দুখীফুল পর্ব-২৭+২৮

0
393

#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২৭

আদিলের চলে যাওয়ার সতেরো দিন আগে ফুল ও শুভর বিয়ের অনুষ্ঠান নির্ধারণ করা হলো। নির্দিষ্ট দিন আসতে এখনো সাতদিন বাকী। সাগরিকা অসুস্থ শরীরেই হেসে নেচে আনন্দ করছে। আদিল সারাটা সময় পরিবারকে সময় দিচ্ছে বিশেষ করে সাগরিকাকে। আদিলের মনে হয়, মেয়েটা যেমন ছটফটে তার পেট থেকেও তেমন ছটফটে বাবু হবে। সাগরিকার আনন্দের সীমা নেই। একদিকে দেবর অন্যদিকে বোনের মতো জা। দুজনই খুব আদরের। এতকিছুর মধ্যে আদিলের মায়ের কথা বলা হয়নি। এক ছেলেকে বিদায় দেওয়ার কষ্ট মনে পুষে রেখে অন্য ছেলের বিয়ের আয়োজন পুরোদমে করছেন। এবারেও শুভর বাবার বাড়ির লোকেদের দাওয়াত করেছেন। শুভর ফুফু আসবেন বলে কথা দিয়েছেন। আদিল সংবাদটা শোনার পর থেকে মায়ের সাথে কয়েকদফা কথা কাটাকাটি হয়ে গেছে। সুইটি খানম এই একটা বিষয়ে খুবই দুর্বল। আদিলের বাবার বাড়ির মানুষদের মুখের উপর কথা বলে না। বিশেষ করে স্বামী মা’রা যাওয়ার পর থেকে ঐ বাড়ির মানুষদের কটু কথা মুখ বুঁজে সহ্য করে নেন। আদিল মাকে শতো বুঝালেও বুঝে না। উনার একটাই বক্তব্য, “তারা তোর বাবার আপনজন। তোর বাবা তাদের যেমন মানতো আমিও তাদের তেমন মান্য করব।”

আদিল তখন চুপ হয়ে গেল। মায়ের সিদ্ধান্তের উপর কী আর জোর খাটানো যায়? ফুল তো সুখের সাগরে ভাসছে। সেই দুই বছর আগের দুখীফুলের জীবন পুরোপুরি পরিবর্তন হয়ে গেছে। যার কৃতিত্ব শুধুমাত্র শুভর উপর বর্তাবে। ফুলকে যত্নে, আদরে পরিবর্তন করে ফেলেছে সে। ফুল বাবা নামক মানুষটাকে ভুলে বসেছে। কিন্তু কথা হল, আদৌও কী তাই! হয়তো না।

ফুল নিজের ঘরে বসে বিয়ের কাপড়চোপড় হাতড়াচ্ছিল। তার অবচেতন মন আজ একটু বেশিই ছটফটে। কারণ একটু অস্বাভাবিক। প্রায় দুই বছর পর আজ ফুলের বাবার কথা মনে পড়েছে। এমনটা নয় যে, ফুলের সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তর কথা ভেবে মনে পড়েছে। ফুলের সাথে তো বাবার কোনো মিষ্টি স্মৃতিই নেই আছে শুধু তিক্ত স্মৃতি। ফুলের ছটফট করার এবারের কারণটা ভিন্ন। কয়েকবছর আগে ঠিক একইভাবে ছটফট করেছিল ফুল তার মায়ের মৃত্যুর সময়। এবারও তেমন অনুভব হচ্ছে তার।

