গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৬
ঘর থেকে বেরিয়ে গেইট ওবদি পথটা ছোট হলেও, গেইট থেকে গাড়ি ওবদি পথটা খুবই লম্বা মনে হচ্ছে সাজির কাছে। চঞ্চল পা দুটো বরফের ন্যায় জমে গেছে ।পা সামনের দিকে চলছেই না।
শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচিয়ে দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সাজি। অন্তঃকোনে জেঁকে বসা মানুষটা তার দিকে তাকিয়ে আছে, ভাবতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। গালের দুপাশ গরম হয়ে লাল বর্ণ ধারণ করেছে।
কিছুটা পথ পেরুলেই সেই মানুষটির খুব কাছে গিয়ে বসতে হবে। গুনে গুনে চার, পাঁচ আঙুলের দূরত্ব হবে হয়তো। এইভাবে দেখে কি ভাবছেন উনি! আচ্ছা বাজে লাগছে নাতো? হৃদস্পন্দনের শব্দ কেমন বিদঘুটে শুনাচ্ছে। অন্তঃকোনে প্রশ্নের জটলা পাকিয়ে গেছে। উত্তর খোঁজার ইচ্ছে নেই,আর না আছে উত্তরের আশা।
সাদ সাজির দিকে তাকিয়ে আছে। চোখ সরিয়ে নিতে গিয়ে আবারো দৃষ্টি প্রগাঢ় করলো। এই দিকে হৃৎপিণ্ড শরীরের সাথে বিরোধীতা শুরু করে আন্দোলিত হচ্ছে। মস্তিষ্কের সাথে হৃৎপিণ্ডের বাকবিতন্ডা চলছে ক্রমশো। এমন চলতে থাকলে অনুভূতিরা দৃষ্টি গোচর হতে দেরি হবে না। নিজেকে ধাতস্থ করে চোখ সরিয়ে নিল সাদ। মনে মনে বলে উঠলো,সময় হোক তখন নাহয় দ্বিধা সংকোচ মিটিয়ে প্রনয়িনীকে দেখবো।আজ তার ছুটি! আজ সত্যি তার ছুটি!
লাজুক দৃষ্টি জোড়া নতো করলো সাজি। তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে লজ্জা নিবারণের প্রচেষ্টা চালালো। অতঃপর সেই লাজের পর্দা ঠেলে গুটি গুটি পা ফেলে এগিয়ে গেলো।
সাদ নিভৃতে গাড়ির দরজা খুলে সামনে তাকালো।
সাজি উঠে বসতেই সাদ ভারী কন্ঠে বলে উঠলো, শাড়ির আঁচল সামলে বস।
সাজি আঁচল গুটিয়ে দরজা আটকালো। হৃৎপিণ্ড ঢিব ঢিব শব্দ করছে। ঢিব ঢিব শব্দটা জোরেই হচ্ছে,পাশে বসে থাকা ব্যাক্তি শুনে ফেলর মতো জোরে। মনে হচ্ছে ভয়াবহ কিছু হওয়ার আগ মুহুর্ত চলছে।
আড়চোখে পাশে বসা ব্যাক্তিগত রমনীকে দেখে নিলো সাদ। পূর্ণ দৃষ্টি রাখলে হয়তো আরেকটু খুটিয়ে দেখতে পেতো। তবে এতেও খুব একটা কম পরখ করেনি। চুল থেকে পা ওবদি স্ক্যান করে ঠিকই নিয়েছে। খোপায় কৃত্রিম ফুল,কানে পরা ঝুমকার দুটো পাথর নেই, ঠোঁটের লিপস্টিক ছড়িয়ে আছে, ব্লাউজের কাঁধ ভেদ করে বি বেল্ট বেরিয়ে পড়েছে। সবটাই একদেখায় চোখে ধরা পড়লো।
গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে স্লোলি ড্রাইভ করতে লাগলো সাদ। আপাতত সবটা এইভাবেই থাক। নামার সময় গুছিয়ে দিবে। নয়তো এখনই লজ্জায় সিটিয়ে যাবে।
সাজি বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ লজ্জা লাগছে তার। লজ্জার কারনে জিজ্ঞেস ওবদি করতে পারছে না যে রিমির জন্য কি গিফ্ট নিয়েছে।
সাদ যেন সেই প্রশ্ন শুনতে পেলো। স্টেয়ারিংএ হাত রেখে নিরেট স্বরে বলে উঠলো, রিমির জন্য বড় টেডি বিয়ার, চকলেট নিয়েছি, সাথে মামুনীর পক্ষ থেকে একটা ড্রেস নিয়েছি।
সাদের গলা শুনে সাজি সাদের দিকে তাকালো। সাদ একটা মোবাইল সাজির দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললো, এইটা রাখ। একটা অনুষ্ঠানে যাচ্ছিস ছবি তুলিস।তোরা মেয়েরাতো আবার ছবি উঠানো পছন্দ করিস।
সাজি বোবা চোখে সাদকে দেখছে।হুট করে কেমন গলার স্বর বদলে গেছে। এই বদলটা সাজি ভালো করেই চেনে।
~ মোবাইল আমাকে দিলে আপনি কি নিয়ে যাবেন?যদি অফিস থেকে কল আসে তখন? তখন আমি কি বলবো?
