দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১৪

0
90

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-চৌদ্দ
মাহবুবা বিথী

চা নাস্তা করেই মাহফুজ আবারও বারান্দায় বসে মোবাইলের ইউটিউবে খবর আর টক শো দেখতে বসলো। আমি নেটফ্লিক্সটা অন করে বসলাম। আমার এই এক সমস্যা। যখনি কোনো মুভি দেখতে বসি তখনি রাজ্যের ঘুম দু,চোখে নেমে আসে। এই কারনে মাহফুজ আমার সাথে মুভি দেখতে চায় না।
কতোক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছি কে জানে। মাহফুজের ডাকে ঘুম ভাঙ্গলো। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি কাঁটা বারোটা ছুঁয়েছে। আমি একটু রেগে মাহফুজকে বললাম,
—-ডাকলেই যখন আর একটু আগে ডাকলে কি এমন ক্ষতি হতো?
—-ডাকতে এসেছিলাম। কিন্তু তুমি যেভাবে শুয়েছিলে তখন ডাকার পরিবর্তে তোমাকে আদর করতে বসতাম। তোমার গায়ের চাদরটা সরে গিয়েছিলো। চোখ সরাতে পারছিলাম না। উরু নাভিমূল স্তন বিভাজিকা সবইতো। থাক আর বললাম না। তবে একথা বলতেই হবে, আল্লাহপাক খুব সুন্দর করে তোমায় গড়েছেন। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো তোমাকে আদর করি। কিন্ত আমি তো আবার তোমার অনুমতি না নিয়ে আজ অবদি তোমাকে স্পর্শ করেনি। তাছাড়া দেখলাম তুমি গভীর ঘুমে অচেতন। তাই আর ডাকিনি।
—-পুরুষ মানুষের চোখ বলে কথা। তার উপর নোংরা কথা বলতে তোমার জুরি মেলা ভার।
—-দেখো,আমি কিন্তু লুইচ্ছা পুরুষ মানুষ নই।
—-শোনো পুরুষ মানুষের যাহা বায়ান্ন তাহা তেপান্ন। এখন আমাকে কাজে হেল্প করো। ফ্রীজ থেকে ভাত, তরকারী বের করে ওভেনে দাও। আমি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসছি।
আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে এসে ডিনার করে এশার নামাজ আদায় করে নিলাম। বিছানায় শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। মাহফুজ ক্লান্ত থাকার কারনে মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি ওর তখনকার কথাগুলো ভাবছিলাম। আর মনে মনে হাসছিলাম। ও অবশ্য ভুল বলেনি। ও আসলেই খুব ভদ্রলোক। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ও কোনোদিন আমাকে জোর করেনি। আমার রেসপন্স না থাকলে কখনও এগোয়নি। ওর এই আচরণগুলো আমার ভীষণ ভালো লাগে। হঠাৎ করে ওর একটা হাত আমার গায়ের উপর এসে পড়লো। আমিও পাশ ফিরে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলাম। খুব মায়া লাগছিলো। ও বাচ্চাদের মতো করে ঘুমুচ্ছে।

পরদিন ভোরে উঠে নিত্যকার রুটিন মেনে মাহফুজও ওর অফিসের দিকে রওয়ানা দিলো। আর আমিও অটো করে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার মাহফুজকে একটা কথা বলা দরকার। ইদানিং আমার মনে হয় কেউ একজন আমাকে ফলো করে। আমি যখনি অটো করে রওয়ানা দেই একটা হুন্ডা আমার পিছনে আসে। একদিন দু,দিন হলে না হয় মানা যেতো ঐ আগুন্তক নিজের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে। কিন্তু আজ একসপ্তাহ থেকে ঐ হুন্ডাওয়ালা আমাকে ফলো করছে। মাথায় হেলমেট পড়ার কারনে চেহারা দেখা যায় না।

