দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৩

0
6

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-তিন
মাহবুবা বিথী

দুপুরে মাহফুজ লাঞ্চ করতে এসে আমাকে রেডী হয়ে থাকতে বললো। আমাকে নিয়ে ফেনীর বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যাবে। এখানে মিরেসরাই যাওয়ার পথে বারইহাট নামে একটা জায়গা আছে। ওখানে কিছু ঝর্ণা আছে। তবে আজ মনে হয় ওখানে যাবে না। শুনেছি ডিসির বাংলোর সামনে একটা দীঘি আছে। নাম বিজয়সিংহ দীঘি। সেন বংশের প্রতিষ্ঠাতা বিজয় সেন এই দীঘি খনন করেছিলেন। চারিদিক নাকি বেশ বৃক্ষশোভিত। বসার জায়গা করা হয়েছে।
আমার শাশুড়ী মা একা থাকবেন বলে কাজের খালাকে ফোনে ডেকে আনলাম। যথারীতি আসরের নামাজ পড়ে রেডী হওয়ার উদ্যেগ নিলাম। শাশুড়ী মায়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখি,উনি বিছানায় চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে। মনে হলো ঘুমিয়ে পড়েছে। তবে একটু আগে উনাকেও আসরের নামাজ পড়তে দেখলাম। ভাবলাম, উনাকে ডেকে বাইরে যাবার কথাটা বলি। পরক্ষণেই মনে হলো কাঁচা ঘুম ভাঙ্গানো কি ঠিক হবে? আমি উনার রুম থেকে বেরিয়ে আমার রুমে চলে আসলাম। পিচ কালারের জামদানী পড়ে নিলাম। সাথে শাড়ির পারের সাথে মিল রেখে গোল্ডেন কালারের ফুলস্লিপ ব্লাউজ পড়লাম। মুখে হালকা মেকাপ করলাম। চোখ ভর্তি করে কাজল পড়লাম। ঠোঁটে ম্যাট কালারের লিপিস্টক দিলাম। শাড়ির সাথে ম্যাচ করে হেজাব পড়ে নিলাম। ডোরবেল বেজে উঠলো। খালা দরজা খুলে দিলো। মাহফুজ ঘরে এসেই বললো,
—তুমি রেডী?
—-হুম,
—–মাকে বলেছো?
—–বলতে গিয়েছিলাম। মা মনে হয় ঘুমিয়ে পড়েছে।
—-এখন একটু গিয়ে দেখে আসো।
আমার যদিও মাহফুজের উপর বিরক্ত লাগছে। কারণ এই বিষয়টা নিয়ে ছোটোবেলা থেকে আব্বু আম্মুকে অনেক নাটক করতে দেখেছি। রেডী হয়ে আম্মু অনুমতির জন্য দাদী রুমে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতো। সেই অনুমতি দিতে দাদীর আধঘন্টা লেগে যেতো। কখনও বা তারও বেশী আবার কখনও অনুমতি জুটতো না। তাই এই বিষয়ে আমার প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয়। যাইহোক অনুরোধে ঢেঁকি গেলার মতো করে শাশুড়ী মায়ের রুমে ঢুকে দেখি উনি তখনও ঘুমাচ্ছেন। আমি আর উনার ঘুম ভাঙ্গালাম না। রুম থেকে বের হতে যাওয়ার সময় চোখ বন্ধ করে শাশুড়ী মা বললো,
—-সাবধানে যেও।
—-মা,আপনি জেগে আছেন?
—-হুম,চোখ বন্ধ করে দোয়া পড়ছিলাম। দ্রুত বের হয়ে যাও। সন্ধা হয়ে যাচ্ছে।
শাশুড়ী মাকে বলে বের হওয়ার সময় মনে মনে ভাবলাম,”ইশ উনার সাথে দেখা না করে গেলে ব্যাপারটা খুব খারাপ হতো।” তবে আমি অবাক হলাম,জেগে থেকে কিভাবে ঘুমের ভাণ করে একটা মানুষ পড়ে থাকতে পারে।
আমি আর মাহফুজ কোয়ার্টার থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিয়ে নিলাম। শরতের শেষ আর হেমন্তের শুরু। এই সময়টা ভীষণ ভালো লাগে। প্রকৃতিতে না শীত না গরম। আকাশে শিমুল তুলোর মতো সাদা মেঘগুলো ভেসে বেড়াচ্ছে। কাশফুল গুলো ফুটে রযেছে। বাতাসে শিউলি কামিনী আর হাসনাহেনার সুবাস ভেসে বেড়াচ্ছে। আমি মাহফুজের দিকে তাকিয়ে অবাক হলাম। আমার পাশে এমনভাবে বসেছে যেন কোনো অপরিচিত নারীর পাশে বসেছে। আমি তো আগেও ওর সাথে রিকশায় ঘুরেছি। তখন ওকে ভীষণ হাসিখুশী দেখেছি। মজার মজার জোকস বলে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করতো। আমার রুপের প্রশংসা করতো। অথচ আজ একবার ভালো করে তাকিয়ে দেখলো না। অবশেষে ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,
—–তোমার কোনো প্রবলেম?
—–না, মানে এখানে তো আমি ম্যাজিস্টেট হিসাবে জয়েন করেছি। এখন যদি তোমার সাথে দাঁত কেলাতে কেলাতে রিকশায় ঘুরি বিষয়টা মনে হয় ভালো দেখাবে না। তাই গম্ভীর হয়ে বসে আছি। যাতে সবাই বলে আমি খুব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন।
—–তাই বলে বউয়ের রুপের প্রশংসাও করা যাবে না। নাকি তোমার ডিসি সাহেব সেটাও করতে বারণ করেছেন।
—তুমি আবার এসবের মাঝে স্যারকে টেনে আনছো কেন? আসলে নতুন জায়গা নতুন পরিবেশ সেজন্য একটু দেখে শুনে চলার চেষ্টা করছি।

