ঘুমাচ্ছে।মাহফুজ বাচ্চাদের মতো করে ঘুমোচ্ছো। ফেনী থেকে গতকাল মালপত্র নিয়ে ফিরেছে। এখানে ওর বরাদ্দকৃত ফ্লাটে মালগুলো আপাতত উঠিয়ে রাখা হয়েছে। আমার কলেজে ইদানিং ব্যস্ততা বেড়েছে। সামনে আবার পরীক্ষা নিতে হবে। ভাবছি সব ঝামেলা গুলো একটু মিটিয়ে নিয়ে ঘর গোছানোর কাজে হাত দিবো। বেচারা অনেক টায়ার্ড।
আমি বাথরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে ওজু করে এসে ফজরের নামাজ আদায় করে নিলাম। এরপর ওকেও ঘুম থেকে ডেকে তুললাম। নামাজের সময় শেষ হয়ে আসছে। ওকে দ্রুত নামাজ পড়ে নিতে বললাম। এরপর কিচেনে গিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে ফ্রিজ থেকে সবজি বের করে কুটতে বসলাম। ফুলকপি,গাজর,বেগুন,শিম আলু,টমেটো পরিমান মতো কেটে নিলাম। পাঁচফোঁড়নের বাগাড় দিয়ে সবজি গুলো পাতিলে দিয়ে দিলাম। পেয়াজ কুচি,একটু রসুন বাটা পরিমানমতো হলুদ মরিচের অল্প গুড়ো আর সিদ্ধ হওয়ার মতো পানি দিয়ে ঢেকে দিলাম। কয়েকটা আস্ত কাঁচামরিচও ছেড়ে দিলাম। চা রেডী করে মাহফুজকে ডেকে বললাম,
—–চা হয়ে গেছে।
ওর হাতে চা আর টোস্ট বিস্কুট ধরিয়ে দিয়ে রাইস কুকারে ভাত চাপিয়ে দিলাম। আসলে আমারও কলেজ আছে আর মাহফুজেরও আজ জয়েনিং এর প্রথমদিন। বেচারা আমাকে অনেক কাজে যেমন সাহায্য করে আমিও ওর প্রয়োজন মতো ওকে হেল্প করি। ফ্রিজে গরুর মাংস,রুইমাছ রান্না করা আছে। সবজি, গরুর মাংস সালাদ দিয়ে দুপুরে ভালোমতই লাঞ্চ করা যাবে। এর মাঝে ভাত ও হয়ে গেল। আজকে ফ্রিজে ভাত ছিলো না। তাই রাঁধতে হলো। ফ্রিজে ভাত থাকলে ওটাই আমরা ওভেনে গরম করে খেয়ে নেই। মাহফুজ এদিক থেকে খুব হেল্পফুল।সবসময় গরম কিংবা টাটকা খাবার খেতে হবে এসব নিয়ে মাহফুজের দিক থেকে কখনও আমার প্যারা নিতে হয় না। মাহফুজের সাথে আমার স্বামী স্ত্রী সম্পর্ক যতটুকু তার থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অনেক বেশী। তবে মনের সিংহাসনে দু,জন দুজনকে বসিয়ে রেখেছি। মুখে কখনও ঘটা করে বলা হয়নি।
ফ্রিজ থেকে ফ্রোজেন পরোটা বের করে তেল ছাড়া সেঁকে নিলাম। আমার একরুমের ডরমেটরী হওয়াতে খাবার টেবিল বসানো সম্ভব হয় নাই। বিছানার উপর পেপার বিছিয়ে পরোটা আর সবজি বেড়ে দিলাম। মাহফুজ এর মাঝে গোসল করে কালো রংয়ের প্যান্ট আর আকাশি রঙের ফুলস্লিপ শার্ট পরে খেতে আসলো। দু,জনে মিলে নাস্তা করে নিলাম। আমি খুব তাড়াহুড়ো করছি। ডকাল ন,টার আগেই আমাকে কলেজে পৌঁছাতে হবে। একবার ভাবলাম মাহফুজের গাড়িতে লিফট নিলে কেমন হয়। পর মুহুর্তে মনে হলো ওতো অন্যান্য ম্যাজিস্টেটের সাথে মাইক্রোবাসে করে অফিসে যাবে। সেখানে ওকে কলেজে নামিয়ে দেওয়া ভালো দেখাবে না। তাই অটোতে করে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
আমি দ্রুত শাড়ি পরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল চিরুনি করছিলাম। অমনি মাহফুজ পিছনদিক থেকে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ ঘসতে লাগলো। আমারও ওর এসব আচরণ ভালোই লাগে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা বাজে। হাতে একদম সময় নেই। ন,টার মধ্যে কলেজে পৌঁছাতে হবে। এমনিতেই প্রিন্সিপাল ম্যাম আমার উপর অসন্তুষ্ট। তাই মাহফুজকে সরিয়ে দিয়ে বললাম,
—- এতো ঢং করার সময় নাই। এখন বের না হলে আমার দেরী হয়ে যাবে।
—-তোমার মাঝে রসবোধ এতো কম কেন?
