দাহন পর্ব-০৩

0
34

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৩

” বিয়ের এক বছর হয়ে গেল কিন্তু বাচ্চা হইলো না। এই মাইয়ার কোনো দোষ আছে নাকি, খবর নিছো আপা?”

মেয়েদের মাসিকের সমস্যাটা সকলেই ভিন্ন চোখে দেখে।মিথিলারও এই সমস্যা ছিল। মিথিলার বিয়ের একবছরের মাথায় এই কথা শুনতে হয়েছিল তার খালা শাশুড়ির কাছ থেকে। সেদিন এত কষ্ট পেয়েছিল! ইচ্ছে করছিল মুখের ওপর কয়েকটা কথা বলে দিতে। মিথিলা সেদিন ভদ্রতার খাতিরে চুপ করে ছিল। সেদিন শাহানা বেগমও তাল মিলিয়েছিলেন বোনের সাথে,” কুলসুমের ছেলের বউরে কোন ডাক্তারের কাছে নিছিল রে! আমাদের বউকেও নিয়ে যাব। সমস্যা পাইলে আগে থেকেই সাবধান হয়ে যাব। আমার একটামাত্র ছেলে! বংশের মানুষ লাগবো না! নাতি নাতনির মুখ দেখাতে না পারলে এমন বউরে দিয়া কী করমু?”

মিথিলা সেদিন বেশ অপমানবোধ করল। পরের সপ্তাহেই সত্যি সত্যি তাকে নিয়ে ভাল গাইনী বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গেল শাহানা বেগম। মনের খচখচানিটা দূর করতে সারাটা সময় মিথিলার পাশে লেপ্টে থাকল। প্রায় সাত আটটা টেস্ট করানোর সময় মিথিলার মনে ভয় হচ্ছিল। ভাবনায় নানান চিন্তা আসছিল। আলট্রাসনোগ্রাফি করানোর সময়টায় মিথিলা একাই ছিল। সে ডাক্তারকে অনুনয় করে বলেছিল যেনো রিপোর্টের কথাটা তাকে আগে জানানো হয়। আলট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট আসলো আধঘণ্টা পরে। মিথিলা সহ শাহানা বেগম ভেতরে গেলেন। মিথিলার শুঁকনো মুখখানা দেখে তখন ডাক্তার কিছু পেরেছে কী না, সে জানে না। রিপোর্টে এসেছিল, মিথিলার ডিম্বাণুতে সামান্য দাগ পড়েছে। শাহানা বেগম শোনার পর নাক মুখ কুঁচকে নিয়েছিলেন। ডাক্তার তখন মিথিলার দিকে তাকিয়েছিল। তার শুকনো মুখ দেখে হেসে শাহানা বেগমের উদ্দেশে বলেছিল,” খালা, কি হয়?”

শাহানা বেগম বিরস মুখে উত্তর দিয়েছিল, ” ছেলের বউ।”

” বউয়ের তেমন সমস্যা নেই তো, খালা। শুধু ডিম্বানুতে হালকা দাগ পড়েছে।এটা কোনো সমস্যাই না। একমাস ঔষধ খেলেই ঠিক হয়ে যাবে।”

শাহানা বেগমের যেনো ডাক্তারের কথা বিশ্বাস হল না। প্রত্ত্যুত্তরে বলল,” বাচ্চা হইবো তো?”

ডাক্তার হাসছিল,” পরের মাসে সুখবর নিয়ে আসবেন, খালা!”

তেঁতো মুখ করে শাহানা বেগম বাড়ি ফিরেছিলেন। সে যাত্রায় মিথিলা বেঁচে গিয়েছিল। কেননা তার শারীরিক কোনো সমস্যা ছিল না। পরের মাসেই এহসানকে সে তার গর্ভে ধারণ করে। তখন যদি সে গর্ভবতী না হতো, শাহানা বেগম সত্যি সত্যি ইমনের কাছ থেকে তাকে তালাক করিয়ে নিত।

