দুখীফুল পর্ব-২৩+২৪

0
415

#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২৩

টিফিনের সময় নাফিস ফুলের সাথেই টিফিন করতে এলো। আজ নাফিসও টিফিন নিয়ে এসেছে। রুটি আর ডাল ভাজি। স্কুলে থাকতে ফুলের সাথে সবসময়ই ভাগাভাগি করে খেতো। আরিফা, ফুল ও নাফিস একসাথে টিফিন খেতে বসলো। তিনজন ভাগাভাগি করে খাচ্ছে। ফুলের হাতের রান্না করা বিরিয়ানি খেয়ে আরিফার চোখ বন্ধ হয়ে এসেছে। সে ফুলের দিকে হেলে পড়ে যেতে যেতে বলল,” দোস্ত, কি রাঁধলি! আমার তো খেয়ে ঘুমিয়ে যেতে ইচ্ছে করছে।”

ফুল হেসে আরিফাকে ধাক্কা দিয়ে উঠালো। নাফিস বাঁকা চোখে আরিফার কাণ্ড দেখে বিড়বিড় করল,” নাটকবাজ, মেয়ে।”

আরিফা নাফিসের আনা টিফিন মুখে নিতে নিতে বলল,” আমি মিষ্টি এনেছি কিন্তু কাউকে দিব না।”

নাফিস বুঝলো তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলা হয়েছে। সে গম্ভীরমুখে উত্তর দিল, ” পঁচা মিষ্টি এমনিতেও পেটে হজম হয় না।”

আরিফা মুখ ফুলিয়ে রাখলো। নাফিসের আনা টিফিন অর্ধেক খেয়ে রেখে দিল। ফুল দুজনের খুনসুটি দেখে মজা পেল। সে আরিফার থেকে মিষ্টি নিয়ে অর্ধেক কামড় বসাতেই সেখানে শুভ এসে উপস্থিত হলো। তার হাতেও বিরিয়ানির বক্স। ফুলের হাত থেকে বাকী অর্ধেক মিষ্টি টুপ করে মুখে নিয়ে আশেপাশে তাকিয়ে বলল,” কেউ দেখেনি তো!”

আরিফা হা করে তাকিয়ে দেখলো। শুভ দাঁত বের করে হেসে আরিফার উদ্দেশে বলল,” মুখ তো বন্ধ করো, খালাম্মা!”

আরিফা মুখ বন্ধ করলেও ঠোঁট নাড়ালো,”এটা কি হলো?”
শুভ উত্তর দিল, ” টিফিন শেয়ার করা হলো। নাও আমার থেকে এক চামচ বিরিয়ানি খেয়ে দেখো তো, কেমন হয়েছে? ”

ফুল, শুভর পেটে গুঁতা দিয়ে ইশারায় না করল। শুভ শুনলে তো! আরিফাকে জোর করে এক চামচ বিরিয়ানি খেতে বাধ্য করল। আরিফা দুই তিনবার চিবিয়ে চোখ বড়ো করে তাকাল। নাফিসের হাত থেকে ফুলের টিফিন কেড়ে নিয়ে সেখান থেকে আরেক চামচ খেল।দুইটার স্বাদ একই মনে হচ্ছে।আরিফা ফুলের দিকে ফিরে বলল,” তুই এই ব্রিলিয়ান্ট ছেলের টিফিন চুরি করেছিস? নাকি সে তোরটা?”

ফুল কাচুমাচু হয়ে বসলো। সে জানে, আজ তার রক্ষা নাই। শুভও তাল মেলালো, ” হ্যাঁ, ফুল বলো বলো!”
ফুল অসহায়ের চোখে নাফিসের দিকে তাকাল। নাফিস বলল, ” এক বাড়িতে থাকলে তো একই খাবার নিয়ে আসবে, তাই না?”
” মানে? ফুল তো শ্বশুর বাড়ি থাকে।”

আরিফার বিহ্বল চেহারা দেখে শুভ মজা নিচ্ছে। নাফিসের দিকে তাকিয়ে আসে আসল কথা শোনার আশায়। নাফিস এইটুকু বলে থেমে গেল।সে ভেবেছিল, ফুল অথবা শুভ হয়তো নিজেদের কথা জানাবে। কিন্তু সে হতাশ হলো। কারণ, ফুল লজ্জায় কিছু বলবে না আর শুভ হলো আস্তো বজ্জাত ছেলে। সে নাফিসের মুখ থেকে শোনার জন্যই এতো কাহিনী ঘটিয়েছে।
আরিফার প্রশ্নবিদ্ধ চাহনি দেখে নাফিসের ইচ্ছে করল দুইটা ঘা বসিয়ে দিতে। মেয়েটা এতো বোকা কেনো? নাফিস, শুভর দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলতে শুরু করল,” ফুলের স্বামীর নাম আরিব মাহমুদ শুভ।”

” অহ শুভ, সুন্দর নাম। কি?”

