দাহন পর্ব-০৫

0
37

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৫

মাথার উপর যান্ত্রিক পাখা অনবরত ঘুরছে। কিছুক্ষণ আগেও সেখানে ঝুলে থাকার জন্য তৈরি হচ্ছিল মিথিলা। শেষ সময়ে সন্তানের কথা ভেবে ডুকরে কেঁদে উঠলো সে। সন্তানকে বুকে জড়িয়ে শুয়ে থাকল সন্ধ্যা পর্যন্ত। মিথিলার মতো কিছু মেয়েরা আছে যারা পরিবারের বড়ো মেয়ে হয়ে থাকে। তারা সারাজীবন ত্যাগ করেই যায়। হোক সেটা জীবনের জন্য অথবা পোশাকের জন্য। ছোটবেলা থেকেই মিথিলা তার মাকে অত্যাচারিত হতে দেখে এসেছে তার দাদীর দ্বারা। মিথিলার মা ধৈর্য ধরে থাকতো। ফলস্বরূপ এখন উনি সুখী। মিথিলাকে তার মা নিজের দিকটা দেখিয়ে ধৈর্য ধরে রাখতে বলছে তাকে। মিথিলাও এতোদিন তাই করে আসছে। আজ ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল তাই তো অমন ভয়ংকর সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল। মিথিলার দিন খুব বিরহে কাটতে লাগল।

স্বামীর ঘরই মেয়েদের আসল ঠিকানা। বিয়ের পর বাবার বাড়ি মেয়েদের অস্থায়ী ঠিকানা হয়ে যায়। বাবার বাড়িতে তারা দুইদিনের মেহমান হয়ে বেড়াতে যায়। মিথিলা নিজের ভাগ্যকে মেনে নিল। মায়ের কথা মেনে পড়ে থাকলো শ্বশুর বাড়ি। একদিন তো ভাগ্য তার সহায় হবে। সেদিনের অপেক্ষায় রইল।

শাহানা বেগম ভাল হওয়ার মানুষ নন। চুন থেকে পান খসলেই গালমন্দ করেন মিথিলাকে। এই তো সেদিনের কথা, বেগুন ভাজি ও ছোট মাছ রান্না করতে বলেছেন শাহানা বেগম। আলু, বেগুন ও মাছ মাখিয়ে বসিয়ে দিল মিথিলা। শাহানা বেগম উঁকি দিয়ে পানির পরিমাপ দেখে বলতে শুরু করলেন,” তোমার কী আক্কেল জ্ঞান নাই বউ? এতো ঝোল কেউ ছোট মাছে দেয়? পারো তো শুধু মাতব্বরি করতে। আমাকে একবারও জিগাইছিলা। তোমার বাপের বাড়ির মানুষ কী রান্নাটা পর্যন্ত শিখাইয়া দেয় নাই?”

মিথিলা তরকারির ঝোল দেখল। পরিমাণ মতোই তো হয়েছে। তবে কী শাহানা বেগম আজও তাকে বিনা দোষে দোষারোপ করতে আসছে? মিথিলা তরকারির ঢাকনা খুলে দিয়ে বলল,” ঢাকনা খুলে দিয়েছি,আম্মা। বাষ্প বের হতে হতে পানি শুকিয়ে যাবে।”
” আমাকে শিখাইতে আইছো? তরকারি লুতালুতা হইয়া যাইবো।”

অন্যদিন হলে মিথিলা চুপ করে থাকতো কিন্তু আজ আওয়াজ তুলল,” আপনার পাতে তরকারি দিতে পারলেই তো হয়! তখন না হয় শক্ত না তুলতুলা দেখে নিবেন!”

শাহানা বেগম অসন্তুষ্ট হলেন। মিথিলার কথার প্রত্ত্যুত্তর করতে পারলেন না। কিই বা বলবেন, কথাটা তো মিথিলা মিথ্যা বলেনি? শাশুড়িকে এই প্রথম সঠিকভাবে জবাব দিতে পেরে মিথিলার মন শান্ত হল। সে আবারও রান্নার কাজে মন দিল।