~ কিছুই বলতে হবে না। বলার জন্য ওই মোবাইলে কল আসবে না। কল আসলেও সেটা আমিই দিবো। আমার কাছে আরেকটা মোবাইল আছে , তুই এইটা নিয়ে যা।
~ ঠিক আছে।
~একটা ঝুমকোতে দুইটা পাথর নেই। এইটা পরেছিস কেন?
সাদের এহেন কথায় হকচকিয়ে গেল সাজি। দুইটা পাথর নেই এইটাও খেয়াল করেছে? কই তাকাতে তো দেখলাম না! তাহলে! ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলো সাজি। মিনমিনে গলায় বলল,,
~ এইটাই ছিল রেনুদির কাছে।
সাদ সরু চোখে তাকিয়ে সুধালো,, রেনুদির কাছে মানে? তোর নেই? তুই রেনুর গুলো নিলি কেন?
সাজি দুপাশে মাথা নেড়ে বুঝালো তার কাছে নেই।
সাদ ভ্রু কুঁচকে বললো,, নেই কেন?
সাজি ঠোঁট কামড়ে কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বলল,, আমি কখনো এইসব পরিনি তাই নেই। আজ ফুপ্পি শাড়ি পরিয়ে দিয়েছে। রেনুদি তার ঝুমকো এনে দিয়েছে। দুটো পাথর নেই তো কি হয়েছে! তাও এইগুলো সুন্দর।
সাদ স্পষ্ট বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, কিছুই সুন্দর নয়। তুমি সুন্দর দেখে তোমাকে জড়িয়ে সব সুন্দর প্রনয়িনী!
সাজির কানে ঈষৎ অস্পষ্ট শোনালেও বুঝতে বাকি রইল না সাদের কথা। তবুও মৌন রইলো সে। বুঝতে দিলো না এই শ্রুতিমধুর বাক্য যে তার কর্ণোগোচর হয়েছে। শুধু শেষ বিকেলের রোদ্দুরে চোখ রেখে মুচকি হাসলো সাজি।
গন্তব্যে পৌঁছালো দু’জন। গাড়ি থেকে নামার আগেই থামিয়ে দিলো সাদ। সিটবেল্ট খুলে এগিয়ে গেলো সাজির দিকে।
সাদের এহেন কান্ডে হকচকিয়ে শুকনো ঢোক গিললো সাজি।
সাদ শান্ত চোখে সাজির দিকে তাকিয়ে বললো, একটু চুপ করে বস! এলোমেলো হয়ে এই ভাবে ভেতরে যাবি?আমি ঠিক করে দিচ্ছি।
সাজি শান্ত হতে পারলো না। হৃৎপিণ্ডের অস্বাভাবিক স্পন্দন তাকে শান্ত থাকতে দিচ্ছে না। টেনে শ্বাস নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করলো।
সাদ ট্যিসু দিয়ে আলতো হাতে ছড়িয়ে থাকা লিপস্টিক ঠিক করে দিলো। শাড়ির আঁচল টেনে কাঁধে উঠিয়ে মিনমিনে গলায় বলল, রিমির কাছে গিয়ে শাড়ির আঁচল সরিয়ে ঠিক করে নিস। আপাতত এইভাবেই ভেতরে যা।
সাজি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো।
সাদ গাড়ি থেকে নেমে সাজির পাশের দরজা খুলে দিল। সাজি নেমে দাড়াতেই ঝুঁকে শাড়ির কুচি গুলো ঠিক করে উঠে দাড়ালো সাদ। সাজি স্টেচুর মতো অনূভুতি শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুঝতে পারছেনা যা হচ্ছে তাকি আধেও সত্য! নাকি সবটাই কেবল ভ্রম!
