দাহন পর্ব-০৮

0
35

#দাহন
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_৮

মিথিলা মাদরাসা থেকে আসার এক দেড় ঘণ্টার মধ্যে সাদিয়ার মা সাদিয়াকে নিয়ে আসলো।মহিলার চোখ মুখ তখন দেখার মতো ছিল। পারলে মিথিলাদের একেকজনকে মে’রে তক্তা বানিয়ে দিত। বাড়িতে ঢুকেই প্রথমে শাহানা বেগমের দিকে আঙুল তুলল সাদিয়ার মা,” আমার মাইয়া ভাইগা গেল কেনো? আপনি এইটুকু মাইয়ারে দিয়া সব কাজ করান। এজন্যই সাদিয়ারে আনছিলেন? এই পচাঁ কাঁদাও নাকি তারে দিয়া পরিষ্কার করাতে চাইছিলেন, মাইয়া না করছে দেইখা মা’র’লেন। কেমন মানুষ আপনি?”

শাহানা বেগম মাথায় হাত রেখে দাঁড়িয়ে রইলেন। তিনি বিষয়টা বুঝার চেষ্টা করতে লাগলেন। সাদিয়াকে মাথায় তুলে রেখেছিলেন তিনি। মেয়েটা মিথ্যা বলে এভাবে প্রতিদান দিল? মিথিলা শাশুড়ির কাছে এসে বলল,” আম্মা, সব কাজ আমি করলাম। সাদিয়াকে কখন পরিষ্কার করতে বললেন?”

শাহানা বেগম মিথিলার কথার তালে তাল মিলিয়ে বললেন,” বউ তো ঠিকই কইলো। এতো ভারী কাম কী তোমার মাইয়া করতে পারব? ওয় তো শুইয়া বউয়ের ঘরে টিভি দেখতাছিল। আমি কাজ করতে করতে শেষ একবার আইসা উঁকিও দিল না। সকাল আটটা থেইকা এগারোটা পর্যন্ত টিভি দেখতাছে। তাই বউয়ের ঘরে গিয়া বলছিলাম, টিভি না দেইখা সিদ্ধ আলু ছিলে দিতে। দিল তো না! বাড়ি থেইকা চলে গেল। এই বউ, কওতো ওরে আমি কী ভারী কাজ করতে বলছি?”

মিথিলা সায় দিল। বলল,” না, আম্মা।”

সাদিয়ার মা সাদিয়ার দিকে তালিয়ে বলল,” কি রে! তোর দাদী সত্য কইছে?”

সাদিয়ার এইটুকুন মুখখানা দেখে মিথিলা বুঝতে পারল যে সে মিথ্যা বলছে। এবার তার সাহস হল। মিথিলা জানালো সেইিনের ঘটনা যেদিন তার শ্বশুর শাশুড়ি ডাক্তার দেখাতে ঢাকা গিয়েছিল। সেদিন এহসানেরও অনেক জ্বর ছিল। সকাল দশটা বাজতে চলল কিন্তু মিথিলা একটা কাজও করতে পারল না। এদিকে ঘরের থালাবাসন, হাড়ি পাতিল এলোমেলো অবস্থায় ছিল। এহসানকে রেখে সে বিছানা ছেড়ে উঠতে পারল না এক মিনিটের জন্যও। ইমন সকালের নাশতা বাহির থেকে আনতে গিয়েছিল। শাহানা বেগম বাড়িতে না থাকলে সাদিয়াই এবাড়ির রাজা সাদিয়াই এবাড়ির রাণী। নিজের স্বাধীন মোতাবেক চলাফেরা করে সে। শাহানা বেগম এই ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে সাদিয়াকে। মিথিলা সেদিন বলেছিল, হাঁড়ি পাতিলগুলো কলপাড়ে রেখে আসার জন্য। আরো বলেছিল, পাশের বাড়ির খালাকে খবর দেয়ার জন্য যেন আজ কাজগুলো করে দিয়ে যায়। বিনিময়ে টাকা দিবে। সাদিয়া কথা শুনল না। এহসানকে ঘুম পাড়িয়ে মিথিলা ঘর থেকে বের হয়ে থালাবাসন সেভাবেই পড়ে থাকতে দেখে নিজেই খালাকে ডাকতে চলে গেল। সাদিয়াকে হাজারবার ডাকলেও সাড়া পেল না। সাদিয়া বাড়ি ছেড়ে চলে গেল। সেদিন ভাগ্য মিথিলার সহায় ছিল। পথিমধ্যে মিথিলার খালা শাশুড়ি সাদিয়াকে ধরে নিয়ে আসলো। মিথিলা আলাপ আলোচনায় সত্যটা বলল। খালা উলটো মিথিলাকে জানাল, “সাদিয়া বলেছে মিথিলা নাকি থালাবাসন ধুয়েমুছে দিতে বলেছে।”