ভরদুপুরে শুভ ঘেমে আচ্ছন্ন শরীর নিয়ে ফুলের ঘরে আসলো। ফুল তখন ঘন কালো কেশবের গোড়ায় চিরুনী চালাচ্ছিল। তার সুমধুর কণ্ঠস্বরে তখন গুন গুন করছিল প্রেমে পড়েছে মন গানটি। শুভর শরীরের সকল ক্লান্ত কোথায় যেনো পালালো। মন গহব্বরে ছেঁয়ে গেল প্রশান্তির বাতাস। শুভ এগিয়ে এসে ফুলের পিছনটায় দাঁড়ালো। আয়নার প্রতিবিম্বে শুভকে দেখে ফুল মুচকি হাসলো কিন্তু কাজ বন্ধ করলো না। শুভর মনে কী চলছে সেই জানে। ফুলের হাত থেকে চিরুনী নিয়ে নিজে আঁচড়ে দিতে থাকলো। ফুল এক ধ্যানে তার বাবু বরকে দেখতে থাকলো। ফুলের বাবু বর এখন আর সেই বাবু বর নেই। আগের ক্লিন সেভ করে থাকা বাবু বরের থুতনিতে একগুচ্ছ দাড়ি হয়েছে। শুভ খুব যত্ন করে দাড়িগুলো ছোট করে রাখে। আজকাল বক্ষস্থল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। নিয়মিত ব্যায়াম করার সুফল হয়তো। ফুলের ইচ্ছে করল, শুভর খোঁচা খোঁচা দাড়িতে হাত বুলিয়ে দিতে। ইচ্ছেকে কখনো দমিয়ে রাখতে নেই। ফুল পিছনে ঘুরতে নিলে শুভ বাঁধা দিলো,” নড়াচড়া করে না, ফুল! আমার কাজের ডিস্টার্ব হচ্ছে।”

ফুল মুখ ফুলিয়ে দাড়িয়ে রইলো। শুভটা এরকমই। সবসময় তার যা ইচ্ছে হয় করে ফেলে কিন্তু ফুলের ইচ্ছেকে মাটিচাপা দিয়ে রাখে। ফুলের মুখ ফুলিয়ে রাখা শুভ স্পষ্ট দর্পণে দেখতে পেল। ফুলের কোমর সমেত চুলগুলো বিনুনী করে রাবারব্যান্ডের সাহায্যে বেঁধে দিল শুভ। এরপর ফুলের সামনে গিয়ে দাড়িয়ে বুকপকেটের কয়েকটা বোতাম খুলে দিয়ে বলল,” কই, ছুঁয়ে দাও!”

ফুল মুখ ফিরিয়ে নিলো। শুভ এবার ফুলের হাত ধরে নিজের লোমশ হীন বক্ষস্থলে হাত ছুঁয়ে দিলো। ফুলের মনে হলো, কেউ তার শরীরে বৈদ্যুতিক ধাক্কা দিল। ফুল সাথে সাথে হাত সরিয়ে নিয়ে শুভকে ধাক্কা দিয়ে বিছানায় ফেলে নিজে পিছনে ফিরে গেল। খিঁচে চোখ বন্ধ করে বলতে লাগল,” ছিহ, শুভ! দিনে দিনে লজ্জা শরম কার বাড়িতে রেখে আসছো?”

” বাসর রাত পর্যন্ত আমার ফুল বউয়ের কাছে ধার দিয়ে এসেছি। যেনো সেদিন পর্যন্ত যত্নে রেখে দিতে পারে। পরেরদিন থেকে তো আর লজ্জা পাওয়ারও সময় পাবে না। কেনান, বউয়ের মন প্রাণ সব শুভর দখলে থাকবে।”

শুভ কথাগুলো বলে ফুলের কোমড় চেপে কাছে টেনে আনলো। শুভর পায়ের উপর ফুলকে বসিয়ে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে পিঠে নাক ঘষতে থাকলো। ফুল শুভর প্রত্যেকটা ছোঁয়ায় কেঁপে উঠলো। শুভর অনিয়ন্ত্রিত হাতজোড়া শক্তকরে ধরে বলল,” একটা কথা বলি?”

” অনেক কথা বলো। আমি তোমার হাজারো কথা শুনতে প্রস্তুত।”

ফুল প্রথমে ইতঃস্তত করল। শুভ বুঝতে পেরে ফুলকে পাশে বসালো। শুভ উঠে ফুলের পায়ের কাছে দুই হাঁটু গেড়ে বসে বলল,” কি বলতে চাও,ফুল?”

ফুল মিনমিন করে বলল,” রাগ করবে না তো!”

” তোমার কথায় কী আমি রাগ করতে পারি?”