রিমির জন্য আনা গিফ্ট গুলো সাজির হাতে ধরিয়ে দিয়ে গাড়িতে উঠে পড়লো সাদ। জানালার কাঁচ নামিয়ে সাজিকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, ফোন নিজের হাতের কাছে রাখবি,যেন কল দিলেই পাই। আর হ্যা! আমি ঠিক নয়টায় তোকে নিতে আসবো।
দুহাতে জড়িয়ে রাখা টেডির আড়াল থেকে মাথা বের করে বলল, ঠিক আছে।
সাদ মুচকি হাসলো।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটে চললো নিজ গন্তব্যে।
সাদের হাসি সাজির দৃষ্টি এড়ালো না। বরং সেই হাসি দৃষ্টিগোচর হতেই অন্তঃকোনে খানিকটা জায়গা আবারো সাদ ভাই নামক ব্যাক্তিটার জন্য বরাদ্দ করা হলো।
রিমির ঘরে গিয়ে শাড়ির আঁচল সরাতেই একরাশ লজ্জা ঘিরে ধরলো সাজিকে। এতক্ষণে বুঝতে পেরেছে, কেন সাদ ভাই তাকে রিমি ঘরে গিয়েই শাড়ির আঁচল ঠিক করতে বললো। আলগোছে ব্লাউজের আড়ালে বি বেল্ট ঢেকে নিলো। রাগের আড়ালে যত্ন শব্দটা লুকিয়ে রেখেছে ভেবেই ঠোঁট এলিয়ে হাসলো সাজি।
রিমির জন্মদিনে বাইরের কেউ ছিলনা বললেই চলে। রিমির মা-বাবা, ছোট ভাই, বাড়ির মালিকের দুই মেয়ে ,সাজি আর বার্থডে গার্ল রিমি। এই কজন নিয়েই তাদের আয়োজন। চারজন মেয়ে মিলে হইহুল্লোড় করে জন্মদিন সেলিব্রেট করায় ব্যাস্ত। তার চেয়ে বড় কথা সবকটা মিলে ফোনে ছবি তুলে মেমোরি ফুল করা নিয়ে উঠে পড়ে লেগেছে।
এইসবের মধ্যে বিপাকে পড়েছে সাজি। সাদের ফোনে নাকি ছবি সুন্দর আসে তাই শাড়ি পরিহিত রমনী গুলো সেই ফোনের উপর উপচে পড়ছে।
ভাগ্যিস সাজি সবার আগেই নিজের বেশ কয়টা ছবি তুলে নিয়েছিলো। তাই আপাতত তার ছুটি। সে দিব্যি সোফায় বসে বসে রিমির ভাই রিহানের সাথে গল্প করছে।
এই দিকে রিমি দুকদম এগিয়ে চলছে। যখন থেকে শুনেছে এইটা সাদের মোবাইল তখন থেকেই তার মাথার সয়তানি বুদ্ধি গুলো কিলবিল শুরু করে দিয়েছে।
সাজির আশপাশে ঘুরে ঘুরে সাজির কচাকচ ছবি তুলছে। সাজি বেচারি বিনা দোষে ভুক্তোভোগী।
ঘড়ির কাঁটা নয়টায় পৌঁছতেই সাজির হাতে মোবাইল ফোন স্বশব্দে বেজে উঠলো। চমকে উঠলো সাজি, ঘন পল্লব ঝাপটে ফোনের স্ক্রীনে চোখ রাখলো। পিটপিট করে তাকিয়ে শেষের দুই ডিজিট খেয়াল করলো। সাদের নাম্বারের শেষের দুটো ডিজিটও একই তাও দ্বিধা দ্বন্দ্বে ভুগছে সে। নাম্বার মুখাস্ত করায় সাজি বরাবরই মূর্খতার প্রমাণ করে। শেষের দুটো ডিজিট ছাড়া সব তালগোল পাকাতে থাকে।