——————–

এহসানের বয়স এখন দেড় বছর। আধোআধো কথা বলতে শিখেছে বাচ্চাটা। মা, বাবা, দাদা, দাদী বলতে পারে সে। মা বলে যখন ডাকে মিথিলার সব কষ্ট শেষ হয়ে যায়। মিথিলার সময় আগের মতোই কাটছিল। শুধু একটা বিষয় মিথিলার জীবনে পরিবর্তন হয়েছিল তা হল, শাশুড়ির টানা কথার প্রত্ত্যুত্তরে মিথিলা এক দুই কথা বলতে শুরু করল।

আম কাঁঠালের সিজন শুরু হল। মিথিলা এই সিজনে নিজেকে গুটিয়ে রাখে কেননা আম তার খুব পছন্দ। অথচ এই বাড়িতে সবার খওয়ার শেষে মিথিলা আমের ভাগ পায়। শাহানা বেগম নিজেই দা নিয়ে হিসাব করে আম কা’টে। সকলে মিলে বসে সেই আম খায়। মিথিলাকে দেয় শেষে। প্লেটের তলায় পড়ে থাকা আম দেখে খেতেও ইচ্ছে করে না তার। ইমনও কোনোদিন কিছু বলে না। মিথিলার ইচ্ছে করলে বাবার বাসায় গিয়ে খেয়ে আসে।

একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মিথিলা দেখল, তার শাশুড়ি সাত থেকে আট বছরের একজন মেয়েকে নিয়ে এসেছে। শাহানা বেগমের বাবার বাড়ি থেকে মেয়েকে নিয়ে আসে। মিথিলা প্রথম খুশি হয়েছিল। এহসানকে দেখাশোনা করার জন্য একজন সাথী এলো। মিথিলা ভেবেছিল, মেয়েটাকে সে পড়াশোনা করিয়ে বড়ো করবে। ভাল একটা ছেলে দেখে বিয়ে দিয়ে দিবে। মিথিলা মেয়েটার মাথায় হাত রাখলো। মেয়েটার মাথায় ছোট ছোট চুল ছিল। গায়ে ছিল ময়লা কাপড়। দুই হাতে তিনটা তিনটা করে চুরি দিয়ে রেখেছে। মিথিলার থেকে মেয়েটাকে নিজের কাছে নিয়ে শাহানা বেগম বলল,” ওর নাম সাদিয়া। ওরে আমি একেবারে নিয়ে আসছি। আমার সব কাজ ও করব তুমি আমার কিছুই ধরবা না।”

মিথিলা অবাক হল। নিচু স্বরে বলল,” এসব কী বলছেন, আম্মা? আমি আপনার কাজ না করলে কেমন হবে?”

” তোমার এখন জবান যেমনে চলে! কয়েকদিন পর তোমার পা ধরে থাকতে হইবো। আমি ঐসব পারমু না। তোমার উপর আমার ভরসা নাই। বুড়া বয়সে এই মাইয়াই আমারে দেখবো।”

মিথিলা বলল,” আমি আপনার একমাত্র ছেলের বউ। মানুষ নানান কথা বলবে তো!”

গরম দুধ বাটিতে ঢাললেন শাহানা বেগম। চার টুকরো পাউরুটি হাতে নিয়ে সাদিয়ার সামনে রাখলেন।সাদিয়ার উদ্দেশে বললেন,” পুরোটা খাবি। ঘরে বিস্কুট, চানাচুর, নিমকি কোনোকিছুরই অভাব নেই।যখন যা ইচ্ছে নিয়ে খাবি।”

মিথিলার প্রশ্নের উত্তর দিল না শাহানা বেগম। ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। পরদিন সকালবেলা। মিথিলা দৈনন্দিন কাজের মতো কাজ করছে। শাহানা বেগম সকালে ঘুম থেকে উঠেন। আজ উঠলেন বেলা করে। চোখ খুলে বিছানায়ই পড়ে রইলেন। মিথিলার শ্বশুর শাশুড়ি দুজনই ডায়াবেটিস রোগী। সকালবেলা রুটি বানাতে হয় তাদের জন্য। প্রতিদিন নয়টা থেকে দশটা রুটি বানায় মিথিলা। নিজের জন্য ভাত রান্না করে সে। আজও রুটি বানিয়েছে সে। ঘরে রুটি নিয়ে প্রবেশ করতেই শাহানা বেগম বলে উঠলেন,” সাদিয়ার ক্ষুধা লাগছে। রুটি দাও ওরে। খেয়ে আমার সাথে ক্ষেতে যাবে।”

মিথিলা হাসিমুখে ডাল দিয়ে রুটি খেতে দিল। মেয়েটা খাচ্ছে। অবাক করার বিষয়ে হল, মেয়েটা একসাথে তিনটা রুটি খেয়ে চার নাম্বার রুটিতে হাত দিয়েছে। এতো ছোট মেয়ের খাওয়ার অবস্থা দেখে কথা হারিয়ে ফেলল মিথিলা। সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে ডাকলো,” এই সাদিয়া, আর খেয়ো না। একটু পর ভাত খেয়ো, আসো!”