—————–

মিথিলারা চার ভাই বোন। তিন বোন এক ভাইয়ের মধ্যে মিথিলা বড়ো। ছেলে চাইতে চাইতে তিন মেয়ের জন্ম দিয়েছেন মিথিলার মা। মিথিলার বিয়ের তিনমাস পর তার মেজো বোনের বিয়ে হয় কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিয়ের সাতমাসের মাথায় তাদের ডিভোর্স হয়ে যায়। মিথিলার বোন বাবার বাসায় চলে আসে। মেজো মেয়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটার পর মিথিলার বাবাও চায়নি তার বড়ো মেয়ের সাথে এমন ঘটনা ঘটুক। তাই তিনি সর্বদা বলতেন মিথিলাকে ধৈর্য ধারণ করতে।
মিথিলার বিয়ের সময় পাত্র নির্বাচনের বেলায় মিথিলার বাবা শুধু ইমনের সরলতা দেখেছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো তখন। বেকার জানা স্বত্তেও এই দুই কারণেই বিয়ে দিয়েছিল মেয়েকে। বর্তমানের ছেলেরা যেখানে বাজে নেশায় আসক্ত থাকে ইমনের ছিল না। এছাড়াও ইমনদের বাড়ির অবস্থা দিক ভাল, এসব বিবেচনা করেই মেয়েকে বিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু কে জানতো, মিথিলার কপালে এতো দুঃখ থাকবে!

বৈশাখ মাসের তপ্ত এক দুপুরে মিথিলা রান্না করছিল। গরমে একাকার অবস্থা। এহসানকে নিয়ে মিথিলার শ্বশুর বাইরে বসে আছে। ইমন সকালে বেড়িয়েছে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়ার কথা বলে। মিথিলা এই ফাঁকে রান্না সেরে নিচ্ছে। শাহানা বেগম আজ কবুতর রান্না করার জন্য বলেছেন। তরকারি কষিয়ে ঝোল দিয়ে ঘরে গেল মিথিলা। গরমে জবুথবু হয়ে বসলো সে। মাথার উপরের পাখা চলছে। একটু পরপরই তরকারি দেখে আসছে সে সময়ের হিসাব করে। শাহানা বেগম ফোনে কার সাথে যেনো কথা বলছিল। জানালা দিয়ে যখন দেখলো মিথিলা বসে আছে সে ফোন কে’টে দিল। শাশুড়ি আসার আভাস পেয়ে মিথিলাও উঠে দাঁড়াল। দেখা গেল মিথিলা পৌছানোর আগেই শাহানা বেগম চুলার পাড়ে চলে এসেছেন। হাঁটার পথে মিথিলাকে প্রতিবারের মতো কথা শোনাতে ভুললেন না,” একটু কী রান্না করে! ঘরে যাওয়ার লাইগা পাগল হইয়া যায়। আমরা লাকড়ি দিয়া রান্না করছি। চুলার পাড় থেকে সড়িই নাই। আমরা শরীর কালা হইয়া যাইবো তা ভাবি নাই। আর এখন বউয়েরা একটু চুলার পাড়ে আসলেই কখন ঘরে যাইবো তা ভাবে।”

মিথিলা শাশুড়ির কথা উপেক্ষা উনার পিছু পিছু আসলো।মিথিলাকে চুলার পাড়ে এসে দাঁড়াতে দেখে শাহানা বেগম রেগে গেল। হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে খালি হাতেই মাটির ঢাকনায় হাত রাখলেন। ফলস্বরূপ যা হওয়ার হয়ে গেল। গরম ঢাকনা ধরতে না পেরে নিচে পড়ে ভেঙে গেল। শাহানা বেগম দোষ দিলেন মিথিলার উপর। মিথিলা শাশুড়িকে ধরে পিছনে নিয়ে আসতে চাইছিল কিন্তু কীভাবে যেনো তরকারি শাহানা বেগমের হাতের উপর পড়ে গেল। মিথিলা শুধু চিৎকার করে বলল,” আম্মা, এটা কী করলেন? ”

শাহানা বেগম তখন মিথিলার হাত ছেড়ে নিচে বসে পড়লো। চিৎকার করে কান্না করতে করতে বলল,” আমার হাত পুড়ে গেল রে! ও মা গো, ও আল্লাহ! আমারে জেন্ত মাইরা ফেলতে চাইছিল। কোন ডা’ই’নী’রে ঘরে আনলাম রে!”

স্ত্রীর বিলাপ শুনে মিথিলার শ্বশুর দৌড়ে আসলেন। মিথিলার কোনো কথা না শুনেই তাকে কথা শোনাতে শুরু করলেন,” তোমার বাপকে আজই খবর দিব। তোমাকে যেন নিয়ে যায়। মনে রেখ, আমার নাতিকে নিয়ে যাইতে পারবা না। কতো বড়ো সাহস! আমার বাড়িতে খাইয়া আমারই ক্ষতি করবার চায়!”