মিথিলা সেদিন খালাকে ইমনকে দিয়ে প্রমাণ দিল। মিথিলা আজ সেই কথাটা সাদিয়ার মাকে জানালো। শাহানা বেগম অবশ্য সেদিন কিছু বলেনি কিন্তু আজ চুপ থাকল না। বলল,” তোমার মাইয়ারে সব দিছি।দুই ইদে দুইটা দুইটা কইরা চারটা জামা কিনে দিছি। জুতা, ঘড়ি সহ সব সাজগোজের জিনিস কিনা দিছি। আর কী করতাম তোমার মাইয়ারে। এই মাইয়ার স্বভাবই ভালা না। নয়তো আমার নামে মিথ্যা কথা কয় কেমনে।”

এক দুই কথাতে সিদ্ধান্ত হল সাদিয়া চলে যাবে। এখানে থাকলে শাহানা বেগম তাকে মে’রে ফেলবে এমন অভিযোগ উঠলো। মিথিলা আটকাল না, সে খুশি হলো। সাদিয়ার প্রতি শাহানা বেগমের ভালোবাসা হয়তো শত অপরাধ করলেও কমবে না। তিনি খুব চেষ্টা করলেন, সাদিয়াকে আটকাতে। সাদিয়া তখন তার মাকে জানাল, ” আমারে এইখানে রাইখা গেলে আবার পালাইয়া যামু। এবার তোমার কাছে যামু না। দুই চোখ যেদিকে যাইবো ঐদিকে চলে যামু।”

আট বছরের একজন ছোট বাচ্চার মুখে কথাটা শুনে মিথিলা কঠিন সিদ্ধান্ত নিল। শাহানা বেগমের অনুমতিও নিল না। সাদিয়ার জিনিসপত্র গাট্টি পাট্টা বেঁধে বাড়ি থেকে বের করে দিল। অবশ্য এবার শাহানা বেগমের কথা না বলার পেছনে মিথিলার শ্বশুরের হাত রয়েছে। ভদ্রলোক ছিটছিটে স্বভাবের। নিজের ছেলে ও নাতনি ছাড়া অন্য বাচ্চাদের দেখতে পারে না। তাছাড়া অন্যের খাওয়া দেখতে পারেন না উনি। সাদিয়াকে নিজের পাশে বসিয়ে শাহানা বেগমের খাইয়ে দেওয়া পছন্দ হয় না তার। সাদিয়া এবার সত্যি সত্যি চলে গেল। মিথিলাও লম্বা নিঃশ্বাস ফেলল।

—————–

আপদ চলে যাওয়ার পরও বিপদ রয়ে গেল মিথিলার জীবনে। সেই বিপদটা আর কেউ নয়, শাহানা বেগম নিজেই। সাদিয়া চলে যাওয়ার পিছনে সম্পূর্ণ দোষ পড়লো মিথিলার ঘাড়ের উপর। মিথিলা হাজার বুঝালেও বুঝল না তার শাশুড়ি। এদিকে মিথিলার চাকরির বয়স একবছর হতে চলল। সে নিজের জন্য একটি স্মার্ট ফোন কিনল। ছেলেকে রিমোট কন্ট্রোল গাড়ি কিনে দিল। মিথিলার এইটুকু জীবনকে বিলাসিতা জীবন বলে আখ্যায়িত করল শাহানা বেগম। চাকরির জীবন বিষাদ করে তুলল। মিথিলা উপায়ান্তর না পেয়ে চাকরিটাও ছেড়ে দিল কিন্তু প্রাইভেট পড়ানো চলতে থাকলো।

এহসানের বয়স চার বছর হতে চলল। মিথিলা ঘরে বসে ছেলেকে যতটুকু সময় পেল পড়াশোনা শিখাতে শুরু করল। আজকাল শাহানা বেগমের কথার ধার ধারে না মিথিলা। ইমনও ফুল সাপোর্ট করে তাকে। সে এখন একটি গার্মেন্টসে চাকরি করে। মিথিলার জীবন সুখ আর সুখ।