সাহস করে কল রিসিভ করলো।
অপরপ্রান্তে বসে থাকা ব্যাক্তি সাজির কন্ঠস্বর শোনার জন্য ব্যাকুল প্রায়। সে জানে আজ কতোটা ধৈর্য নিয়ে নয়টা ওবদি অপেক্ষা করেছে। সে পারলে পুরো পৃথিবীর ঘড়ির কাঁটা হাত দিয়ে টেনে নয়টায় এনে থামায়। কিন্তু নিরুপায়!তার না সেই ক্ষমতা আছে,আর না সেই ক্ষমতা হবে কখনো।
সাজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে নরম গলায় সালাম দিলো।
সাদ গভীর নিঃশ্বাস ফেলে সালামের উত্তর দেয়।
~ আমি বাইরে আছি। ধীর পায়ে নিচে নেমে আয়। তড়িঘড়ি করে আসবি না। শাড়ির সঙ্গে পা বেজে পড়ে যাবি। সাবধানে।
সাদের অতিশয় আদুরে গলায় কেঁপে উঠলো সাজি। অদ্ভুত ভালোলাগায় ছেয়ে গেছে চারপাশ। প্রিয় বান্ধবীর সঙ্গ ত্যাগে বিন্দুমাত্র খারাপ লাগলো না। বরং ক্ষনে ক্ষনে পুলোকিত হওয়া মন নিয়ে বিদায় জানিয়ে রওনা দিলো।
শাড়ির কুচি একহাতে সামলে , সামনে পা ফেলে এগোলো।
গাড়ির দরজা খুলে রেখে পাশে দাঁড়িয়ে আছে সাদ। সাজি কাছে আসতেই যত্ন করে বসিয়ে আঁচল গুটিয়ে সাজির হাতে দিলো।
অন্ধকার হওয়াতে সুবিধা হলো সাজির। ল্যাম্পপোষ্টের ঈষৎ আলোতে নির্লজ্জের মতো তাকিয়ে নরম গরম মানুষটাকে মন ভরে দেখছে সে।
শার্টের দুটো বোতাম খুলে রেখেছে সাদ। গুটানো হাতা দুটো উপর নিচ হয়ে আছে। চুলগুলো খানিকটা এলোমেলো হলেও সব মিলিয়ে কাউকে ঘয়েল করার মতো সুন্দর লাগছে।
ড্রাইভিং সিটে বসে আলো জ্বালিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো। তখনও সাজির দৃষ্টি জোড়া সাদ ভাইয়ে আবদ্ধ।
সাদ বাঁকা হেসে স্টেয়ারিং উইল গুরিয়ে বাড়ির পথের উল্টো দিকে নিলো। প্রনয়িনীর মুগ্ধ দৃষ্টিতে সে অবগত। সাদ তো বরাবরই চাইতো এইভাবেই তাকিয়ে তার প্রনয়িনী তাকে দেখুক।
গাড়ি তার গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছে কিনা তা সাজি জানে না। তবে গাড়ি থামলো এক নিস্তব্ধ পরিবেশে। থমথমে পরিবেশ গা ছমছম করার মতো হয়েও, সাজি ভয়ে সিটিয়ে পড়লো না। পড়বেই বা কেন?সাদ ভাই নামক মানুষটা আছে তার পাশেই তো আছে। ভয় পেলো না সাজি না ঘাবড়ালো সে বরং আশেপাশে তাকিয়ে চেনার চেষ্টা করলো। আধেও কি জায়গাটা তার পরিচিত?