মিথিলা বারবার বলছে সে ইচ্ছে করে কিছু করেনি কিন্তু তার কথা কেউ কানে নিল না। শাহানা বেগম তখনো বিলাপের সুরে কাঁদছে। এহসানকে মিথিলার কোলে দিয়ে শ্বশুর চলে গেল বার্ন ক্রিম আনতে। মিথিলা তা দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো।

সবকিছু পরিস্কার করতে করতে বেলা গড়িয়ে গেল। শাহানা বেগম দুপুরের খাবার খেলেন না। উলটো মিথিলার বাবাকে ফোন করলেন জলদি আসার জন্য। মিথিলার বাবা আসলো বিকাল চারটায়। মিথিলা জানতো না তার বাবা আসবে। বাবা এসে সরাসরি মিথিলার ঘরে প্রবেশ করে প্রথম প্রশ্নটা করল, ” তুই কী চাস? আমি যেনো মরে যাই!”

মিথিলা, বাবার আগমনে খুশি হবে নাকি বাবার প্রশ্ন শুনে অবাক হবে বুঝতে পারল না। সে অবাকের সুরে প্রশ্ন করল,” কী হয়েছে, আব্বু!”

” বেয়াইনের সাথে কী করেছোস?”

মিথিলা যা বুঝার বুঝে গেল। সে কিছু বলবে তার আগেই শাহানা বেগম ঘরে আসলো। মিথিলার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলল,” বেয়াই আসছেন? আসেন আসেন আপনার মেয়ের কী করেছে দেখে যান।”

মিথিলার বাবা একবার মেয়ের দিকে তাকিয়ে চলে গেলেন। মিথিলা চোখের পানি মুছে শাশুড়ির ঘরের দ্বারের সামনে দাঁড়াল। মিথিলা শুনতে পেল শাহানা বেগম বলছে,” দেখেন বেয়াই, আমার হাতটা দেখেন! আপনার মেয়ে ইচ্ছে করেই আমার হাতে তরকারি ফেলে দিছে। আমার শখের মাটির ঢাকনাও ভেঙে ফেলছে।”

মিথিলার বাবা স্বান্তনার সুরে বললেন,” আমি মিথিলার বিচার করতেই আসছি। আপনি কান্না করবেন না বেয়াইন।”

শাহানা বেগম কান্না থামালেন না। মিথিলার বাবা মেয়ের গালে দুইটা থাপ্পড় বসিয়ে বললেন,” কেন বেয়াইনের গাত পুড়ালি?”

গালে হাত রেখে মিথিলা উত্তর দিল,” মা খালি হাতে ঢাকনা ধরেছিল। গরম সহ্য করতে না পেরে ফেলে দিছে। আমি তো মাকে বাঁচাতে গিয়েছিলাম কিন্তু কীভাবে হয়ে গেল!”

মিথিলার বাবা মেয়ের হাত ধরে শাহানা বেগমের সামনে নিয়ে দাড় করিয়ে বললেন,” পায়ে ধরে মাফ চা।”

মিথিলা বলল,” আমি মায়ের হাত পুড়িনি।”

” মাফ চা মিথিলা। নয়তো তোর মাকে আমি আজই তালাক দিব।”

মিথিলা মাকে খুব ভালোবাসে। আর সে এটাও জানে, তার বাবা স্বজ্ঞানে হোক অথবা রাগের মাথায় হোক! যা বলবে তাই করবে। মিথিলা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে শাশুড়ির পায়ে লুটিয়ে পড়লো। শাহানা বেগম বেজায় খুশি হল। লোকদেখানো কাজ করতে শুরু করল
এবার মিথিলার বাবার জন্য মিথিলাকে খাবার আনতে বলল। বাবা খায়নি বরঞ্চ মিথিলাকে বলে গেল, যেন পরবর্তীতে তার নামে নালিশ না শুনতে হয়।

বাবার কথা রেখে আসছে সে। শ্বশুর বাড়িতে যাই ঘটুক না কেন, বাবার বাড়িতে কখন বলতে চায় না। সয়ে নিচ্ছে সে।
মিথিলার জীবন বৃত্তান্ত লেখা শত শত শব্দ লেখেও শেষ হবে না। আমাদের মাঝে এমন হাজার হাজার মিথিলা আছে, যারা পরিস্থিতির চাপে পড়ে মুখ বুঝে সহ্য করে নেয়। আর যারা শাহানা বেগমের মতো ভুমিকা পালন করে তাদের বিচার পৃথিবীতে একটু হলেও হয়। যেমনটা আগামী পর্বে শাহানা বেগমের সাথে হবে।

চলবে………………