দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০২

0
5

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-দুই
মাহবুবা বিথী

আমার বিয়ের দিন শ্বশুর বাড়িতে যাবার পর শাশুড়ী মা আমাকে যখন মিষ্টিমুখ করালেন তখন উনার হাতে হীরার নাক ফুলের বক্সটা তুলে দিলাম। উনি জিনিসটা হাতে পেয়ে বললেন,
—–এটা কি,?
—-মা,আপনার জন্য আমার একটা ছোটো গিফট।
উনি বক্সটা খুলে নাকফুলটা হাতে নিয়ে দেখলেন। আমি জানি উনার খুব পছন্দ হয়েছে। কারণ পছন্দ হলে মানুষের মুখের এক্সপ্রেশন বদলে যায়। তারপর উপস্থিত সবার দিকে তাকিয়ে বললেন,
—-আমারকি এসব পড়ার বয়স আছে?
শ্বশুর সাহেবের মনে হয় শাশুড়ী মাকে একটু খোঁচা ইচ্ছে হলো। উনি নাকফুলটা দেখে বলে উঠলেন,
—-তুমি আবার এ বয়সে শিং কেটে বাছুরের দলে নাম লিখিয়ো না।
একথা বলেই শ্বশুর সাহেব ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সাথে সাথে আমার শাশুড়ী মায়ের মুখটা অমাবশ্যার অন্ধকারে ডুবে গেল। শ্বশুরের কথা শুনে আমার মেজাজটা একটু খারাপ হলো। বলতে ইচ্ছে হয়েছিলো,ছত্রিশ বছর ধরে এই মানুষটার একটা হীরের নাকফুলের শখ ছিলো। অথচ লাইফ পার্টনার হয়ে আপনি এর হদিস রাখতে পারেননি। তাহলে তো শিং কেটে আর বাছুর হতে হয় না। কিন্তু এখন তো কিছু বলা যাবে না। আসার সময় আম্মু বার বার বলে দিয়েছে আমি যেন কোনো স্পষ্ট কথা না বলি। এটা আমার একটা বড় দোষ। মুখের উপর সত্যি কথা বলে দেওয়া। আমার বড় ভাসুর শাশুড়ী মাকে সান্তনা দিয়ে বললো,
—-আব্বা তোমার সাথে জেলাস করে একথা বলেছে। এসব গায়ে মেখো না।
মাহফুজ উনার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-তুমি তো জানো মা, বাবার কথা বার্তার ধরণটাই এমন। দেখোনি আমাকে সারাজীবন মানুষের পা ধোয়া পানি খেতে বলেছে। পরীক্ষায় নাম্বার একটু কম পেলেই বলতো,ওমুককে দেখ ক্লাসে ফাস্ট হয়েছে। ওর বাপ ওরে ভাত তরকারী খাওয়ায় আমিও খাওয়াই। অথচ ও ফাস্ট হতে পারলো। তুই পারলি না। যা ওর পা ধোয়া পানি গ্লাসে গ্লাসে খা। তাহলে যদি তোর কিছুটা উন্নতি হয়। কি করবে মেনে নাও।
আমার একমাত্র ননদ এসে বললো,
—-খুব তো আব্বার দোষ ধরছিস? অথচ এই মানুষটার জন্য তুই আজকে এই পজিশনে দাঁড়িয়েছিস।
আমার অবশ্য এদের খুনসুঁটি গুলো ভালোই লাগছে। এটুকু বুঝলাম,এরা সবাই খুব দিলখোলা মানুষ। এমন সময় বড় জা উনার কাছে এসে বললো,
—-এতো কথা বার্তার মাঝে আপনার আর নাকফুলটা পড়াই হবে না। আসেন আমি পড়িয়ে দেই।
আমার বড় জা উনার নাকে নাকফুলটা পড়িয়ে দিলো। ভালোই লাগছে শাশুড়ী মাকে। লাইটের আলো পড়ে জ্বলজ্বল করছে। আসলে বিয়ের পর নতুন বাড়ি নতুন পরিবেশে আমি কি করে মানিয়ে নিবো সেটা নিয়ে খুব ভাবনায় ছিলাম। কিন্ত এখন এদের দেখে ভালোই লাগলো। এরা সবাই সহজ সরল মানুষ। আমি ছোটো বেলা থেকে নানারকম জটিলতা দেখে বড় হয়েছি। কারণ আমার বাবা সংসারের বড় ছেলে। উনারা তিনভাই তিনবোন। আমার বাবা যখন মেট্রিক পরীক্ষা দেয় তখন দাদা মারা যান। সেই থেকে বাবার লড়াই শুরু। নিজেকে অনেক কষ্ট করে আল্লাহপাকের রহমতে ভালোভাবে প্রতিষ্টিত করেছেন। তিন বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। অথচ আমার বাকী দুই চাচা গায়ে ফুঁ লাগিয়ে বেড়িয়েছে। একজন তো মেট্রিকের গন্ডিই পার হতে পারলো না। আর অন্যজন কোনো রকমে ডিগ্রীটা পাশ করলো। অথচ ভাবখানা এমন আমার বাবা সুযোগ পেয়েছে বলে পেরেছে। উনারা সেই সুযোগ পাননি। সুতরাং বাবাকেই সবকিছু করে দিতে হবে। দাদী কালে ভদ্রে প্রতিবাদ করলেও বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিরব দর্শকের ভুমিকা পালন করতেন। যাইহোক এতো জটিলতার মাঝে বড় হয়ে শ্বশুর বাড়ির সহজাত সরলতা আমাকে মুগ্ধ করলো। বিয়ের দিন শ্বশুর বাড়ি গিয়ে সারাদিনের ভারী পোশাক গয়নাগুলো খুলে একটা সুতি শাড়ি পড়ে ওয়াশরুম থেকে ফ্রেস হয়ে আসলাম। গয়নাগুলো আলমারীতে গুছিয়ে রাখার সময় মাহফুজ আমাকে বললো,