ইনশাআল্লাহ চলবে,,,
গল্পের নাম:#দীর্ঘ_রজনী।
লেখনীতে:#সাদিয়া_আফরোজ।
পর্ব:১৭
গাড়ি থামিয়ে নিশ্বঃচুপ হয়ে বসে আছে সাদ। নিরবতা ভাঙ্গার প্রয়োজন মনে করেনি। সে চায় পাশে বসা রমনী নিরবতা ভেঙ্গে কিছু বলুক,প্রশ্ন করুক।
কিন্তু সেই রমনী নিরবতা ভাঙ্গতে নারাজ। সেতো বাইরের অন্ধকারচ্ছন্ন পরিবেশ দেখায় মত্ত।
খানিকটা বিরক্ত হলো সাদ। সিট বেল্ট খুলে ঘুরে বসলো সাজির দিকে। চুড়ি বিহীন শূন্য হাত জোড়া নিজের হাতের আদলে নিতেই কেঁপে উঠলো সাজি। আচম্বিত হয়ে তাকালো সাদের দিকে। সাদের নরম দৃষ্টি আরো বেশি কাঁপিয়ে তুলছে তাকে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সাদ খানিকটা পোক্ত করলো হাতের বাঁধন।
সাজি চোখে সুধালো, কি করছেন?
চোখের ভাষা পড়তে দেরী হলো না। বক্র হেসে মাথা কাত করলো সাদ। অতঃপর ডান হাত উঠিয়ে সাজির খোঁপা খুলে কৃত্রিম ফুল ছুড়ে ফেললো বাইরে। মূহুর্তে চুল গুলো পিঠে ছড়িয়ে পড়লো।
সাদের এমন কাজে থমকে গেলো সাজি। চোখ জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়। জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিলো, কি হলো সাদ ভাই? হঠাৎ করে এতো অপরিচিত লাগছে কেন আপনাকে? কথা গুলো মনে মনে আওড়ালেও মুখ দিয়ে বেরুলো না। কম্পিত ঠোঁট জোড়া দাঁত দিয়ে চেপে ধরে কম্পন থামালো।
সাদ আলতো হাতে সাজির চুল গুলো ঠিক করে দিয়ে মিহি কন্ঠে বলে উঠলো,, শাড়ির সাথে খোলা চুলে সুন্দর লাগে তোকে। চুল বাধবি না,তোর খোলা চুল আমার পছন্দ তাই চুল বাঁধবি না।
সাদের এহেন কথায় একরাশ লজ্জায় নুইয়ে গেলো সাজি। চোখ বুজে মাথা নিচু করলো। সাদ পেছনের সিট থেকে একটা প্যাকেট নিয়ে খুললো। ঝনঝন শব্দে মাথা উঠালো সাজি।
চুড়ির দোকান খুলে বসেছে সাদ । হরেক রংএর কাঁচের চুড়ি। সেই প্যাকেট থেকে বেছে বেছে লাল চুড়ি খুঁজে নিতে ব্যাস্ত সে।
সাজি তা দেখে মিনমিনে গলায় বলল,, এতো চুড়ি কার সাদ ভাই?কিই বা খুঁজছেন এতো?
সাদ অতি মনোযোগী হয়ে বিরক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,, সব আমার প্রনয়িনীর। তার জন্যই লাল চুড়ি খুঁজছি।
সাজি অবুঝের মতো চুড়ির প্যাকেট হাতে নিয়ে বলল,, দিন আমি খুঁজে দিচ্ছি।
সাদ ঠোঁট কামড়ে হাসলো। মেয়েটা সবটা না বুঝেই করছে। বুঝলে হয়তো লজ্জায় নুইয়ে পড়বে। সাদ রহস্য করে বললো,,
~ সত্যি খুঁজে দিবি?
সাজি হাত থেমে গেল। টনক নড়লো সাদের কথায়। বারকয়েক সাদের বলা কথাটা মনে মনে আওড়ালো। এইখানে আসা ওবদি যা যা ঘটলো সবটা পুনরায় চিন্তা করলো। সাজি সবটা বুঝতে পেরে ভীরু চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে বলল,, প্রনয়ীনি?