কলেজে পৌঁছে রোল কলের খাতা নিয়ে ক্লাসে ছুটলাম। আজ একটানা দুটো পর্যন্ত ক্লাস আছে। দুটোর পর আবার ডিসি স্যারের সাথে প্রিন্সিপাল ম্যামের মিটিং আছে। আমাদের সবাইকে থাকতে বলেছে। এতো দেরী করে মিটিং হলে আমার খুব বিরক্ত লাগে। কিছু করার নাই। ডিসি সাহেব খুব ব্যস্ত মানুষ। লাঞ্চের আগে আসতে পারবেন না। অগত্যা এসময়টাতে মিটিং এর সিডিউল দেওয়া হলো। এর মাঝে মাহফুজ ফোন দিয়েছিলো। ওকেও জানিয়ে দিলাম আমার বাসায় ফিরতে সন্ধা হয়ে যাবে।

ক্লাস শেষ করে মিটিং এ উপস্থিত হলাম। ডিসি সাহেব খুবই ভদ্রলোক টাইপের মানুষ। খুব অমায়িক। কোনো অহমিকা নেই। উনার কথা শুনেই বুঝলাম কাজের ক্ষেত্রে উনি শতভাগ সৎ থাকার চেষ্টা করেন।উনি নিজ থেকে মাহফুজের নাম বলে আমার সাথে পরিচিত হলেন। হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বিকাল পাঁচটা বাজে। এদিকে আকাশটা কালো করে এসেছে। এখন মাঘ মাস। মনে হয় বৃষ্টি নামবে।
“বৃষ্টি হলে মাঘের শেষ
ধন্য রাজার পূন্য দেশ”
কিন্তু আমার তো টেনশন হচ্ছে। কলেজ থেকে বের হতেই এক বিশাল ঝড়ো বাতাস বয়ে গেল। চোখে মুখে ধুলো লেগেছে। কিছুই দেখতে পারছি না। ব্যাগ থেকে টিসু বের করে চোখটা মুছে নিলাম। বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। একটাও অটো কিংবা রিকশা কোনো কিছুর দেখা পেলাম না। এদিকে চারিদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। ভাবলাম মাহফুজকে একটা ফোন দেই। মোবাইল বের করে দেখলাম ২% চার্জ আছে। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। জানি ফোন করতে না করতে চার্জ শেষ হয়ে যাবে। তবুও মাহফুজকে কল করলাম। রিং হচ্ছে। কিন্তু ওতো ফোন ধরছে না। মাহফুজ ফোনটা ধরতেই চার্জ শেষ হয়ে গেল। এদিকে মুষলধারে বৃষ্টি নামছে। আমি সকালের সেই হুন্ডাওয়ালাকে দেখতে পেলাম। বুকটা কেমন কেঁপে উঠলো। ঐ মুহুর্তে একটা অটো পেয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি অটোতে উঠে খুব জোরে অটোড্রাইভারকে চালাতে বললাম। হুন্ডাটা এমনসময় আমার অটোর কাছাকাছি পৌঁছে গেল। আমি পিছনে ঘুরে দেখলাম, জোরে বাতাস আর মুষলধারে বৃষ্টির কারনে হুন্ডাটা ঐ আগুন্তক একটা গাছের নীচে থামিয়ে রাখলো।

