#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-পনেরো
মাহবুবা বিথী
সেই বৃষ্টির রাতের পর থেকে বাইকওয়ালাকে আর দেখিনি।এই বিষয়টা আমাকে ভাবাচ্ছে। কলেজে এসে ক্লাস শেষ করে কমনরুমে বসলাম। একটু ক্লান্ত লাগছে। ইদানিং আমার প্যানিক অ্যাটাক হয়। আমার মাথায় সেই বৃষ্টির রাতের বাইকের ঘটনাটা গেঁথে আছে। কিছুতেই মাথা থেকে সরাতে পারছি না। যতটুকু আমি নিজের সম্পর্কে জানি জ্ঞানত কোনোদিন কারো ক্ষতি করিনি। যখনভাবি ঐ রাতে যদি ঐ বাইকওয়ালা আমাকে ধরতে পারতো তাহলে ঘটনাটা কোনদিকে মোড় নিতো। আমি যদি সেদিন ওর দ্বারা লাঞ্চিত হতাম মাহফুজ কি আমায় মেনে নিতো? নাকি এই সমাজ সংসার আমাকে কলঙ্কের তিলক পরিয়ে দিতো।ফোনটা বেজে উঠলো। মোবাইল ওপেন করে দেখি মাহফুজ ফোন দিয়েছে। ফোনটা রিসিভ করে হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
—-my love কেমন আছো?
—-সকালেই দেখলে আমি কেমন আছি। এতো ন্যাঁকামি করে জিজ্ঞাসা করার কি আছে?
—-আছে,তোমার মাথায় কি ঘুরপাক খাচ্ছে তা,আমি বেশ বুঝতে পারছি।
আমি ভাবলাম ও হয়তো বলবে ওর ভালোবাসায় আমি গদগদ হয়ে আছি। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো,
— বাসায় আসো তোমার জন্য সারপ্রাইজ আছে। আজ হাফবেলা ছুটি নিয়েছি।
কি সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে সেটা জানার জন্য ক্লাস শেষ করেই বাসার পথে রওয়ানা দিলাম। আমার একটা অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। অটোতে উঠেই বার বার পিছন ফিরে তাকাই। কেমন একটা ভয় কাজ করে।
বাসার সামনে যেতেই মাটনবিরিয়ানীর সুবাসে পেটের ভিতর ঘুমিয়ে থাকা ক্ষুধাটা মোঁচড় দিয়ে উঠলো। কার বাড়িতে রান্না হচ্ছে কে জানে? সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতেই সুবাসটা আরো প্রকট হলো। ডোরবেল চাপতেই মাহফুজ দরজা খুলে বললো,
—-আসুন মহারানী,আপনার জন্যই অপেক্ষা করছি। ব্যাগটা রেখে ওয়াশ রুমে গিয়ে ফ্রেস হয়ে আসেন। খুব ক্ষিদে পেয়েছে।
—-মাটন বিরিয়ানী তুমি রান্না করেছো?
—জ্বী ম্যাডাম,
মনে মনে বললাম, লোকটা পারেও বটে। দুপুরের রান্নাতো করাই ছিলো। ঘেমে নেয়ে রান্না করার কি দরকার ছিলো। আচ্ছা সারপ্রাইজটা কি? সেটাতো জানা হলো না। কৌতূহল অবদমিত করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-এটা কি সেই সারপ্রাইজ?
—-না,খাওয়ার পর ধীরে সুস্থে সারপ্রাইজটার বিষয়ে কথা বলবো।
ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে এসে খুব মজা করে মাটন বিরিয়ানী দিয়ে লাঞ্চ করে নিলাম। মাহফুজ খেয়েই বিছানায় শুয়ে পড়লো। আমি এঁটো বাসনগুলো কিচেনে রেখে বিছানায় বসে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-এবার বলো তোমার সারপ্রাইজটা কি?
—-সেদিন বৃষ্টির রাতে যে কালপ্রিট তোমার পিছু নিয়েছিলো তাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তুমি তো আমাকে কিছুই বলোনি। ঐ কালপ্রিট বহুদিন থেকেই তোমার পিছু নিয়েছিলো।
আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। ও আমার চোখের সামনে আঙ্গুল দিয়ে তুরি বাজিয়ে বললো,
—-হা,করে দেখছো কি? এতোবড় একটা ঘটনা আমাকে না জানিয়ে তুমি ঠিক করোনি।
—-বলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু—-
—কিন্তু কি?
