দাম্পত্যের খেরোখাতা পর্ব-০৮

0
3

#ধারাবাহিক গল্প
#দাম্পত্যের খেরোখাতা
পর্ব-আট
মাহবুবা বিথী

মাহফুজকে একসপ্তাহের খাবারটা গুছিয়ে দিলাম। এমনি এমনি দেইনি। এখানে আমার স্বার্থ জড়িত আছে। ওকে কনফার্ম করিয়ে নিয়েছি যে সংসারের খরচের দায়িত্ব ওকেই পালন করতে হবে। আমিও করবো। সেটা আমার ইচ্ছেমতো করবো। ও যেন কখনও আমার উপর চাপিয়ে না দেয়। মাহফুজও মাম্মাস বয়ের মতো আমার কথাগুলো মেনে নিয়েছে। বেচারার খুব মন খারাপ। দু,জনকে দুজায়গায় থাকতে হবে। তবে আমি ওকে বলেছি,
—-তোমার পায়ে তো কেউ শিকল পড়িয়ে রাখেনি যে তুমি যেতে পারবে না। যখনি মন চাইবে চলে যাবে।
—-তাতো যেতেই পারি। তবে ছুটি তো পেতে হবে।
—-দেখো,আমার পক্ষে রংপুর থেকে ফেনী আসা সো টাফ। সুতরাং তোমাকেই আসতে হবে।
একসপ্তাহের ছুটি খুব তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল। আমিও ঢাকার উদ্দেশ্য আজ রওয়ানা দিবো। এবার আর মাহফুজকে সাথে নেইনি। বেচারাকে আমার জন্য ডিসি স্যারের কাছে ছুটি চেয়ে বিব্রত হতে দেইনি। আসলে প্রতিটি মানুষকে ইনডিভিজুয়াল চলা শিখে নিতে হয়। তাহলে জীবন চলার পথে কোনোদিন কারো বোঝা হয়ে থাকতে হয় না। মানুষ সত্যিকার অর্থে বড় একা। এই পৃথিবীতে প্রতিটি মানুষ একা আসে। আবার তাকে একাই চলে যেতে হয়।
বেলা এগারোটায় স্টারলাইন বাসে করে রওয়ানা দিলাম। বিশাল লম্বা জার্ণি হবে আজ। ঢাকা পৌঁছে কয়েকঘন্টা বিশ্রাম নিয়ে রাত এগারোটার বাসে রংপুরের উদ্দেশ্য রওয়ানা দিবো।
পাঁচটার দিকে কমলাপুর টিটিপাড়া পৌঁছে গেলাম। ফারদিন আগে থেকেই গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলো। বাসায় পৌঁছে একটা ঘুম দিলাম। আটটার দিকে আম্মু আমায় ডেকে দিলো। ব্যাগ পত্র গুছিয়ে রাতের খাবার খেয়ে রাত দশটার দিকে বের হলাম। এগারোটায় নাবিলের স্ক্যানিয়া বাসে উঠে পড়লাম। একটা সিঙ্গেলসিট বুকিং দিয়ে রেখেছিলাম। সিটটা একটু নামিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। মাহফুজ এর মাঝে ফোন দিয়ে খোঁজ নিলো। ঠিকঠাকভাবে রওয়ানা দিলাম কিনা? ওকে সব জানিয়ে আমি আয়াতাল কুরছি পড়ে গায়ে ফুঁ দিলাম। এরপর একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম।

ছ,টার দিকে গাড়ি রংপুরে কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে গেল। আমি লাগেজপত্র নিয়ে একটা অটো ভাড়া করলাম। এরপর ডাকবাংলোর পথে রওয়ানা হলাম। ডাকবাংলো পৌঁছে ওয়াশরুমে গিয়ে হাতমুখ ধুয়ে ফ্রেস হয়ে আসলাম। ইলেক্ট্রিক চুলায় চায়ের পানি চাপিয়ে দিয়ে বিছানার চাদর চেইঞ্জ করে নিলাম। আসার সময় আম্মু কেক বানিয়ে দিয়েছিলো। চায়ের সাথে দু,পিস কেক দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। ডাকবাংলোর কেয়ারটেকারকে ডেকে একটা খালা ঠিক করে নিলাম। ঘরমোছা কাপড় ধোয়া, বাথরুম ধোয়া,সবজি কুটার জন্য তিন হাজার বেতনে খালা সানন্দে রাজি হলো। সাথে সাথে কোমরবেঁধে কাজে নেমে পড়লো। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে কাজ শেষ করে খালা চলে গেল। আমিও রেডী হয়ে স্বপ্নতে কিছু গ্রোসারী কিনতে চলে গেলাম। ফ্রোজেন রুটি, পাঁচ কেজি নাজির শাহ চাউল, দুই কেজি সানফ্লাওয়ার ওয়েল,লবন, মধু,চাপাতা,নিডো দুধ কিছু কাঁচা সবজি কিনে আনলাম। আজ তো শনিবার। কাল থেকে আমার অফিস শুরু হবে। লেকচার সিট তৈরী করা, ছাত্র ছাত্রীদের হ্যান্ডেল করা,এছাড়া এই নতুন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে হবে।

পরদিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে ফজরের নামাজ পড়ে নিলাম। এরপর ফ্রিজ থেকে দুটে ফ্রোজেন রুটি বের করে সেঁকে নিলাম। সাথে এক কাপ দুধচা আর একটা ডিমপোস দিয়ে নাস্তা করে নিলাম। কেয়ারটেকারকে একটা অটো ডেকে দিতে বললাম। নভেম্বরমাসের শেষের দিকে শীত যেন এখানে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে। আপাদমস্তক ওভারকোট দিয়ে নিজেকে ঢেকে নিলাম। অটোতে ঠান্ডা বাতাস যেন শরীরের লোমকূপ ছিদ্র করে ভিতরে ঢুকে যায়। অটো চলে আসাতে রওয়ানা দিলাম। রংপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র সেন্ট্রাল রোডে আমার কলেজটি অবস্থিত। রাস্তা বেশ ফাঁকা ছিলো। ন,টার মধ্যে কলেজে পৌঁছে গেলাম। প্রথমদিন ভালোই কাটলো। প্রিন্সিপাল ম্যাম বেশ সদালাপী মানুষ। আমার সাবজেক্ট ছিলো কম্পিউটার। আমাকে আইসিটির টিচার হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। প্রথমদিন খুব একটা চাপ ছিলো না। সবার সাথে পরিচিত হলাম। নিজের ক্লাস রুটিনটা বুঝে নিলাম। দুটোর মধ্যে বাসায় চলে আসলাম। আজ আর রান্না করতে ইচ্ছে হলো না। বাইরে থেকে খাবার অর্ডার করে এনে খেয়ে ফেললাম। যোহরের নামাজ পড়ে বিছানায় শরীরটা এলিয়ে দিতেই শাশুড়ী মা ফোন দিলেন।
—-হ্যালো,ফারাহ্ কেমন আছো? সবকিছু ঠিকঠাকভাবে গুছিয়ে নিতে পেরেছো?
—-ভালো আছি মা। হুম, মোটামুটি গুছিয়েছি।
—-সকালে কি নাস্তা করলে?
—–ফ্রোজেন রুটি কিনে এনেছিলাম। ওটাই সেঁকে নিয়ে খেয়েছি।
—-দুপুরে কি খেলে?
—-খাবার অর্ডার করে এনে খেয়েছি মা।
—-তা বেশ ভালো করেছো।
পাশ থেকে আমার শ্বশুর বলছেন, “যে টাকা তোমার বউ আয় করবে তা মনে হয় নিজের পিছনেই ওর সব ব্যয় হবে।”
শাশুড়ী মা শ্বশুরের কথায় বিরক্ত হয়ে যেন আমায় বললেন,
—-একদম ঠিক কাজ করেছো। তুমি ছাড়া তোমার শরীরের ভালো মন্দ আরাম আয়েশের খোঁজ কেউ রাখবে না। সবার আগে নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ তারপর সংসারের বাকি হিসেব।
আমার শ্বশুর পাশ থেকে আবার বলে উঠলেন,”এমনি তো নাচুনি বুড়ি। তার উপর দিচ্ছো ঢোলে বাড়ি। দাও যতখুশি দাও। আমার কথা তো তোমাদের কারো ভালো লাগে না।”
আমার শাশুড়ী মা তাড়াতাড়ি ফোন রেখে দিলেন। আমার অবশ্য এসব কথা গায়ে লাগে না। জন্মের পর থেকে দাদীর মুখে বহুত শুনছি।