কিছুদূর যাওয়ার পর অটোটা নষ্ট হয়ে গেল। ড্রাইভার বললো,ও আর যেতে পারবে না। মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। মনে মনে বললাম,”নষ্ট হওয়ার জায়গা পেলো না।” তারপরও অনুরোধ করে বললাম,
—-মামা, দেখেন না কষ্ট করে একটু চালানো যায় কিনা?
—-চালানো গেলে আমি আপনারে ঠিকই নিয়া যাইতাম। ঝড় বাদলায় আপনাকে একা ছাড়তাম না।ব্যাটারীর চার্জ শেষ হয়ে গেছে।
অগত্যা ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। কখন আবার ঐ হুন্ডাওয়ালা ব্যাটা চলে আসে। ভয়ে বুকটা কাঁপছে। মনে মনে আয়াতুল কুরছি পড়ে যাচ্ছি। এদিকে শোঁ শোঁ করে ঝড়ের গতি বেড়েই চলেছে। মুহু মুহু বিদ্যূতের গর্জন শোনা যাচ্ছে। ঐ বাইকওয়ালা আবার আসতে শুরু করেছে। রাস্তার হ্যালোজেনের আলোতে আমি ওর অবয়বটা দেখলাম। আমিও বাসার কাছাকাছি চলে আসছি। ওর হাত থেকে বাঁচতে উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে লাগলাম। বাসার গলিতে ঢুকতেই লোডশেডিং হলো। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। উর্দ্ধশ্বাসে দৌড়াতে গেলে অন্ধকারে মনে হয় কারো সাথে ধাক্কা খেলাম। ওর হাতের ছাতাটা উড়ে গেল। এমনসময় রেগে কিছু বলতে যাবে, অমনি চেঁচিয়ে বললাম, মাহফুজ আমি। বিদ্যুত চমকানোর আলোয় দুজন দু,জনকে দেখে জড়িয়ে ধরলাম। সেসময় বাইকটা বেশ জোরে দ্রুতগতিতে আমাদের ক্রস করলো। মাহফুজ আমাকে জড়িয়ে ধরে ঘরে নিয়ে গেল। মোবাইলের আলোতে আমার ফ্যাকাশে চেহারা দেখে বললো
—-তুমি কি কোনো কারনে ভয় পেয়েছো? আর তোমার মোবাইল বন্ধ ছিলো কেন?
এতোটা পথ হেঁটে আসাতে আমি খুব ক্লান্ত। তাই খুব আস্তে বললাম,
—-চার্জ ছিলো না। ভয় পাওয়ার ব্যাপারটা এই মুহুর্তে চেপে গেলাম।
ও কিছু না বলে কিচেনে গিয়ে দুটো মোমবাতি জ্বালিয়ে এনে বললো,
—-একটা মোমবাতি নিয়ে তুমি ওয়াশরুমে যাও। ফ্রেস হয়ে আসো। আমি কফি বানিয়ে দিচ্ছি।
আমি মোমবাতি নিয়ে ওয়াশরুমে গিয়ে ড্রেস চেঞ্জ করতে গিয়ে মনে হলো,”আমি তো পোশাক নিয়ে বাথরুমে ঢুকিনি। বাথরুমেই মাহফুজের একটা কালো শটস আর আকাশি রঙের গেঞ্জি ছিলো। ওটা পড়েই বের হয়ে আসলাম। আমার খুব শীত লাগছিলো। মাহফুজের সামনে যেতেই ও চোখ গোল করে আমাকে দেখতে লাগলো। এমনসময় বাজের শব্দে আমি মাহফুজকে পিছনদিক থেকে জড়িয়ে ধরলাম। শব্দ থেমে যাবার পর ও আমার হাত ধরে পিছন দিক থেকে সামনে আনলো। আমি চোখ বন্ধ করে রেখেছি। আর ওর অনুভবটুকু উপলব্ধি করতে পারছি। আমি ধাতস্ত হয়েই ওর হাতের মুঠি থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলাম। কিন্তু ও আমার সামনে রাখা মোমবাতিটা ফুঁ দিয়ে নিভিয়ে দিলো। ওর উষ্ণশ্বাস আমার কানের লতি থেকে গলা ঘাড় অবধি নেমে এলো। ওর হাত আমার কোমরকে স্পর্শ করলো। বাইরের প্রলয় আর ঘরের প্রলয় যেন মিলেমিশে একাকার হলো। ঝড় একসময় থেমে গেল। মাহফুজ আমাকে জড়িয়ে ধরে মুখের কাছে মুখ এনে বলল,
—-তুমি কি কোনো কারনে ভয় পেয়েছিলে?
—+বাজ পড়ার শব্দকে আমি খুব ভয় পাই।
একবার মনে হলো বাইকওয়ালার ঘটনাটা বলি। কিন্তু পরক্ষনেই মনে হলো আরো একটু অবজার্ভ করে তারপর বলি। আমার নিরবতায় মাহফুজ আমাকে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো,
—+এভাবে অন্ধকার রাস্তায় দৌড়ানো তোমার ঠিক হয়নি। যদি কিছু হয়ে যেতো? আর মোবাইলে সবসময় চার্জ দিয়ে রাখবে। তোমাকে ফোনে না পেয়ে আমার এদিকে জান যায় যায় অবস্থা। এই ঝড়ের মধ্যে আমি ছাতা নিয়ে ঐ গলিতে পায়চারী করছিলাম। ওদিকে অরুপটাও নাই। খোঁজ নিয়ে জানলাম, ও নাকি বাড়িতে গিয়েছে। কি একটা সময় যে আমি পার করেছি!

চলবে