ওর আচরণ দেখে আর কথা শুনে আমার খুব হাসি পেলো। কারণ নতুন ম্যাজিস্টেট হয়েছে বলে কথা! তার ভাব তো একটু হবেই। আমরা দু,জনে গিয়ে বিজয়সিংহ পুকুরের পাশে বসলাম। ঝিরি ঝিরি ঠান্ডা বাতাসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল। গোধুলীর আবীর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। সেই রক্তিম আলোর ছায়া দীঘির উপর পড়াতে বেশ সুন্দর লাগছে। চারিদিকে বড় বড় গাছ। দীঘিটা ঠিক সার্কিট হাউসের সামনে। ডিসির বাংলোটাও সার্কিট হাউসের পাশে। মাগরিবের আযান শোনা যাচ্ছে। আমরা আরো কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করে ফুসকা আর চটপটি খেয়ে রিকশা করে বাড়ির পথে রওয়ানা হলাম।

টায়ার্ড থাকার কারনে দ্রুত ডিনার করে শুয়ে পড়লাম। পরদিন সকালে নাস্তা করে মাহফুজ যখন বের হচ্ছিলো তখন আমার শাশুড়ী মা ওকে ডেকে বললো,
—-আজ একটু তাড়াতাড়ি ফিরবি?
——কেন মা,কোনো জরুরী কিছু?
—+হুম,আমিও ফেনী শহর দেখার জন্য তোর সাথে একটু বের হবো।
—-এখানে তোমার ঘোরার মতো কোনো জায়গা নেই।
—-সেটা তো আমি বুঝবো?
—–রিকশার ঝাঁকুনিতে তোমার কষ্ট হবে।
—-তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোর পেটে জন্মেছি।
—এ তোমার কেমন কথা মা?
—-শোন, আমি যখন যাবো বলেছি, অবশ্যই যাবো। তুই তাড়াতাড়ি আসবি।
মাহফুজ আরো কিছু বলতে চাচ্ছিলো। আমি ওকে ইশারায় থামতে বললাম। মাহফুজ খুব বিরস বদনে অফিসের দিকে রওয়ানা হলো। ও চলে যাবার পর আমি আর শাশুড়ীমা নাস্তা করে নিলাম। এরমধ্যে কাজের খালা এসে গেলে শাশুড়ী রান্না করতে উনাকে নিয়ে কিচেনে ঢুকলেন। যাওয়ার সময় আমাকে ভাইবার কথা মনে করিয়ে দিতে ভুললেন না। আমিও আমার রুমে গিয়ে পড়াশোনা করতে বসলাম। আসলেই পরীক্ষা একদম নাকের ডগায়। তাই আমিও পরিপূর্ণ মনেযোগ দিয়ে সাধারণ জ্ঞানের বইটা খুলে পড়তে বসলাম। কখন যে তিনঘন্টা সময় পার হয়ে গেল আমি টের পাইনি। কাজের খালা এসে গোসলের তাগিদ দেওয়াতে বুঝলাম, সময় অনেকটা