—-অসময়ে রসবোধ আসে না। এবার তাড়াতাড়ি বের হও।
মাহফুজ নীচে নেমে আমার জন্য অটো ঠিক করলো।আমি দরজায় তালা দিয়ে অটোতে উঠলাম। মাহফুজ মাইক্রোবাসে করে অফিসের দিকে চলে গেল।
আমার বিয়ের প্রায় বছরখানিক হতে চললো তবুও মনে হয় আমরা দু,জন একদম নতুন। আমার দাম্পত্যজীবনের প্রতিটা দিন আমার কাছে নতুন। আজকের দিনের সাথে গতদিনের কোনো মিল খুঁজে পাই না। নিজেকে বড় ভাগ্যবতী মনে হয়। একজন লাইফ পার্টনার তার সঙ্গীকে এতো ভালোবাসতে পারে সেটা মাহফুজের সাথে সংসার না করলে বুঝতে পারতাম না। নানা কথা ভাবতে ভাবতে অটো কলেজের গেটে এসে থামলো। ভাড়া মিটিয়ে হাত ঘড়িটার দিকে তাকিয়ে দেখি পৌনে ন,টা বাজে। দ্রুত অফিসরুমে ঢুকে এটেনডেন্ট খাতাটায় সই দিয়ে রোল কলের খাতাটা নিয়ে দোতলায় সেকেন্ড ইয়ারের ক্লাস রুমে ঢুকলাম। রোল কল করার সময় খেয়াল করলাম যে মেয়েটাকে আমি পাশ মার্ক দেই নাই সেও ক্লাসে এসে বসেছে। বুঝতে পারলাম,প্রিন্সিপাল ম্যাম তার গদি রক্ষার্থে ঠিকই এই মেয়েটাকে সেকেন্ডইয়ারে উঠিয়ে দিয়েছেন। পড়াতে গিয়ে দেখি সামনের বেঞ্চের মেয়েটা খুব অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে আমাকে বললো,
—-ম্যাম,আমি একটু ওয়াশরুমে যাবো।
তাকিয়ে দেখি ওর পুরো ড্রেস রক্তে ভেজা। আমি বুঝতে পেরেছি ওর হয়তো পিরিয়ড ওভার ফ্লো হয়ে গেছে। কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তোমার কাছে স্যানেটারী ন্যাপকিন আছে?
ও লজ্জা পেয়ে না,সূচক মাথা নাড়লো। আমি আমার ব্যাগ থেকে একটা প্যাড ওর হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলাম।
ক্লাস শেষ করে কমন রুমে বসা মাত্রই মোবাইলটা টুং করে বেজে উঠলো। ওপেন করে দেখি মাহফুজ মেসেজ পাঠিয়েছে।
—-my love কি করছো?