ফুল মনে সাহস সঞ্চয় করে বলতে শুরু করল,” মা যখন আমাকে ছেড়ে চলে গিয়েছিল তখন আমার মন যেনো কেমন করছিলো। আজ সকাল থেকে ঠিক একইরকম লাগছে। বাবা আমার সাথে কখনো ভালো ব্যবহার করেনি জানি কিন্তু আজ ববাার জন্য অস্থির লাগছে।”

শুভ চুপচাপ ফুলের কথা শুনে গেলো। তার মস্তিষ্কে তখন ফুলের সাথে করা খারাপ ব্যবহার ঘুরপাক খেতে লাগলো। আকস্মিক মনে হলো, এবারও যদি ফুল সেখানে যায় তাহলে অনেক বড়ো ক্ষতি হয়ে যাবে। শুভ আঁজলা ভরে ফুলের গালে হাত রাখল। ফুলের কপালের সাথে কপাল ঠেকিয়ে বলল,” একদম সেখানে যাবে না, ফুল! তারা তোমার কেউ না। তুমি সেখানে গেলে আমার কাছ থেকে তোমাকে দূর করে ফেলবে।”

ফুল, শুভকে বুঝাতে লাগল,” একবার বাবাকে দেখেই চলে আসবো, শুভ। প্লিজ, একবার।”

এপর্যায়ে শুভর কথা না শোনার কারণে রেগে গেল। ফুলকে ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে উঁচু আওয়াজে বলল,” আমি বলেছি, তুমি সেখানে যাবে না মানে যাবে না। তোমার উপর কোনো খারাপ মানুষের ছায়াও পড়তে দিব না।”

ফুলের চোখে পানি। শুভ কখনোই তার সাথে উঁচু আওয়াজে কথা বলে না। বিগত এক বছরে শুভর এই রূপ ফুল দেখেনি। ফুল ছলছল চোখে তাকিয়ে বলল,” ঐ মানুষটা আমার বাবা,শুভ! সে খারাপ হতে পারে কিন্তু আমার জন্মদাতা পিতা।”

শুভর গরম মাথা আরো গরম হয়ে গেলো। সে আয়নার সামনে রাখা চেয়ারটায় লাথি মারল। ফলস্বরূপ চেয়ার অদূরে পড়ে রইলো। ফুল ভয়ে বিছানায় হাত পা গুটিয়ে কাঁদতে থাকলো। শুভ মাথা চেপে আগের মতোই চিৎকার করে বলতে শুরু করল,” কসম, ফুল। তুমি যদি আমার কথা অমান্য করো, তবে….!”

ফুল হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদতে থাকল। তার কিছু বলার নেই। শুভর এই রূপ সে দেখতে পারছে না। এই শুভকে ফুল চেনে না। এই শুভ ফুলের শুভ নয়। অন্য কেউ।
ফুলের শুভর মাঝে রাগ নেই। আছে শুধু ফুলের জন্য অসীম ভালোবাসা।

শুভ রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। তাই ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শুধু ঘর থেকে নয় বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল।

এদিকে নিচ থেকে চিৎকার চেঁচামেচি আওয়াজ শুনে সাগরিকা উপরে আসলো। সিঁড়ির কাছাকাছি আসতেই শুভকে রেগেমেগে চলে যেতে দেখে বাঁধা দিতে চাইলো। কিন্তু শুভ শুনলো না।

সাগরিকা ঘরে আসতেই চেয়ার পরপ থাকতে দেখে ফুলকে ডাকলো,” ঘরের এই অবস্থা কেনো রে? আর শুভর কী হয়েছে? ও কী তোর উপর হাত তুলেছে? ”

ফুল চোখের ওানি মুছে মাথা না বোধক ইশারা করল। অর্থাৎ শুভ তার উপর হাত তুলেনি। সাগরিকা সাবধানে এগিয়ে আসলো। ফুলের পাশে বসে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ফুল বিশ্বস্ত বোন নামক জাকে পেয়ে জড়িয়ে ধরে বলতে শুরু করল,” আমার শুভ পাল্টে গেছে, ভাবী! এই শুভকে আমি চিনি না।”

————————

কথায় আছে, বাবা মায়ের কিছু হলে সন্তানের মনের মধ্যে উশখুশ করে। ঠিক তেমন সন্তানের কিছু হলে কীভাবে যেনো বাবা মায়েরা আগ থেকেই আঁচ পেয়ে যায়। ফুলের হলুদের ঠিক আগেরদিন সকালবেলা,

ফোলা ফোলা মুখ নিয়ে ফুল নিচে আসলো। সে সারারাত কেঁদে ভাসিয়েছে। শুভ চলে যাওয়ার পর আর বাড়ি ফিরেনি। বকশি কাকার বাড়িতে ছিল। একেবারে গভীররাতে ফিরেছে। ফুলের মনে পাহাড় সমান কষ্ট নিয়ে শুভর কাছে আর যায়নি। শুভও প্রতিবারের মতো ফুলের অভিমান ভাঙাতে আসেনি। এই কষ্টে ফুলের আরো মনঃক্ষুণ্ন হয়েছে।

