দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-১৬

0
2

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-ষোলো
মাহবুবা বিথী

আমি কমনওয়েলথ স্কলাশিপের জন্য আবেদন করেছিলাম। সেখান থেকে পজেটিভ নিউজ এসেছে। তবে আরো কিছু ডকুমেন্ট চেয়েছে। সেগুলো জমা দিলে ওরা আমার বিষয়টা ফাইনাল করবে। সে কারনে মাহফুজকে এই মুহুর্তে জানাতে চাইছি না। আমি জানি মাহফুজ এই খবরটা পেলে খুব কষ্ট পাবে। ও খুব শখ টোনাটুনির মতো একটা সংসার। আমার জন্যই ফেনী থেকে বদলী নিয়ে এখানে চলে এসেছে। নিউজ পাবার পর থেকে আমারও একটা অন্যরকম অনুভূতী হচ্ছে। ওকে ছেড়ে যেতে মন চাইছে না।
আমি কিছুটা খেলার ছলেই এপ্লাই করেছিলাম। স্বপ্নেও ভাবিনি আমার স্কলারশিপ হয়ে যাবে। তাও আবার কমনওয়েলথ এর মতো একটা কাঙ্খিত স্থানে। আমাদের মতো পড়ুয়ারা এই স্বপ্নটাকে যুগযুগ ধরে বুকের তোরঙ্গে লালন করি। সময়টা যদিও বেশী না। একবছর দেখতে দেখতে পার হয়ে যাবে। তারপরও কেমন যেন লাগছে। আমি আসলে মাহফুজকে না জানিয়ে স্কলারশিপের আবেদন করেছিলাম। কিছুটা সন্দিহান ছিলাম। ভেবেছিলাম হয়তো হবে না। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি আটটা বেজে গেছে। কিচেনের কাজ গুছিয়ে টেবিলে নাস্তা দিয়ে মাহফুজকে ডেকে খেতে বললাম। আজ থেকে কলেজে পরীক্ষা শুরু হবে। একারনে দশটার আগেই আমাকে কলেজে পৌঁছাতে হবে। আমি রেডী হয়ে এসে টেবিলে মাহফুজের সাথে নাস্তা খেতে বসে ওর দিকে তাকিয়ে দেখি প্লেটে খাবারগুলো শুধু নাড়াচাড়া করছে। ওকে একটু অন্যমনস্ক লাগছে। আমার কাছে ওকে ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তোমার কি শরীর খারাপ? খাবারগুলো খাচ্ছো না কেন?
—-না,এই তো খাচ্ছি।
ও রুটি টুকরো সাথে সুজি নিয়ে মুখে দিলো। আমি জানি মাহফুজ চাপা স্বভাবের। ওর পেট থেকে কথা বার করতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। আমার যেহেতু তাড়া আছে তাই ওকেও তাগিদ দিয়ে বললাম,
—-আমাকে এখুনি বেরুতে হবে।
মাহফুজ একটু মনমরা হয়ে বললো,
—-ঐ বদমাইশটা আগাম জামিন নিয়েছে।
—-তোমার কি এই কারনে মন খারাপ?
—-না, ভাবছি এরকম অপরাধীরা যদি আগাম জামিন নিতে পারে তাহলে তো বিচার বিভাগের উপর মানুষের আস্থা থাকবে না।
—-ওর নামে কি আগে কোনো মামলা ছিলো?
—-ওর নামে কেউ এখানে মামলা করার সাহস পায় না। খুন রাহাজানি এসব অপরাধে অভিযোগ দায়ের হয়েছে। এমনকি একটা মেয়েকে তুলে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগও আছে। আসলে ওর বাবা ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের একজন এমপি। সেই ক্ষমতার অপব্যবহার ছেলে করে।
—-এ আর নতুন কি? আমাদের দেশে তো এসব হয়ে আসছে। এসব নিয়ে ভেবো না।
—-ভাবনাটা তো তোমাকে নিয়ে। ও যদি আবার তোমার পিছু লাগার চেষ্টা করে?
—-এতো ভাবলে তো আমরা চাকরি করতে পারবো না। তবে চোখ কান খোলা রেখে চলতে হবে। চলো বের হয়ে যাই।
আমরা দু,জন দরজায় তালা দিয়ে বের হয়ে গেলাম। মাহফুজ অফিসের মাইক্রোবাসে উঠে অফিসের দিকে রওয়ানা দিলো। আমি একটা অটো নিয়ে রওয়ানা দিলাম। যদিও মাহফুজের সামনে সাহস দেখালাম কিন্তু জামিন পাওয়ার কথা শুনে আমিও একটু ঘাবড়ে গিয়েছি। অটোতে উঠেই একবার পিছনদিকে তাকিয়ে নিলাম। কেউ ফলো করছে কিনা। অটোওয়ালাকে দ্রুত চালাতে বললাম।
কলেজের সামনে এসে নামতে গিয়ে শাড়িটা অটোতে আটকে যাওয়াতে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতেই নিজেকে সামলে নিলাম। তখন পাশ দিয়ে বাইকের স্পীড বাড়িয়ে দিয়ে ঐ সন্ত্রাসীটা চলে গেল। বাইকের পিছনে ওর বোন বসা ছিলো। ভাড়া মিটিয়ে এগিয়ে যেতেই আমার ঐ তথাকথিত ছাত্রী আমাকে সালাম দিলো। আমি ওর দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকিয়ে মনে মনে সালামের উত্তর দিলাম।
কলেজের ভিতরে ঢুকতেই পিছনদিক থেকে কে যেন বললো,
—-,হ্যালো,ম্যাম আপনি মনে হয় জানেন,কেউ সালাম দিলে তার উত্তর দিতে হয়।
—-জানি তো!
—-আমার বোনের সালামের উত্তর তো দিলেন না।
—-দিয়েছি কি না সেই কৈফিয়ত তো আপনাকে দিবো না।
এ কথা বলেই দ্রুত পা চালিয়ে কলেজের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মনে মনে ভাবলাম, এদের সাহস এতো বেড়েছে যে চাকরি করা আসলেই কঠিন হয়ে পড়ছে। অফিসরুমে ঢুকেই প্রথমে এটেনডেন্ট খাতায় সাইন করে আমি রোল কলের খাতা, পরীক্ষার খাতা, প্রশ্নপত্র নিয়ে আমার ক্লাসরুমে চলে গেলাম। ক্লাসে ঢুকেই সবাইকে বই ব্যাগ রুমের বাইরে রেখে আসতে বললাম। ছাত্রীরা বই ব্যাগ বাইরে রেখে আসতেই খাতা দিয়ে দিলাম। এরপর ঘন্টা পড়তেই প্রশ্নপত্র দিয়ে দিলাম। শুনসান নির্জনতায় সবাই পরীক্ষা দিচ্ছে। আমি পুরো রুমে পায়চারী করতে লাগলাম। আমার সাথে ডিউটিতে সালেহা আপাও আছেন। উনি গতকাল আমাকে জানিয়েছেন,আজ আসতে উনার হাফ এন আওয়ার দেরী হবে। আজকের সকালের ঘটনাটা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না।