গড়িয়েছে। পড়ার টেবিল থেকে উঠে শাশুড়ী মায়ের ঘরে উঁকি মেরে দেখি,মা নামাজ পড়ছেন। আমি অবশ্য সকালেই গোসল করে নিয়েছি। এখন ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি বেলা তিনটা বাজে। মাহফুজ এতো দেরী করছে কেন বুঝতে পারছি না। অন্যদিন দুটোর মধ্যে বাসায় চলে আসে।আমি কিচেনে গিয়ে খাবার গুলো টেবিলে বেড়ে দিলাম। ডোরবেলটা বেজে উঠলো। মনে হয় মাহফুজ আসছে। শাশুড়ী মা গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। মাহফুজ হাত ধুয়ে টেবিলে খেতে বসলো। আমি আর শাশুড়ী মা ও খেতে বসলাম। আমি খেয়াল করলাম মাহফুজ মুখ গোমড়া করে খেতে লাগলো। সেদিকে তাকিয়ে শাশুড়ী মা মুচকি মুচকি হাসছেন। বেলা ছোটো হয়ে আসছে। আসরের আযান দিয়ে দিলো। খাওয়া শেষ করে শাশুড়ী মা ওকে বললো,
—-তুই কি এখন অফিসে যাবি?
—+না,স্যারকে বলে এসেছি এবেলায় আর যাবো না। এজন্য একটু দেরী করে এসেছি।
—-আসরের নামাজ পড়েই রেডী হচ্ছি। আগে বের হলে আগেই বাসায় আসতে পারবো। তুইও নামাজ পড়ে নে।
মাহফুজ রুমে এসে নামাজ পড়ে বিছানায় গা,টা এলিয়ে দিলো। ওর মুখ গোমড়া দেখে জিজ্ঞাসা করলাম,
—-অফিসে কোনো ঝামেলা হয়নি তো?
—-আচ্ছা মায়ের কি এবয়সে রিকশায় করে ঘোরাটা শোভা পায়?
—-তোমার এই কথাটাতে আমার আপত্তি। কারণ এসবের কোনো বয়স লাগে না। ঘোরাঘুরি সব বয়সে করা যায়। বলতে পারো মাকে নিয়ে ঘুরতে বের হলে এন্টিনাকে সচেতন রাখতে হবে। হাত ধরে রিকশায় বসাতে হবে, নামাতে হবে। ভালো রেস্টুরেন্টে নিতে হবে। সবসময় তারদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংসারের চাপে হয়ত শখ আহ্লাদগুলো এতোদিন চাপা পড়েছিলো। সন্তান হিসাবে সেগুলো পূরণ করা তোমার দায়িত্ব। একটু ঘুরতেই তো চেয়েছেন। রাজ্য তো কিনে দিতে বলেননি।
—-আমার মনে হচ্ছে, আম্মু তোমার সাথে জেলাস করছে। কাল তোমাকে নিয়ে বের হয়েছি। এজন্য আজকে উনারও বের হওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।