—-আমার একজনকে সন্দেহ হয়েছিলো। কনফার্মের অপেক্ষায় ছিলাম।
—-কনফার্ম করতে গিয়ে যদি তোমার বড় কোনো বিপদ হয়ে যেতো? তোমার কাকে সন্দেহ হয়।
—-ক,দিন আগে আমি রোকেয়া ভার্সিটির ছাত্রলীগের
এক নেতার বোনকে পাশ করিয়ে দেইনি। পরে প্রিন্সিপাল ম্যাম ঐ ছাত্রীকে পাশ করিয়ে দেন।
—-তাকে সন্দেহ করার কি কারণ?
—–এখানে আসার পর ঐ ছাত্রলীগের নেতার সাথেই আমার টক্কর লেগেছিলো। এছাড়া তো কারো সাথে লাগেনি।
—-হুম,ঐ নেতা তোমাকে ভয় দেখানোর জন্য পিছনে
লোক লাগিয়ে রেখেছিলো।
—-তুমি কি করে জানলে?
—-সেই ঝড় বৃষ্টির রাতে তোমার ভয়ক্লিষ্ট মুখ দেখে কিছু একটা আঁচ করেছি। এই ডরমিটরির পাশেই যেহেতু সার্কিট হাউস এখানে তো সিসি ক্যামেরা আছে। তাই ক্যামেরা চেক করতেই ঐ বাইকওয়ালার ছবি পাই। বাইকের নাম্বার প্লেট টুকে নিয়ে পুলিশ দিয়ে অনুসন্ধান চালাতে থাকি। যাক মুহুর্তেই কালপ্রিটটাকে ধরে ফেলি।
—–নেতাকে ধরেছো নাকি হাতা ধরেছো?
—-নেতাটা হাত ফসকে গিয়েছে। তবে হাতাটাকে ধরে, লকাপে পুরে দিয়েছি। ম্যাজিস্টেটের বউয়ের পিছনে লাগার সাধ চিরজীবনের মতো মিটে যাবে।
—-কিন্তু এর পরিনাম কি ভালো হবে?
—এতো ভয় পেলে চলবে না।
মনে মনে ভাবলাম, আসলে এই কারনে মাহফুজকে বলতে চাইনি। ও এরকমটা করবে এটা আমি জানতাম। তাই চিন্তিত হয়ে মাহফুজকে বললাম,
—-এই সব কাহিনী ঘটাবে বলে তোমাকে বলিনি। কারণ এখন পরিস্থিতি ভিন্নরকম। আমরা দু,জনেই সরকারী চাকরি করি। সুর্যের থেকেও বালি বেশী গরম হয় কথাটা ৃনে রেখো। এটা একটা প্রবাদ। এই যে হাতাকে ধরেছো, নেতার নামে অ্যারেস্ট ওয়ারেন্ট জারি করেছো,দেখো কোথাকার পানি কোথায় গিয়ে গড়ায়। তোমার নেলীর কথা মনে আছে?
—-হুম,ফরেনারদের মতো দেখতে
—-হুম, তুমি তো জানো, ও রংপুর মেডিকেল থেকে এমবিবিএস পাশ করেছে। আমার বান্ধবীও ডাক্তার। ওর হাসব্যান্ড সাকিবভাইও রংপুর মেডিকেল কলেজের ছাত্র ছিলেন। দু,জনেই একসাথে বিসিএস কোয়ালিফাই করে স্বাস্থ্য ক্যাডারে জয়েন করেছে। এরপর দুজনের মাদারীপুর সদর হাসপাতালে পোস্টিং হয়। ভালোই চলছিলো ওদের দাম্পত্য জীবন। কিন্তু হঠাৎ ওদের সুখের সংসারে শকুনের থাবা পড়লো। সাকিবভাই সেদিন সদর হাসপাতালে ডিউটিতে ছিলো। সেসময় গুলিবিদ্ধ একটা ছাত্রের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। সাকিবভাইয়ের উপর ময়নাতদন্ত করার দায়িত্ব অর্পিত হয়। সাকিবভাই রিপোর্টে লিখেন গুলি করে ঐ ছাত্রকে মারা হয়েছে। স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা নিজেদের মধ্যে অর্ন্তদন্দে গোলাগুলিতে জড়িয়ে পড়ে। ঐ ছাত্রটি সেখানে গুলিবিদ্ধ হয়। কিন্তু ঐ কলেজের ক্ষমতাসীন দলের এক ছাত্র নেতা এসে বলে,
—-গুলিবিদ্ধ হয়েছে একথা লেখা যাবে না। হার্ট ফেইলোর হয়ে মৃত্যু হয়েছে লিখতে হবে।
কিন্তু সাকিবভাই রাজী হলেন না। উনি রিপোর্টে সত্য কথাই লিখলেন। যারফলে পুলিশ কেইস হলো। সন্ত্রাসীদের গ্রেফতার করা হলো।