আরিফার মুখাবয়ব দেখে শুভর সাবধানে ফুলের হত মুষ্টিবদ্ধ করে বেঞ্চের উপর রেখে বলল,” আমার বউ।”

নাফিস মুখ বাঁকা করে ভেঙাল। বিড়বিড় করে শুভর কথা রিপিট করলো,” উহ,আমার বউ!”

শুভ ফুলের বিরিয়ানির বক্স নিয়ে নিজেরটা ফুলের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে খেতে লাগল। নাফিসের কী যেনো হলো, সে নিজের টিফিনবাক্স থেকে আরিফার অর্ধেক খাওয়া রুটিতে কামড় বসালো। এদিকে আরিফা চিৎকার করছে, ” আরে ঐটা আমার এঁটো! ”

নাফিস মুখে খাবার রেখে বল,” আমি খেয়ে ফেলেছি। এখন কী পেট থেকে বের করে দিব?”

আরিফা চুপসে গেলো। তবে ফুলের বরের পরিচয় জানার পর থেকে একাকী ফুলের সাথে কথা বলার জন্য ছটফট করতে থাকলো।
এদিকে শুভ নাফিসের হিংসাত্মক মনোভাব দেখে মজা পেলো। নাফিসের কাঁধে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল,” হবে নাকি বন্ধু! ছুটির পর এক টান!”

নাফিস ছি মার্কা চোখে তাকিয়ে শুভর পেটে গুঁতা দিয়ে বেঞ্চ থেকে উঠে গেলো।

—————–

শীতের কোনো এক ছুটির দিনে শুভ, ফুলের জন্য চমৎকার কিছু আয়োজন করল। সাগরিকার সাহায্যে পুরো ছাদ মোমবাতি দিয়ে সাজালো। ফুলের প্রিয় ফুল ছাঁদে বিছিয়ে দিল। ফুলের পছন্দ অপছন্দ মাথায় রেখে ত্রুটিহীনভাবে সমস্ত কাজ করতে চেষ্টা করল। সাগরিকা দেবরের অস্থিরতা দেখে হাসল। পিঠে চাপড় দিয়ে বলল,” ফুলের খুব পছন্দ হবে।”

শুভ তবুও ঘামে। কি থেকে কি করবে ভাবতে ভাবতেই সময় ফুরায়। সাগরিকা শুভকে ছাদে রেখে ফুলকে খবর দিতে চলে যেতে নিল। শুভ ভাবিকে থামায়। ছাদের কোণায় লুকিয়ে রাখা প্যাকেট বের করে হাতে দিয়ে বলে,” তৈরি হয়ে নাও, ভাবী। ভাইয়া নিচে অপেক্ষা করছে।”

সাগরিকা মুখে হাত দিয়ে দাড়িয়ে যায়। দুই ভাই মস্তো বড়ো সেয়ানা। একজন বউকে চমকে দেয়ার জন্য সাহায্য চায় তো অপরজন তাকে চমকে দিতে দাড়িয়ে রয়। সাগরিকা শুভর মাথায় হাত রেখে দোয়া করে চলে গেল।

ফুলকে সাগরিকা সাদা রঙের গাউন পরিয়েছে। শুভ নিজে পছন্দ করে কিনেছে। সাগরিকা আগেই মিথ্যা বলে ফুলকে তৈরি হতে বলেছিল। ছাদ থেকে সাগরিকা নেমে ফুলের ঘরে গেল। চোখের সামনে সাদাফুলকে দেখে মাশাআল্লাহ বলল। ফুল লজ্জায় নত হয়ে বলল,” তুমি তৈরি হলে না?”