এরমাঝে শাশুড়ী মা রেডী হয়ে আমাদের রুমে আসলেন। আমার কিনে দেওয়া নাগড়াটা পড়েছেন। একটা আবায়া গায়ে জড়িয়েছেন। মাথায় কালো রংয়ের হেজাব।ভ্যানিটি ব্যগটাও আবায়ার সাথে ম্যাচিং করে নিয়েছেন। উনারা মা ছেলে বেরিয়ে গেলেন। কাজের খালাও বের হয়ে গেল। আমিও আবার পড়ায় মনোনিবেশ করলাম। মাগরিবের আযান দিচ্ছে। আমি ওয়াশরুমে গিয়ে ওজু করে এসে নামাজ পড়ে নিলাম। এরমাঝে ডোরবেল বাজলো। দরজা খুলতেই শাশুড়ী মা আর মাহফুজ ঘরে ঢুকলো। শাশুড়ী মা দ্রুত নামাজে বসলেন। মাহফুজও ওজু করে নামাজ পড়ে একটু বিরক্ত হয়ে আমাকে বললো,
—–মায়ের যতো বয়স বাড়ছে তত বাচ্চাদের মতো আচরণ করছে।
—-কেন কি হয়েছে?
—-তার কষ্ট হবে বলে অটো নিতে চাইলাম। কিন্তু সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো তোমাকে নিয়ে কিসে করে ঘুরেছি। যেই বললাম রিকশায়। অমনি তারও বায়না সেও রিকশায় চড়বে। অগত্যা হাত ধরে রিকশায় উঠালাম। আবার নামালাম। কথায় কথায় জিজ্ঞাসা করলো তুমি কি খেয়েছো। বললাম ফুসকা আর চটপটি। অমনি তারও বায়না ফুসকা আর চটপটি খাবে। তাকে ভালো রেস্টুরেন্টে খাওয়াতে চাইলাম। না,সে ফুসকা আর চটপটি খাবে। তুমি যদি আম্মুর ফুসকা খাওয়া দেখতে। বাচ্চা মানুষের মতো করে ফুসকা খাচ্ছে। ফুসকাওয়ালাকে বলছে, মামা আর একটু ঝাল দেন। আমি আশে পাশে তাকিয়ে দেখছি আমার অফিসের কেউ আছে নাকি? কিযে একটা অবস্থা।
—-তুমি বিষয়টা পজেটিভলি দেখো। সেই কোনকালে খেয়েছে। ফুসকার স্বাদের কথা হয়তো ভুলেই গিয়েছিলো। আমাদের খাওয়ার কথা শুনে হয়তো আবার মনে পড়েছে। তাই হয়তো খেতে চেয়েছে।
—শোনো, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি, হানিমুনে যাওয়ার সময় মাকে নিয়ে যাবো।
—–মানে কি আমরা কি দলবল নিয়ে হানিমুন করবো?
—+শোনো যাবো তো ঐ কুয়াকাটা। মা যেতে চাইলে নিয়ে যাবো। তা,না হলে তোমাকে নিয়ে ঘুরে আসার পর মা বায়না করবে তাকে নিয়ে যেতে হবে। আমার পক্ষে এতো ধকল নেওয়া সম্ভব না। আর তুমি এতো প্যারা নিও না। আব্বা তো থাকবেন সমস্যা কি?উনারা উনাদের মতো থাকবেন আর আমরা থাকবো আমাদের মতো।
—-তাহলে তো এটা হানিমুন হলো না। দলবেঁধে তো আর যাই হোক হানিমুন করা যায় না।
—+মন খারাপ করো না, একটু গুছিয়ে নিয়ে আমরা আসল হানিমুনে দুবাই যাবো।
মেজাজটা যদিও খারাপ হলো। কিন্তু ওটাকে ইগনোর করলাম। সময়ই বলে দিবে কখন কি করতে হবে? আগে থেকে প্যানিক করে লাভ নেই।

চলবে