আকস্মিক ফুলের কানে অতি পরিচিত কণ্ঠস্বর এলো। ফুল দৌড়ে প্রধান ফটকের কাছে আসলো। সাজেদা বুবু বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। ফুলকে দেখে কান্না করতে করতে এগিয়ে আসে। অনেকদিন পর, সাজেদাকে দেখে ফুল নিজের কান্না নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। জড়িয়ে ধরলো সাজেদাকে। ফুলের শাশুড়ি ও সাগরিকা ইতিমধ্যে ফুলের পিছনে এসে দাঁড়ালো। সাজেদা বুবু ম’রা কান্না কাঁদছে। ফুল সাজেদাকে ছেড়ে জিজ্ঞেস করল,” কেমন আছো, সাজেদা বুবু?”

সাজেদা চোখের পানি মুছলো না। ফুলের মাথায় হাত বুলিয়ে বলতে লাগলো,” আমি ভাল আছি,ফুল। কিন্তু তোর আব্বা তো ভাল নাই। তোর আব্বা ম’ই’রা গেছে।”

ফুল স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। মস্তিষ্কে তখন একটা কথাই আসলো,” আজ থেকে আমি এতিম।”

ফুলের নড়াচড়া দেখতে না পেয়ে তাড শাশুড়ী এগিয়ে আসলো। ফুলকে পিছন থেকে ধরে বলল,” মারে! মৃত্যু কখনো বলে আসে না। তুই নিজেকে সামলে নে। আমি শুভকে খবর দিচ্ছি।”

ফুলের শাশুড়ি শুভ ও আদিলকে ফোন করল। দুইভাই তখন শহরের পথে ছিল। বিয়ের কিছু কেনাকাটা করা বাকী আছে। রওনা দিলেও চারঘণ্টা লেগে যাবে। শুভ মাকে বলল,” সে এসে ফুলকে নিয়ে যাবে। ফুল যেনো একা একা না যায়।”

ফুলের শাশুড়ি কথাটা জানালে ফুল মানলো না। সে সাজেদা বুবুর সাথে চলে যাওয়ার জন্য আবদার করলো। ফুলের শাশুড়ি ভাবলো, উনার একটি নিষেধ যদি ফুল তার বাবাকে শেষবারের মতো দেখতে না পারে তবে কখনো নিজেকে ক্ষমা করতে পারবে না।”

ফুলের শাশুড়ি রাজি হয়ে গেলেন। ফুলকে সাজেদার সাথে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু উনি জানেন না, উনার এই সিদ্ধান্তে ফুল ও শুভর সম্পর্কের উপর কেমন প্রভাব ফেলবে।

চলবে……………

#দুখীফুল
#আফসানা_মিমি
#পর্ব_২৮

কিছু বিজ্ঞ মানুষের মন্তব্য,বয়স বাড়লেও মেয়েদের বয়স নাকি হাঁটুর নিচে থাকে। বয়স বাড়ার সাথে সাথে নাকি আচরণগত পরিবর্তন চলে আসে। শুভ ও ফুলের নিজেদের বর্তমান অবস্থা ঠিক এমনই।