সাদিয়া উঠে আসলো না উলটো শাহানা বেগমের কাছে নালিশের সুরে বলল,” ও নানু! আমারে খেতে দেয় না।”

শাহানা বেগম তেতে উঠলেন। গলা উঁচু করে বললেন,” এই মাইয়ারে বউটা আজই বাড়ি থেকে বের করে দিব। বউটা আমার সুখ দেখতে পারে না।”

মিথিলা কী ভেবে নিষেধ করেছিল শাহানা বেগম কী ভাবলো। রুটি খেয়ে ফেললে তারা খেতো কী! মিথিলা কিছু বলল না। নতুন মেয়ের সামনে নিজেকে খারাপ বানাতে চায় না।
কথিত আছে, যার জন্য করি চুরি সেই বলে চোর। প্রায় একঘণ্টা পর শাহানা বেগম খেতে বসলে রুটি কম পেলেন। মিথিলাকে তখন ডেকে বললেন,” রুটি খাইতে মন চাইলে বেশি কইরা বানাইবা। নিজে পেট ভরে খেয়ে দুইটা রুটি কেমনে রাইখা দিলা।”

মিথিলা প্রতিবাদের সুরে উত্তর দিল,” সকালে আমি ভাত খাই, আম্মা। আপনি ভুলে গেলেন! রুটি তো নতুন মেয়েটা খেলো।”

” ও আল্লাহ গো! তোমার পেটে এতো হিংসা। মেয়েটাকে আনলাম একদিনই হয়নি। এখনই শুরু করছো।”

মিথিলা হাজার কথা বলেও শাহানা বেগমকে বিশ্বাস করাতে পারল না। নানান যুক্তি দাঁড় করিয়ে মিথিলাকে চুপ করিয়ে দিল।

শাহানা বেগমের ব্যবহার দিনেদিনে খারাপ হতে লাগলো। সাদিয়াও মিথিলার সাথে উলটা পালটা আচরণ করতে শুরু করলো। শাহানা বেগম যেভাবে ধমক দিয়ে কথা বলে সেভাবেই ধমক দিতে থাকলো। মিথিলা মাঝে মঝে চুপ করে থাকে আবার মাঝে মাঝে সাদিয়াকে দু একটা কথা শুনিয়ে দেয়।

কিছুদিন পর দুপুরবেলা মিথিলা রান্না করছিল। শাহানা বেগম আম কাঁঠাল নিয়ে বসলেন বারান্দায়। সাদিয়াকেও পাশে বসালেন। বারান্দা পেরিয়েই রান্নাঘর। মিথিলা সেদিক দিয়ে আসা যাওয়া করে থাকে। এহসানকে দোলনায় শুয়ে দিয়ে রান্না করছে মিথিলা। শাহানা বেগম আম কে’টে সাদিয়াকে খাওয়াচ্ছেন। মিথিলা ইতোমধ্যে সাত আটবারের মতো আসা যাওয়া করলো। শাহানা বেগম একবারের জন্যও মিথিলাকে খেতে বলল না।উলটো মিথিলাকে দেখিয়ে দেখিয়ে সাদিয়ার হাতে আম দিয়ে বললেন,” আমার কেনে মেয়ে নাই। তুইই আমার মেয়ে। খা বেশি বেশি খা।”

মিথিলার কেনো যেনো খুব কষ্ট লাগলো। চোখ দিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি পড়লো। সে বিড়বিড় করে বলল,” আমাকে এতো যত্ন করে কোনোদিনও খাওয়ান নাই, আম্মা! আমাকে মেয়ে ভাবলে আজ আমাদের সম্পর্ক অন্যরকম থাকতো।”

চলবে…………..