দাহন পর্ব-০৭

0
40

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৭

শাহানা বেগমের আনা মেয়েটা চলে গিয়েও গেল না। এবারের মতো ক্ষমা করে দিলেন শাহানা বেগম। মিথিলা লম্বা নিঃশ্বাস ত্যাগ করা ছাড়া কিছুই করতে পারল না। তবে মিথিলার জীবনে স্বামীর সুখ চলে আসলো। ইমনটা কীভাবে যেনো পালটে গেলো। শাহানা বেগম এখন একদিকে কথা শুনিয়ে চলে গেলে ইমন অপরদিকে এসে মিথিলাকে শান্তনা দিতে শুরু করতে থাকল। মিথিলার মনে হল, এই বুঝি সুখের মুখ দেখা হবে তার।

ইমন তখনো বেকার। চাকরি করার ধৈর্য নেই। ব্যবসা করতে গেলে টাকার প্রয়োজন পড়ে। শাহানা বেগম ও তার স্বামী বেঁচে থাকা অবস্থায় ইমনকে ব্যবসা করার জন্য টাকা দিবে না। মিথিলাও এই সময়ে বাবার বাড়ি থেকে সম্পত্তির ভাগ আনবে না। ইমন আজ ভাল আছে, টাকা পেলে যদি আগামীকালই আগের মতো হয়ে যায়! শেষে তো মিথিলার এপাড়েও কিছু থাকবে না ঐপাড়েও কিছু থাকবে না। মিথিলা পড়াশোনায় ভাল ছিল। সে ভাবল নিজেই কিছু করে নিবে। এভাবে তো আর চলবে না! এহসানও বড়ো হচ্ছে। এখনই আধো আধো বুলিতে এটা সেটার আবদার করে। ইমনের কাছে তো টাকা নেই। সে চাইলেও সন্তানের আবদার পূরণ করতে পারে না। মিথিলা আশেপাশের কিন্ডারগার্টেন স্কুলে ও মাদরাসায় চাকরি খুঁজতে লাগল। একটাসময় চাকরি পেয়ে গেল। কিন্ডারগার্টেন থেকে মাদরাসার চাকরি সঠিক মনে হলো। মাত্র তিন হাজার বেতনে সে চাকরি করা শুরু করল। সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা পর্যন্ত ক্লাস করতে থাকল মিথিলা। এই সময়টাতে এহসানকে নিজের কাছেই রেখে দেয়। ছেলেকে কোলে নিয়ে ক্লাস করায়।

মিথিলার চাকরির কথা শুনে মনে প্রশ্ন আসলো না যে, শাহানা বেগম এতো সহজেই মিথিলার চাকরি করা মেনে নিবে?
উত্তর বলা হোক, ফজর নামাজের পর মিথিলা সারাদিনের রান্না ও সংসারের টুকটাক কাজ করে মাদরাসায় যায়। কাজ যেহেতু হয়ে যায় এতে শাহানা বেগম কিছু বলার সুযোগ পায় না। মিথিলার দিনকাল এভাবেই অতিবাহিত হতে লাগল। চাকরি করার পাশাপাশি কয়েকজন ছাত্র ছাত্রী প্রাইভেট পড়াতে শুরু করল। এতে করে মাসে ছয় থেকে সাত হাজার টাকা চলে আসতো। মিথিলা প্রথম বেতন পেয়ে মিথিলা তার বাবা, নানা ও শ্বশুরের জন্য লুঙ্গি কিনে আনল। শাশুড়ির জন্য গজ কাপড় কিনলো। পরের মাসে সাদিয়ার জন্য গোল জামা ও এহসানের জন্য কাপড় কিনল। মিথিলা ভেবেছিল, শাহানা বেগম কাপড় পেয়ে খুশি হবেন কিন্তু না! শাহানা বেগম মুখ ফুলিয়েই রাখলেন। মিথিলা তৃপ্তি তখন পেল, যখন শুনতে পেল তার নানা খুশিতে চোখ ভিজে গেছে। পরেরদিনই নাকি ঐ লুঙ্গি পরে নামাজ পড়েছে। আর মিথিলার বাবা নাকি লুঙ্গি দেখে খুব খুশি হয়েছে। মিথিলা এইটুকুতেই শান্তি পেল।