—-এই মাত্র ক্লাস শেষ করে কমনরুমে এসে বসেছি।
—-আমি তোমার কলেজের দিকে আসছি। ডিসি স্যার কাল থেকে ফুলকোর্সে অফিস করতে বললেন। আজ হাফ বেলা করে বাসায় যেতে বললেন। ভাবছি তোমায় নিয়ে পুরো রংপুর শহর টো টো করে ঘুরবো।
—ওকে।
আমাকে নিবিষ্ট মনে মোবাইলে চ্যাটে ব্যস্ত থাকতে দেখে সালেহা আপা ফোড়ন কেটে বললেন,
—-বাব্বাহ তোমাদের এতো প্রেম?
—-কি করে বুঝলেন আমি আমার হাসব্যান্ডের সাথে চ্যাট করছি। অন্য কেউ তো হতে পারে।
—-আমার বিয়ে হয়েছে পাঁচ বছর। এই সময়গুলো আমি পেরিয়ে এসেছি। তাই মুখ দেখলেই বুঝতে পারি কার দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে। তবে কি জানো, পুরুষ মানুষকে বেশী আহ্লাদ দিবে না। ভালোবাসাটা মনের মধ্যে রাখবে। ওদেরকে বুঝতে দিলে মাথায় উঠে ওরা ডুগডুগি বাজায়। আর ওদেরকে সবসময় ব্যস্ত রাখবে। তাহলে দুষ্টু বুদ্ধি মাথায় আসবে না। আর একটা কথা ওদের হাতে অঢেল টাকাও রাখবে না। সেটা দিয়ে ওরা তখন নানা অকাজে খরচ করবে।
এমন সময় মাহফুজের মিসকল আসলো। আমি আপুর কাছে বিদায় নিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে ভাবছিলাম,
“আপু তো জানে না মাহফুজকে আমি কি পরিমান ব্যস্ত রাখি। আর টাকা তো ওর কাছে বেশী থাকার কথা নয়। সংসারের সব খরচ তো ওকেই বহন করতে হয়। আমি যেহেতু চাকরি করার পরও একজন গৃহিনীর মতো সার্ভিস দেই সেহেতু আমার ইনকামের টাকাও আমি নিজের কাছেই যত্ন করে রাখি। তবে খরচ করি না তা নয়। ভাবছি সামনে মাহফুজকে একটা আই ফোন কিনে দিবো।”
নীচে নেমে দেখি সাহেব আমার অটো ঠিক করে দাঁড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে মাহফুজ বললো,
—-চলো,আগে কোথাও গিয়ে লাঞ্চ সেরে ফেলি।
যেই ভাবা সেই কাজ। মেডিকেল মোড়ের সামনে বৈশাখীতে গিয়ে নানা পদের ভর্তা ডাল, সবজি মাছ দিয়ে লাঞ্চ করলাম। এরপর চিকলি ওয়াটার পার্কে গিয়ে নৌকা করে ঘুরলাম। ভালো লাগলো। ছুটির দিন না থাকায় ভীড়ভাট্টা কম ছিলো। মাগরিবের আজানের আগেই অটো করে বাসার পথে আমরা রওয়ানা দিলাম। কাল আমার অফ আছে। ভাবছি রাতে নেটফ্লিক্সে মুভি দেখবো। বাসায় পৌঁছে শাড়ি চেইঞ্জ করে ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে মাগরিবের নামাজ আদায় করে নিলাম। মাহফুজও নামাজে বসেছে। আমি মাংসের কাটলেট বানিয়ে ফ্রিজে রেখেছিলাম। সেটাকে ওভেনে গরম করতে দিয়ে চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিলাম। মাহফুজ মোবাইলে খবর দেখছিলো। আমার হাতে চা আর কাটলেট দেখে বললো,
—কিভাবে বুঝলে আমার এখন কাটলেট খেতে ৃন চাইছিলো।
আমিও একটু পার্ট নিয়ে বললাম,
—-এই না হলে আমি তোমার বউ।
চলবে