” এই তো যাচ্ছি। তোমার জন্য ডাকপিয়ন সেজে এসেছি। নাও তোমার চিঠি।”

ফুল অবাকের সাথে খুশি হলো। বেশি চিন্তা না করে চিঠি খুলে পড়া শুরু করল,

প্রিয় শুভর সুখীফুল,

তুমি কী জানো, তুমি আস্তো একটা মনভোলা। আজকের দিনটা কীভাবে ভুলে গেলে? এই বিশেষ দিনে তো উচিত ছিল, গুনে গুনে আমাকে চুমু খাওয়ার কিন্তু!

তুমি হয়তো মনে করতে চেষ্টা করছো আজকের বিশেষ দিনের কথাটা। উহ, মস্তিষ্কে এতো চাপ দিতে হবে না। আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি ফুল! আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। ঠিক একবছর আগে, রাতের আঁধারে তিনবার কবুল বলার মাধ্যমে তোমাকে নিজের করে নিয়েছিলাম।

জানি, সেদিনের ঘটনাটা তোমার জন্য কষ্টকর ছিল কিন্তু আজ প্রমিজ করছি; আজকের রাতটা তোমার সুখের রাতগুলোর মধ্যে একটি রাত হবে।

ফুল বউ, ছাঁদে অপেক্ষা করছি। জলদি এসো।

ইতি
তোমার শুভ

ফুলের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। সময় অপচয় না করে ছাদের দিকে ছুটলো।

ফুলের ইচ্ছেগুলোর মধ্যে একটি ইচ্ছে ছিল, শুভর সাথে ছাদে বসে রাত জেগে গল্প করা। শুভ ফুলের ইচ্ছের কথা ভুলেনি। এই দিনটার জন্যই অপেক্ষা করছিল। এদিকে ফুল, ছাদের কাছাকাছি আসতেই শিউলিফুলের ঘ্রাণ পেল। ধীরপায়ে এগিয়ে এসে দরজা খুলে অবাক হয়ে গেল। সারা ছাদ মোমবাতি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে শুভ। জমিনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে হাজারো শিউলি ফুল। ফুল গাউন উচু করে হেঁটে সামনে আগালো। আশেপাশে শুভ নামক শান্তিকে খুঁজতে থাকলো। শুভকে পেলো ছাদের শেষ কোণায়। ফুল কাছাকাছি আসতেই শুভ ফিরে তাকালো।

ফুলকে দেখে শুভ এতোটাই আবেগপ্রবণ হয়ে গেলো যে, তার চোখে পানি চলে আসলো। ফুল, শুভকে জড়িয়ে ধরল। সে জানে ঐ চোখের পানির কারণ ফুল। একজন মানুষ কতোটা ভালোবাসলে চোখে পানি আসে। ফুলকে খুব শক্তকরে জড়িয়ে রেখেছে শুভ। পাঁজা কোলে তুলে ফুলকে নিয়ে দোলনায় বসলো। ফুল তখনো শুভর বুকে মুখ গুঁজে রেখেছে। শুভ মুখ খুলল,” জামা পছন্দ হয়েছে?”

ফুল মাথা না বোধক ইশারা করল। শুভ দুষ্ট হেসে বলল,” তবে খুলে দাও!”

ফুল শুভর বুকপকেটে কামড় বসিয়ে দিল। শুভ আহ করে আর্তচিৎকার করে বলল,” রাক্ষসী, বউ।”

ফুল জায়গাটায় ঠোঁট ছুঁয়ে দিল। শুভ ফুলকে বসিয়ে চোখে চোখ রেখে বলল,” কিছু মনে পড়ে?”

” কি মনে পড়বে?”
” আমাদের বিয়ের!

ফুল, শুভর ঠোঁটে হাত রেখে বলল,” ঐদিনের কথা মনে করো না, শুভ!”

শুভ কাতর গলায় বলল,” আমি সেদিন,,,

” আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, শুভ। যদি জানতাম, একরাতের যন্ত্রণা পাওয়ার পরের জীবনটা অন্যরকম হবে তবে সে রাতের জন্য কখনো আফসোস করতাম না। তুমি আমার পাশে আছো কাছে আছো। তোমাকে ছুঁয়ে দিতে পারছি; এটাই অনেক।”

শুভ হাসলো। ফুলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লো। ফুলের পেটের দিকে ফিরে মুখ গুঁজে বলল,” স্বামীর সেবা করো তো!”
ফুল মাথায় হাত বুলাতে থাকলো। দীর্ঘসময় অতিবাহিত হওয়ার পর শুভ চট করে উঠে বসলো। ফুলের চোখে চোখ রেখে বলল,” আজ একটা পঁচা আবদার করব।”

ফুল ভ্রু নাচিয়ে বলল, কী?”