ইমনের জন্য পাঞ্জাবী কিনতে চেয়েছিল মিথিলা কিন্তু ইমন নিষেধ করে দিল। সে বলল,” বিয়ের পর শখ করে হলেও তোমাকে কিছু কিনে দিতে পারিনি। এই টাকাগুলো দিয়ে তোমার শখ পূরণ করো।”

মিথিলার মন তবুও মানেনি। সে ভেবে নিল, ইমনের প্রয়োজনীয় জিমিসটাই সে একদিন না একদিন কিনে দিবে। মিথিলার জীবন ভালোই চলছিল। শাহানা বেগম আগের মতোই। নতুন করে মিথিলার পিছু লাগার কারণ খুঁজে পেল। সকালবেলা মিথিলা রান্না করে রেখে যায় সেই খাবার নাকি উনি খেতে পারে না। তাই মিথিলাকে দুপুরের খাবার রান্না করতে নিষেধ করে দিল। কয়েকদিন শাহানা বেগম রান্না করলেও পরবর্তীতে মিথিলা দুপুরে আসলেই দুনিয়ার কথা বলতে শুরু করল,” আমার বয়স হইছে। কতো আর কাজ করমু। সারাদিন কাজ করতে করতে শরীরটা ভেঙে আসে। দুপুরে মাছ আনলে কা’টু’ন লাগে। আবার রান্নাও করুন লাগে। আমি তো কামের বেডি। বউ রাজরানীর মতো চাকরি কইরা খাইবো আর আমি কামলা দিমু।”

মিথিলা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে। পরেরদিন রান্না করে গেলেও এসে দেখে সেই খবার এভাবেই পড়ে আছে। শাহানা বেগম যেগুলো রান্না করেছেন সেগুলোই খাচ্ছে। কোনোদিন তো খাবার ফেলে দিত শাহানা বেগম। মিথিলা বুঝতে পারল,তার চাকরিই এতো অশান্তির কারণ। একদিন তো ভাবে সে চাকরিটা ছেড়েই দিবে। পরমুহূর্তে ইমন তাকে বুঝায় চাকরি না ছাড়তে। শাশুড়ি সারাজীবনই বলে আাছে এবং বলবেই। তুমি চাকরি ছেড়ো না।

এভাবেই সময় যেতে লাগলো। শাহানা বেগম কাগজে কলমে সাদিকে নিয়ে আসলো। সাদিয়াও এবাড়িতে সারাজীবনের জন্য থাকতে শুরু করল। এহসানের বয়স এখন তিন বছর। কথা বলতে পারে। মিথিলা এখন আর সাথে নিয়ে যায় না। বাড়িতে রেখে যায়। মিথিলার শ্বশুরের আদেশ ছিল নাতনিকে যেনো বাড়িতেই রেখে যায়। মিথিলার সাংসারিক জীবনে আরেকটি তথ্য দেয়া হয়নি। এহসানের জন্মের আগে ও পরে কখনও মিথিলাকে বাবার বাড়ি একদিনের বেশি থাকতে দেয়নি। এহসান হওয়ার আগের কারণ হল, ছেলের বউ থাকতেও শাহানা বেগম কাজ করতে পারবে না। এমনও হয়েছে আগেরদিন মিথিলা বাবার বাসায় গেল পরেরদিনই শাহানা বেগম অসুস্থ হয়ে পড়তো। কখনো মাথা ঘুরাচ্ছে বলে বিছানায় পড়ে থাকতো আবার কখনো শরীর ব্যথার কথা বলে বসে থাকতো। এহসান হওয়ার পর মিথিলার বাবা বাড়ি নিয়ে কারণ দাঁড়াল, মিথিলার শ্বশুর শাশুড়ির মনে হল বাবার বাড়ি গেলেই তাদের নাতনি নানা নানীর পাগল হয়ে যাবে। দাদা দাদীকে কম চিনবে। মিথিলা কতো বুঝাল, নানা নানীর ভালবাসাই আলাদা। বাবার বাড়ি সারাজীবন পড়ে থাকলেও র’ক্ত র’ক্ত’কেই চিনবে। কিন্তু তারা মানেনি। মিথিলা আগেরদিন বিকালে গেলে পরেরদিন বিকালে চলে আসে। এখন তো মিথিলা চাকরি করে, এখন চাইলেও বাবার বাড়ি যেতে পারবে না।