—-ড্রইং রুমে সবাই বসে আছে। গয়নাগুলো সবাইকে একটু দেখিয়ে আনো।
ওর কথা শুনে আমার খুব সংকোচ বোধ হলো। নিজের কাছে নিজেকে হ্যাংলা মনে হলো। আমি গোল্ড পছন্দ করি তাই বলে হ্যাংলামো পছন্দ করি না। মাহফুজকে বললাম,
—–আমি হ্যাংলার মতো গয়না দেখাতে পারবো না।
—-এখানে তুমি হ্যাংলামোর কি দেখলে? বিয়ের শাড়িও যেমন সবাই দেখে তেমনি গয়নাটাও দেখতে পছন্দ করে।
অগত্যা গয়না নিয়ে আমাকে যেতে হলো। আমি ড্রইংরুমের টেবিলে গয়নাগুলো রাখলাম। সবাই আমার মায়ের বাড়ির দেওয়া গয়নাগুলো নেড়ে চেড়ে দেখলো। অবশ্য আমার বাবার বাড়িতেও আত্মীয়স্বজন সবাই আমার শ্বশুর বাড়ির দেওয়া গয়নাগুলো ধরে ধরে দেখেছে। বিশেষ করে চাচা ফুফুরা দেখেছে। তাদের কথা হচ্ছে আমার বাবা মানে উনাদের ভাই আমাকে দশভরি গোল্ড দিলেন তো মেয়ের শ্বশুরবাড়ি থেকে কি দিলো দেখা দরকার। অবশ্য উনারাও গয়নাগুলোর প্রশংসা করেছে। আসলে ডিজাইনগুলো আমি মাহফুজকে ইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড করে দিয়েছিলাম।শ্বশুর সাহেব গয়নাগুলো ধরে বললেন বেশ ভারী আছে। শাশুড়ী মা সবটা দেখে বললেন,
—-যাকাত কিম্তু তোমাকে দিতে হবে। আমার ছেলে কিন্তু দিতে পারবে না।
আমি একটু মুচকি হাসলাম। মনে মনে বললাম, যেগুলো আপনার ছেলে বানিয়েছে সেগুলো তাকেই দিতে হবে। আর আমার বাপের বাড়িরটা আমি দিবো। যাক গয়নাগুলো গুছিয়ে নিয়ে রুমে চলে আসলাম। মাহফুজ বিছানায় শুয়ে মোবাইল ক্রল করছে। আমাকে দেখে বললো,
—-তুমি জানতে চাইলে না কেন তোমাকে গয়না দেখাতে বললাম?
আমি ওর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম। ও আমার দিকে তাকিয়ে বললো,
—-আমাদের মতো পরিবারে ছেলের বৌ বলো আর মেয়ে বলো এই বাজারে দশ ভরি গোল্ড দেওয়া বিশাল ব্যাপার। বলতে পারো আমরা কল্পনাই করতে পারি না। কারণ আপুর বিয়েতে মাত্র চারভরি গোল্ড দেওয়া হয়েছে। ভাবীকে পাঁচভরি গোল্ড দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে তোমাকে দশভরি দিতে গিয়ে কেউ কেউ বিরক্ত হয়েছে। বিশেষ করে ভাবি খুব বিরক্ত হয়েছে। কারণ তোমাকে পাঁচভরি দিলে বাকি টাকাটা দিয়ে খাওয়ার পিছনে খরচ করা যেতো। তাহলে ভাইয়ার উপর চাপ পড়তো না। তখন আমি বলেছিলাম,
—-আব্বা তোমাদের যা দিয়েছে। আমাকেও তা দিয়েছে। বাড়তি টাকাটা তো আমি দিলাম।
ভাবি তখন মেজাজ দেখিয়ে বললো,
—-দেখবো তোমার শ্বশুর বাড়ি থেকে কি দেয়?
এদিকে আমার বাবা তো বেঁফাস কথা বলার উস্তাদ। উনি পট করে বললেন”তোমার বাপের বাড়ির গয়না তে আজ অবধি চোখেই দেখলাম না। বাবার কথা শুনে ভাবি তো কান্নাকাটি জুড়ে দিলো। উনাকে নাকি সুযোগ পেলেই অপমানিত করা হয়। আমি তখন কপট রাগ দেখিয়ে বাবাকে বললাম,
—-তুমি আমাদের দেবর ভাবীর মাঝখানে ঢুকছো কেন?
বাবাও কম যান না,অমনি বলা শুরু করলেন,
“উচিত কথা বললে সবারই গায়ে ফোসকা পড়ে।” এজন্য তোমাকে দেখাতে বললাম। শাশুড়ী মায়ের ডাকে আমি শোয়া থেকে উঠে বসলাম।
—-কি ঘুমিয়ে পড়েছিলে? আমার গোসল যোহরের নামাজ সব হয়ে গেলো।
—না,মানে,
—–বুঝেছি,ওরকম বিয়ের পরপর তোমার শ্বশুরও আমাকে সারারাত জাগিয়ে রাখতো। তারই তো ছেলে কেমন হবে সে আমি বুঝে নিয়েছি।
আমার খুব লজ্জা বোধ হলো। তাই দ্রুত ওজু করার কথা বলে ওয়াশরুমে চলে গেলাম।

চলবে