শুভ জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,” তোমাকে আজ নিজের করে পেতে চাই।”

ফুল দুই হাতে মুখ ঢাকলো। সরাসরি লজ্জায় ফেলা শুভর কাজ। সে হুটহাট এমন কথা বলে যা ফুলের জন্য লজ্জাজনক। শুভ আর অপেক্ষা করল না। ফুলের ঠোঁট জোড়ায় অধিকার চালাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

দীর্ঘ এক বছর পর। হ্যাঁ, একবছর পর ফুলের বাবু বরের মনে হলো, তার বউটা বড়ো হয়ছে। সাথে সেও। প্রথমবারের মতো ফুলের কাছাকাছি আসার কথা ভাবতেই শরীরে শিহরণ বয়ে গেলো। ফুলকে কোলে তুলে পর পর শব্দ করে ঠোঁটে কয়েকটা চুমু খেল। ছাঁদের বাতি বন্ধ করে নিজের ঘরের দিকে আগালে।

ফুল, আগেও শুভর ঘরে এসেছে কিন্তু আজকের আসাটা একদম অন্যরকম। শুভ, ফুলকে বিছানায় শুয়ে দিয়ে সারাঘর পায়চারি করতে থাকলো। ফুলের দিকে এগিয়েও শুঁকনো ঢোক গিলে দূরে সরে গেলো। ফুলের কাছে আসতেই ভবিষ্যতের কথা ভাবনায় আসে আর দূরে সরে গেলে নিজের পিপাসী মনের কথা।

পরিশেষে মনের সাথে যুদ্ধ করে শুভ হেরে গেলো। ঘরের বাতি নিভিয়ে ফুলের কাছাকাছি আসলো। এতোটা কাছাকাছি, যেখান থেকে ফুলের নিঃশ্বাস অনুভব করা যায়। শুভ ফিসফিস করে ফুলের কানের কাছে এসে বলল,” আমরা কী বড়ো হয়ে গেছি, ফুলবউ?”

চলবে……..

#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২৪

দীর্ঘ ভালোবাসাময় রজনীর পর নতুন দিনের আগমন ঘটলো ধরণীতে। সূর্যের আলো চোখে পড়তেই শুভর ঘুম ভেঙে গেল। আড়মোড়া ভেঙে পাশে ফুলকে দেখে মুচকি হাসলো। ফুল গুটিসুটি মেরে ঘুমাচ্ছে। ঘুমন্ত ফুলের দিকে কিছুক্ষণ অপলকভাবে তাকিয়ে দেখল। পরমুহূর্তে মনের কোণে দুষ্ট ভাবনা বাসা বাঁধলো। এগিয়ে এসে তার ফুলবউয়ের কপালে ঠোঁট ছোঁয়াল। শুভর মনে হলো, উত্তপ্ত আগুনে ঠোঁট ছুঁয়ে দিয়েছে সে। তৎক্ষনাৎ সরে আসলো। শোয়া থেকে একদম বসে পড়লো। ফুলের কপালে ও গলার নিচে হাত রেখে চমকে গেল। জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে মেয়েটা। শুভ গালে হাত রেখে দুইবার ফুল বলে ডাকল। ফুল সাড়া দিল না শুধু গুঙিয়ে উঠলো। শুভ পুনরায় ডাকল,” এই ফুল, শুভ্রফুল! কথা বলো! আ’ম সরি বউ। আর কখনো! উফ।”

শুভ উঠে বাথরুমে চলে গেল। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে বের হলো। তার মাথা কাজ করছে না। কাকে ডাকবে, কী বলবে বুঝতে পারছে না। একবার মনে হল, মাকে ডেকে আনবে পরমুহূর্তে ভাবলো, ফুলের অসুস্থতা দেখে হাজারো প্রশ্ন করবে। তখন শুভ লজ্জায় উত্তর দিতে পারবে না। ফুলকে ভালোভাবে শুইয়ে দিয়ে শুভ সাগরিকাকে খুঁজতে চলে গেল। সকালের নাস্তা তৈরি করে সাগরিকা মাত্রই উপরে উঠছিল। শুভকে বিচলিত হতে দেখে জিজ্ঞেস করল,” কী হয়েছে, শুভ? তোমার এই অবস্থা কেনো?”