————-

মিথিলার শ্বশুর বাড়ির এলাকা নীচু এলাকা। বর্ষাকালে বাড়ির চারপাশের ডোবাগুলো ভরে যায় কিন্তু বাড়ি পর্যন্ত পানি আসতে পারে না। এবারের বর্ষাকাল মিথিলার জন্য কাল হয়ে এলো। টানা তিনদিন ধরে বৃষ্টি হল। বাড়ির চারপাশের ডোবা গুলো ভরে গেল। চতুর্থদিনের মাথায় বাড়িতেও পানি উঠলো। শুধু মিথিলার শ্বশুর বাড়িতে নয় পুরো এলাকা পানিতে ডুবে গেল। সকালে ঘুম থেকে উঠে দ্বার খুলতেই একটি বড়ো ঢেউ এসে শাহানা বেগমকে ফেলে দিল। ও মা গো বলে যখন আর্তচিৎকার করল মিথিলার ঘুম তখন ভাঙল। দরজা খুলে পানি দেখে দিশেহারা হয়ে গেল মিথিলা। এহসানকে কোলে তুলে কান্না করতে থাকল। এদিকে কয়েক মিনিটের মধ্যে হাঁটু সমান পানি উঠে গেল। সারা এলাকায় হাহাকার অবস্থা। এমন পানি কেউ কখনো দেখেনি। বাড়ি ছেড়ে তো চলে যাওয়া সম্ভব না। মিথিলা ভেবে নিল, এহসানকে তার বাবার বাসায় রেখে আসবে। মিথিলার বাবার বাড়ি তিনতলা বিশিষ্ট সেখানে পানি উঠার সম্ভাবনা নেই। যেমন ভাবনা তেমন কাজই করল মিথিলা। ছেলেকে ইমনের কাঁধে চড়িয়ে বলল,” আমাদের জান আপনার কাছে দিয়ে দিলাম। ওকে সাবধানে দিয়ে আসেন।”

ইমন চলে যাওয়ার সময় বলল,” আব্বা আম্মারে দেখে রাইখো। অবস্থা খারাপ হইলে উনাদেরও রাইখা আসমু।”

ইমন চলে যেতেই মিথিলা কাজে নেমে পড়লো। ওয়ারড্রবের সকল কাপড় বস্তায় ভরে উঁচু জায়গায় রাখল। রেফ্রিজারেটরের নিচে টি টেবিল সেট করে দিল। শাহানা বেগম মাথায় হাত রেখে আহাজারি করেই যাচ্ছেন। উনি সাদিয়ার কথা চিন্তা করছেন। এই পানিতে মেয়েটার কী হবে! মিথিলা একবার বলতে চেয়েছিল, এহসানের সাথে চলে যেতে। পরমুহূর্তে সাদিয়ার স্বভাবের কথা মনে পড়লো। শ্বশুর বাড়িতে ইমনেরও একটা সম্মান আছে। সাদিয়া কিছু চু’রি করলে ইমনেরই সম্মানে কমবে।

শাহানা বেগম সাদিয়াকে তার মায়ের কাছে রেখে আসলো। বলাবাহুল্য সাদিয়ার মা আছে কিন্তু বাবা নেই। দুইবেলা অনাহারে ও একবেলা খেয়ে মহিলা পড়ে থাকে। মেয়ের মুখে একমুঠো ভাত তুলে দেয়ার সামর্থ নেই। শাহানা বেগম মেয়েটার কষ্ট দেখে নিজের সাথে নিয়ে আসলো। সাদিয়ার বাবাকে নিয়ে কখনো প্রশ্ন করলে সাদিয়ার মা একবার উত্তর দিল, সাদিয়ার বাবা বেঁচে নেই। আরেকবার উত্তর দিল, সাদিয়ার বাবা নাকি তিনমাসের পেটে রেখে চলে গেছে। মিথিলা একটা কথাও বিশ্বাস করল না। সাদিয়ার মা মাঝে মাঝে বাড়িতে আসে। মেয়েকে দেখতে আসার বাহানায় একথালি ভাত খায়। খাওয়া নিয়ে মিথিলার সমস্যা নাই। মহিলাটা খাওয়ার পর ভদ্রতার খাতিরে প্লেট বাটিও গুছিয়ে রাখে না। এমনকি মেয়েকেও গোছাতে বলে না। মিথিলা এসে প্লেট বাটি পরিষ্কার করে।সাদিয়ার মা তখন বলতো, ” সাদিয়া এখন আপনার মেয়ে। কাপড় চোপড় পরিয়ে পুতুলের মতো সাজিয়ে রাখবেন। ঠিক আপনার ছেলের মতো।ভাবি, আপনার কী কষ্ট হচ্ছে? ”