সিটে মাথা এলিয়ে সাজির একহাত টেনে বুকের বাঁ পাশে চেপে ধরলো সাদ। ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত গলায় বলে উঠলো,, হুম! এইখানটায় থাকে সে। অনেক বছর হলো জেঁকে বসেছে।বড্ডো অবুঝ ওই মেয়ে।
থমকালো সাজি,কিঞ্চিত আবাক হলো। সাদের চেপে ধরা হাতের দিকে তাকিয়ে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। ঘোর লাগা চোখে চাইলো। না হাত সরালো, না চোখ সরালো। বরং বিনা দ্বিধায় জিজ্ঞেস করলো,, এখন কোথায় সে?
সাদ সাজির চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে বলল,, ঠিক আমার চোখে সামনে , হৃৎপিণ্ডের খুব কাছে। দেখবি তুই তাকে?
সাজি তৎক্ষণাৎ হাত সরিয়ে মাথা নাড়ালো। সাদ বাঁকা হেসে দু মুঠো লাল চুড়ি সাজির হাতে পরিয়ে দিতে দিতে বললো,, তোর নজর লাগবে সাজি। তোর মতো চঞ্চল মেয়ের নজর লাগবে। আমার প্রনয়ীনি যে বড্ডো সরল ,বড্ডো ভীতু।তোর নজর লাগবে।
সাজি মুচকি হেসে মাথা নোয়ালো। বুকের ভেতর কালবৈশাখী ঝ*ড় উঠেছে অনূভুতির ঝড়।সবটাই সাদকে ঘিরে।সাজি জানে সাদের প্রনয়িনী কে। তাও মুখে শোনার লো*ভ সামলানো মুশকিল।সাজি অতোটাও বোকা নয় যে এতো কিছুর পরেও বুঝবে না। বরং জেনে বুঝেও বোকার মতো রইলো। মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করলো। এতো সকাল ধরা দিবেনা তাকে। আরেকটু পোড়াবে।
সাজি রাগ, ভয় উপেক্ষা করে লজ্জায় আড়ষ্ট হলো। আর সাজির এই লাজুক চেহারাই সাদের কাছে উত্তর স্বরূপ। উত্তরের অপেক্ষা রইলো না তার। ক্ষীন ইচ্ছে থাকলেও সাদ জানে এই রমনী তাকে সেই উত্তর এতো সহজে দিবে না। এই রমনী তাকে জ্বা*লিয়ে পু*ড়িয়ে শে*ষ করে তবেই উত্তর দিবে।
সাদ গাড়ি থেকে নেমে পড়লো। সাজির পাশের দরজা খুলে হাত ধরে নামালো। ঈষৎ আলো আর ঝিরঝির বাতাস সব মিলিয়ে এই পরিবেশ অনূভুতি ব্যাক্ত করার জন্য উপযুক্ত। সাজি দুজনের হাতের বাঁধনের দিকে তাকালো। সাদ বক্র হেসে বলল,, মিলিটারি ক্যাম্পে এইভাবে হাঁটা যায় না সাজবাতি। সেই হিসেবে আমি মিলিটারি ক্যাম্প থেকে ভালোই।
চমকে উঠলো সাজি। তার যতটুকু মনে পড়ে এইকথা শুধু তার বাবাকেই বলেছিলো। তাহলে সাদ ভাই শুনলো কি করে?বাবা বলে দেয়নি তো? ঘা*বড়ে গেল সাজি। আড়চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিবে তার আগেই সাদ রসিকতা করে বললো, তুই চাইলে সত্যি সত্যি তোকে মিলিটারি ক্যাম্পে রেখে আসতে পারি।
~আমি কখন বললাম এইসব?