শুভ খেয়াল করল, ফুলের চিন্তায় সে খালি গায়েই বের হয়ে চলে এসেছে। যা সে কখনোই করে না। শুভ নিজের দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে বলতে শুরু করল,” ফুল!”

সাগরিকাও ভয় পেল,” কি হয়েছে ফুলের? ও ঠিক আছে তো?”

” ফুলের অনেক জ্বর,ভাবী।”

সাগরিকা ফুস করে নিঃশ্বাস ফেলল। সে ভেবেছিল ফুলের খারাপ কিছু হয়েছে হয়তো। সাগরিকা শুভর মাথায় দুটো ঘা বসিয়ে ফুলের ঘরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। শুভ পিছন থেকে ভাবীকে ডাকল,” ভাবী, ফুল আমার ঘরে।”

শুভর কণ্ঠে অপরাধবোধ স্পষ্ট। সাগরিকা কপালে হাত রেখে শুভর ঘরে গেল। ফুলকের কপালে হাত রেখে বুঝলো অনেক জ্বর। শরীর পুড়ে যাচ্ছে। সাগরিকার পিছনেই শুভ চিন্তিত হয়ে দাড়িয়ে আছে। সে উদ্বিগ্ন সুরে জিজ্ঞেস করল,” কি হয়েছে ভাবী? জ্বর তো অনেক। ও কথা বলছে না কেনো? ফুল ঠিক আছে তো?”

সাগরিকা বিরক্ত সুরে উত্তর দিল,” সামান্য জ্বর এসেছে। গতকাল রতেও ঠিক ছিল। হঠাৎ কীভাবে! ”

কথা বলতে বলতে সাগরিকার চারপাশে নজর ঘুরিয়ে যা বুঝার বুঝে গেলো। শুভর উদ্দেশে বলল,” চিন্তা করো না। মাথায় পানি ঢালতে হবে। ওর গা মুছে দিতে হবে। তুমি পারবে? নাকি আমি করে দিব?”

শুভ মিনমিন সুরে বলল,” আমিও বুঝে ফেলেছি, ভাবী! আমি আর ফুলকে ছুঁয়েও দেখব না।”

সাগরিকা ততক্ষণে বাথরুম থেকে বালতি করে পানি নিয়ে এসেছে। নিজেই ফুলের মাথায় পানি ঢালতে শুরু করল। শুভকে বোকার মতো দাড়িয়ে থাকতে দেখে ধমক দিল,” দাড়িয়ে আছো কেনো? কলেজে যাবে না? মায়ের প্রশ্নের মুখে পড়তে না চাইলে তৈরি হয়ে কলেজে যাও। আর একটাও কথা না। আমি ফুলকে দেখে রাখবো।”

শুভ গেল না। মন সায় দিচ্ছে না। তার ফুল বউ কতো কষ্ট পাচ্ছে ভেবেই বুকে ব্যথা করছে। শুভ একরাশ মন খারাপ নিয়ে তৈরি হয়ে নিল।

মাথায় পানি ঢালার কিছুক্ষণ পর ফুল নড়েচড়ে উঠলো। সাগরিকা ফুলের গা মুছে দিয়ে নিচে নামলো। শুভকে দেখল না খেয়েই বের হয়ে গেছে। গাড়িও সাথে নিল না। আদিল জিজ্ঞেস করলে সাগরিকা চতুরতার সাথে কে’টে গেল। কী দরকার, অন্যের পার্সোনাল বিষয় নিয়ে আলোচনা করার! সাগরিকা শাশুড়িকে খাবার বেড়ে দিয়ে উপরে চলে গেল। ফুলকে গরম দুধ খাইয়ে দিয়ে ঔষধ খাওয়াল। সাগরিকা ততক্ষণ ফুলের পাশে বসে থাকলো যতক্ষণ না ফুলের শরীরের তাপ কমলো।