ফুল সাজেদা বুবুর সাথে পিত্রালয়ে ফিরল। ঠিক কতোদিন পর চেনাজানা পরিবেশে আসলো গননা করা যাবে না। আজ প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার ইচ্ছে নেই ফুলের। চোখ ভরে বাড়ি ভিটে দেখারও ইচ্ছে নেই ফুলের। তার চোখজোড়ায় এখন পিতাকে শেষবারের মতো দেখার আকুলতা। বাড়ির সামনে মানুষ গমগমে। ভেতর থেকে গুনগুন আওয়াজ করে কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। বাইরে খাটিয়ায় ফিরোজকে শুইয়ে রাখা হয়েছে। ফুল ধীরপায়ে সেদিকটয় এগিয়ে গেল। সাজেদা বুবু ফুলকে ধরে নিয়ে যাচ্ছেন। খাটিয়ার পাশে বসারত ইমাম সাহেব, যিনি মৃত ব্যক্তি অর্থাৎ ফুলের বাবার চেহারা দেখানোর দায়িত্বে আছেন; ফুলকে দেখামাত্রই চেহারার উপর থেকে সাদা কাফনের আচ্ছাদন খুলে দিলেন। ফুল বাবা বলে খাটিয়া ধরে বসে পড়লো। আজ ফুল তার বাবার খুব কাছাকাছি বসে আছে। জীবনের এই সময় পর্যন্ত কখনো এতো কাছাকাছি বসেনি। কখনো আদরে আলাপে মজে উঠেনি। কখনো পুতুল কেনার আবদার করেনি। কখনো বাবার কোলে চড়ার শখ জাগেনি। ফুল ফিরোজের সারামুখে হাত বুলিয়ে দিল। বিড়বিড় করে কিছু পড়লো। ফুলের মনে পড়লো, তার মায়ের মৃত্যুর সময়কার ঘটনা। সেই সময়ে ফুল চিৎকার করে কান্না করেছিল। মা মা বলতে বলতে ছোট্ট ফুল অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরে আসলো তখন সে সাজেদা বুবুর কোলে ছিল। সাজেদা বুবুর মুখ থেকেই মায়ের কবর দেয়া হয়ে গেছে শুনতে পেয়েছিল। ফুলের দুখ ভরা জীবনে সেদিনের পর থেকে দুখ দ্বিগুণ হয়ে গিয়েছিল।

ফুল চোখের পানি মুছে উঠে দাঁড়াতেই ফুলের সৎ মা সকলের সামনে ফুলের চুলের মুঠোয় ধরে দূরে সরিয়ে দিলেন। সাজেদা বুবু ফুল বলে চিৎকার করে ফুলকে ধরতে নিলে লিপি বলতে শুরু করেন,” ঐ অলক্ষুণে মেয়েকে যদি তুমি সাহায্য করো তাহলে তোমার সন্তানের মাথা খাও।”

গ্রামাঞ্চলে এসব কুসংস্কার অনেক মানা হয়। বিশেষকরে আদিকালের দাদী নানীরা এসব মেনে থাকেন। সাজেদা মুখে হাত রেখে বললে,” এইডা কি কইলা,বউ?”

লিপি উত্তর দিল না। ফুলের দিকে তেড়েমেড়ে আসতে আসতে বললেন,” তোর লাইগা আমি বিধবা হইয়া গেছি। তোর চিন্তা করতে করতে মানুষটা ম’ই’রা গেছে। দুই বছর পর আইয়া কি দেখাইতে আইছোস যে, তুই আমগোর অনেক খোঁজ নিছোস?”

” এসব কি বলছো? তোমাদের জন্যই আমি বাড়িতে আসিনি। বাড়িতে আসলেই তুমি আমার উপর হাত…..

ফুলের কথা শেষ হতে দিল না, লিপি। সকলের উদ্দেশে বলতে শুরু করল,” শোনেন সবাই, সতিনের মাইয়ারে আমার মতো কেউ আপন ভাইবেন না। আমি আপন ভাবছি দেইখাই এতো ভালো ঘরে বিয়া দিছি কিন্তু এই মাইয়া আমার কপালেই ঝাঁটার বাড়ি দিল। দুই বছর আগে, দাওয়াত কইরা আনছিলাম যেনো দুই চার পয়সা দিয়া বাপের চিকিৎসার খরচটা দেয়। কিন্তু এই মাইয়া করলো কী? সাহায্য না কইরা আমার ঘর তছনছ কইরা চইলা গেলো। বিশ্বাস না করলে ঘরের ভাঙা প্লেট বাটিগুলো দেইখা আসতে পারেন। আমার শখের জিনিস। অনেক কষ্টের টাকায় কেনা। ফালাই নাই। রাইখা দিছি।”

কিছু মহিলাদের ডিটেকটিভ সাজার খুব ইচ্ছে থাকে। কৌতূহল মেটাতে কয়েকজন ঘরে গেলো। সোকেজে ভাঙা প্লেটবাটি দেখে বাইরে এসে বলল,” সত্যিই তো!”