আজ পরীক্ষা শেষ হলো। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। পরীক্ষা একমাস ধরে চললো। আজ খুব ক্লান্ত লাগছে। পরীক্ষা শেষের ঘন্টা পড়তেই আমি আর সালেহা আপা পরীক্ষার খাতা,লুস সিট, নিয়ে টিচার্স রুমে চলে আসলাম। পরীক্ষার খাতাগুলো প্রিন্সিপাল ম্যামের কাছে বুঝিয়ে দিয়ে কলেজ থেকে বের হয়ে আসলাম। অমনি পিছনদিক থেকে সালেহা বলে উঠলেন,
—-কি ব্যাপার বাড়ি যাবার জন্য এতো অস্থির কেন? স্বামীর আদর খাওয়ার জন্য দ্রুত বাড়ি যাচ্ছো? আমরা কিন্তু সব বুঝি।
—-হুম একটু বেশী বুঝেন।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে অটো নিয়ে বাড়ির পথে রওয়ানা দিলাম। আজ তো বৃ্‌হস্পতিবার। মাহফুজ বৃহস্পতিবার আগেই বাসায় চলে আসে। আমি আড়াইটার দিকে বাড়ি পৌঁছে গেলাম। ডোর বেল বাজাতেই মাহফুজ দরজা খুলে দিলো। ঘরে ঢুকতেই ও আমাকে বললো,
—–ওয়াশরুম থেকে দ্রুত ফ্রেস হয়ে আসো। আমি টেবিলে ভাত বেড়ে দিয়েছি।
ফ্রেস হয়ে এসে দ্রুত লাঞ্চ করে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিলাম। একমাস পরীক্ষার ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় নিজের দিকে তেমন একটা খেয়াল রাখতে পারিনি। কিন্তু আজ শরীরটা ছেড়ে দিয়েছে। সারা শরীরে ব্যথা। বিশেষ করে পা দুটো ভীষণ ব্যাথা করছে। আমার ছটফটানি দেখে মাহফুজ আমায় বললো,
—+কোনো সমস্যা হচ্ছে?
—-হুম,পা দুটো খুব ব্যথা করছে।
আমার কথা শুনে মাহফুজ আমার পায়ের কাছে এসে বসলো। তারপর আমাকে বললো,
—-আমি কিন্তু খুব ভালো মেসেজ করতে পারি। তুমি চাইলে আজ তোমার পা দুটো মেসেজ করে দিতে আমার কোনো আপত্তি নাই।
মনে মনে বললাম,প্লিজ বলেছো যখন তখন হাত দুটো কাজে লাগিয়ে দাওনা। আমি তো সহ্য করতে পারছি না। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ও আবার বললো,
—-মেসেজ করলে দেখবে খুব আরাম লাগবে।
—-দাও।
মাহফুজ খুব যত্ন করে আমার পা দুটো মেসেজ করছে। আমারও বেশ আরাম লাগছে। একটু পর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম,ও একটু অস্বস্তিতে আছে। তাই ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-তোমার কি অস্বস্তি হচ্ছে?
—-না, আমার অস্বস্তি হচ্ছে না। তবে এই দৃশ্য আমার মা দেখলে হার্টফেইল করতো। আর আমাকে বলতো তোকে পেটে ধরেছি, জন্ম দিয়েছি,ম্যাজিস্টেট হয়েছিস কি বউয়ের পা টেপার জন্য?
—-সমস্যা নেই,মাতো দেখছে না। আর তুমি তো আমাকে বলেছো, ছোটোবেলায় প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আধঘন্টা ধরে মায়ের পা টিপে দিতে। সুতরাং অস্বস্তি কাটাকাটি। আর তাছাড়া তোমার যখন পা ব্যথা করে আমিও কিন্তু সুন্দরভাবে মেসেজ করে দেই। তাহলে তুমি দিলে সমস্যা কোথায়?

চলবে