প্রতি সপ্তাহে মাহফুজ রংপুরে আসে। আমারও সময়গুলো ভালো কাটে। ফেনী থেকে বাসে করে ঢাকায় আসে। তারপর প্লেনে করে রংপুর আসে। খুব বেশী সময় লাগে না। কখনও প্লেনের টিকিট আমি কেটে দেই। কখনও ও কাটে। এর মাঝে শ্বশুর একদিন ফোন দিলেন। মাহফুজ তখন আমার এখানে। ফোন দিয়ে মাহফুজকে সবার আগে জিজ্ঞাসা করলেন,
—–তুই কোথায়?
—-আমি রংপুরে।
—–এতো ঘনঘন রংপুর যাস কেন?
মাহফুজও একটু তেতে বললো,
—-কেন আসি তুমি জানো না আব্বা?
আমার শাশুড়ী পাশ থেকে বলে উঠলেন,
—-এ আপনার কেমন প্রশ্ন? ছেলে আমার বউয়ের কাছে যাবে এটাই তো স্বাভাবিক।
—-না,মানে তোমার তো অনেক টাকা খরচ হয়। তোমার মা যেভাবে ফারাহ্কে বুদ্ধি দিচ্ছে তাতে ওযে কোনো খরচ করবে না সেটা আমি ভালোই বুঝতে পারছি।
—-না,তুমি বুঝতে পারোনি। ফারাহ্ আমাকে প্লেনের টিকিট কেটে দিয়েছে। সুতরাং তোমাকে আমার ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে প্যারা নিতে হবে না।
ওদের বাবা ছেলের কথা শুনে আমার খুব হাসি পেলো। মাসখানিক সময় পার হয়ে গেল। আমি প্রথম মাসের বেতন পেয়ে আমার মাকে দশ হাজার এবং শাশুড়ীমাকেও দশহাজার টাকা পাঠিয়ে দিলাম। টাকা হাতে পেয়ে শাশুড়ী আমাকে ভিডিও কল দিয়ে বললেন,
—-তুমি আমাকে টাকা পাঠিয়েছো কেন? তুমি বরং তোমার মাকে পাঠিয়ে দাও।
কিন্তু আমি ভিডিও কলে শাশুড়ী মায়ের মুখটা দেখলাম। আনন্দে ঝলমল করছে। টাকার পরিমানটা খুব বেশী না।কিন্তু উনার আনন্দিত মুখটা আমাকে অনেক খুশীতে ভরিয়ে দিলো।
আমিও খুশী মুখ করে শাশুড়ী মাকে বললাম,
—-আমার প্রথম মাসের বেতন থেকে আপনাকে আর আমার আম্মুকে টাকা পাঠিয়ে দিয়েছি। আপনারা আপনাদের পছন্দের গিফট কিনে নিবেন।
আম্মুর টাকাটার খোঁজ নেইনি। তবে শাশুড়ী মা প্যানাসোনিকের বেলেন্ডার কিনেছেন। খুব বেশী কিছু না।
সেদিন ছিলো ছুটির দিন। প্রচন্ড শীত পড়েছে। ফেনীতে ভিআইপি আসবে বলে মাহফুজ ছুটি পায়নি। আমারও মনটা খারাপ লাগছে। তারউপর এতো শীত পড়েছে যে নিজে থেকে উঠে কিছু করতে মন চাইছে না। বেলা বারোটা পর্যন্ত শুয়েছিলাম। এদিকে আবার ক্ষিদে লেগেছে। বাইরে খাবার অর্ডার করলাম। দুপুরের খাবার খেয়ে কেয়ারটেকারকে দিয়ে বাহির থেকে চা আনিয়ে নিলাম। যোহরের নামাজ পড়ে মগে চা নিয়ে মুভি দেখার জন্য কেবলই নেটফ্লিক্স খুলে বসেছি। অমনি ফোনটা বেজে উঠলো। স্ক্রীনে তাকিয়ে দেখি আমার জা ফোন দিয়েছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে বলে উঠলো,
—–ফারাহ্ কি করছো?
—-নেটফ্লিক্সে মুভি দেখছিলাম।
—-কি ভাগ্য তোমার মুভি দেখারও সময় পাও। আমার তো পোড়া কপাল।
—-কি হয়েছে ভাবি?
—-না কিছু না। ভাবছি তোমার ভাগ্যের কথা। মা কোনোদিন তোমার হাতে সেবাযত্ন তেমন নিলেন না। তারপরও ভিডিও কলে তোমার রুম দেখে সবার কাছে গল্প করে আমার ছোটো বউ অনেক গোছালো। কাজে কর্মে পরিস্কার। অথচ এভাবে কোনোদিন আমার প্রশংসা করতে দেখলাম না।
আমি আসলে কি বলবো বা কি বলা উচিত বুঝতে পারছি না। কেননা আমার শাশুড়ীমাকে কোনোদিন আমার জায়ের নিন্দে করতে শুনিনি। উনি কখনও কারো নিন্দা করেন না।

চলবে