মিথিলা ভদ্রতার খাতিরে না বলতো। কিন্তু পরেরবার থেকে সাবধান হয়ে গেল। সাদিয়ার মা বাড়িতে আসলে কাজের বাহানায় ব্যস্ত থাকতো।

শাহানা বেগম সাদিয়াকে মায়ের কাছে রেখে আসলো। পানি তখন কোমর সমেত। ইমন এহসানকে রেখে চলে আসলো। মিথিলা দেখে তখন বলল,” তুমি আসতে গেলে কেনো?”

ইমন উত্তর দিল, ” বউকে ফেলে নিজে আরাম করার মতো কাপুরুষতা ছেড়ে দিয়েছি। বাঁচলে একসাথেই বাঁচবো, ম’র’লে একসাথে।”

মিথিলা কিছু বলল না। ইমন ভাল হয়ে গেলেই ভাল। বিকাল পর্যন্ত পানি নেমে যাওয়ার কোনো নাম নিল না। এমনকি বাড়লোও না। এহসান এখনো ছোট, মিথিলাকে ছাড়া এক রাত্রিও থাকতে পারে না। ইমন সিদ্ধান্ত নিল, মিথিলাকে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দিবে। মিথিলা শুনে না করল কিন্তু ইমন মানলো না। মিথিলাকে জোর করে পাঠিয়ে দিল।

মিথিলা রাত কীভাবে পাড় করলো সেই জানে। পানি উঠার কারণে রান্না বন্ধ। তিনজন মানুষ অনাহারে আছে। সকাল হতেই মিথিলা রান্না করে শ্বশুর বাড়ির উদ্দেশে রওনা দিল। ঘরে শুঁকনো খাবার ছিল। মিথিলার শ্বশুর ও শাশুড়ির ডায়বেটিস আছে। শুকনো খাবার খেয়ে তারা দুর্বল হয় পড়লো। মিথিলা পৌঁছাল সকাল আটটায়। পানি দিয়ে আসতে সময় নিল একঘণ্টা। বাড়িতে এসে তিনজনকে খাবার পরিবেশন করে আবারও বাবার বাড়ি চলে আসলো।

পানি থাকলো পুরো এক সপ্তাহ। মিথিলা এই কয়েকদিন সকালে শ্বশুর বাড়ি আসতো আর বিকালে ছেলের জন্য চলে যেত। পানি পুরোপুরি নেমে যাওয়ার পর ঘর বাড়ি পরিষ্কার করতে থাকলো নিজেই। এরমধ্যে সাদিয়ার মা মেয়েকে নিয়ে আসলো। শাহানা বেগম ভেবছিল, সাদিয়ার মা কাজকর্মে সাহায্য করবে কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমাণ করে দশ মিনিটের মধ্যেই চলে গেল। এবারে কিছু খেল না। কেনো খেল না বুঝে আসলো তো?

বাড়ির চারপাশের পরিবেশ মোটামুটি ঠিক করে এহসানকে বাড়িতে নিয়ে আসলো মিথিলা। যথারীতি মাদরাসায় যাওয়া শুরু করল। শাহানা বেগমের ঘরের কাজ কিছু বাকী ছিল। মিথিলা করতে চাইলে শাহানা বেগম কাজ করতে দিল না। উলটো বলল,” তুমি মাদরাসায় যাও। অনেকদিন বাঁধা করছো।পরে বেতন কা’ই’টা নিব।”

শাশুড়ির এতোদিন পর সুবুদ্ধি হওয়া দেখে মিথিলা খুশি মনে চলে গেল। কিন্তু বিপত্তি ঘটলো তখন যখন মিথিলা বাড়ি এসে শুনলো সাদিয়া বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গেছে। মিথিলার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো। ভাবনায় ভাল কিছুর পরিবর্তে খারাপটাই বেশি আসলো।যারমধ্যে একটি ভাবনা হল, সাদিয়াকে যদি কেউ ধরে নিয়ে মে’রে ফেলে? তবে তাদের উপরই তো দোষ আসবে! টাকার জন্য সাদিয়ার মা পুলিশ কেস করবে। তখন মিথিলাদের কী হবে?

চলবে………