একদিন দুপুরবেলা শাহানা বেগম মিথিলাকে ডাকলেন। উনার হাতে হাজার টাকার বান্ডিল। মিথিলা কখনো শ্বশুর বাড়িতে এসে এতো টাকা একসাথে দেখেনি। দেখবেই বা কীভাবে। মিথিলার শ্বশুর অল্প টাকা গোনার সময় ভুল করে মিথিলা ঘরে ঢুকে গেলে পিছনে ফিরে যায় নয়তো টাকা লুকিয়ে ফেলে। মিথিলা তাই টাকার কথা উঠলে দূরে দূরে থাকে।

শাহানা বেগম মিথিলাকে বান্ডিল ধরিয়ে দিয়ে বলল,” বউ, বারো হাজার টাকা আলাদা করো তো?”

মিথিলা জানতে চাইল কেনো কিন্তু শাহানা বেগম উত্তর দিল না। বিকালে কোনো কিছু না বলে শাহানা বেগম উনার বাবার বাড়ি চলে গেল। মিথিলা শাহানা বেগমের এহেন কাজে অভ্যস্ত। কাউকে কিছু না বলেই যেখানে ইচ্ছে সেখানেই চলে যায়। এভাবেই মিথিলার জীবন চলতে লাগল।

——————–

কিছুদিনপর মিথিলা বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লো। শরীর জ্বালাপোড়া, বমি বমি ভাব, মাথা যন্ত্রণা ইত্যাদি সমস্যা দেখা দিতে শুরু করল। মিথিলা ভেবেছিল সে দ্বিতীয়বারের জন্য হয়তো মা হবে কিন্তু না। অল্প কয়েকদিনের মধ্যে মিথিলা বিছানায় পড়ে গেল। ডাক্তার দেখিয়েও তার সমস্যার সমাধান হল না। এখন ইমনকেও সহ্য হয় না মিথিলার। কোনো কারণ ছাড়াই চিল্লানো শুরু করে ইমনের উপর। সবকিছু অসহ্য লাগে মিথিলার। এহসানকেও দূরে দূরে রাখে। এই সময়ে শাহানা বেগম ভাল দাদীর দায়িত্ব পালন করা শুরু করল। এহসানের খাওয়া, গোসল থেকে শুরু করে দিনের বেশি সময় নাতনির সাথে কাটানো শুরু করল। ইমনের সাথেও ভাল ব্যবহার শুরু করল। যেমন: মাসের খরচ থেকে এক্সট্রা টাকা দিতে থাকল ছেলেকে। ছেলের পছন্দের খাবার রান্না করে সামনে বসিয়ে খাওয়ানো।

মিথিলার এখন এসব দেখার সময় হয় না। তার কিছুই ভাল লাগে না। মিথিলার অসুস্থতার জন্য তাকে বাবার বাড়ি নিয়ে আসলো ইমন। শাহানা বেগম এহসানকে নিজের কাছেই রেখে দিল। ইমনকে যাওয়ার সময় বলল,” বউয়ের অসুখ। নিজেকে সামলাতে পারে না, ছেলেকে সামলাইবো কেমনে। তুই বরং বউকে রেখে চলে আয়। দাদাভাইকে আমি একা সামলাতে পারমু না।”

মিথিলার নিষেধ করারও শক্তি রইলো না। এহসানকে রেখে বাবার বাড়ি চলে গেল। ইমন ছেলের জন্য মিথিলাকে রেখে চলে গেল।

নিজের ঘরে শুয়ে ছিল মিথিলা। মিথিলার মা মেয়ের জন্য ঝাল ঝাল ডালের বড়া বানাচ্ছেন। মিথিলার শরীর এতোটাই দুর্বল হতে থাকল, একগ্লাস পানি নিজের হাতে নিয়ে পান করবে সেই শক্তিও পেত না। মিথিলাকে দেখতে তাদের একজন ভাড়াটিয়া মহিলা এলো। মিথিলার করুণ অবস্থা দেখে মিথিলার মাকে বলল,” ভাবী, মিথিলাকে ভাল কবিরাজ দেখান। ওকে দেখে মনে হচ্ছে কেউ কালো জা’দু করেছে।”

চলবে………..