লিপি বিশ্বজয়ী হাসি দিল। মনে মনে আওড়াল, ” বলেছিলাম না! তোকে সুখে থাকতে দিব না। এই যে দেখ, সকলের চোখে তোকে কীভাবে অপরাধী বানাই।”

এতো মানুষের সামনে ফুল কীভাবে বলা শুরু করবে বুঝতে পারছে না। একজন হলে বুঝানো যেতো কিন্তু এখানে তো শত শত মানুষ। সাজেদা বুবু ফুলকে ইশারায় চলে যেতে বলল। ফুল এটাই উত্তম মনে করলো। বাবার খাটিয়ার দিকে তাকিয়ে চলে যাওয়ার জন্য উদ্যোগ নিতেই লিপি থামিয়ে দিয়ে বলল,” একা আইলি যে, তোর বড়োলোক শ্বশুর বাড়ির মানুষেরা কই। কেউ আইলো না যে? নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়া তোকে বাইর কইরা দিছে। তোর যা স্বভাব, বিয়ার পরও এখানে যেমন ফষ্টিনষ্টি করছোস। শ্বশুর বাড়িতেও কী নাগরের লগে দেখা কইরা ধরা খাইছোস।”

ফুলের চোখ দিয়ে টপটপ পানি ঝড়তে শুরু করে দিয়েছে। নিজের সম্পর্কে ঘৃণিত কথা শুনে গা ঘিনঘিন করছে। এরমধ্যে ফিরোজের মৃতদেহ জানাজার জন্য নিয়ে যাওয়া হবে। এলাকার সবচেয়ে মুরুব্বি মানুষটা দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বলতে লাগলেন,” মৃত মানুষরে নিয়ে যাইতাছি। যদি কারো কাছে দেনা পাওনা থাকে তো মাফ কইরা দিয়েন।”

লিপি বলে উঠলো, ” আমি কোনোদিন মাপ করুম না। ওয় সারাজীবন আগুনে পুইড়া মরব।”

মুরুব্বি বলল, ” এসব কী কও? মানুষটা তোমার স্বামী হয়।”

লিপি বলতে শুরু করল,” আমারে বিয়া করার পরে কি দিয়া গেলো? না সুখ দিতে পারলে না সন্তান। সতিনের মেয়ে তো মা বইলা কোনোদিন মানে নাই। আমি কেমন বাঁচমু?”

লোকমুখে গুঞ্জন শুরু হলো। লিপির সাহসও বাড়লো। সে কান্নার মাত্রা বাড়িয়ে বলতে শুরু করল,” এই যে দেখেন, বাপ মইরা যাওয়ার সাথে সাথে মাইয়া আইসা হাজির হইছে। সয় সম্পত্তির ভাগ বসাইতে। এই যে, একটু আগেই কইলো এই বাড়ি তার মায়ের। আমাকে নাকি ঘাড় ধাক্কা দিয়া বাইর কইরা দিব। সাজেদা বুবুও শুনছে।জিজ্ঞেস করেন সবাই।”

সাজেদা বুবু মুখে হাত দিয়ে অস্পষ্ট সুরে বললেন,” মিছা কথা।”

মুরুব্বি এবার ফুলের দিকে তাকালেন। উনার চোখ মুখের অসন্তোষের ছাপ। ফুলের উদ্দেশে বললেন,” তোমার বাপ বাঁইচা থাকা অবস্থায় কী কী করছে তা কইতে চাই না। একজনের অভিশাপে যেমন মানুষ আগুনে পুড়ে ঠিক তেমনই একজনের দোয়ায় মানুষ ফুলের বাগানে ঘুরে। সহায় সম্পত্তি দিয়া তুমি কি করবা। শুনলাম, তোমার শ্বশুর বাড়ি খুব বড়োলোক। এই বাড়ি ভিটা তোমার মায়েরে দিয়া দেও। এই বাড়ির উপর তোমার কোনো অধিকার রাইখো না।”

ফুল বলতে চাইছে,” আমার কিছুই লাগবে না।”

কিন্তু বলতে পারছে না। কান্নার কারণে গলা শুকিয়ে আসছে। ফুলের নীরবতা দেখে সবাই বুঝলো ফুল মানবে না। তাই কয়েকজনকে দায়িত্ব দিয়ে গেলো ফুলকে দেখে রাখতে। কবর দেয়া শেষে সকলে বৈঠকে বসবে।

এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ বৈঠকে বসলেন। সাদা কাগজে ফুলের দস্তখত নিলেন। ফুল নিজেকে অসহায় লাগতে শুরু করলো। এত সময় পর তার মনে হলো, শুভর কথাগুলো। শুভ থাকলে ফুলকে এখনই উদ্ধার করে ফেলতো। ফুল নিজের দিকে তাকালো, আগামীকাল তার হলুদ অথচ আজ তাকে ঠিক দুই বছর আগের জায়গায় রাখা হয়েছে। দুই বছর আগে সে যেমন অসহায় ছিলো আজও তেমন অসহায়।

সাজেদা বুবুকে লিপি মিথ্যা বলে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। বাড়ির আধিপত্য পেয়ে লিপির সাহস বেড়ে গিয়েছে। ঘরে বসেই ভাবছে, আজ এবাড়ি থেকে দুইটা লাশ বের হলে কেমন হয়?”

