দাহন পর্ব-০৬

0
37

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৬

আজকাল মিথিলা নিজের মধ্যে বেশ পরিবর্তন খেয়াল করল। আগের মতো চোখের পানি ফেলে না সে। শাশুড়ির কটু কথাও হেসে উড়িয়ে দেয়। কেননা সে যতোই কষ্ট পাবে তার শাশুড়ি ততোই জ্বালাবে এতদিনে বুঝতে পেরেছে সে। নরম তুলতুলে মেয়েদের সবাই পিষে দিতে চায়। বিয়ের এতো বছর পর মিথিলা বুঝতে পারল।

মিথিলাদের মতো মেয়েদের জীবন এতো সহজভাবে চলতে থাকবে সেটা ভাবা বোকামি। শাহানা বেগমের আনা মেয়েটা উনার মতোই। সারাদিন মিথিলার সাথে থেকে তার দোষগুলো খুঁজে বের করবে। শাহানা বেগম বাড়িতে ফিরলে গড়গড় করে সব বলবে। শাহানা বেগম কী আর তখন বসে থাকবে? মিথিলার দু চারটে কথা শুনিয়েই শান্তি মিলে।

বিকালবেলায় মিথিলা এহসানের সাথে খেলছিল। তখন ইমন বাসায় আসলো। এই সময়ে ইমনকে দেখে বিশেষ প্রতিক্রিয়া দেখালো না সে। আগের মতোই খেলতে লাগলো। ইমন একটি চিপ্সের প্যাকেট ও একটি ডালভাজার প্যাকেট বিছানার উপর রাখলো কিন্তু কিছু বলল না। ও বাবা ও বাবা বলে ছেলেকে কোলে নিয়ে কিছুক্ষণ আদর করে আবার চলেও গেল। মিথিলা ভেবেছিল ইমন কিছু বলবে। ভাল মন্দ বিচার করার বয়স তো তার হয়েছে। আর কতো ধৈর্য ধরবে মিথিলা ভেবে লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল।

মিথিলার প্রতিবেশী দেবরের বিয়ে হয়েছে বছর ছয়মাস হবে। মেয়েটার নাম সেলিনা। ব্যবহার তার খুবই মিষ্টি। দেখা হলে, ভাবি ভাবি বলে মুখ ভরে ডাকে। মেয়েটার সাথে কথা বলে মিথিলারও ভাল লাগে। শাহানা বেগম আড়চোখে দেখে শুধু কিছু বলে না। সময় হলে যে সে কিছু বলবে, সেটাও জানা মিথিলার। ইমন চলে যাওয়ার পর সেলিনা আসলো। মিথিলা দাড়িয়ে সেলিনাকে বসে নিজেও বসে পড়লো।শুরু হলো সাংসারিক আলাপ। বিবাহিতা নারীরা তিন-চারজন একত্রিত হলেই খেজুরে আলাপ শুরু করে।যার মধ্যে অধিকাংশই সংসার অথবা স্বামী শাশুড়ি জাতীয় হয়। গল্প করার এক ফাঁকে সেলিনা ইতস্ততভাবে বলল,” আপনাকে একটা প্রশ্ন করি, ভাবি?”

মিথিলা সরলমুখে বলল,” হ্যাঁ, বলো।”

” বিয়ের পর কারণ ব্যতীতই কী প্রতিদিন ফরজ গোসল করতে হয়?”

মিথিলা থমকে গেল। একটাসময় সেও এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল। বিয়ের একমাস যেতে না যেতেই শাহানা বেগম সরাসরি বলেছিল,” পড়ালেখা জানা মাইয়া হইয়াও এটা জানো না যে, সকাল সকাল ফরজ গোসল করতে হয়? তোমারে তো ভেজা কাপড় একদিনও নাড়তে দেখি।”

মিথিলা লজ্জায় নিচু স্বরে বলেছিল, ” আমি রাতেই গোসল করে ফেলি, আম্মা?
শাহানা বেগম বিশ্বাস করেনি।উলটো বলেছিল,” পাক নাপাক কী বুঝো না নাকি? খবরদার এই নাপাক শরীরে আমার ঘরেও ঢুকবা না।”