—-যাক সাকিবভাই একটা ভালো কাজ করেছে।
—-তুমি পুরোটা আগে শোনো। তারপর মন্তব্য করো। এরপর নেলীর সংসারে শকুনের কুদৃষ্টি পড়লো। এক গভীর রাতে নেলী আর সাকিবভাইয়ের দরজায় অচেনা কিছু আগুন্তক কড়া নাড়লো। রাত তখন দুটো। সাকিবভাই ওদের পরিচয় জানতে চাইলে উনারা বললেন,
“আইশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে উনারা এসেছেন।”
দরজা খুলে দিতেই হুড়মুড় করে উনারা ঘরের ভিতরে ঢুকলেন। এবং সাকিবভাইকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যেতে চাইলেন। উনার পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি ছিলো। উনি চেঞ্জ করতে চাইলেন। সেই সময়টুকু উনাকে দেওয়া হলো না। টেনে হিঁচড়ে হাতে হ্যান্ডকাপ পরিয়ে জীপে নিয়ে উঠালেন।
সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার নেলী তখন পাঁচ মাসের অন্তসত্তা ছিলো। এরপর থানার দরজায় দরজায় নেলী ধর্ণা দিলো। কেউ সাকিব ভাইয়ের খোঁজ দিতে পারলো না। ওর একটা ফুটফুটে মেয়ে সন্তান হয়েছে। আজ তিনবছর হয়ে গেল সাকিব ভাইয়ের কোনো খোঁজ মেলেনি। ওদের পরিচিত এক আত্মীয়ের কাছে শুনেছে ডিজিএফ এর আয়নাঘরে সাকিব ভাই বন্দী আছে। ঐ আত্মীয় মেজর হিসাবে সেনাবাহিনীতে কর্মরত আছেন।
—-নেলী কি হাল ছেড়ে দিয়েছে নাকি এখনও খোঁজ করছে।
—-হাল ছেড়ে দেয়নি। কিন্তু ওকে থ্রেট দেওয়া হয়েছে।
—-কারা থ্রেট দিয়েছে?
—-তাতো ও বলতে পারে না। ওর মোবাইলে মেসেজ আসছে সাকিব ভাইয়ের বিষয় নিয়ে যদি বেশী বাড়াবাড়ি করে তাহলে ওর অবস্থাও সাকিব ভাইয়ের থেকে ভয়ানক হবে। কারণ ওকে আগে রে*প করা হবে। আর ওর মেয়েটাকে পতিতালয়ের খালাদের কাছে দিয়ে দেওয়া হবে। যাতে বড় হয়ে রাতের রাজাদের সেবায় নিজেকে অনায়াসে বিলিয়ে দিতে পারে। তুমি ভাবতে পারছো যারা ওকে এই থ্রেট দিয়েছে তাদের পাশবিকতা পশুদেরও হার মানিয়ে দিবে। বাচ্চাটার বয়স কেবল আড়াই বছর। ওর কাছে ঘটনাটা শোনার পর আমার গা টা কাঁটা দিয়ে উঠলো।
—-নেলী এখন কোথায়?
—-ও এসডি হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পোস্টিং হয়েছে। জানো, বাচ্চাটা জন্মের পর আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ও আমার হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললো,
—-বাবা, কি জিনিস আমার মেয়েটা কোনোদিন জানতে পারবে না।
—-আমি কিছু বলতে পারিনি। কারণ কিছু কিছু ঘটনায় সান্তনাটাকে করুণার মতো লাগে।
আমি বুঝতে পারছি, কথাগুলো শুনে মাহফুজ খুব টেনশনে আছে। তাই নিজের টেনশনটাকে রিলিজ করার জন্য বললো,
—-ভয় পাইলে ভয়। ভয়কে জয়কে করতে শিখতে হয়।
—-সেই অভিজ্ঞতার আলোকে তোমাকে জানাতে চাইনি। আমার পিছনে যে ফেউ লেগেছিলো তার উৎপত্তি কোথায় তা আমি ঠিক আন্দাজ করতে পেরেছিলাম। তোমাকে আরএকটা বিষয় আমার জানানো হয়নি। কনফার্ম না হয়ে জানাতে চাইছি না। এটা আরো একটা সারপ্রাইজ।
চলবে