লিপি কোমড়ে গুঁজে রাখা বাটনফোন বের করল। নাম্বার বের করে কাউকে ফোন করে বলল,” বি’ষ ভালোভাবেই কামে লাগছে। অহন আরেকটারে কেমনে বিদায় করা যায় সেই ব্যবস্থা করো।”

অপরপাশ থেকে প্রত্ত্যুত্তর শুনে লিপি মুখ জ্বলজ্বল করে উঠলো। ফোন কে’টে হাতে পানের বাটা নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো। উদ্দেশ্য, উপস্থিত সকলকে এবার বিদায় জানাবেন লিপি। মানুষ থাকলে তো আর তার পরিকল্পনা সফল হবে না।
——-

মৃত বাড়ি থেকে একে একে সকলেই চলে যেতে থাকলো। ফুলও সকলের মতো বিদায় নিল। যাওয়ার আগে মায়ের কষ্টে গড়া বাড়িটায় পুনরায় চোখ বুলালো। কয়েক কদম আগালেই দুই জোড়া পা ফুলের পথ আগলে দাঁড়ালো। ফুল থেমে মানুষদের দেখার জন্য মাথা তুলল। দুজন ছেলে ফুলের পথ আটকে দাড়িয়েছে যাদের ফুল কখনোই দেখেনি। আকস্মিক একজন ছেলে ফুলের হাত ধরে ফেলল। আশেপাশে কাউকে দেখতে না পেয়ে ঘরের দিকে টেনে নিয়ে যেতে থাকলো। ফুল ছাড়া পাওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেও সফল হতে পারলো না। ফুল চেঁচাতে নিলে অপরজন ফুলের মুখ চেপে ধরলো। ফুল ছটফট করতে থাকলো। ছেলেদুটো ফুলকে ছাড়লো না। ঘরে প্রবেশ করতেই লিপি দরজা আটকে দিল। শরীরের সর্বোচ্চ শক্তি প্রয়োগ করে ফুলের দুই গালে থাপ্পড় বসালো। ছেলে দুটোকে বলল,” শক্ত করে ধরে রাখ। আগে গহনা গুলো খুলে নেই।”

ফুলের কানের, হাতের ও গলার গহনা তখনই খুলে নিলো লিপি। লোভে তার চোখজোড়া চিকচিক করছে। গহনাগুলো সাথে সাথে পরেও নিল লিপি। তার কতোদিনের লোভ ছিল এই গহনাগুলোর উপর। ছেলে দুটোর মধ্যে একজন লিপির প্রেমিক অপরজন বন্ধু।

অপরজন মুখ খুলল,” মাইয়ারে কি করমু?”

লিপি জানালো,” যা মন চায় কর। তয় এই বাড়িতে রাইখা না। অন্যখানে লইয়া যা।”

তখন সন্ধ্যা নামছে। ওড়না দিয়ে ফুলের হাতমুখ বেঁধে দেয়া হয়েছে। দুজন ছেলে ফুলকে নিয়ে ঘর থেকে বের হলো। বাড়ির পিছনের দিক দিয়ে নিয়ে যেতে থাকলো।
ফুল ছটফট করছে। তার চোখে মুখে বেঁচে থাকার আকুলতা। শুভর মায়াবি চাহনি চোখের সামনে ভেসে উঠলো তখনই। ফুলের শাশুড়ির যত্ন, সাগরিকার আগলে রাখা ও আদিলের দায়িত্ববোধ মনে পড়ে চোখ দিয়ে টপটপ পানি ঝড়তে শুরু করলো। ফুলকে তারা কোথায় নিয়ে যাচ্ছে সে জানে না। নিজের কৃতকর্মের জন্য খুব আফসোস হলো ফুলের।

হয়তো আজই দুখীফুলের দুখের জীবনের পরিসমাপ্তি ঘটবে।

চলবে……..