কারণ ছাড়া ফরজ গোসল করার কোনো মানেই হয় না। মিথিলা এই কথাটা সেদিন বলতে পারেনি। শ্বশুর, প্রতিবেশীদের সামনে যা অসম্মানিত হয়েছিল সে। ঘরে এসে খুব কেঁদেছিল। এছাড়াও স্বামী স্ত্রীর মিলনের সময়টায় শাহানা বেগম দরজা আটকে রাখার কারণ জিজ্ঞেস করতো। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে কি করছে দেখার চেষ্টা করতো। বলে রাখা হোক, স্বামী স্ত্রীর আপত্তিকর ও বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি দেখার জন্য উনি উঁকি দিত না। বরঞ্চ উনার মনে ভয় হতো, যদি মিথিলা এক কথা দুই কথা ফুসলিয়ে ইমনকে নিজের বশে এনে ফেলে। শাহানা বেগম এই ভয়টা পেত।
একদিন তো সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলেছিল শাহানা বেগম। স্বামী স্ত্রীর মিলনের সময়ে এতো জোরেই দরজায় ( পুরোনো কাঠের দরজা) আঘাত করে বসলো যে, দরজার নব ভেঙে গেল। শাহানা বেগম দুজনকে সেই অবস্থায় দেখে কিছু না বলে চলে গেল। এলোমেলো অবস্থায় দুজনকে দেখে ফেলার কারণে মিথিলার ইচ্ছে করছিল ম’রে যেতে। ইমনও লজ্জায় সেদিন মূর্ছা গিয়েছিল কিন্তু মাকে কিছুই বলল না। এখন মিথিলা ভয় পায় না। তবে একটা কাজ করে সে।যেহেতু তার শাশুড়ির ছেলে ও ছেলের বউয়ের ব্যক্তিগত বিষয় জানতেও আগ্রহী। মিথিলা শাহানা বেগমকে লজ্জায় ফেলতে ইচ্ছে করেই শাশুড়ির উপস্থিতির আভাস পেয়ে সকালে ভেজা কাপড় দড়িতে মেলে দিয়ে আসে। এতে শাহানা বেগম শুধু মুখ ফুলিয়ে বসে থাকে।

অতীতের কথা ভেবে অন্যমনস্ক হয়ে গিয়েছিল মিথিলা।সেলিনার ডাকে ধ্যান ভাঙে সে হাসিমুখে উত্তর দিল,” তা করতে যাবে কেনো, বোকা মেয়ে?”

” আমার শাশুড়ি তো বলে করতে।”

মিথিলা বর্তমানে যেই কাজটা করে সেই বুদ্ধি দিল। মিথিলা সঠিক ভুল ভাবল না। তার ভাবনায় একটাই চিন্তা ছিল তা হল, মিথিলার মতো এতো নরকের জীবন যেনো কেউ পাড় না করে।
সেলিনার সাথে গল্প করতে করতে সন্ধ্যা নেমে এল। ঘরে বিস্কুট, চানাচুর ছিল। মিথিলা গত সপ্তাহে বাবার বাড়ি থেকে আসার সময় নিয়ে এসেছিল। সেগুলোই সেলিনার সামনে দিয়েছিল। শাহানা বেগম সাদিয়াকে নিয়ে পৌরসভায় গিয়েছিল। সাদিয়ার জন্ম নিবন্ধন তৈরী করতে। মজার বিষয় হল, পিতা মাতার জায়গায় ইমন ও মিথিলার নাম উনি দিল। সেলিনা থাকা অবস্থায় শাহানা বেগম চলে এলো। প্লেটে বিস্কুট চানাচুর দেখে জিজ্ঞেস করল,” এগুলো কই থেকে আনছো, বউ?”

মিথিলা স্বাভাবিক সুরে উত্তর দিল, ” বাবার বাসা থেকে।”

শাহানা বেগম মুখ বাঁকিয়ে নিল ঠিকই কিন্তু পরমুহূর্তে সাদিয়ার উদ্দেশে বলল,” এত বিস্কুট সেলিনা একলা শেষ করতে পারব না। নষ্ট কইরা লাভ নাই। এই সাদিয়া তুইও গিয়া খা, যা।”

মিথিলা অবাক হলো। সাদিয়া এসে দুইহাতে চারটা বিস্কুট নিয়ে খেতে বসে পড়লো। সেলিনা লজ্জা পেল নাকি বিভ্রান্ত হল বোধগম্য হল না। মিথিলার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। অবশিষ্ট চানাচুর ও বিস্কুট খেয়েও সাদিয়ার পেট ভরল না। সে শাহানা বেগমের কাছে গিয়ে আরো খাবার চাইলো। মিথিলা নামাজের জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিল
শাহানা বেগম তখন এসে রাগান্বিত স্বরে বলল,” একটু খাওনই তো চাইছিল,তোমার কইলজা তো চায় নাই। মুখের সামনে থেইকা খাওন কেমনে কাইড়া নিলা?”

মিথিলা বিস্ময়কর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,” আমি তো খেতে না করিনাই। ও তো সব খেয়েই গেল।”

মুখের উপর কথা শুনে থতমত খেয়ে গেল শাহানা বেগম। কথা ঘোরানোর জন্য বলল,” আরো বিস্কুট থাকলে দাও।”

মিথিলা জবাবা দিল,” আমার বাপের বাড়ি থেকে আনা কিছুই ও পাবে না। তাছাড়া এগুলো এহসানের জন্য। আব্বু আসার সময় কিনে দিছে।”