———-

এদিকে শুভ কলেজে এসে মনমরা হয়ে বসে রইলো। তার সামনেই বই খোলা কিন্তু মনোযোগ নেই। ক্লাস শুরু হতে পনেরো মিনিট বাকী আছে। একে একে সকল শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষে প্রবেশ করছে। নাফিসও আসলো। শুভকে একা বসে থাকতে দেখে ভ্রু যুগল কুঁচকে নিলো। সারা কক্ষে নজর ঘুরিয়ে ফুলকে দেখতে না পেয়ে ভাবলো হয়তো বাহিরে আছে। ক্লাস শুরু হওয়ার সময় আরিফাকে একা বসে থাকলে দেখে কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়লো।

নাফিস কখনো আগ বাড়িয়ে শুভর সাথে কথা বলতে যায় না। দেখা যায়, শুভই সময়ে অসময়ে নাফিসকে এসে জ্বালাতন করে। এটা সেটা বলে নাফিসের মাথা গরম করে ফেলে। অথচ আজ! আজ শুভ এক জায়গায়ই বসে আছে। নাফিসের মনে সন্দেহ জন্মাল। টিফিনের সময় যখন সকল শিক্ষার্থী শ্রেণীকক্ষ থেকে বের হয়ে গেল। আরিফা ও নাফিস তখন শুভর কাছে আসলো। শুভ বেঞ্চিতে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। অপরাধবোধ কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে শুভকে। ফুলের খবর নেওয়ার মতো মুখ নেই শুভর কাছে। তার মনে হচ্ছে, গতকাল ফুলের কাছাকাছি আসার জন্যই জ্বর এসেছে।

নাফিস শুভর পাশে বসে ডাকল,” ফুল ঠিল আছে তো, শুভ?”

শুভ মাথা তুলে তাকালো। তার চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে। আরিফা প্রশ্ন করল,” ফুল তো কখনোই কলেজ বন্ধ দেয় না। আজ কি হলো?”

শুভর মনে হলো সে বিশ্বস্ত কাউকে পাশে পেয়েছে। এক্ষুণি মনের সকল কথা সেই মানুষটাকে বলে মন হালকা করা যাবে। শুভ হঠাৎই নাফিসকে জড়িয়ে ধরলো। জড়িয়ে ধরেও ক্ষান্ত হয়নি। মেয়েদের মতো নাক টেনে কান্না করতে শুরু করল। নাফিস অবাক হলো। মুখে রা নেই তার। সে ভাবতে পারেনি শুভ তাকে! আরিফা মুখে হাত রেখে দাড়িয়ে দেখতে লাগলো।

নাফিসের মনে এবার সত্যি সত্যি ভয় ঢুকলো। সে শুভর পিঠে আলতোভাবে চাপড় দিয়ে বলল,” ঠিক আছে, ঠিক আছে। মেয়েদের মত কান্না না করে কি হয়েছে বলো।”

শুভ নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ সময় নিল। নাফিসকে ছেড়ে চোখ মুছে বলল,” আমার ফুলকে আমি কষ্ট দিয়েছি, নাফিস। ও আমার জন্য জ্বরে কাতরাচ্ছে।”

কথাটা বলে মুখে হাত দিয়ে আবারো হু হু করে কেঁদে উঠলো শুভ। নাফিস ভেবেছিল, শুভর পাগলামো লোক দেখানো। নাফিসকে জ্বালাতেই হয়তো ফুলের সাথে ঘেঁষে বসে আর নয়তো কেয়ার করে। অথচ নাফিসের ধারণা একদম ভুল প্রমাণিত হলো। শুভর চোখের পানি বলে দিচ্ছে সে ফুলের জন্য কতোটা পাগল। ছেলেদের নাকি কাঁদতে নেই। কোনো ছেলের চোখে যদি পানি আছে আর সেই পানির প্রতিটা ফোঁটা যদি কোনো মেয়ের জন্য হয়ে থাকে। তবে সেই মেয়ে ভাগ্যবতী।

নাফিস, শুভকে স্বান্তনা দিয়ে বলতে শুরু করল,” সামান্য জ্বরই তো। ঠিক হয়ে যাবে। কান্না থামাও।”
” ওর কষ্ট হচ্ছে ভাবতেই আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আমি ম’রে যাচ্ছি,নাফিস। আমার ফুল!”