~তুই বলিসনি। হয়তো আমি ভুল শুনেছি।
~শুনতেই পারেন।
সাদ সাজির হাত সামনে এনে কোমলমতি গলায় বলল,, প্রসঙ্গ যেখানে সাজি,সাদ সেখানে ভুল শুনতেই পারে না।
সাজি মুচকি হেসে সাদের হাত ধরে সামনে পা বাড়ায় । তার সাথে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি হানা দেয়। সাজি মুচকি হেসে মিনমিনে গলায় বলল,,ভালোবাসেন সাদ ভাই?
সাদের পা থেমে গেল। সন্দিহান হয়ে সাজির দিকে তাকালো। সাজির দুষ্টু হাসি উপলদ্ধী করতেই জবাব দিলো,, উঁহু বাসি না।
~ তাহলে সেই দিন গাড়ির ভেতরে ঘুমের ঘোরে বললেন কেন?
সাজির কথায় ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বললো,, মানে! কি বলেছি?
সাজি আড় চোখে সাদের দিকে তাকিয়ে বলল,, ভালোবাসি সাজবাতি। বড্ড বেশি ভালোবাসি।
সাদের চোখ জোড়া কোটর থেকে বেরিয়ে আসার জোগাড়। কপালে সুক্ষ্ম ভাজ ফেলে বললো,, সত্যি?
সাজি সাদের হাত ছাড়িয়ে শাড়ির আঁচল ধরে দ্রুত পা ফেলে এগিয়ে যেতে যেতে বলে উঠলো,, এই সাজি মিথ্যা বলেনা সাদ ভাই। আপনি আরো আগেই ধরা পড়েছেন। বিশ্বাস না হলে আপনার পিএ কে জিজ্ঞেস করুন।
পিএর কথা বলতেই মনে পড়লো, ওইদিনের পর থেকে রায়হান তাকে দেখলেই মিটমিট করে হাসে। সেই হাসির কারন এতো দিন না বুঝলেও এখন ঠিকই বুঝতে পারছে।
সাদ মাথা নিচু করে ঠোঁট কামড়ে হাসলো। তার মানে সে অনেক আগেই বলে দিয়েছে?তার সাজবাতি অনেক আগেই জেনে বসে আছে! তাহলে এতো দিন জিজ্ঞেস করলো না কে? আফসোস হচ্ছে খুব এই ভেবে,এতো বছরের ভালোবাসা ঘুমের ঘোরে প্রকাশ পেলো?
সাদ দৌড়ে পেছন থেকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে থুতনি ঠেকালো।সাজি চোখ বন্ধ করে ঠোঁট প্রসস্ত করে হাসলো। সাদ ফিসফিস করে বলে উঠলো,, ভালোবাসিস সাজবাতি? একবার বেসে দেখ। এই সাদ তোকে ঠকাবে না।
সাজি কয়েক সেকেন্ড চুপ করে থেকে পেছনে ঘুরলো। সাদের হাত ধরে গাড়ির দিকে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো, ছিঃ সাদ ভাই এইসব কোন ধরনের কথা। আমি কেন এইসব করতে যাবো? তওবা তওবা।মা শুনলে মা*রবে।
সাদ ঠোঁট টিপে হেসে বলল,, ওকে দ্যান ফাইন। বিয়ের পর বাসিস। আপাতত আমি ছাড়া কারো দিকে না তাকলেই চলবে।
সাজি গাড়িতে বসলো। সিট বেল্ট বেঁধে বিড়বিড় করে বলে উঠলো,, বুঝ হওয়ার পর থেকে কারো দিকে তাকাতে দিয়েছেন! যে এখন এতো কিছুর পর দিবেন। ঘাড় ত্যাড়া।ভালোবাসবো না ছাই।আগে সব ধমকের বদলা নিবো। চোখের সামনে কোনো ছেলে পড়লে দুই এক মিনিটের প্রেম সেরে ফেলবো।
সাদ গাড়ি স্টার্ট করে নিরেট স্বরে বলে উঠলো ,, ভালোবাসা অন্ধ হয়। আমার আবার অন্ধ বউ নিয়ে সংসার করতে কোনো অসুবিধা নেই। এমন চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেল। নয়তো চো*খ দুটো খু*লে ফ্রিজে রেখে দিবো।
ইনশাআল্লাহ চলবে,,