শাহানা বেগম রাগে কটমট করে নিজেই মিথিলার ঘরে প্রবেশ করল। বিস্কুটের বয়াম থেকে চার পাঁচটা তুলে নিয়ে বয়াম জমিনে আছড়ে ফেলে চলে গেল। যাওয়ার সময় বলল,” আমার স্বামীর কামাই খাও আর এই মাইয়ারে বাপের বাড়ির দুইটা বিস্কুট দিতে পারো না। আজ তোমার শ্বশুর আসুক, একটা বিহিত করমুই।”

মিথিলার ইচ্ছে করছিল শাশুড়ির হাত থেকে খাবারগুলো কেড়ে নিতে কিন্তু তা করল না। কেননা সে তো শাহানা বেগম হতে চায় না। মিথিলাই থাকতে চায় তবে নতুনরূপে।

——————-

কিছুদিন পর,

শাহানা বেগম সকালে উঠে চিৎকার চেচামেচি করছে। মিথিলা রান্না করছিল। সব ফেলে এসে দেখল শাশুড়ি বলছে,” ঘরের সব খাওন কে খাইয়া ফেলে? কালই তো এতোগুলা বিস্কুট আনলাম চা দিয়া খাওনের লাইগা। আজ দেখি মাত্র ছয়টা বিস্কুট আছে। মিথিলার কেনো যেনো মনে হচ্ছে তার উপর দোষ আরোপ করা হবে। তাই সে বলল,” সাদিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, আম্মা। ঐদিন চিঁড়া ভাজা চুরি করে খাওয়ার সময় আমি দেখে ফেলেছিলাম।”

” ঐ বউ! মিছা দোষ দিবা না। এইটুকু মাইয়া রাক্ষস নাকি যে সব বিস্কুট খাইয়া ফেলবো?”

মিথিলা উত্তর দেয়ার আগেই তার শ্বশুর বাড়ি ফিরে আসে। গায়ের পাঞ্জাবী খুলে পকেটে হাত দিয়ে বলতে শুরু করে,” গতকাল আমার কাছে পাঁচশো টাকার একটা নোট ছিল। মাগরিবের সময় মসজিদের দান বক্সে টাকা দেওয়ার সময় ভাঙতি করছিলাম। সন্ধ্যার পর মোট দুই কাপ চা খাইছিলাম। তিনটা তিনশো টাকার নোট,পঞ্চাশ টাকার একটা নোট আর বাকী টাকা দশ টাকার নোট ছিল চারটা। আজ রিক্সা ভাড়া দিতে গিয়া দেখি তিনশো পঞ্চাশ টাকার নোট আছে কিন্তু ভাঙতি টাকাগুলো নাই। ও ইমনের মা, তুমি নিছিলা টাকা?”

শাহানা বেগমের এমনিতেই মাথায় রাগ ছিল। উনি দিলেন মিথিলার শ্বশুরকে ধমক,” রাইতে কী সিনেমা দেখবার যাইয়াম যে আমনের পকেট থেইটা টাকা চু”’রি করাম! খুঁইজা দেখেন, পাইয়া যাইবেন।”

শ্বশুর শাশুড়ির কথোপকথনের মাঝে মিথিলা লক্ষ্য করল সাদিয়া চুপ করে এক কোণায় দাড়িয়ে আছে। মিথিলা যা বুঝার বুঝে গেল। সে শাহানা বেগমের ঘরে ঢুকে সাদিয়ার জিনিসপত্রে হাত দিল। এদিকে শাহানা বেগম চিল্লিয়ে যাচ্ছে,” সাদিয়ার কাপড় হাতাও কেন। ও কী চু’রি করছে? মাইয়াডারে বাড়িত আনার পর থেইকাই বউডা দেখতে পারে না।।”

মিথিলা বিশেষ কিছু পেলো না। তবে তার ঘরের ক্লিপ, ব্রেসলেট ঠিকই পেলো। মিথিলার হাতে সেগুলো দেখার পর শাহানা বেগম বলল,” তুমি নাকি দিছো?”

মিথিলা বলল, “না।”

ইতিমধ্যে ইমনের ঘুম ভাঙলো। বাহিরের শোরগোল শুনে ছেলেকে কোলে নিয়ে এসে এসব দেখে বলল,” ওর স্কুল ব্যাগে দেখো গো, মিথিলা?”

আমার পাঁচ টাকার একটা কয়েনও জায়গা মতো নেই। ও যে নেয় আমি দেখেছি। মিথিলা তাই করলো। ব্যাগে হাত দিয়ে শ্বশুরের সব টাকা বের করলো। শাহানা বেগম ও মা”গি”র ঝি বলে বেদম পি’ট’ল সাদিয়াকে। সকলে বুঝতে পারল সকল চু”’টির পেছনে ওরই হাত রয়েছে।

মিথিলা শাশুড়িকে থামালো না। বরং শুনিয়ে শুনিয়ে বলল,” পরের জন্য গর্ত খুঁড়লে নিজেরই সেই গর্তে পড়তে হয়,মা! আপনি আমার ক্ষতি করার জন্য মেয়েটাকে বাড়ি এনে নিজের সম্পদই ধ্বংস করলেন।”

চলবে………