শুভ থামলো না। আরিফা আনমনে বলল,” ফুল, কতো ভাগ্যবতী। তার জন্য কেউ একজন আছে চোখের পানি ফেলার জন্য।”

শেষের কথাটা শুনে নাফিস আরিফার দিকে তাকালো। মেয়েটা আজকাল কেমন চুপচাপ হয়ে থাকে। হয়তো নাফিসের অবহেলা সহ্য করতে পারছে না। নাফিস ভাবল, নিজেকে আরেকবার সুযোগ দিবে। মনটাকে জোর দিবে কাউকে ভালোবাসার জন্য। হয়তো এই মেয়েটাকে তার জন্য তৈরী করা হয়েছে।

ছুটির পর নাফিস শুভকে নিয়ে দোকানে গেল। শুভর মন ভাল করার আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকলো। শুভ টু শব্দ পর্যন্ত করল না। এমনকি বাড়ি যাওয়ার জন্য তাড়া দেখাল না। নাফিস নিজেই শুভকে নিয়ে শুভর বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হলো।

রিকশা থেকে যখন নাফিস নামলো তখন বিকাল পাঁচটা বাজতে চলল। শুভ নত মাথায় নাফিসকে নিয়ে বাড়িতে ঢুকলো। সাগরিকা তখন বাটিতে করে ফুলের জন্য স্যুপ নিয়ে যাচ্ছিল। শুভর পাশে অপরিচিত ছেলেকে দেখে থেমে গেল। নাফিসের পরিচয় শুভ দিল। সে ফুলের ছোটবেলার বন্ধু। সাগরিকা হেসে কথা বলতে শুরু করল,” ভালো হয়েছে এসেছো। ফুল উপরে আছে। জ্বর কমেছে কিন্তু শরীর দুর্বল। তুমি বসো, আমি ওকে ডেকে দিচ্ছি। ”

নাফিস সাগরিকাকে নিষেধ করে বলল,” ডাকতে হবে না। ও রেস্ট নিক। আমি বরং এবার উঠি। দেরী হলে মা চিন্তা করবে।”

” না না, খালিমুখে এক পাও আগাতে পারবে না। শুভ, তোমার বন্ধুকে নিয়ে হাতমুখ ধুয়ে বসো। আমি খাবার দিচ্ছি।”

শুভর মা তখন ঘর থেকে বের হয়ে আসলেন। এসেই ছেলের পিঠে দুটো ঘা বসিয়ে বলতে শুরু করলেন,” কে বলেছিল, মেয়েটাকে আইসক্রিম খাওয়াতে? জানিসই, মেয়েটার এসবে অভ্যাস নেই। এবার জ্বর আসলো তো। ইশ জ্বরের ঘোরে শুধু মা মা বলে ডাকছে।”

শুভ অবাক হয়ে গেলো। গতকাল রাতে তো! ভাবনার আংশিক কথা আসতেই সাগরিকার দিকে চোখ গেল। সাগরিকা চোখের ইশারায় বুঝালো। তার শাশুড়ি মাকে সেই মিথ্যা বলেছে। শুভ মায়ের মা’র হজম করে চুপ করে থাকলো। সাগরিকার হাত থেকে স্যুপের বাটি নিয়ে বলল,” আমাকে দে। আমি খাইয়ে দিয়ে আসি। এই সুযোগে মাথায় তেল দিয়ে দেই। তুই ওদের খাবার দে।”

নাফিস চুপচাপ শুভর পরিবারের সদস্যদের দেখল। সে বুঝতে পারল, ফুল এখানে সুখে আছে। শুভর পরিবারের প্রত্যেকটি সদস্য ফুলকে ভালেবাসে। সাগরিকা, নাফিসকে খাইয়ে তবেই ছাড়লো।

নাফিসকে বিদায় দিয়ে শুভ নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকলো। ফুলের ঘরের দিকে চোখ পড়তেই দেখতে পেল, শুভর মা ফুলকে স্যুপ খাওয়াতে চেষ্টা করছে। কিন্তু মেয়েটা খেতে পারছে না। শুভ একরাশ মন খারাপ নিয়ে ঘরে ঢুকলো। কলেজ ড্রেস না খুলেই মনে কষ্ট রেখে লম্বা একটা চিঠি লেখতে বসলো। যেই চিঠির প্রতিটা লাইনে, প্রতিটা বাক্যে ছিল আবেগ ও ফুলের জন্য ভালোবাসা।

চলবে…………..